ব্লক প্রসঙ্গের বাকি অংশ:
রাশিয়ার উদ্যোগে কনফেডারেশন রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন বানানোর একটা ছোট লাভক্ষতির খতিয়ান নিয়ে এবার শুরু করব। এতে দেখা যাবে, বাস্তবে অন্য দেশগুলোর নগদ লাভ হয়েছে এই যে, এরা পিছিয়ে পড়া এক প্রাক-পুঁজিতান্ত্রিক জঠর জ্বালা থেকে বের হতে পেরেছে। কিন্তু এতটুকুই অর্জিত হতেই বিনিময়ে রাশিয়ার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হিমশিম খেতে হয়েছে। আর নিজের রাষ্ট্র গড়া, রাষ্ট্রকে সার্বভৌম করার কাজ ফেলে রেখে এসব দেশ আজ কতটুকু আগাতে পারবে বা পারছে সে প্রশ্ন প্রকট হতে শুরু হয়েছে। বিক্রি হওয়াই যার নির্ধারিত ভাগ্য বলে স্বীকার করে শুরু হয়েছে, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাবার পর তা নতুন ক্রেতা আমেরিকার কাছে কোন নীতি-অবস্হানহীনভাবে নিজের যার যা আছে তাকেই বেচেই সম্ভবত ও একমাত্র সে আবার বেচে থাকতে চেষ্টা করবে। তাতে, আমেরিকার ইরাক হামলার পর তার শখের পাহারাদার বহুজাতিক বাহিনীতে পাহারাদারের চাকরীই সই। ইউরোপে গিয়ে খোলামেলা ঘুরে নিজের জনশক্তি কাজকর্ম করে খেতে পারতে পারে চিন্তা করেছে, কাজেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদ, ন্যাটোর মেম্বারশীপ সোনার হরিণ - এগুলো পেতে তাকে ন্যাংটা হয়ে যেতে হলেও সে রাজি। সম্প্রতি জর্জিয়া - আমেরিকার সাথে গাঁটছাড়া বাধা গেছে- এই সাহসে রাশিয়ার সাথে বলপ্রয়োগে সমাধান পথে গিয়ে নাকানি চুবানি খেয়ে এখন আমছালা দুটোই যাবার অবস্হা। চেকশ্লোভিয়া, যুগশ্লোভিয়ার ভেঙ্গে পড়া, টুকরো টুকরো দেশ হয়ে যাওয়া, সার্ব, ক্রেট, বসনিয়া, কসোভোর যুদ্ধ -প্রমাণ করে রাষ্ট্র গঠনের কাজটা জন্মের সময় এতই দুর্বল গাছাড়াভাবে করা যে এখন কিছু করেই নিজেকে রক্ষা করতে সক্ষম হওয়া যাচ্ছে না, চারিদিকে একটা নীতিহীন অবস্হানের মধ্যে কোন মতে টিকে থাকার সংগ্রাম করতেই সব শেষ। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো, ব্লক বাস্তবে ভেঙ্গে গিয়েছে ঠিকই কিন্তু ব্লক ধারণাটা এমন একটা ভাবনা দাড় করাবার ভান করেছে যেন সার্বভৌম রাষ্টের ক্লাসিক ধারণা ছাড়িয়ে সে এখন একটা বিকল্প। অথচ, রাষ্ট্র ধারণার ইতিহাসে জায়গা করতে চেয়ে শেষে হয়ে দাড়িয়েছে একটা ব্যর্থ, অক্ষম প্রচেষ্টা। সোভিয়েত ইউনিয়ন গড়ে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ত্ব এই ক্লাসিক প্রশ্নটার কোন বিকল্প ধারণা গড়তে পারেনি বরং রাষ্ট্র কেন দরকার, কেন সে টিকে থাকে সেই মাথা খারাপ করা প্রশ্নের মধ্যেই আবার চিন্তা ঘুরপাক খেতে থাকে।
প্রতিটি পড়শি বা অন্য রাষ্ট্র নতুন রাষ্ট্রের ভরপুর সম্ভাবনাময় শত্রু - এই গুরুত্ত্বপূর্ণ প্রস্তাবকে পাশ কাটিয়ে কোন ধারণা দেখা যাচ্ছে এখনও তৈরি হতে পারেনি। ব্লকের ধারণা বিষয়টাকে বরং ঘোলাটে করে একে কেবল রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ধারণার খাপে ভরে বিতর্কটাকেই পথভ্রষ্ট করেছে। ব্লক ধারণার ভিতরে - রাষ্ট্র মানেই অন্য আর সব রাষ্ট্রের সাথে শত্রুতা সম্পর্ক - রাষ্ট্রের সংজ্ঞার এই মৌলিক ও ক্লাসিক ধারণাকে অস্বীকার করা হয়েছে। মনে করা হয়েছে এই মৌলিক স্বার্থের দিকটা যার জন্য ওটা রাষ্ট্র, ওর অস্তিত্ত্বের