প্রখ্যাত সাংবাদিক আতাউস সামাদ 'যেভাবে আমরা পেলাম দিনটি' কলামে একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাঠকদের সম্মুখে পরিবেশন করেছেন। তার এই কলামের মাধ্যমে অনেকে নতুন করে জানতে পেরেছেন, ৭ মার্চের বিখ্যাত ভাষণের শেষ বাক্যটি ছিল, জিয়ে পাকিস্তান। অপরাপর বিখ্যাত ব্যক্তিদের মধ্যে সাবেক প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি হাবিবুর রহমানও তার এক লেখায় বিষয়টি উল্লেখ করেছিলেন।
আদালত আমাদের স্বাধীনতার ঘোষকের ব্যাপারে একটা রায় দিয়েছেন। এই রায় পেয়ে যারা অত্যধিক উল্লসিত হয়ে পড়েছেন তারা বুঝতে পারেননি, আদালতের লম্বা হাতটি রাজনৈতিক বিতর্ক পর্যন্ত টেনে এনে দেশের বিচার ব্যবস্থার কি সর্বনাশা ক্ষতিটি করা হয়েছে। বুদ্ধিবৃত্তিক এবং রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মগুলোতে তর্ক-বিতর্ক এবং বিভিন্ন পর্যায়ে সামাজিক ডায়ালগের মাধ্যমে এসব রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব স্থিত অবস্থায় চলে আসে কিংবা সময়ের পরিক্রমায় তা একটা সহনীয় ও ভারসাম্য রূপ ধারণ করে। এসব বিতর্ককে দেশের রাজনীতি ও গণতন্ত্র সহজেই অ্যকোমোডেট করতে পারে। ফায়ার ফাইটার হিসেবে আদালত এগিয়ে এলে তাতে এসব আগুন না নিভে আরো বেড়ে যায়।
যেমন জিয়াউর রহমানকেই স্বাধীনতার ঘোষক বলে দাবি করেছেন বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী। তিনি জানিয়েছেন, পরবর্তী সময়ে এ ঘোষণার বিষয়টি গণভবনে এক অনুষ্ঠানে এক ঘণ্টা ধরে দেখানো হয়েছিল। তাতে মহা ক্ষেপা ক্ষেপেছেন তার নিজের ভাই ও বর্তমান সরকারের মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী। দুই ভাইয়ের এ বিতর্ক থামাতে যদি আদালত ফায়ার ফাইটারের ভূমিকা নেন তাতে দুই ভাইয়ের মধ্যকার ফায়ার থামবে না। সেই ফায়ারের তাপে বরং আদালত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এখন এক ভাইয়ের দৈনিক জনকণ্ঠ দরকার হয়ে পড়লে অন্য ভাইয়ের দরকার পড়ছে দৈনিক আমার দেশ-এ। এর রায় সুরাহা করার ভার জনগণের ওপরই ছাড়তে হবে। এসব জটিল সময়ে জনগণ তাদের নিজস্ব কমনসেন্স ব্যবহার করে। তথ্য-উপাত্ত দেখে নির্ধারণ করবে কোন ভাই সত্য কথাটি বলেছেন। এক ভাই ভবিষ্যৎ মন্ত্রীত্বের আশায় কথা বলছেন, নাকি অন্য ভাই বর্তমান মন্ত্রীত্ব টেকানোর জন্য মুখ খুলেছিলেন তাও একদিন স্পষ্ট হবে।
স্বাধীনতার ঘোষণায় ৭ মার্চের ভাষণটি মূল উপাদান হিসেবে গণ্য করা হয়। এ দেশের ইথারে এর চেয়ে বেশি বাজানো কোনো সঙ্গীত বা শব্দমালা খুঁজে পাওয়া যাবে না। কাজেই সেই বিখ্যাত ভাষণ থেকে কে বা কারা এবং কি কারণে এ শব্দটি গায়েব করে ফেললো সে ব্যাপারে আদালতের একটা রায় বা ব্যাখ্যা অতি জরুরি। কারণ মূল ভাষণ থেকে এই শব্দ দুটি গায়েব করে আদালতকে বিভ্রান্ত করা হয়েছে বলে স্পষ্ট প্রতীয়মান হচ্ছে। বিবদমান অবস্থার