somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প ঃ রোস্তম ফকিরের দেমাগ (পর্ব -০৩)

২৩ শে আগস্ট, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


রোস্তম ফকির
(পর্ব -০৩)
শহীদুল ইসলাম প্রামানিক
সারাদিন কেউ রোস্তম ফকিরের দেখা পেল না। সন্ধার পূর্বমূহুর্তে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সেই দালান ঘর থেকে আধা মাইল উত্তরে পাওয়া গেল। রাস্তার পূর্ব পার্শ্বে পূর্ব দিকে মুখ করে পানির দিকে তাকিয়ে লাঠির গোরার অংশ মাটিতে ঠেকিয়ে উপরের অংশ নিজের ঘাড়ে হেলান দিয়ে দুই হাতে লাঠির মাঝখানে ধরে বসে আছে। মুখটি সুখনা। হয়তো সারা দিন খাওয়া হয়নি। রোস্তম ফকিরের সমবয়সী আকবার আলী কাছে এসে ডান পার্শ্বে বসে বলল, রোস্তম ভাই, সারা দিন কই ছিলেন?
রোস্তম ফকির জবাব দিল, ঐ উত্তর দিকে।
--- রিলিফ আনতে যান নাই?
--- না।
--- কেন?
--- ঐ চোরের দেয়া রিলিফ আমি নিমু না।
--- সারা দিন খাইছেন কিছু?
--- না।
--- ভিক্ষায় গেছিলেন?
--- না।
--- না খায়া কয় দিন থাকবেন?
--- আল্লায় যে কয় দিন রাখে।
--- রাইতে খাইবেন কি? ঘরে খাওন আছে?
--- না।
--- তাইলে এক কাজ করেন, সোজা আমার ডেরায় চইলা যান, আমি কয়া দিতেছি, আমার বউ চারটা গম দিলে ভাইজা খায়া নিয়েন। বুড়া বয়সে না খায়া থাকা ঠিক না।
--- গম কই পাইলেন?
--- চেয়ারম্যানের কাছ থিকা রিলিফ আনছি।
--- ঐ চোরের দেয়া রিলিফের গম আমি খামু না।
রোস্তম ফকিরের এরকম কথায় লোকটি খুব আশ্চার্য হলো। সারা দিন না খেয়ে আছে, ক্ষুধায় মুখ শুকিয়ে গেছে, তারপরেও চেয়ারম্যানের উপর থেকে তার জেদ কমছে না। বৃদ্ধ বয়সে চাল চুলোহীন ফকিরের প্রতিবাদী কণ্ঠ তার কাছে ভাল লাগলেও, না খেয়ে প্রতিবাদ করাটা ভাল লাগল না। তার এরকম জেদ আর কখনও দেখেনি। এর আগে ভিক্ষার জন্য মানুষ কত তাকে তিরস্কার করেছে। কিন্তু প্রতিবাদ করা তো দূরের কথা, প্রতিউত্তুর করতেও কখনও দেখা যায়নি। বৃদ্ধ হলে মানুষের মেজাজ খিটখিটে হয়। রোস্তম ফকিরের আজ তাই হয়েছে।
আগে রোস্তম ফকিরকে দেখলে কেউ তার দিকে তেমন একটা তাকাতো না। গতরাতের ঘটনার পর থেকে ফকির যার সামনেই পড়ছে সেই একবার তাকে ভাল ভাবে তাকিয়ে দেখছে।
রোস্তম ফকির আর আকবার আলীর কথাপোকথনের সময় কৌতুলবশতঃ অনেকেই সেখানে জড়ো হয়েছিল। কেউ কেউ বলল, রোস্তম ভাই, আপনি চেয়ারম্যানের কাছে যায়া মাফ চান। তাইলে আপনারে গম দিয়া দিব।
রোস্তম ফকির পিছন ফিরে তাকিয়ে বড় বড় চোখ করে বলল, মইরা গেলেও আমি চেয়াম্যানের কাছে যায়া মাফও চামু না, ঐ চোরের গমও নিমু না।
পাশান নামের আরেক জন বলল, রোস্তম ভাই, আপনে চেয়ারম্যানরে বার বার চোর চোর কইতেছেন ক্যান? এটা হুনলে তো চেয়ারম্যান আপনারে বাইন্ধা পিটাইবো।
রোস্তম বলল, পিটানোর আর বাকী রাখছে কি? রাইতে আমরে পিটাইছে না?
নুরুন্নবী বলল, রাইতে তো পিটাইছে মাইরা ফালায় নাই। এবার পিটাইয়া মাইরাই ফালাইবো। আচ্ছা আচ্ছা মাইনষে হের সাথে জোড়া ধরে না। আর আপনি ফকির হয়া জোড়া ধরবার গ্যাছেন। আপনার আসলে আক্কেল নাই। বুড়া হইছেন তো হুস হারা হইছেন।
রোস্তম ফকির এবার রেগে গিয়ে বলে উঠল, এই হারামজাদা। তোরে উপদেশ দিবার কইছি। আমারে তোরা পাগল পাইছস -- না- -হ? যা হারামজাদা, আমি আর এইহানে থাকুম না। বলেই উঠে দাঁড়িয়ে গেল।
লোকটি আবার বলল, থাকবেন কেমনে? নিজে খান ভিক্ষা কইরা, আবার চেয়ারম্যানরে কন চোর।
রোস্তম ফকির এ কথা শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে তার দিকে ফিরে উত্তেজিত হয়ে বলল, আরে হারামজাদা-- রোস্তম ভিক্ষা কইরা খাইলেও জীবনে কোন দিন চুরি কইরা খায় নাই। শালা চোরের দল, চেয়ারম্যানের সাফাই গাইতে আইছে আমার কাছে। বলেই সে দক্ষিণ দিকে হন হন করে চলে গেল।
তার চলে যাওয়ার ভাব দেখে অনেকেই হো হো করে হেসে উঠল। আবার অনেকে তার জন্যে দুঃখ করল। মধ্য বয়সী হযরত আলী ছেলে-ছোকরাদের ধমক দিয়ে বলল, এ-- ই- - তোরা ফকিররে ক্ষ্যাপাইতাছোস ক্যান হা- - হ-। একে তো ফকির তার উপর আধাপাগোল মানূষ, কখন কি কয় হুস নাই। একটুতেই চেইতা যায়। তারে উল্টাপাল্টা কথা কয়া আরো চেতাইতেছোস। বেশি চেতাইলে আবার না রাগে দুঃখে হার্ঠফেল কইরা মরে! লোকটির ধমকের পরে আর কেউ কোন কথা বলল। সবাই চুপচাপ যে যার জায়গায় চলে গেল।