সমার্থক - তাকে ভুলে গিয়ে, চেপে রাখা সম্ভব। এখানে ধরে নেয়া আছে, কোন জনগোষ্ঠি নতুন রাষ্ট্র হিসাবে আবির্ভূত হবার পর যেনবা চাইলেই অন্য রাষ্ট্রের সাথে "বন্ধুরাষ্ট্র" (সত্যি সত্যি মানে করে ডিপলোমেটিক ভাষায় নয়) হতে পারে। সময় ও ইস্যুভিত্তিক বিশেষ পরিস্হিতিতে উভয়ের লাভ (win win) অর্থে না, স্হায়ীভাবে ভাবে একটা রাষ্ট্রের জোট (alliance) করা সম্ভব। আরও লক্ষণীয়, সোভিয়েত ইউনিয়ন রাষ্ট্রের আলাদা সিদ্ধান্ত গ্রহণ ক্ষমতা বজায় রেখে কোন হাল্কাপাতলা রাষ্ট্রের জোট নয়। জোটের উদাহরণ হিসাবে যেমন, আরব লীগ, ইসলামি ঐক্য সংস্হা (OIC), আফ্রিকান ইউনিয়ন বা এমনকি ইউরোপীয় ইউনিয়নও নয়। পাঠক একদিকে এদেরকে রাখুন অপরদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন কল্পনা করুন। সোভিয়েত ইউনিয়নকে মনে করা হয়েছে রাষ্ট্রের ফেডারেশন। এটাই সেই কাঁচের পাথরের বাটি জাতীয় সমস্যা। এমনকি যারা সোভিয়েত ইউনিয়নের কেউ না, যেমন, চেকোশ্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি বা রুমানিয়া কথাই যদি ধরি, এদেরকে আলাদা রাষ্ট্র বলে স্বীকার করে নেয়া হয়েছিল, অথচ সোভিয়েত ইউনিয়নের "বন্ধু" রাষ্ট্র বলেও নাকি মানা হতো - এদের উপর ট্যাঙ্ক চালানোর ঘটনাকে আমরা "বন্ধু" রাষ্ট্র বা রাষ্ট্র ধারণা কত প্রকট সমস্যা সঙ্কুল ছিল বুঝতে পারি। এই ধরনের চিন্তার ভিতর আরও মারাত্মক বিষয় ধরে নেয়া আছে। মনে করা হয়েছিল জন্ম নেয়া নতুন কোন রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ত্ব ও নিরাপত্তা নিয়ে নিজে ভাবার দরকার নাই। যেমন আমেরিকা বা রাশিয়ার বৈদেশিক নীতির বাস্তবায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়াই নতুন রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ত্ব ও নিরাপত্তার গ্যারান্টি পাবার উপায়।
রাষ্ট্র সম্পর্কে এসব ভাবনা থেকেই দুনিয়া জুড়ে চালু কমিউনিষ্ট আন্দোলনের আরও একটা গুরুত্ত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট হলো, এরা যে রাষ্ট্রের বদল ঘটাবার জন্য আন্দোলন করছে একে ভাঙ্গা বা বদলাবার জন্য যতটা মরিয়া কর্তব্যজ্ঞান করে ঠিক ততটাই রাষ্ট্র গঠন বা constitute করার যে একটা দিক আছে সেটা বুঝতে পারে না। বড় জোড় একটা ক্ষমতা দখল টাইপের কিছু একটা বুঝে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের আকার দেবার জন্য কমিউনিষ্টের কাজটা কী সে কিছু বুঝে উঠতে পারে না। ঐতিহাসিকভাবে দেখলে রাষ্ট্র ক্ষমতা ও রাষ্ট্র কাঠামো (categorical division of power and apparatus) লেনিনের হাতে বিকশিত এই ধারণাটাই এদের মধ্য না থাকার কারণে এই চিন্তাটা চর্চার মধ্যেও অনুপস্হিত। এসব কিছুর সম্মিলিত ফলাফল হলো সে যে কোন দেশের কমিউনিষ্ট পার্টি হোক বা ক্ষমতাসীন কমিউনিষ্ট পার্টি হোক - সবার গন্তব্য ছিল "দুনিয়ার মজদুর এক হও" বলে শ্লোগানের আড়ালে সবাই নিজ নিজ দেশে সোভিয়েত বৈদেশিক নীতির একএকজন সফল সুচারু বাস্তবায়ক। । অথচ এরা বিপ্লবী আবেগে ঠেলায় যে তিতা-সত্যটা ভুলে গিয়েছিল তা হলো, শেষ বিচারে রাশিয়া একটা আলাদা রাষ্ট্র ফলে এর অস্তিত্ত্বের সমার্থক এর একটা আলাদা স্বার্থ এই রাষ্ট্র জন্মানোর সাথ সাথে সহজাত তৈরি হয়ে গেছে। এই