গত কয়েকদিন ধরে ঢাকা শহরে আওয়ামী লীগের সরকার পরিচালনায় সাফল্য তুলে ধরে অনেক বিলবোর্ড লাগানো হয়েছে। এটা নিয়ে যথারীতি বিপক্ষে সমালোচনা শুরু হয়েছে, আর আওয়ামী লীগের সমর্থকেরা এর যথার্থতা তুলে ধরছেন। নিজের সাফল্য তুলে ধরায় দোষ নেই, গ্লানিও নেই। কিন্তু এই সাফল্য প্রচারের একটা উল্লেখযোগ্য দিক আমার কাছে ধরা পড়েছে, সেটা হচ্ছে শাসকরা রাষ্ট্র পরিচালনা বলতে কী বোঝেন? এবং তাদের সাফল্য বলতে তাঁরা কী বোঝেন? উনারা উনাদের কর্তব্য বলে যেটা মনে করেছেন এবং সাফল্য বলতে যা বুঝেছেন সেটাই বিলবোর্ড গুলোতে তুলে ধরা হয়েছে বলেই আমি ধরে নিচ্ছি। সেই আলোকে আসুন আমরা দেখি উনারা উনাদের কর্তব্য বলে যেটাকে ধরে নিয়েছেন এবং সাফল্য বলেতে যেটা বুঝিয়েছেন সেটা উনাদের কর্তব্য ছিল কিনা এবং সেগুলো সাফল্যের মাপকাঠি হতে পারে কিনা?
জনগন একটা দলকে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষমতা অর্পণ করে। রাষ্ট্র সেই ভূখণ্ডের জনগনের সামাজিক চুক্তির সর্বোচ্চ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। এই রাষ্ট্র দুটো মুল কাজ করে,
১/ কিছু সামাজিক সেবা নিশ্চিত করে, যেমন, আইন শৃঙ্খলা, সামাজিক নিরাপত্তা, জনসেবা, সম্পদের কল্যাণমুখী পুনর্বিতরণ এবং বাজার নিয়ন্ত্রণ।
২/ প্রাক পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থাকে আরো অগ্রসর এবং প্রগতিশীল পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় রুপান্তর।
প্রথমটাকে বলা হয় সার্ভিস ডেলিভারি মডেল আর দ্বিতীয়টাকে বলা হয় ট্রান্সফরমেসন মডেল। রাষ্ট্র বিজ্ঞান বলে যে, সার্ভিস ডেলিভারি মডেলের সাফল্য নির্ভর করে রাষ্ট্র ট্রান্সফরমেসন মডেলে কতটুকু সফল। তাহলে এটা বলা যেতেই পারে, সাফল্য মুলত নির্ভর করে ট্রান্সফরমেসন মডেলে কে কতটা ভালো করছে তার উপর। বাংলাদেশের মুল রাজনৈতিক দলগুলো যখন ভোট চায় তখন তাঁরা বলার চেষ্টা করে শেখ মুজিব বা জিয়ার মডেলে এই ট্রান্সফরমেসন মডেলে সাফল্য আসবে। সেই চিন্তাকে তাঁরা তাদের প্রয়াত নেতার স্বপ্ন বলে একটা বিমূর্ত ধারণা দেয়। এবং তাদের নেতার মডেল তাঁরা কখনো সহজভাবে এবং স্পষ্টভাবে ভোটারদের বুঝিয়ে দেয়না। এবার আমরা যদি সাফল্য বলতে আওয়ামী লীগ যা যা বোঝাতে চাইছে সেটা দেখি তাহলে লক্ষ্য করবো উনারা সার্ভিস ডেলিভারি মডেলের সাফল্যকেই উনাদের সাফল্য বলে ধরে নিয়েছেন। এই সার্ভিস ডেলিভারি মডেলগুলো আসলে রাষ্ট্র নামক প্রতিষ্ঠানটির একটি ধারাবাহিক সাফল্য, সরকারের নয়। রাষ্ট্রের সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট বা সামাজিক চুক্তির যদি কোন পরিবর্তন না ঘটে তবে সেই ধারাবাহিকতা নষ্ট হয়না। ধরা যাক, সাদ্দাম হোসেনের সময় একটা স্মাজিক চুক্তির অধীনে ইরাক রাষ্ট্রটি চলতো, সাদ্দাম হোসেনকে উৎখাত করে একটা নতুন সামাজিক চুক্তির অধীনে ইরাক চলছে। এই ক্ষেত্রে সাদ্দাম হসেন রেজিমের রাষ্ট্র উৎখাত হওয়ার কারণে সেই সার্ভিস ডেলিভারির ধারাবাহিকতা থাকবেনা। এই বিষয়টা নিশ্চয় আমরা লক্ষ্য করছি।