প্রেক্ষাপটে ২৫ মার্চ রাতে লিখিত ঘোষণার যথার্থতা প্রমাণ করা কঠিন। সেই জায়গায় ৭ মার্চের অবিকৃত ভাষণটি (জিয়ে পাকিস্তান সংবলিত) স্বাধীনতার ঘোষণার ব্যাপারে একটা শক্তিশালী প্রমাণ হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। কাজেই এখানে ঐতিহাসিক প্রমাণ নষ্ট করার জন্য শুধু নৈতিক প্রশ্ন নয়, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আদালতের রায় থাকায় একটা আইনি প্রশ্নও এখন সামনে এসে পড়েছে। এই শব্দ কটি বিলোপ করাতে আদালতের যে রায় এসেছে তাতে এ শব্দ কয়টি যুক্ত থাকলে আদালতের বিবেচনা ভিন্ন হতে পারে।
৭ মার্চের ভাষণটি আওয়ামী লীগ স্বাধীনতার চূড়ান্ত ঘোষণা হিসেবে দেখাতে চায়। কিন্তু ছন্দময় ভাষণের শেষে ছন্দহীন এ বাক্যটি সেই প্রচেষ্টায় বড় বাধা হয়ে দেখা দেয়। স্বাধীনতার পর তার আগের সব ইতিহাস নতুনভাবে ও নতুন আঙ্গিকে ঢেলে সাজাতে যে এ বাক্যটি পরিহার করতে হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই।
এখানে নববধূর প্রতি নিখাদ ভালবাসা প্রদর্শন করতে গিয়ে সাবেক প্রেমিকার সর্বশেষ চিহ্নটুকু গায়েব করা জরুরি হয়ে পড়েছে। সাবেক প্রেমিকার সঙ্গে ভালোবাসা ছিল, এখন আর নেই। এমন সহজ, সুন্দর ও নির্ভেজাল স্বীকারোক্তির চেয়ে কষ্টকর উপায়ে প্রমাণ গায়েব বা উধাও করাতে পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে পড়ে। তাতে খুশি না হয়ে নববধূ আরো সন্দিহান হয়ে পড়ে।
একজন মানুষের জীবনে যেমন বিভিন্ন প্রেম আসতে পারে। ইতিহাসের পথ পরিক্রমায় একটা জাতির জীবনেও বিভিন্ন মানচিত্র, পতাকা বা তার জন্য আবেগ-প্রেম-ভালোবাসা থাকতে পারে। পরের বাস্তব পরিস্থিতি কখনোই আগের ফেলে আসা আবেগ-অনুরাগ বা সেই কাহিনী মুছে ফেলতে পারে না।
এখানে একটা বিষয় উল্লেখ করলে অপ্রাসঙ্গিক হবে না। কে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি তা বিবিসি বাংলা বিভাগ তাদের পরিচালিত একটি সার্ভের মাধ্যমে আমাদের জানিয়ে দেয়। আজব প্রকৃতির সেই সার্ভেটিতে কেজি আর ফুটের মধ্যে কোনটি বড় তাও বের করে ফেলা হয়। কোনো খেলোয়াড় আর রাজনৈতিক নেতাকে একই নিক্তিতে মাপা হয়। আওয়ামী লীগের কাছে সার্ভেটি ছিল বাইবেল সমতুল্য। কারণটি সহজেই বোধগম্য। ফলটি হাতে পেয়ে আওয়ামী লীগ ও সমঘরানার সুশীল সমাজ এতোটাই উল্লসিত হয়ে পড়ে, এ সিরিয়ালটির নিচের দিকে খুব ভালো করে খেয়াল করে নাই। শ্রেষ্ঠ ১০০ বাঙালির লিস্টে ৩০ থেকে ৪০-এর কোনো একটা জায়গায় ছিলেন প্রফেসর গোলাম আজম। দেখা গেল, অনেক বাঘা বাঘা বাঙালির মাথার অনেক উপরে বসে হাসছেন প্রফেসর গোলাম আজম।
স্বাধীনতার ৩০-৩৫ বছরের মধ্যে প্রফেসর আজম যদি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালিদের লিস্টে ৩০-৩৫-এ স্থান করে নিতে পারেন। তবে শত বছর পরে কী হবে তা কেউ বলতে পারে না। তখন শেখ মুজিবের কণ্ঠে জিয়ে পাকিস্তান শব্দটি আবারও পুনস্থাপন করে প্রফেসর আজমের সঙ্গে যুগ্ম চ্যাম্পিয়নের খেতাবটি অক্ষুণ্ণ রাখার প্রয়োজন দেখা দিতে পারে।