স্বার্থটা যেটা এর পররাষ্ট্র নীতির ভিতরে প্রতিফলিত সেটা সবসময় অন্য কোন কমিউনিষ্ট বা নন-কমিউনিষ্ট রাষ্ট্র, নতুন কিংবা পুরানো রাষ্ট্রের স্বার্থের সাথে কখনও মিলবে কখনও মিলবে না - এটাই সবচেয়ে স্বাভাবিক। কোন নতুন কিংবা পুরানো রাষ্ট্রের স্বার্থের ভিতরে রাশিয়া কখনও কিছু তার জন্যও ভাল অথবা সবটাই তার জন্য ভাল মনে করতে পারে, তবুও এর মানে এই না যে রাশিয়া তার জন্য সবসময় পক্ষের বা "বন্ধুরাষ্ট্র" এভাবে বিবেচনা করতে হবে। এমনকি অন্য সময়ে একই বা ভিন্ন ইস্যুতে হয়তো দেখা যাবে ঘটনা পুরা উল্টা।
চীনের অভিজ্ঞতা:
দুনিয়াকে কাপিয়ে দেয়া দ্বিতীয় যে কমিউনিষ্ট বিপ্লব তা ঘটেছিল চীনে। ওরাই প্রথম বুঝেছিল, "দুনিয়ার মজদুর এক হও" স্লোগানের আর সোভিয়েত বৈদেশিক নীতিতে প্রতিফলিত রাষ্ট্রের স্বার্থ এদুয়ের মধ্যে একটা বিরোধ আছে। কথাটা আমি যতটা গুছিয়ে বললাম চীনা কমিউনিষ্ট পার্টি ঠিক এভাবেই বুঝেছিল এটা আমার দাবি নয়। চীনা কমিউনিষ্ট পার্টির সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে "সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ" বলে মূল্যায়ন ও অভিযোগটাতে যদি কোন সারবস্তু থাকে তবে ওটাকে এই আলোকে দেখা যেতে পারে। তবে দুঃখজনকভাবে বলতে হচ্ছে, চীনারাও কথাটা বলছে রাশিয়ার সাথে সম্পর্কের একটা বাস্তব অভিজ্ঞতার উপরে দাড়িয়ে, রাষ্ট্র ভাবনায় চিন্তার, তত্ত্বের সমস্যা হিসাবে নয়; এটাকে তত্ত্বীয়ভাবে রাষ্ট্র ভাবনার কমিউনিষ্ট আন্দোলনের সমস্যা বলে বুঝেছে - এরকম কোন বুঝের উপর দাড়িয়ে বলা কথা হিসাবে আমরা দেখছি না। এজন্য অভিযোগ উপস্হাপনটাও গোলমেলে। রাশিয়ান বিপ্লব কীসে পরিণত হয়ে গেছে সেই রাষ্ট্র চরিত্র (একটা উদ্ভট শব্দ, আসলে বলতে চেয়েছে বৈশিষ্ট) উল্লেখ করে দিয়ে বলার চেষ্টা। এভাবে বৈশিষ্ট তুলে কথা বলাটা মানে ঘটনার লক্ষণ দেখে ঘটনা বর্ণনার (রোগ না রোগের লক্ষণ) চেষ্টা। ফলে এর সমাধান পেতে তা আমাদের যথেষ্ট কাজে আসেনি, তবে কাদা ছুড়াছুড়িতে খুব কাজে লেগেছে। আমাদের দরকার ছিল চিন্তার কোন সমস্যার কারণে এটা হয়েছে সেটাসহ খুজে দেখা। তাহলে এর সমাধানটা কী হতে পারে, নিজেরাও একই দোষ দোষী কীনা - এসব বিপর্যয় এড়ানো যেত হয়ত।
চীনের বেলায় সবচেয়ে যেটা গুরুত্ত্বপূর্ণ, নিজেও সেই একই ব্লক ধারণা কান্ধে নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের মত তবে ভিন্ন নিজের ব্লক খুলে বসা। সোভিয়েত ব্লক ধারণা বিরোধীতা করে চীনও আলোচ্য প্রস্তাবকেই সমর্থন করেছে। এজন্য সোভিয়েত বিরোধীতার কিছুদিন পরে এক পর্যায়ে আলবেনিয়াকেও চীনের বিরুদ্ধে একই চীনা সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের অভিযোগ করতে দেখেছি।
ব্যাপার হলো সারকথায় আমি যা বলতে চাচ্ছি - চীনারা যদি বুঝতে সক্ষম ও একমত হত, রাষ্ট্র মানেই অন্য রাষ্ট্র তার সম্ভাবনাময় শত্রু - এই প্রস্তাব সত্যি ফলে, রাষ্ট্র মাত্রই ওর একটা একান্ত স্বার্থ আছে থাকবে। কিন্তু তাসত্ত্বেও ইতিহাসের কোন বিশেষ পরিপ্রেক্ষিতে অন্য রাষ্ট্রের সাথে দরকারি সাময়িক সমঝোতাগুলো করার সুযোগ নেয়া যায়। যেখানে সমঝোতা করতে পারছে না তা আকাঙ্খি রাষ্ট্রকে খোলাখুলি জানাতে পারে। আমি বলতে চাচ্ছি, রাষ্ট্র হিসাবে সব রাষ্ট্রের একান্ত স্বার্থ আছে, যতক্ষণ সে রাষ্ট্র ততক্ষণ তার এই স্বার্থ আছে, অস্তিত্ত্ব ও স্বার্থ সমার্থক। একমাত্র রাষ্ট্রের অস্তিত্ত্ব না থাকলে তার কোন স্বার্থ নাই। তবে সেক্ষেত্রে মানে হবে ঐ জনগোষ্ঠি নিজেদেরকে কোন রাষ্ট্রের মধ্যে গঠন (constitute) করা পর্যন্ত পৌছাতে সক্ষম হয় নাই। একথা যদি বুঝি ও মানি তবে নিজের স্বার্থে কথা বলছি একথা জানান দিয়ে কথা বলাই তো ভালো।