এবার দেখা যাক সার্ভিস ডেলিভারি মডেলের যে সাফল্য গুলো দাবী করা হয়েছে সেগুলোর জন্য সরকারের নেতৃত্ব কতখানি ভুমিকা রেখেছে? এমন কয়েকটা ক্ষেত্রে সাফল্য দাবী করা হয়েছে যেগুলো খুবই হাস্যকর এবং এক্সটারন্যাল ফ্যাক্টর যেখানে সরকারের কোন ভুমিকা থাকেনা। অ্যাট লিস্ট সেই ঘটনাটা ঘটানোর ক্ষেত্রে কোন কৃতিত্ব সরকারকে দেয়া যায়না। তবে কৃতিত্ব দেয়া যায় যে সরকার বাধা দেয়নি, সেটা ঘটতে দিয়েছে। যেমন ধরা যাক থ্রি জি মোবাইল সেবা চালু। এটা তো যে কোন সরকার থাকলেই হতো, এটা টেকনলজিক্যাল ডেভেলপমেন্ট। আরেকটা সুচকের সাফল্য দাবী করা হয়েছে, যেমন, ইন্টারনেটের ব্যবহার বাড়া। সারা পৃথিবীতে এটা বেড়েছে, তৃতীয় বিশ্বে এটা দ্রুত গতিতে বাড়ছে, বাংলাদেশে বাড়তেই হবে।
মাক্রো-ইকোনোমিক অনেকগুলো সূচকের ক্ষেত্রে ‘রিজিম চেঞ্জ’ বা ক্ষমতাসীন দলের পরিবর্তন-এর তেমন কোন সম্পর্ক নেই। যেমন জিডিপি প্রবৃদ্ধি হার, মাথাপিছু আয়, দারিদ্র দূরিকরণ হার, সরাকরি আয-ব্যয় (বাজেট), শিশু এবং মাতৃ মৃত্যুর হার.......এগুলোর ক্ষেত্রে সবসময়ই একটা অগ্রগতি থাকবে। এসব ক্ষেত্রের অগ্রগতি কেউ কখনো এককভাবে দাবি করতে পারে না। সুতরাং এগুলো নয, বরং একটা দল বা জোট ৫ বছরের জন্য নতুন নতুন কি বিশেষ কর্মসূচি/প্রকল্প হাতে নিচ্ছে, সেগুলি কতটা জনপ্রিয হচ্ছে বা হয়েছে, গেুলির সুফল মানুষ কতটা পাচ্ছে.......এগুলি হলো সাফল্যের মাপকাঠি। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অবশ্য অর্থনতির অগ্রগতির মূল মাপটাঠি হবে আর্থক থাতের শৃংখলা ও দুর্নীতি প্রতিরোধ। ধরুন, আপনি দেখালেন যে জিডিপি একটি বিশেষ রিজিম-এ খুব ভালো, তাবে দুর্ণতি খুব বেশি। সাধারণ মানুষ কিন্তু দুর্নীতির অবস্থা বিবেচনা করেই রিজম-এর ব্যর্থতা মেপে ফেলবে, জিডিপি নিয়ে মাথা ঘামাবে না। সে হযতো জানে না, কিন্তু আমি -আপনি জানি যে, দুনীতি মারাত্মক আকারে থাকলেও জিডিপি বাড়তে পারে। একই রকম সত্য হলো মাথাপিছু জাতীয় আয়ের ধারণা। এটাতো একটা গড়। আর এ ধরণের ম্যক্রো-ইকোনোমিক সূচকগুলোর অগ্রগতি ঘটে ধীর লযে............অনেক ধরণের উদ্যোগ, পরিসি ও বিনিযোগ-এর কিউমিলিটিভ ইফেক্ট হিসেবে। সুতরাং এগুলোকে কখনোই একটি বিমেষ রিজিম-এর সাফল্যের সুচক হিসেবে হাজির করা হয় না