এই সহজ ও নির্ভেজাল সত্যটি আওয়ামী লীগ মেনে নিলে এ দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার অর্ধেক কমে যেত। মুসলিম লীগের ঔরস থেকে জন্ম নেয়া আওয়ামী লীগের এই প্রক্রিয়ায় নিজের বাপ-দাদার বোধ-বিশ্বাসের চিহ্ন এবং ইতিহাসের পাতা গায়েব করার প্রচেষ্টাটি আমাদের একটা স্থায়ী ব্যারাম হিসেবে দেখা দিয়েছে। নগদ লাভ-লোকসানের কথা বিবেচনায় নিয়ে তারা সব সময় কাজ করে। কখনোই অতীতের দিকে তাকায় না। আবার ভবিষ্যৎও দেখতে পায় না। সে জন্যই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণ থেকে পাকিস্তানের প্রতি অনুরাগ-সূচক বাক্যটি গায়েব করে ফেলেছে। কারণ এ বাক্যটি যথাস্থানে রাখলে আওয়ামী লীগের কাকতাড়ুয়ার আদলে রাজাকারতাড়ুয়া রাজনীতিটি হুমকির মুখে পড়ে। সেটি বন্ধ হলে ইতিহাসের পেছন থেকে মুখ ঘুরিয়ে দেশটি সামনের দিকে অগ্রসর হতে বাধ্য। পরিস্থিতি আজ এতোটুকু বেসামাল, আওয়ামী লীগের এই পশ্চাৎপদ রাজনীতির বিরুদ্ধে যে বা যারাই দাঁড়াবে তারাই রাজাকার, যুদ্ধাপরাধী বা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধী হিসেবে গণ্য হয়ে পড়বে।
এমন পরিস্থিতিতে কিছুটা ক্যালকুলেটেড রিস্ক মাথায় নিয়ে এই ঐতিহাসিক দায়িত্বটুকু পালন করেছেন আতাউস সামাদ। ৭ মার্চের ভাষণের রেকর্ড ও নথি থেকে কেন এ বাক্যটি গায়েব হয়ে গেল তা নিয়ে আতাউস সামাদ কোনো আলোচনায় যাননি। সেই আলোচনায় রত হলে নিশ্চয় তাকে ভীমরুলের চাকের মুখে পড়তে হতো। জানি না সেই ভীমরুলের চাকের কথা চিন্তা করেই কি না লেখাটির শেষ দিকে তিনি একটা উপসংহার টেনেছেন, বাংলাদেশ জাতীয় পরিষদের প্রথম অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মন্তব্য করেছিলেন, ৭ মার্চের ভাষণের মাধ্যমে তিনি জাতিকে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য তৈরি করে রাখেন এবং ২৫ মার্চ রাতে স্বাধীনতার ঘোষণা চট্টগ্রামে পাঠিয়ে দেন। ৭ মার্চের ভাষণটি তার দেয়া ব্যাখ্যার আলোকেই দেখা উচিত।
আতাউস সামাদের পরামর্শ মতো ঘটনাগুলো দেখতে গেলে পাঠক কিছুটা খটকায় পড়ে যায়। জিয়ে পাকিস্তান যুক্ত থাকলে কোনোভাবেই এ ভাষণটি স্বাধীনতার চূড়ান্ত ঘোষণা হিসেবে চালানো যায় না। বরং বলা চলে, এটা ছিল ছয় দফার আলোকে স্বাধিকার আদায়ের জন্য রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টির এক চমৎকার কৌশল। ৭ মার্চ পর্যন্ত আমাদের স্পষ্ট রাজনৈতিক অবস্থানটি মুজিব-ইয়াহিয়ার দীর্ঘ সংলাপের কারণে আরো অস্পষ্টতার ছায়ায় ঢাকা পড়ে যায়।
এ সুযোগটি নেয় সুচতুর পাকিস্তানি সামরিক জান্তা। রাজনৈতিক নেতৃত্বকে আলোচনার টেবিলে ব্যস্ত রেখে ভেতরে ভেতরে সামরিক হস্তক্ষেপের পরিকল্পনা করে। এইভাবে সম্ভাব্য গণযুদ্ধটিকে প্রথম প্রহরেই নস্যাৎ করে ফেলার পরিকল্পনা নেয়া হয়।