সে খোলাখুলি পথে না গিয়ে "দুনিয়ার মজদুর এক হও" স্লোগানের আড়ালে (যেহেতু একথার প্রয়োজন সব বিপ্লবী মানে যদিও এর ব্যবহারিক রূপ বিষয়ে তত্ত্বীয় সমস্যার হাল হয়নি) অন্য রাষ্ট্রকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করা, ব্লক বানানো; এমনকি আবার নন-কমিউনিষ্টদের মতনই পরিস্হিতি তৈরি করে অথবা তৈরি পরিস্হিতির সুযোগে সে ফাঁদে ফেলে বা বড়ভাইয়ের গায়ের জোড় দেখিয়ে নিজ রাষ্ট্রের স্বার্থ উদ্ধার করা -এটা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য, সবচেয়ে অমার্জনীয়।
চীনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের অভিযোগ:
ঘটনার সত্যতা হলো, গণপ্রজাতন্ত্রী চীন রাষ্ট্র ১৯৭১ সালে বাংলাদেশকে সমর্থন করে নাই। কেন? এই প্রশ্নটাকে মাথায় রেখে রাষ্ট্র ভাবনা ইতিহাসের ভিতর দিয়ে যেভাবে গড়িয়ে চলেছে তাকে ধরার চেষ্টা করতে গিয়ে এখানে পৌছেছি। এখন এর সহজ উত্তর দেয়া একেবারে সহজ।
চীনের জনগোষ্ঠির রাষ্ট্রীয় স্বার্থ ওর পররাষ্ট্র নীতিতে যা সবচেয়ে ভালোভাবে প্রতিফলিত, ওটা আমাদের জনগোষ্ঠির রাষ্ট্র আকাঙ্খার স্বার্থের সাথে ম্যাচ করে নাই। দ্বিতীয়ত, আমরা ব্যবহৃত হয়ে গেছি।
১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময়ে বিশেষ করে যুদ্ধের পরে পরে, নকশাল আন্দোলন রাষ্ট্রকে সশস্ত্র মোকাবিলা করতে গিয়েছিল। এর বিরুদ্ধে প্রচারের দরকারে আওয়ামী লীগ-ভারতীয়-সোভিয়েত একটা ভাবাদর্শগত বিচার, পাল্টা বক্তব্য ছিল - আমি পাঠককে এথেকে আরও গভীরে নিয়ে যেতে চাই। এই প্রচারমূলক বক্তব্যের ভিতরে সত্যতা আছে। আমি পাঠককে আরও গভীরে নিতে চাই এজন্য যে আজ এই প্রচারের শুধু সত্যতা বিস্তারে জন্য জানা আমাদের জন্য যথেষ্ট নয়। বরং গভীর পর্যালোচনার ভিতর দিয়ে আমাদের রাষ্ট্র ভাবনা বিষয়কে যদি আরও স্বচ্ছ করতে পারি, আজকের প্রেক্ষিতে আমাদের লাভালাভি সেখানে। আমি এজন্য এখানে নকশাল আন্দোলনের কোন পর্যালোচনাও করতে যাব না, প্রাসঙ্গিকও নয় বলে। । ফলে দুই কুকুরের কামড়াকামড়ি জাতীয় প্রসঙ্গ পাশে রেখে আরও দূরে যেতে পাঠককে আহ্বান রাখব।
চীনা রাষ্ট্রের দিক থেকে দাঁড়িয়ে দেখলে, আমরা দেখব ১৯৬৯ সাল থেকেই চীনা রাষ্ট্র একটা তার গুরুত্ত্বপূর্ণ স্বার্থের ব্যাপারে চেষ্টা করে যাচ্ছে। বিষয়টা হলো, মুখ্যত জাতিসংঘের সদস্যপদ, তবে আরও অনেক কিছু। আগেই জানিয়েছি অক্টোবর ১৯৭১ সালের আগে চীন জাতিসংঘের সাধারণ সদস্যও নয়। এটা শুধু সাধারণ সদস্যপদের মামলা নয়, নিরাপত্তা পরিষদের ভেটোধারী স্হায়ী সদস্যপদেরও বিষয়। আরও স্পষ্ট করে বললে এটা একইসঙ্গে তাইওয়ানকে বহিস্কার করার মামলা। তাই জটিল, দীর্ঘদিন থেকে চীন সদস্যপদের জন্য আবেদন করে বসে থাকলেও প্রতিবার সাধারণ সভার আগেই আমেরিকান ভেটোতে তা নাকচ হয়ে গেছে। আমি যদিও জাতিসংঘের