(দুই)
ওই শোনো! খুব খেয়াল কৈরা শোনো! ও তোমাগো কথা কয় না! আমার কথাই কইতাছে। এই অধম মোকসেদ ব্যাপারী সারাদিন যা কয় তাই কইছে ওই অবুঝ পাখিটা। শ্রী-কৃষ্ণ-রাধাও না, আল্লা-রসুল-খোদাও না! পাখি কইতেছে- পেয়াজ-রসুন-আদা! গরীব মানষের কথা কয়। খেয়াল কৈরা শোনো!!
হরষিত ও রমজান একেবারে চুপ হয়ে গেলো। আরে মোকসেদ কয় কি?? মোকসেদ.... কি কয়! পাখি নাকি কয়... পেয়াজ-রসুন-আদা!!
এদিকে এতক্ষণের ঝগড়া আর মারামারির হাওয়া গ্রামে গিয়েও ঠেকেছে। একে একে লোক আসতে আসতে এখন একেবারে ভিড় জমে গিয়েছে বটতলায়। সবাই জানতে চাচ্ছে, ব্যাপার কি? কিন্তু ব্রাহ্মণ আর ঈমামের দিকে তাকিয়ে সহজেই বুঝে যাচ্ছে... হাতাহাতি ভালই হয়েছে। ব্রাহ্মণের গায়ের নামাবলী যেমন ধুলায় গড়াচ্ছে তেমনি ঈমামের টুপিও। আর পরণের অন্য পোশাকের অবস্থাও যথেষ্ট খারাপ।
বিপিন মাতবরও হাটতে হাটতে চলে এসেছে বটতলায়। অনেকে তাকে সামনে যাওয়ার জায়গা করে দিলো। দাদায় গ্রামে মাতবরী করতো, বাবাও মরার আগপর্যন্ত মাতবরী-সর্দারী করেছে আর বিপিনও এখন পর্যন্ত মাতবরীই করে। তবে অন্যান্য গ্রামের শালিস বিচারে তেমন যায় না সে। নিজের গ্রামের সমস্যাই দেখাশোনা করে। বটতলা নিজের গ্রামের আওতায় পড়ে বিধায় পুরো সমস্যা সমাধানের দায়ভার বিপিন মাতবর স্বদায়িত্বে নিজের কাঁধেই তুলে নিলেন।
খুব ভদ্রভাবে হরষিত এবং রমজানকে বেঞ্চিতে বসতে বললেন বিপিন মাতবর। তারপর ঘটনার আদ্যপান্ত শুনলেন। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে চিন্তাও করলেন।
ভিড় ক্রমান্বয়েই বাড়ছে। পাশের গ্রামেও খবর চলে গিয়েছে। না জেনেই অনেকে অনেকভাবে ব্যাখ্যা করছে ঘটনার। আর শোনা মাত্র বটতলার দিকে ছুট দিচ্ছে মানুষ।
পাখিটা ততক্ষণে তালগাছ থেকে অন্য কোথাও চলে গিয়েছে। এত লোকের সমাগম দেখে হয়তো ভয়ই পেয়েছে সে।
বিপিন মাতবর নিজের মতো করে একটা সমাধান দিতে চাইলেন। সবাইকে চুপ করতে বলে নিজের কথা শুরু করলেন... আচ্ছা বিষয়টা তোমরা দু’জন খুব সাধারণ ভাবেই নাও। ও তো পাখি! কি ভাবে ডাকলো, কি বলে ডাকলো সেটা নিয়ে মারামারি করা ঠিক না। পাখি তো পাখির মতোই ডেকেছে। সে শ্রী-কৃষ্ণ-রাধা বললেই কি! আর আল্লা-রসুল-খোদা বল্লেই কি! বা ওই মোকসেদের পিয়াজ-রসুন-আদা বল্লেই বা কি! তোমরা দুইজন তো বন্ধুই ছিলা। দুইজনই ধর্মের কাজ করো। দুইজনে কোলাকুলি করে সবার মাঝে মিলে যাও, ব্যাস! হয়ে গেলো।
হরষিত গজগজিয়ে উঠলো... রমজান যদি মেনে নেয় পাখিটা কৃষ্ণ নাম জপছিলো... আমি ওর সাথে মিলতে রাজি। তা না হলে... আমি... আমি ব্রাহ্মণ! হিন্দু ধর্মের এধরনের অবমাননা....ধর্মের নামে এরকম ধোঁকাবাজী আমি সহ্য করবো না।
রমজান আলীরও মেজাজ চড়ে গেলো আবার... না, আমি নিজের কানেই শুনেছি, পাখিটা আল্লার নাম করছিলো। আপনি হিন্দু মাতবর হয়ে ব্রাহ্মণের দিকে টানবেন তা হবে না। আমি আল্লা-রসুল বিরোধী কোন কথাই মানবো না।
বিপিন মাতবর জীবনে বহু সালিসে নানান মসস্যা ফেস করেছে, সমাধানও বের করেছে নিজের মতো করে। কিন্তু এ রকম ধর্মীয় সমস্যা তার কাছে একেবারেই নতুন। হরষিতের দিকে টেনেও সে কিছু বলতে পারছে না। কারণ তাহলে মুসলমানরা পরে যদি জোট বেঁধে আসে.. তখন! আবার রমজানের পক্ষ নিয়েও কিছু বলা যাচ্ছে না। রাধা-কৃষ্ণকে নিয়ে টানাটানি! এ তো ভাল কাজ নয়! খুবই চিন্তায় পড়ে গেলো বিপিন মাতবর।