দাবী করা হয়েছে জি ডি পি বেড়েছে। সন্দেহ নাই সেটা বেড়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের জি ডি পি বাড়তে শুরু করেছে ১৯৯০ থেকে এবং এই ধারাবাহিক উন্নয়ন কোন সরকারের আমলেই কমেনি। গ্রাফ দেখুন।
শিশু মৃত্যুর হার কমেছে বলে দাবী করা হচ্ছে; সেটা ২০০০ সাল থেকেই ক্রমাগত কমছে। গ্রাফ দেখুন।
এটা না কমলেই বরং আশ্চর্য হতে হতো। শিশু মৃত্যুর হারের ক্ষেত্রে কিন্তু আমরা এই অঞ্চলে মাত্র আফগানিস্তান আর পাকিস্থানের চাইতে একটু এগিয়ে, অন্যরা আমাদের চাইতে ভালো অবস্থায় এমনকি নেপাল, ভূটান ও আমাদের চাইতে এগিয়ে। তবে আমরা যদি বলতে পারতাম যে আমরা ভারতের চাইতে এগিয়েছি সেখানে হয়ত আমরা সরকারকে কৃতিত্ব দিতে পারতাম। শিশু মৃত্যুর হারের দিক থেকে আমরা বিশ্বের শীর্ষ ৫০ টি দেশের মধ্যে একটি। এটা কোন গর্বের অবস্থান হতে পারেনা।
দাবী করা হচ্ছে দারিদ্র কমেছে। মানলাম কমেছে, কিন্তু এই কমাটা শুরু হয়েছে কবে থেকে? ২০০৪ সাল থেকে। গ্রাফ দেখুন।
সেই সময়ের পর থেকে তো তিনটা সরকার বাংলাদেশের ক্ষমতায় ছিল। এই কৃতিত্ব আসলে কোন বিশেষ সরকারের নয়, এই কৃতিত্ব রাষ্ট্র নামের সেই প্রতিষ্ঠানের যার মালিক জনগন।
তাহলে কৃতিত্ব দাবী করা যেত কোথায়? করা যেত ট্রান্সফরমেসন মডেলে, যার মাধ্যমে একটা পুঁজিবাদী রাষ্ট্র “অরগানাইজার অব কন্সেন্ট” বা জনগনের হেজিমনি তৈরির দায়িত্ব নেয়। হেজিমনির অর্থ হচ্ছে সেই আদর্শবাদ বা ভ্যালু সিস্টেম যেটা সমাজের প্রগতিশীল রুপান্তরে জনগণের আদর্শিক বন্ধন এবং নৈতিক সম্মতি নিশ্চিত করে। রাষ্ট্রীয় ক্যাপাসিটি তৈরি করা সরকারে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ব। রাষ্ট্রের আদর্শিক কর্তৃত্ব বা হেজিমনি তৈরি হয়েছে কিনা সেটা চারটা প্যারামিটার দিয়ে বোঝা যায়। ১/ সমাজে পেনিট্রেট করার সক্ষমতা। ২/ সামাজিক সম্পর্কগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা। ৩/ রিসোর্স এক্সট্রাক্ট করার ক্ষমতা (কর সংগ্রহ) ৪/ নির্ধারিত পথে সেই সংগৃহীত সম্পদের ব্যবহার। এই ক্ষেত্রে সরকার কী করেছে সেটা জানাতে পারলে কৃতিত্ব নেবার বিষয়টি এবং দেবার বিষয়টি স্পষ্ট হতো।
তবে আওয়ামী লীগের কি দাবী করার মতো কৃতিত্ব নেই? সেই কৃতিত্বের বিষয়টা হাজির করতে হবে তাদেরই যারা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন। সেই কাজটি তো জনগন করে দেবেনা। জনগন এখন পরীক্ষক। উত্তর আওয়ামী লীগকেই দিতে হবে। যে উত্তর দেয়া হচ্ছে সেটার দুর্বলতা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া পরীক্ষকের কর্তব্য, উত্তর বলে দেয়া নয়।