সদস্যপদ বিষয়কে ধরে কথা শুরু করেছি তবু চীনের ঐ সময়কে বুঝতে এটা অবশ্যই যথেষ্ট নয়। তারপরেও ইস্যুগুলোর সবিস্তারে না গিয়ে সংক্ষেপে শিরোনামে বলছি। ১৯৫৮ সাল থেকে শুরু হওয়া সাংস্কৃতিক বিপ্লব ভাটায় এসে এক ধরণের থিতাচ্ছে, এর খতিয়ান টানা শুরু হয়েছে, ২. চীন-রাশিয়ার সীমান্ত এলাকায় পরস্পরের উপর স্হানীয় সীমায় তবে সশস্ত্র সংঘাত দেখা দিয়েছে। এতে চেক, হাঙ্গেরির উপর রাশিয়ান সামরিক অভিযানের কথা স্মরণ করে চীন ভালরকম ভীত হয়ে পড়েছে। ৩. বিপ্লবের ২০ বিছর পরও আশানূরূপ অর্থনৈতিক অপর্যাপ্ত অবিকাশ মোকাবিলার পথ কী তা নিয়ে পার্টিতে বিরোধ দেখা দিয়েছে। এখানে একটা কথা মনে রাখা দরকার, ব্লক ধারণার আর একটা অনুসঙ্গ হিসাবে আলাদা দ্বীপের মত "সমাজতান্ত্রিক" দুনিয়া বিকশিত হচ্ছিল, বাইরে থেকে বিনিয়োগ নেয়া জায়েজ কী না - এসব চিন্তা তখনও না তত্ত্বে না ব্যবহারিক বাস্তবতা হিসাবে কমিউনিষ্ট চিন্তায় ফয়সালা হয় নাই। এটা আজও তত্ত্বে সমাধান না হলেও, ব্যবহারিক সুবিধা বিবেচনাতে আন্তর্জাতিক পূঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কের দুনিয়ায় অংশ নিতে সবাই এগিয়ে যাচ্ছে। লেনিনের সাম্রাজ্যবাদের লগ্নি পূঁজি তত্ত্বের পর এর আর কোন আপটুডেট নাই। বিশষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক পূঁজির সঙ্কট মিটাতে ১৯৪৪ সালে থেকে শুরু করে যেসব নতুন ফাইন্যান্সিয়াল প্রতিষ্ঠান (IMF, WB, WTO) গড়ে উঠতে শুরু করেছে এই লক্ষণের মানে কী তা নিয়ে কোন তত্ত্বীয় মূল্যায়ন না করে, কেবল ব্যবহারিক সুবিধা বিবেচনাতেই এগুলোর সাথে সম্পর্ক পাতানোর মাপকাঠি হয়ে আছে। ফলে "বিড়াল ইদুর মারে কী না" - এগুলোই সেই মাপকাঠি। মূলকথা হলো তত্ত্বীয়ভাবে সমাধান না জানলেও, ব্যবহারিক যুক্তিতে পশ্চিমের দুয়ার খোলার একটা ভাবনা সক্রিয়ভাব চীনের বিবেচনায় ছিল। এই পটভূমিতে আমরা চীনকে নিয়ে কথা বলতে বসেছি।
এবার মূলকথায় ফিরে আসি। এসব নিয়ে আমেরিকার সাথে ডায়লগ ওপেন করার তাগিদ উভয় দেশ অনুভব করলেও কোন ডিপলোমেটিক সম্পর্ক না থাকায় পাকিস্তানের মাধ্যমে অপ্রত্যক্ষ আলোচনা চলছিল। এরই একটা ফলাফলে ঐ সময়েই পেকে উঠে। পাকিস্তানের সাথে এই উভয় দেশের ভালো ঘনিষ্ট সম্পর্ক তাই, পাকিস্তান একটা ব্রিজ হিসাবে চীন-আমেরিকার সম্পর্কে একটা পরিণতি আনার ক্ষেত্রে গুরুত্ত্বপূর্ণ নির্ধারক ভূমিকা পেয়ে যায়।
এবার আয়ুব খান বা পরবর্তিকালে ইয়াহিয়া খানের দিক থেকে দেখলে এটাই পাকিস্তানের এই মেডিয়েটরের ভূমিকা নেবার গুরুত্ত্ব তার সামনে একটা ইউনিক সুযোগ হিসাবে হাজির হয়। পাকিস্তান তার নিজের আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক উথাল-পাথাল মানে আমাদের দিক থেকে দেখলে গণঅভ্যূত্থান, আগামি রাষ্ট্রের জন্য প্রাকপ্রস্তুতি পোয়াতি ব্যাথার কালপর্ব -এসব সমস্যা মোকাবিলায় পাকিস্তান চীনের সহায়তা চেয়ে বসে। মনে রাখতে হবে পাকিস্তানের ভুমিকাটা চীন-আমেরিকার আসন্ন ডিনারে starter meal এর মতো। এই শর্তগুলোকে কাজ লাগিয়ে বাংলাদেশের (পূর্ব পাকিস্তান) চীনপন্থি কমিউনিষ্ট পার্টির উপর চীনের প্রভাব আয়ুব খান ও পরবর্তিকালে ইয়াহিয়া খান পুরোপুরি নিজের স্বার্থে ব্যবহারে পাকিস্তান সফল হয়। ১৯৬৯ এর গণঅভুত্থান যাতে সমাজের ছাত্র ও শহুরে জনগোষ্ঠির বাইরে বিশেষত শ্রমিকদের সংগঠিত করতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা ও প্রভাব ছিল মোহাম্মদ তোয়াহার। ফলে গণঅভ্যুত্থান সফল করা পর্যন্ত বড় নির্ধারক ভুমিকা নিলেও এই সফলতার পরপরই বাংলাদেশের (পূর্ব পাকিস্তান) রাজনীতিতে নির্ধারক ঘটনাটা ঘটে। ভাসানী ইয়াহিয়ার সাথে লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডারের (LFO) গোলটেবিল আলোচনা বর্জনের ডাক দেয়। এই প্রজন্মের পাঠকের কাছে বোধগম্য করার জন্য একটু বিস্তারে যাবে। পাকিস্তান আমলে কমিউনিষ্ট নামে পার্টি করা নিষিদ্ধ ছিল বলে ভাসানীর নেতৃত্ত্বে ন্যাশনাল আওয়ামি পার্টির (ন্যাপ) নামে ভাসানীকে সামনে রেখে চীনাপন্থী কমিউনিষ্ট ধারাগুলো (হক, তোয়াহা, আলাউদ্দিন ইত্যাদি) রাজনৈতিক তৎপরতা চালাত। গণঅভুত্থানকে সফল পরিণতি দিতে আওয়ামী লীগ সকল দলের সাথে মিলে ন্যাপ হিসাবে এরা সবাই ভুমিকা রেখেছে। আয়ুব খানকে হার মেনে ক্ষমতা হস্তান্তরে রাজি হয়েছে। এখন আলোচনার একটা পর্যায় শুরু হচ্ছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পদ্ধতিতে কী হবে তার ফর্মুলা কী হবে তার নিগোশিয়েশন। এই ফর্মুলা, নিগোশিয়েশনের আইনী নাম লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার (LFO)। দীর্ঘ সামরিক শাসনের পরবর্তীতে, সবাই মানে এমন গঠনতন্ত্র (constitution) বলে কিছু অবশিষ্ট নাই। ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা কেবল আইনী দিক থেকে দেখলে, আমাদের বাচ্চার-বুঝ হলো একটা নির্বাচন (মাথায় কাজ করে একটা সংসদ নির্বাচন) দিয়ে দিলেই তো হয়। কিন্তু ঘটনা হলো, সংসদ খাড়া করা বা নির্বাচন চাওয়া মানেই ধরে নেয়া হয়ে যায় কোন একটা গঠনতন্ত্র (constitution) আগে থাকতে আছে, রাষ্ট্র গঠন (constitute) হয়ে আছে। তার অধীনে একটা নির্বাচন চাছ্ছি। অথচ সবাই মানতে রাজি আছে বাস্তবে এমন কোন গঠনতন্ত্র (constitution) বলে কোন কিছু অবশিষ্ট নাই। একথার ভাবগত অর্থ হলো, আসলে জনগোষ্ঠি তখনও রাষ্ট্রে নিজেকে সংগঠিত (constitute) আত্মপ্রকাশ করে নাই। তবে হওয়ার পথে লড়াই সংগ্রামরত। ফলে আইনী দিক থেকে (LFO) হলো সেই বিবদমান পক্ষের চুক্তিপত্র এবং দাঁড় করানো একটা প্রি-আইনী একমতের ভিত্তি যার উপর দাড়িয়ে জনগোষ্ঠি নিজেকে রাষ্ট্রে সংগঠিত (constitute) করবে, গঠনতন্ত্র (constitution) রচনা করবে। আবার ঐ গঠনতন্ত্র (constitution) কারা প্রণয়ন ও কাদের কোন সভার অনুমোদনে তা গৃহীত বলে বিবেচিত হবে - সেই গঠনতন্ত্র (constitution) সভার সদস্য নির্বাচন ছিল ১৯৭০ এর নির্বাচনের লক্ষ্য। ওখানে জগাখিচুরি অবশ্যই ছিল, যেমন গঠনতন্ত্র (constitution) সভার সদস্য নির্বাচন মানে যেন তারাই আবার সংসদ সদস্য - এমন ধারণা ওখানে ছড়িয়ে রাখা ছিল। যেখানে গঠনতন্ত্রই (constitution) নাই সেখানে কোন গঠনতন্ত্রের (constitution) অধীনে সংসদ নির্বাচন আহ্বানের আয়োজন হবে? আগে গঠনতন্ত্রের সভার সদস্য নির্বাচন, না আগে গঠনতন্ত্রের একটা হাওয়াই অস্তিত্ত্ব ধরে নিয়ে তার অধীনে সংসদ নির্বাচন -এসব জগাখিচুরি ওখানে ছিল। যা হোক সেই (LFO) সংক্রান্ত গোলটেবিল আলোচনা বর্জনের ডাক দিয়েছিলেন ভাসানী ন্যাপ। কেন?