বুঝে হোক বা না বুঝে হোক, আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব সেদিকেই পা বাড়ায়। শেখ মুজিব গ্রেফতার বরণ করে নেয়াটিই তার কৌশল হিসেবে গ্রহণ করেন। তিনি পাকিস্তানিদের যুদ্ধ প্রস্তুতি ঘুণাক্ষরেও টের পাননি, এটা বললে তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞাটি অহেতুক প্রশ্নের সম্মুখীন করা হবে। তাকে হাতের নাগালে পেয়ে হিংস্র পাকিস্তানি হানাদারদের ক্রোধ কমে গিয়েছে। তারা আর বাঙালিদের কচু কাটা করে নেই। গ্রেফতার বরণের পেছনে এ যুক্তিটিও মেনে নেয়া কষ্টকর।
অপরাপর নেতারা যে যার মতো নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান। প্রস্তুতিহীন একটা জাতি ভয়ংকর যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। অথচ এমন মুহূর্তে দরকার ছিল একটি বজ্রকণ্ঠের। নিঃসন্দেহে শেখ মুজিবের কণ্ঠটিই ছিল জনগণকে উজ্জীবিত করার সর্বোত্তম মন্ত্র যার প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন স্বয়ং তাজউদ্দীন আহমদ। তিনি অনেক চেষ্টা করেছিলেন এমন একটি ঘোষণা শেখ মুজিবের কণ্ঠ থেকে রেকর্ড করে রাখার জন্য। কিন্তু শেখ মুজিব রাজি হননি। তার কণ্ঠে স্বাধীনতার স্পষ্ট ঘোষণা আর ওয়ারলেসের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেয়া লিখিত ঘোষণার মধ্যে পার্থক্যটি স্পষ্ট। তিনি ২৫ মার্চে লিখিত ঘোষণা পাঠিয়েছিলেন, এটা সত্য বলে ধরে নিলেও বলতে হয়, দুধের স্বাদ কখনোই ঘোলে মেটে না। যদিও ঘোলটি একই দুধ থেকেই তৈরি হয়। কণ্ঠ রেকর্ড করার উপকরণ মজুদ থাকার পরও কেন লিখিত ঘোষণাটি ব্যবহার করতে হলো, এটাও একটা বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দেয়।
তখন সময়ের এই চাহিদা অনেকটা পূরণ করেছে তদানীন্তন মেজর জিয়ার ওই মুহূর্তের ঘোষণাটি। ২৬ মার্চ থেকে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত যুদ্ধের প্রথম প্রহরটিতে জিয়ার এ ঘোষণাটি টনিকের মতো কাজ করেছে। সেনাবাহিনীর একটা অংশের সরাসরি বিদ্রোহ পাকিস্তানি বাহিনীর মনোবলে চরম আঘাত হানে। কারণ জিয়া নামটি অপরিচিত হলেও মেজর শব্দটি জনগণের কাছে অপরিচিত ছিল না।
এর মাধ্যমে আচমকা আক্রমণে ছিন্ন-ভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃত্ব নিজেদের গুছিয়ে নেয়ার অবকাশটি ফিরে পায়। যুদ্ধের সময়টিতে সব কিছুতে একটা চমৎকার সমন্বয় কাজ করেছে। যুদ্ধের সামগ্রিক প্রস্তুতি ও পরিকল্পনায় একজনের সীমাবদ্ধতা অন্যজন পূরণ করেছে। এটা ছিল একটা চমৎকার টিম ওয়ার্ক। কিন্তু স্বাধীনতা অর্জনের পর পর আওয়ামী লীগ এক আজব মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সব কৃতিত্ব একটি দল ও তার নেতাকে পাইয়ে দিতে অপরাপর সকল দল এবং ব্যক্তির কৃতিত্বকে খর্ব করা হয়। স্বাধীনতার ঘোষক জিয়ার কৃতিত্বকে খাটো করার জন্য বলা হয়, একটি বাঁশিতে ফু-এর মাধ্যমে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয় নেই।