সন্ধার পরে অনেকেই রোস্তম ফকিরকে খুঁজল, কিন্তু দেখা পেল না। কানু মন্ডল গরু রাখার জন্য যে ছাপড়া গোয়াল তুলেছিল তারই আড়ালে চুপ করে না খাওয়া অবস্থায় শুয়ে থাকল। ভোরে ঘুম থেকে উঠে ফজরের নামাজ পড়ে কিছুক্ষণ রাস্তার উপর বসে থেকে বেলা উঠার পর পর আস্তে আস্তে উত্তর দিকে রওয়ানা দিল। রাস্তায় যার সাথেই দেখা হলো সেই তাকে বলল, রোস্তম ভাই ভাল আছেন? কই যাইতেছেন? ইত্যাদি ইত্যাদি।
রোস্তম ফকির এর আগেও এ রাস্তায় অনেক যাতায়াত করেছে। তবে আজকের মতো এতো কুশলাদি কখনও কেউ জিজ্ঞাসাবাদ করে নাই। দুর্ধর্ষ চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে রিলিফ চুরির প্রতিবাদ করায় তার জনসমর্থন বেড়ে গেছে। রোস্তম ফকিরের নাম এখন অত্র এলাকার মানুষের মুখে মুখে। রোস্তম ফকিরের কাজের প্রশংসা মুখে উচ্চারণ না করতে পারলেও তার সাথে কথা বলে নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করছে।
সারাদিন সারারাত না খাওয়া শরীরে রোস্তম ফকিরের হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। তারপরও সে ঐ ইউনিয়নের সীমানার ভিতর ধনী-গরীব কারো কাছেই ভিক্ষার আবদার করল না। তার ধারণা, ভিক্ষা চাইলে যদি চেয়ারম্যানের দেয়া রিলিফের গম বের করে দেয়। পণ করেছে না খেয়ে মরে গেলেও চেয়ারম্যানের দেয়া কোন কিছু সে গ্রহণ করবে না।
বয়সের ভারে ন্যুজ্ব তারোপর দুর্বল শরীর। অভুক্ত থাকায় একটু হাঁটলেই শরীর অস্থির লাগছে। একটু পর পর বসে জিরিয়ে নিয়ে আবার হাঁটা শুরু করছে। এভাবে হাঁটতে হাঁটতে সকাল ৮টা / ৯টার দিকে পাশের ইউনিয়নে গিয়ে পৌঁছল। সেখানে ভিক্ষা চাইলে দু’একটি ঘর থেকে ভিক্ষা দিলেও বেশিরভাগ লোকই নিষেধ করে দিল। বন্যার কারণে রাস্তায় আশ্রয় নিয়েছে চাল ডাল সাথে আনে নাই। যে কারণে অনেকেই ভিক্ষা দেয়ার ইচ্ছা থাক সত্বেও দিতে পারছে না। অনেকে আবার ভিক্ষা চাওয়ায় তিরস্কার করছে।
(--- চলবে ---)