বাংলাদেশের (পূর্ব পাকিস্তান) চীনাপন্থি কমিউনিষ্ট পার্টির উপর চীনের প্রভাব যেটা আয়ুব খান ও পরবর্তিকালে ইয়াহিয়া খান নিজের স্বার্থে হাসিল করতে পেরেছিলেন - এটা সেই প্রভাবের ফসল, তবে অবশ্যই সবটা কারণ নয়। সোজা বাংলায় চীনা রাষ্ট্রে স্বার্থের কাছে আমাদের জনগোষ্ঠির রাষ্ট্রে নিজেকে সংগঠিত (constitute) করার আকাঙ্খাটা বিক্রি হয়ে গেছিল। এখন আমার এই ব্যাখ্যাকে আরও সবল করার জন্য আরও কিছু তথ্যে যাব।
আমরা যখন ২৫ মার্চের ভয়াল রাত্রি পার হচ্ছি, ইয়াহিয়ার এই নৃশংস হত্যাকান্ড কাজের নিন্দা করতে মনোযোগ দেবার মত অবস্হায় চীনা রাষ্ট্র নাই। বরং পাকিস্তান ইয়াহিয়া শাসকের প্রতি মৌন বা অপ্রতক্ষ্য সমর্থন আছে - এতে চীনা স্বার্থের তীব্রতা কতটা মারাত্মক ছিল তা আমরা বুঝতে পারি। ১৯৭১ সালের জুলাই, ছিল একটা গুরুত্ত্বপূর্ণ সময়। প্রেসিডেন্ট নিক্সনের জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা হেনরি এ কিসিজ্ঞার পাকিস্তান সরকারের আমন্ত্রণে সফরে এসেছেন, পাকিস্তানের পাবলিক ঘোষণায় আমরা এটা জেনেছিলাম। পাঠক বোধহয় উৎফুল্ল হচ্ছেন, কিসিজ্ঞার ইয়াহিয়াকে কী বুদ্ধি দিয়েছিলেন থ্রীলার পত্রিকা কলামে আমরা যেমন দেখি তেমন কিছু একটা বলব। সরি হতাশ করলাম, পাঠক আমি থ্রীলার লেখক নই। আমি কেবল কিছু তথ্যের আশ্রয় নিব, উভয়ের কী কথা হয়েছিল - কল্পনায় রাঙ্গিয়ে এমন কোন গল্প ফাঁদব না। পাকিস্তান সফরে এসে ৯-১১ জুলাই এই দুই দিন কিসিজ্ঞারের অনুষ্ঠানসূচি কী কেউ জানে না। কিসিজ্ঞার জনসমক্ষ থেকে গায়েব ছিলেন। অনেক পরে জানা গেল গোপন সফরে তিনি চীন গিয়েছিলেন। এই সফর চীন ও আমেরিকার জন্য খুবই দরকারি একটা সাক্ষ্যাত ছিল। প্রথমত এটা ছিল বিগত প্রায় দুবছর ধরে চলে আসা নিগোশিয়েশনের একটা প্রথম পরিণতি টানা, ফসলগুলো ঘরে তোলা, নতুন আরও লাভের পথের দিশ ঠিক করা। এর ব্যবহারিক কাজ হিসাবে এসেছিল আমেরিকান প্রেসিডেন্ট নিক্সনের জন্য চীন সফরের আয়োজন করা। চৌ-এন-লাইয়ের সাথে বসে কিসিজ্ঞারের প্রেসিডেন্টের ভিজিটের বিস্তারিত আলোচনার ধাপ সেরে নেওয়া। চীনাদের দিক থেকে আলোচনা আগানোর প্রথম ধাপ ছিল পরস্পরের স্বীকৃতি বিনিময় আদায় করে নেয়া। মানে, জাতিসংঘে তাইওয়ানকে সরিয়ে চীনকে স্হায়ীসদস্য পদে মেনে নেওয়া। কিসিজ্ঞারের সফরে আলোচনার ফলাফলে ইতিবাচক সাড়া হিসাবে আমরা দেখেছিলাম দুদিন পরেই। ১৪ জুলাই প্রেসিডেন্ট নিক্সন কিসিজ্ঞারের সাথে চীনা নেতা আলোচনার প্রতি তাঁর ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করতে ঘোষণা করলেন, চীনা পণ্য ও পণ্যের চলাচলের ব্যাপারে আমেরিকা তার শর্তের তালিকা আরও ছোট ও শিথিল করবে। এরপরের দিন ১৫ জুলাই ারও চমক। প্রেসিডেন্ট নিক্সন হঠাৎ করে প্রেসের সামনে ঘোষণা দিলেন পরের বছর অর্থাৎ ১৯৭২ সালের মে মাসে তিনি চীন সফরে যেতে চান। নিক্সনের ঘোষণার তিন সপ্তাহের কম সময়ের মধ্যে তাঁর পররাষ্ট্র উপদেষ্টা উইলিয়াম পি রজারর্স ঘোষনা দেলেন, আমেরিকা জাতিসংঘের পরবর্তী সাধারণ সভায় চীনের বসা ও নিরাপত্তা পরিষদে সদস্যপদ তাইপেই (তাইওয়ানের রাজধানী) থেকে পিকিং কে দেওয়ার ব্যাপারটা সমর্থন করবে।