তারা আরো বলেন, স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার জন্য জিয়ার হাতে কোনো ম্যান্ডেট ছিল না। কিন্তু রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধ কোনো ম্যান্ডেটের মাধ্যমে শুরু হয় না। এগুলো হয়ে পড়ে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে।
তাছাড়া ম্যান্ডেটের প্রশ্ন এলে বলতে হয় আওয়ামী লীগের হাতে জনগণের ম্যান্ডেট ছিল স্বায়ত্তশাসনের জন্য। কখনোই স্বাধীনতার জন্যে নয়। ছয় দফার কোথাও স্বাধীনতার কথা উল্লেখ নেই।
সন্দেহ নেই, এই কথার মাধ্যমে পেছনের দীর্ঘ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার দিকে ইঙ্গিত করা হয়। এর বাস্তবতা অস্বীকার করার উপায় নেই। এই যুক্তি ধরে আওয়ামী লীগের পেছন বরাবর একটু অগ্রসর হলে আবারও হোচট খেতে হয়। কারণ এই দেশে স্বাধীনতার চেতনার বীজ বপনকারী আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা মওলানা ভাসানীকে এই কৃতিত্ব থেকে প্রায়ই বাদ রাখা হয়।
মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী যখন পাকিস্তানকে আসসালামু আলাইকুম জানিয়েছিলেন তখন আওয়ামী লীগ এর মূল অংশ পাকিস্তানকে আহলান সাহলান জানাতেই ব্যস্ত ছিল। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কেন্দ্রে প্রধানমন্ত্রী হন। এই প্রদেশে মুখ্যমন্ত্রী হন আতাউর রহমান এবং তার মন্ত্রীসভার সদস্য হন তরুণ শেখ মজিবুর রহমান। মওলানা ভাসানীর এই বেরসিক আসসালাম সঙ্গত কারণেই ক্ষমতার রসে আপ্লুত আওয়ামী লীগের ভালো লাগেনি। তাই আওয়ামী লীগ ছেড়ে মওলানা ভাসানীকে ন্যাপ প্রতিষ্ঠা করতে হয়। তারপরও আজ ভাসানীর নাম পারতপক্ষে উচ্চারণ করা হয় না। সব জায়গায় শুধু শেখ মুজিব।
স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসটি মুজিবে শুরু, মুজিবেই শেষ। এই রিলে রেইসটিতে যে আরো কয়েক প্লেয়ার রয়েছেন, তাদের অগ্রাহ্য করে পুরো রেইসটিতে মুজিবকেই রাখা হয়। ১৯৫২ সালে জেলে আটক থাকলেও চিরকুট পাঠিয়ে ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বে মুজিবকে বসাতে হবে। ২৫ মার্চে অতর্কিত গ্রেফতার হলেও এরই মধ্যে স্বাধীনতার ঘোষণাটি ওয়ারলেসের মাধ্যমে পাঠিয়ে দিতে হবে। অন্য কাউকে সামান্য কৃতিত্ব দেয়া যাবে না।
স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল সংগঠক তাজউদ্দীন আহমদও এই রাসায়নিক বিক্রিয়ার শিকার হয়ে পড়েন। সশরীরে স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্ব দিলেও নতুন দেশটির প্রথম সরকারের হানিমুন পিরিয়ডেই তাকে কোণঠাসা করে ফেলা হয়। কারণ এক নেতা এক দেশ তত্ত্বের সম্মুখে তিনিও কিছুটা হুমকি সৃষ্টি করেছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে তার সগৌরব উপস্থিতি অন্য