শহীদুল ইসলাম প্রামানিক
জিন্নতের সমবয়সী আরেক জন ছিলেন আবুবকর। আবুবকরও জিন্নতের মতই কিছুটা অনিয়মিত ছিল। ক্লাস ফোরে হাফ এয়ারলি পরীক্ষা দেয়ার পর আর স্কুলে আসে নাই। সেও বিয়ে করে ঐ বয়সেই সংসারী হয়েছিল। আট দশ বছর আগে বাজারে দেখা। তার মেয়ের ঘরের নাতি সাথে ছিল। নাতি ক্লাস সেভেনে পড়ে। তার নাতির চেহারা দেখে লজ্জাই পেলাম। এক সাথে ক্লাস টুতে পড়লাম অথচ ওর নাতির বয়সি ছেলেও আমার নাই। ওর নাতির চেয়ে আমার ছেলের বয়স কম।
এর পরের বয়স্ক ছাত্রের নাম হাফিজ। এই ছাত্রের বয়স ঐ দুইজনের মত অত না হলেও বারো তেরো বছরের কম নয়। টেনে টুনে ক্লাস ফোরে উঠার পরেই বিয়ে করে সংসারী হলো। বিয়ে করার পর এই ছাত্র আর স্কুলে আসে নাই।
ক্লাস ফোরে থাকতে আলতাফ নামের আরেকজনের লেখা পড়া বন্ধ হয়ে গেল। আলতাফ আমাদের চেয়ে বয়সে বড় ছিল তবে আবুবকর জিন্নতদের মত অত বয়স্ক ছিল না। এই ছাত্রটির মেধা ভালো ছিল কিন্তু অর্থিক অভাবের কারণেই পড়া বন্ধ করতে বাধ্য হলো। অভাবের একটি বর্ণনা না দিয়ে পারছি না। সেই সময়ে যে সব পরিবার খাদ্য অভাবে না খেয়ে থাকতো তাদের কষ্টের বর্ণনা দেওয়া কঠিন, তারপরেও একটি ঘটনা তুলে ধরার চেষ্টা করছি--
আলতাফ, রশীদুন্নবী আর গোলাম কিবরীয়া একই গ্রাম থেকে আসতো এবং এক সাথেই আসতো। সেদিনও ক্লাসে ওরা একসাথেই এসেছিল। তখন ছিল চৈত্র মাস। হেড স্যার বাংলা ক্লাস নিতেছিলেন। এক এক করে সবাইকে বাংলা রিডিং পড়তে হচ্ছে। আলতাফ আমার পাশের বেঞ্চিতে ছিল। রিডিং পড়ায় আলতাফের উচ্চারণ স্পষ্ট হচ্ছিল না। উচ্চারণ স্পষ্ট না হওয়ায় হেড স্যার গালের মধ্যে ঠাস করে থাপ্পর দিতেই আলতাফ দাঁড়ানো থেকে টলকে বেঞ্চের উপর পড়ে যায়। গোলাম কিবরীয়া পাশেই বসা ছিল। সে তাড়াতাড়ি আলতাফকে জড়িয়ে ধরে স্যারকে উদ্দেশ্য করে বলল, স্যার, ও তো কাল থেকে না খাওয়া।
স্যার যেন লজ্জায় পড়ে গেলেন। পাল্টা প্রশ্ন করলেন, কেন-- না খাওয়া কেন?
গোলাম কিবরীয়া স্যারের দিকে তাকিয়ে বলল, স্যার, ওদের ঘরে দু’দিন হলো ভাত নাই। গত কাল দুপুরে ওর মা একটু খুদ ভেজে দিয়েছিল তাই খেয়ে ও দু’দিন হলো আছে।
স্যার থ হয়ে গেলেন। না খাওয়ার কারণে আলতাফের উচ্চারণ স্পষ্ট হচ্ছে না এটা স্যার বুঝতে পারেন নাই। যদি বুঝতে পারতেন আলতাফ না খাওয়া তাহলে কখনই তাকে ঠাস করে থাপ্পর মারতেন না। নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়েই স্যার তাড়াতাড়ি পাঞ্জাবীর পকেট হাতাতে লাগলেন। স্যারের পকেটেও তেমন পয়সা ছিল না। পাঞ্জাবীর উপর নিচের সবগুলো পকেট হাতিয়ে সর্ব সাকুল্যে ছয় আনা পয়সা পেলেন। এই ছয়আনা পয়সা গোলাম কিবরীয়ার হাতে দিয়ে বললেন, তাড়াতাড়ি দোকান থেকে এক প্যাকেট বিস্কুট নিয়ে আয়।
স্কুলের দক্ষিণ পাশেই বাজার ছিল। গোলাম কিবরীয়া দৌড়ে বাজারে গিয়ে ছয় আনা দিয়ে একটি সলটেস বিস্কুটের প্যাকেট কিনে আনল। সেই বিস্কুট খাওয়া পর্যন্ত স্যার কাছেই বসে থাকলেন। বিস্কুট খাওয়া শেষ হলে স্যার নিজ হাতেই আলতাফকে গ্লাসে করে পানি খাওয়ালেন। এরপর বই খাতা আলতাফের হাতে দিয়ে বাড়ি যেতে বললেন। আলতাফকে বিদায় দিয়ে স্যার আর ক্লাস নিলেন না।
এই ঘটনার পরেও আলতাফ আরো কিছুদিন স্কুলে এসেছিল কিন্তু একটা পর্যায়ে অভাবের তাড়নায় আর পড়তে পারে নাই। প্রাইমারী স্কুলে পড়ার সময় স্কুল জীবনের বর্ণনা করতে গিয়ে কত কথাই না মনে পড়ছে। অনেকেই হয়তো মনে করবেন আমি বানিয়ে বানিয়ে গল্প লিখছি। না ভাই, বানিয়ে বানিয়ে গল্প লিখছি না, সেই সময়ে স্কুল জীবনে ঘটে যাওয়া বাস্তব ঘটনা থেকেই কিছু ঘটনা তুলে ধরার চেষ্টা করছি। (উপরের ঘটনাটি ১৯৬৯ সালের)
(ক্রমশ)
আগের পোষ্ট পড়ার জন্য এখানে ক্লিক করুন ঃ
প্রাইমারী স্কুলের বিবাহযোগ্য সহপাটিগণ এবং কিছু ঘটনা