আমরা তাহলে স্পষ্ট দেখলাম, চীনা রাষ্ট্র নিজের প্রকট স্বার্থে এমন বুঁদ হয়ে গেছিল, যেটাকে বলে হুঁশ হারানো অবস্হা যাতে সে নিজের বেষ্ট বন্ধুর নিষ্ঠুরতা আচরণ লক্ষ্য করতে পারছিল না। বরং পাকিস্তানের অবস্হানই সমর্থন জুগিয়ে বসেছিল। অবশ্য ওখানে আঞ্চলিক যুদ্ধকৌশলগত স্বার্থও ছিল।
এবার একটু বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে আবার ফিরব। বলেছিলাম (LFO) সংক্রান্ত গোলটেবিল আলোচনা বর্জনের ডাক দিয়েছিলেন ভাসানী। এতে (LFO) ব্যর্থ হয়ে যায়নি। কারণ বর্জনের ডাক দিলেও ভাসানী ন্যাপের ছাতার তলে কাজ করা কোন কমিউনিষ্ট ধারা বিকল্প কোন দৃশ্যমান রাজনৈতিক পদক্ষেপ কর্মসূচি নেয়নি। আসলে দল সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঠিকই কিন্তু কেন নিয়েছে, কে নিয়েছে - তা মাঠের সাথে জনগোষ্ঠির উপস্হিত মেজাজের সাথে যে সামজ্ঞস্য নাই - তা কর্মী নেতা সবাই বুঝতে পারছিলেন। কিন্তু কিছু করার নাই, দলের এক গায়েবি সিদ্ধান্তের জ্বালে সবাই আটকা। সোজা কথায় আসলে, একটা নৈতিক বিপর্যয়ের ঝড় বয়ে গিয়েছিল সবার উপর দিয়ে। ফলে এথেকে বের হতে সবাই যেন মনে মনে অপ্রত্যক্ষে চাইছিল গণআকাঙ্খাটার যেন মৃত্যু না হয়, শেখ মুজিবের মাধ্যমে হলেও যেন এটা একটা পরিণতি পায়। শেখ মুজিব যখন ইয়াহিয়ার সাথে (LFO) সংক্রান্ত প্রথম দিনের গোলটেবিল আলোচনায় যোগ দিতে যাচ্ছেন, একদম আক্ষরিক অর্থে কথাটা সত্য,তাঁর যাবার পথে তিনি ভাসানীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। আলোচনায় সফলতা বরকত পাবার জন্য "হুজুরের দোয়া" নিতে। এই ঘটনাটা খুবই প্রতীকি। জনগোষ্ঠি হিসাবে আমাদের রাজনৈতিকতার মাত্রা, এর ধরণ, আমরা কীভাবে ভাবতাম, ঐ ভাবনার সীমাবদ্ধতার ভিতরে কী সমাধান বের করেছিলাম - এসব কিছু যেন প্রতীকায়িত হয়েছে ঐ ঘটনায়। এলাইনটা লিখতে বসে যে আবেগ অনুভব করছি তাহলো এই ভেবে যে, "দুনিয়ার মজদুর এক হও" শ্লোগান ত্যাগ করা যে ঠিক নয় এটা বুঝতে পেরেছিলাম। এটা যেমন সত্য ঠিক তেমনি, আমাদের জনগোষ্ঠির রাষ্ট্রে নিজেকে সংগঠিত (constitute) ও আত্মপ্রকাশের যে আকাঙ্খাটা অনুভব করছি - ওটাও তো সত্য। তাহলে চিন্তার এই জট থেকে বের হবার পথ কী? শেখ মুজিবকে মওলানা ভাসানীর দোয়া করছেন, আগিয়ে যেতে ইঙ্গিত করছেন। এটাই সেই আগানির পথ। কখনও কখনও মানুষের চিন্তার ফাঁদ বাস্তবতার চেয়ে বড় মনে হয়ে সামনে খাড়া হয়ে যায়। তবু শেখ মুজিবের ভিতর দিয়ে আগানির পথ ভেসে উঠুক এই দোয়া তিনি করার সুযোগ নিতে পেরেছিলেন। এটা ভাবছি আর ভাবছি, শিহরিত হয়ে উঠছি।