কারো অনুপস্থিতিকে বড় করে তুলতে পারে। অবশ্য যুদ্ধের পুরো সময়টিতে ময়দানে অনুপস্থিত নেতার প্রতি তিনি কোনো অবিশ্বস্ততার প্রমাণ রাখেননি। যা কিছু করেছেন মুজিবের ছবি বা নাম নিয়েই করেছেন। রাজনীতিতে গুরু মারা বিদ্যাটি ভাসানী-মুজিবের বেলায় প্রযোজ্য হলেও মুজিব-তাজউদ্দীনের বেলায় কখনোই প্রযোজ্য নয়। তারপরও সাবধানের মার নেই। ফলে তাকেও সাইড লাইনে বসিয়ে রাখা হয়।
৭ মার্চে শর্তযুক্ত স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েও পরে ইয়াহিয়া, ভুট্টোর সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা চালিয়ে যাওয়া এ পাকিস্তান জিইয়ে রাখার প্রচেষ্টাই প্রতিফলিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যতোটুকু আন্তরিকভাবে পাকিস্তানের অখন্ডতা বজায় রাখতে চেয়েছিলেন পাকবন্ধু ইয়াহিয়া ও ভুট্টো ঠিক ততোটুকু চাননি।
ভুট্টো-ইয়াহিয়ার ছলনায় ও নিরীহ বাঙালির ওপর অতর্কিত আক্রমণে সংযুক্ত পাকিস্তানের ভাগ্যটি চূড়ান্তভাবে নির্ধারিত হয়ে যায়। পাকিস্তানের এক বিখ্যাত কার্টুনিস্ট তার এক কার্টুনে দেখিয়েছিলেন, ইয়াহিয়া খানকে এক হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছে এবং নয় মাস পর তিনি একটি নবজাতকের জন্ম দিয়েছেন। এমন নির্মম সত্যটি তুলে ধরার জন্য সেই কার্টুনিস্টকে ১৯৭১-পরবর্তী পাকিস্তানি শাসকদের রোষানলে পড়তে হয়েছিল।
৭ মার্চের ভাষণটি স্বাধীনতার চূড়াত্ত ঘোষণা হিসেবে দাঁড় করাতে অসুবিধা হলো ইতিহাসের এই কয়েকটা পাতা। এটা ছিল, স্বাধীনতার চূড়ান্ত ঘোষণা, নাকি ছয় দফার ভিত্তিতে স্বায়ত্বশাসন আদায়ের জন্য উপমহাদেশে প্রচলিত একটি রাজনৈতিক হুমকি, এ প্রশ্নটি স্বাভাবিকভাবেই এসে যায়। এ হুমকিতে ইয়াহিয়া-ভুট্টোর হুশ ফিরলে পাকিস্তান সত্যিকার অর্থেই জিইয়ে যেতো। শেখ মুজিব হতেন সংযুক্ত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী নেতা হিসেবে সৌদি বাদশাহ আবদুল্লাহর আগে বা পরে তার নামটি উচ্চারিত হতো। মৃত্যুর পর তার স্মৃতি জাদুঘরে জায়নামাজ রেখে এখন সাচ্চা মুসলমানের পরিচয়টি হাস্যকর ভাবে তুলে ধরতে হতো না।
তা না হওয়াতে এবং পাকিস্তানি বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণে পুরো প্রেক্ষাপট এবং গণনা বদলে যায়। আমাদের সামগ্রিক রাজনীতি স্বাধীনতা নামে পুকুরের কিনারায় দাঁড়িয়েছিল। আমরা এই পুকুরে নামবো, কি নামবো না, এমন যখন করছি তখন মাথা মোটা ইয়াহিয়া-ভুট্টো ধাক্কা মেরে আমাদের পুকুরে ফেলে দিয়েছে। তখন সেই পুকুরে নেমেই জনগণের প্রকৃত প্রতিরোধটি সৃষ্টি হয়। ৭ মার্চে শুকনো শরীরে আমরা যে ঘোষণা শুনেছিলাম, এখন ভিজা শরীরে নতুন ঘোষণার প্রয়োজন দেখা দেয়। তাই ধাক্কা খেয়ে পুকুরে পড়ে জনগণের ম্যান্ডেটের কথা মনে আসেনি। মনে এসেছে, কিভাবে এ হায়েনাদের হাত থেকে মুক্ত হওয়া যাবে সেসব ভাবনা। এ ভাবনাতেই তখন ওই পুকুর থেকে একটি ভেজা কণ্ঠ ভেসে আসে, আমি মেজর জিয়া বলছি। তার কাছে এখন জনগণের ম্যান্ডেট ছিল কি না তা জানতে চাওয়া অর্থহীন।
