ঢাকার আদি ইতিহাস আমাকে অসম্ভব টানে। কিভাবে, কবে এ অঞ্চলের নাম ঢাকা হলো, কিভাবে অথবা কবে ঢাকা নামের একটি অঞ্চলের সূচনা হলো আমার খুব জানতে ইচ্ছা হয়, ঢাকার সরু অলিগলিতে, ঢাকার পুরোনো দালানের স্তর খসে পরা প্রতিটি ইটের আনাচে-কানাচে লুকিয়ে আছে কতো অজানা, সুন্দর, দুঃখের, কিংবদন্তীর কাহিনী। ঢাকার রাস্তা-অলিগলি দিয়ে যখন হাঁটি - তখন অবাক বিষ্ময়ে দেখি আর ভাবি কত কিছুই না হয়ে গিয়েছে আমাদের এই ঢাকাতে-যার তেমন কিছুইতো জানিনা! কতো লুকিয়ে থাকা ইতিহাস, কতো না জানা ঘটনা যা অনেক আগেই চিরকালের জন্যই বিলীন হয়ে গিয়েছে। জানতে ইচ্ছা করে খুব। এতো আমাদেরই ঢাকা- যার বয়স ৮০০ বছরেরও বেশি..এতো পুরোতন একটা শহর যা আজও টিকে আছে মাথা উঁচু করে এবং থাকবে ভবিষ্যতেও। পৃথিবীতে হয়তো এমন পুরাতন শহর খুব বেশি একটা নেই, যা এখনও টিকে আছে। এতো আমাদেরই অহংকার- গর্ব। ঢাকার লুকিয়ে থাকা, হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস নিয়ে লিখার ইচ্ছা অনেকদিন থেকেই- সে থেকেই আমার ঢাকার মসলিন নিয়ে লিখার প্রচেষ্টা। চেষ্টা করবো যথা সম্ভব প্রয়োজনীয় তথ্য দিতে, এসব তথ্য অনেকদিন থেকেই একটু একটু করে অনেক কষ্ট করে সংগ্রহ করা ।
কিংবদন্তী ঢাকার মসলিন- পর্বঃ এক
মসলিন নিয়ে গল্প-গাঁথা, কিংবদন্তীর কেন শেষ নেই । মসলিন কত পাতলা হত, ম্যাচ বাক্সে পুরে ফেলা যেত আস্ত একটা শাড়ি! এসবের পাশাপাশি মসলিন যাঁরা তৈরি করতেন সেই তাঁতিদের প্রতি অত্যাচারের কাহিনী, আঙুল কেটে ফেলার কাহিনী এসব আমাদের সবারই কম বেশি শোনা। এগুলোর কতগুলো সত্যি, কতটুকু মিথ্যা তা অন্য প্রসঙ্গ, কিন্তু এই আলোচনা এটাই প্রমাণ করে মসলিন আমাদের ভারি আগ্রহের বিষয়।
মসলিন শব্দের উদ্ভব কিভাবে ?
হেনরি ইউল এর প্রকাশিত অভিধান হবসন জবসন থেকে আমরা পাই মসলিন শব্দের উদ্ভব মসূল থেকে। ইরাকের এককালের নামি ব্যবসা কেন্দ্র মসূলে তৈরি হত সূক্ষ্ম সব কাপড় । যতদূর জানা যায়, ইংরেজরা আমাদের এই সূক্ষ্ম কাপড়কে নামকরণ করে মসলিন হিসেবে ।
কিন্তু ঢাকা আর আশেপাশের এলাকাতে- মুঘল আমলে সপ্তদশ শতকে মসলিন শিল্প বিকাশ লাভ করেছিল চূড়ান্ত রকম। আজও আমরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেই যুগের মসলিসকেই মনে করি।
ঢাকাই মসলিনের অনন্যতার কাহিনী ছড়িয়ে পরেছিল সর্বত্র। মসলিন রপ্তানি হতো ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশে, এমনকি তা রপ্তানি হতো ইউরোপ-আফ্রিকাতেও।
আমরা যেমন আজকেও মসলিন নিয়ে গর্বিত, তেমনি মসলিন দেখে অভিভূত হয়েছিলেন ভিনদেশী ভূগোলবিদ আর পর্যটকরা। পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত লোকজন ঢাকা-সোনারগাঁও এর এই উঁচুমানের মসলিন দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। নবম শতকে ভূগোলবিদ সোলায়মান একটি বই লিখেছিলেন- 'সিলসিলাত উত তাওয়ারীখ' । তাতে রুমী নামের এক দেশের কথা আছে যেখানে এত সূক্ষ কাপড় তৈরি হত যে চল্লিশ হাত লম্বা আর দুইহাত চওড়া কাপড়ের একটি পুরো টুকরো প্রবেশ করানো যেত একটি সাধারণ আংটির মধ্যে দিয়ে। ধারনা করা হয় রূমী হচ্ছে আজকের বাংলাদেশ। সবমিলিয়ে এ দেশের কাপড়ের ঐতিহ্য আজকের নয়-বহু শতকের পুরানো।
তবে প্রাচীন আমল থেকেই বাংলাদেশের বস্ত্র শিল্পের সুখ্যাতি থাকলেও মূলত মুঘল আমলে ঢাকা যখন রাজধানী হয় তখন থেকেই সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কাপড়ের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে থাকে । সম্রাট, নবাবেরা মসলিন কাপড় কেনা আরম্ভ করেন চড়া দামে। সে যুগে মসলিন তৈরির জন্য বিখ্যাত ছিল ঢাকা, ধামরাই, সোনারগাঁ, টিটবাদি, জঙ্গলবাড়ি আর বাজিতপুর। জঙ্গলবাড়ি অধিকাংশের পেশা তখন মসলিন বোনা। উনিশ শতকের প্রথমভাগেও সেখানে একাজে নিয়োজিত ছিলেন প্রায় একশ তাঁতি পরিবার। জঙ্গলবাড়ি থেকে মাইল কুড়ি দূরে বাজিতপুর- ওখানে জন্মাতো উচুঁমানের কার্পাস, যা থেকে তৈরি হতো উঁচুমানের মসলিন। আজ থেকে দু'শ বছর আগেও বিদেশী বণিকেরা সোনারগাঁ থেকে মসলিন বিদেশে রপ্তানী করতো। ওখানকার প্রায় দেড়হাজার তাঁতি সে সময় মসলিন বুনে সরবরাহ করতো ইংরেজ কোম্পানিকে। জেমস টেলর সাহেব ১৮৫১ সালে
যখন মসলিনের উপর একটি পান্ডুলিপি তৈরি করেন মসলিনের স্বর্ণযুগ তখন পড়তির দিকে; অথচ যা জানা যায় ঢাকাতে তখনও সাতশ' ঘরের বেশি তাঁতি নিয়োজিত ছিল এই কাজে।
-- চলবে --
আজকে আমার এক বছর পূর্তি হল ব্লগে
সেই উপলক্ষে আমি এই কিংবদন্তী ঢাকার মসলিন পর্ব দেয়া শুরু করলাম..আশা করি সবার ভালো লাগবে।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০০৯ রাত ১:০৪