এদিকে লোক সমাগম ক্রমান্বয়েই বাড়ছে। শত শত লোক এসে রৌদ্রের মধ্যেও দাঁড়িয়ে যাচ্ছে মাঠে। মাঠের পশ্চিম পাশের স্কুল ঘরে বসেও অনেক গ্রামবাসী বিশেষ করে মহিলা ও বৃদ্ধরা অপেক্ষা করছে বিপিন মাতবরের রায় শোনার।
হ্যা! বিপিন মাতবর এতক্ষণে একটা সমাধানের পথ বের করতে পারলেন বোধহয়। অন্তত যাতে কোন ধর্মের অবমাননা না হয়, সেদিকটা তার মাথায় সব সময়েই কাজ করছে। উঠে দাঁড়ালেন বিপিন মাতবর। সবাইকে চুপ করতে বললেন! একটু গলা খাকানি দিয়ে পরিস্কার করে নিলেন গলাটা। তারপর নিজের রায় ঘোষণা শুরু করলেন.... আমি মনে করি বিষয়টা এখন খুবই জটিল জায়গায় চলে গিয়েছে! ধর্ম বলে কথা। তাই আমি মনে করছি হরষিত আর রমজানেরই প্রমাণ করতে হবে কে সঠিক! ঐ যে তালগাছটা! যেটায় ওই পাখিটা বসে ডাকছিলো! ওই তালগাছেই উঠতে হবে, হরষিত ও রমজানকে। তাল গাছের মাথা থেকে লাফ দিয়ে পড়তে হবে- প্রমাণ করতে হবে নিজের বিশ্বাস ও কানে শোনা পাখির ডাক সত্য। মোকসেদ ব্যাপারীও তার দাবী প্রমাণ করতে চাইলে হরষিত ও রমজানের মতো তাকেও তাল গাছ থেকে লাফ দিতে হবে। কি হরষিত তুমি রাজি??
হরষিত একেবারে লাফ দিয়ে উঠলো... রাজি মানে... অবশ্যই রাজি! হিন্দু ধর্ম যে সত্য! ওই পাখি যে কৃষ্ণ নাম করছিলো! তা আমি প্রমাণ করেই ছাড়বো। কৃষ্ণের আশির্বাদ থাকলে..... ওই তাল গাছ কেন....
রমজান আলীও সোজা হয়ে দাঁড়ালো। আশে-পাশে তাকিয়ে দেখলো.. হ্যা! তার পরিচিত অনেক মুসলমান তার মুখের দিকে তাঁকিয়ে আছে। জেদ এসে গেলো রমজানের মনেও!
দৃঢ চিত্তে রমজান বললো.. হ্য! আমিও রাজি! আল্লা পাকের দোয়ায় আমার কথাই সত্যি হবে! উপস্থিত মুসলমানরা ঈমাম সাব- ঈমাম সাব বলে সবাই হাতে তালি দিয়ে উঠলো।
বিপিন মাতবর এবার মোকসেদ ব্যাপারীকে জিজ্ঞাসা করলো- তুমি কি তোমার দাবী ঠিক মনে করো মোকসেদ?
মোকসেদও বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠলো! বললো- হ্য! আমার দাবী আমি ঠিক মনে করি! পাখিটা আমার কথাই বলছিলো- পিয়াজ-রসুন-আদা! তবে আমি তাল গাছ থেকে লাফানোর মধ্যে নাই। তাতে আমার কথা কেউ বিশ্বাস করুক আর না করুক। অনেক কষ্ট করে পয়সা রোজগার করি। আমার সংসারে আমিই একমাত্র রোজগারকারী। ওরা দু’জন পরের বাড়ী ভাল ভাল খায় তাও আবার মাগনা। ওগো শরীরে তেজ বেশি। ওরা লাফ দিক!
অনেকেই মোকসেদ ব্যাপারীর কথায় যুক্তি খুঁজে পেলো! কেউ কেউ বললো- আরে ব্যাপারী তো আর কোন ধর্ম নিয়ে কথা কইতেছে না! ও তো কইতেছে ওর কাম নিয়ে। ওর লাফানোর দরকার নাই।
বিপিন মাতবর আবার হাক ছাড়লো- কি! আপনারা উপস্থিত সবাই কি কন? আমার বিচারে আপনাদের মত আছে তো?? সমবেত জনতা যেন কলকল করে উঠলো.. হ! হ! ঠিক বিচার! ঠিক বিচার! ওরা কেমন ব্রাহ্মণ আর কেমন ঈমাম সেটারও প্রমাণ হবে।
বিপিন মাতবরের রায়ের সাথে সাথে আর একটি ঘটনাও ঘটে গেলো! উপস্থিত অনেক মানুষই উর্ধ্বশ্বাঃসে ছুট দিলো গ্রামের দিকে। কেউ কেউ সাইকেলে উঠেই মিলিয়ে গেলো অন্য গ্রামে। আশে পাশের গ্রামগুলোতে মুসলমান জনবসতি বেশি থাকলেও হিন্দু-মুসলমান সামাজিক সম্প্রীতি বজায় রেখেই এই এলাকায় বসবাস করছে পুরুষাণুক্রমে। ধর্মীয় বা সামাজিক কোন সমস্যা দেখা দিলেও নিজেরা আবার মিটমাট করে নেয়। কিন্তু আজকের সমস্যা সম্পূর্ণ অন্যরকম। তাই স্কুলমাঠে হিন্দু-মুসলমানরা যে যার ধর্মের লোকসমাগম ঘটাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
(চলবে......)