আজ জাতির যে আংকলরা স্বাধীনতার ঘোষণা থেকে জিয়ার নামটি মুছে ফেলতে চাচ্ছেন কিংবা তাকে শুধু ঘোষণার পাঠক হিসেবে তুলে ধরতে চাচ্ছেন সেই চাচারা সেদিন আপন প্রাণ বাঁচাতে তল্পি-তল্পাসহ বর্ডারের দিকে ছুটে গিয়েছিলেন। তাদের হাব-ভাব দেখে মনে হয়, ওই ঘোষণাটি ছিল আলো ঝলমল পরিবেশে কোনো এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ঘোষণা পাঠের মতো।
আমাদের সামরিক এবং বেসামরিক প্রশাসনের আনুগত্যের রঙটি শাসকের রং দেখে পাল্টে যায় এবং তা শুধু বর্তমান যুগে বিএনপি বা আওয়ামী লীগের হাওয়া দেখেই পাল্টাচ্ছে এমন নয়। আনুগত্য বদলানোর এ সুবিধাজনক ধারাটি সম্ভবত সেই মোঘল পিরিয়ড থেকেই চালু ছিল। ভবিষ্যৎ নামে পেন্ডুলামটি অনিশ্চিত ঠেকলে বড়জোর ফিশফিশানির মাধ্যমে বলা হয়, ভাই, আপনি আগান, আমরা আপনার পেছনে আছি। এ পেন্ডুলামটি যেদিকে যতোটুকু কাত হয়, আমাদের ফিশফিশানিটুকু সেই অনুপাতে জোরালো হয় বা মিলিযে যায়। অন্ধকার ও বিপদ সংকুল গর্তে সব সময় প্রথমে মাথা নয়, অন্য উপায় না থাকলে সর্বোচ্চ নিজের পা-টি এমনভাবে এগিয়ে দিই যাতে বিপদ অনুভূত হলে সহজেই বের করে ফেলা যায়।
তাই ঠিক টাইমে যুদ্ধে অংশ নিতে না পেরে এ দেশের এরশাদরা যুদ্ধের পর সব সময় অনুতাপ-এ দগ্ধ হন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বড় রক্ষক এক কবি পুরো যুদ্ধের সময় দৈনিক পাকিস্তান সম্পাদনা করে কাটিয়েছেন। যুদ্ধের পর বের করেছেন তার লেখা কবিতার পান্ডুলিপি। তখনকার গ্রাউন্ড রিয়ালিটি অনুভবের নিমিত্তে এই অপ্রিয় কথাগুলো উল্লেখ করতে হলো।
এই যখন অনেকের অবস্থা ছিল তখন তদানীন্তন মেজর জিয়া নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তার কথা না ভেবে প্রকাশ্যে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তিনি ভালো করেই জানতেন, তার পরিবার কোনো সুরক্ষিত বাড়িতে বিশেষ অনুদানে নিরাপত্তা হেফাজতে থাকবে না। নিজের এই সাহসী ঘোষণা পরিবারের নিরাপত্তা ঝুকি হাজারগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল। তার পরিবারের এমন নাজুক পরিস্থিতি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ব্যবসায়ীরা আজ নোংরা মন্তব্য করতেও কুণ্ঠিত হয় না। অনুকূল পরিবেশে ক্রেডিট নেয়ার মতো মানুষের অভাব এ দেশে কখনোই হয়নি। কিন্তু প্রতিকূল পরিবেশে নিজের নাম নিয়ে এমন একটি ঘোষণা ভয়ংকর সাহসের কাজ ছিল।
মতলববাজ গোষ্ঠি আজ যাই বলুক, এগুলো সক্রিয় বিবেচনায় নিয়ে এ দেশের মানুষ স্বাধীনতার ঘোষক নামে আলাদা একটি খেতাব সৃষ্টি করেছে। কাজেই শত আদালতকে ব্যবহার করে ও বাইরে থেকে সাদা সুশীল আমদানি করে এ খেতাবটি তার কাছ থেকে কেড়ে নেয়া যাবে না।
সূত্র: ধানের শীষ , মার্চ ২০১১ সংখ্যা