গল্প ঃ রোস্তম ফকির (পর্ব-০১
গল্প ঃ রোস্তম ফকির (পর্ব -০২)
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে আগস্ট, ২০১৬ দুপুর ১২:৪৪
৩৭৫ বার পঠিত
১৫টি মন্তব্য ১৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ভিসা বন্ধ করায় ভারতকে ধন্যবাদ।

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০২ রা ডিসেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩



ভারত ইদানীং ভিসা দিচ্ছেনা; তারা ভিসা না দিয়ে আমাদেরকে শিক্ষা দিতে চায়! তাদের করদ রাজ্য হাতছাড় হওয়া খুবই নাখোশ, এতোই নাখোশ যে মোদী মিডিয়া দিনরাত বয়ান দিচ্ছে এই দেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতের চিকিৎসা বয়কট এবং

লিখেছেন পবন সরকার, ০২ রা ডিসেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:৫৬


ভারতের এক হাসপাতাল ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশের কোন রুগিকে তারা চিকিৎসা দিবে না। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো যে হাসপাতাল থেকে এই ঘোষণা দেয়া হয়েছে সেই হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়ার জন্য বাংলাদেশের... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। চামচা পুঁজিবাদ থেকে চোরতন্ত্রে পরিণত হয়েছিল দেশ

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০২ রা ডিসেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৩:১৩






চামচা পুঁজিবাদ থেকে দেশ চোরতন্ত্রে পরিণত হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনৈতিক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, আমলা, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা মিলে চোরতন্ত্র করেছে।

সোমবার... ...বাকিটুকু পড়ুন

শেখ হাসিনাকে ভারত ফেরত পাঠাবে তবে............

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০২ রা ডিসেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৩:৪২


শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে বিচারের জন্য ভারতের কাছে ফেরত চাইতে হলে অবশ্যই বাংলাদেশকে প্রতিহিংসামূলক বিচারপদ্ধতি বাদ দিতে হবে। বিচারে শেখ হাসিনা যাতে ন্যায় বিচার পান বাংলাদেশকে আগে তা নিশ্চয়তা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারত সোনার ডিম পাড়া হাঁস হারিয়েছে

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০২ রা ডিসেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৫২



শেখ হাসিনা ভারতে বসে ষড়যন্ত্র-অপপ্রচার করছেন। ভারত চাচ্ছে বাংলাদেশে একটি অশান্তি হোক। কারণ ভারত একটি মসনদ হারিয়েছে। সোনার ডিম পাড়া হাঁস হারিয়েছে।

আওয়ামী লীগ প্রতিদিন একটি সোনার ডিম পেড়ে নরেন্দ্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

×