মাঠের কোনায় একটা তাল গাছ। বেশ উঁচু। মাঠের পূর্ব পাশে খাল আর পশ্চিম পাশে গ্রামের একমাত্র প্রাইমারী স্কুল। খালের পাড় ঘেষে মাঠ ছুয়ে পায়ে চলা মেঠো পথ ঢুকেছে গ্রামে। মাঠের পর একটু ফাকা জায়গা পেরিয়েই গ্রামের শুরু।পথের পাশে একটা বটগাছ পথ এবং মাঠের কিছুটা অংশ ছায়া করে রেখেছে।গ্রামের ছেলেরা কাঠ দিয়ে একটা বেঞ্চি বসিয়েছে বটগাছের ছায়ায়, যাতে ভরদুপুরের রৌদ্রেও সেখানে বসে খোসগল্প করা যায়।
পাশের গ্রামের হরষিত ব্রাহ্মণ যাচ্ছিলেন পূজা পড়ানোর কাজে।গরমের মধ্যে হাটতে হাটতে বটগাছের ছায়ায় বেঞ্চিতে বসে একটু জিড়িয়ে নেয়ার লোভ সামলাতে পারলেন না তিনি। আহ! কি দক্ষিণা বাতাস! সব বাতাস যেন এই বটগাছের নিচেয়! বেঞ্চিতে বসেই পকেট থেকে বের করলেন জপমালার গেরুয়া রংয়ের ছোট কাপড়ের থলেটি। এক মনে মালা জপ শুরু করলেন হরষিত ব্রাহ্মণ।
হঠাৎ একটা পাখির ডাক থামিয়ে দিলো হরষিতকে। আরে পাখিটা তো ঠিক তার মতোই কৃষ্ণনাম জপছে বলে মনে হচ্ছে! খুব খেয়াল করে আবার শোনার চেষ্টা করলো সে! হ্যা ! ঐ তো! ঐ মাঠের কোনার তাল গাছটাতেই ডাকছে পাখিটি। আ-হা! পাখিটি একেবারেই স্পষ্ট বলছে! শ্রী-কৃষ্ণ-রাধা! একেবারে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। শ্রী-কৃষ্ণ-রাধা! বিরামহীন ভাবে ডাকছে পাখিটি। শ্রী-কৃষ্ণ-রাধা! আ-হা! আর কি মধুর কন্ঠ। জপমালার থলির ভিতরে কখন যে হরষিতের হাতটা থেমে গেছে সে বুঝতেও পারেনি। কৃষ্ণ প্রেমে মহিত হয়ে পাখির ডাক শুনছে হরষিত ভট্টাচার্য আর মনে মনে বলছে- তোমার লীলা বোঝা দায় হে দয়াল! তোমার লীলা বোঝা দায়....
রহমতপুর মসজিদের ঈমাম সাহেব যাচ্ছিলেন পথ দিয়ে।বটগাছের ছায়ায় বেঞ্চির উপরে বসা হরষিত ব্রাহ্মণের দিকে নজর গেলো ঈমাম সাহেবের। গলা ঝেড়ে কথা বললেন- আরে হরষিত যে! হরষিত ঈমামের ক্লাসমেট ছিলো কিছুদিন। হঠাত করে রমজান আলী মাদ্রাসায় পড়তে চলে গেলেও সেই অল্প দিনের বন্ধুত্বটা এখনও রয়ে গেছে।তাই বন্ধুত্বের সুরে আবারো বললো- কি রে হরষিত, কথা বলছিস না যে?
হরষিত রমজানের হঠাৎ আগমনে কিছুটা বিব্রত হলেও কথা বললো হাসি মুখেই। একটু ঘোরের মধ্যে ছিলাম। তুই তো এগুলো বুঝবি না! হিন্দু হলে হয়তো বুঝতিস।
কি ব্যাপার তুই কিসের কথা বলছিস? কথার ভাব না বুঝতে পেরে বললো রমজান।
একটু খেয়াল করে শোন! ঐ যে তালগাছে যে পাখিটা ডাকছে। আমি এখানে বসে কৃষ্ণ নাম জপা শুরু করতেই পাখিটা আমার সাথে সাথে ডাকা শুরু করলো। আ-হা! কি স্পষ্ট! শ্রী-কৃষ্ণ-রাধা! কি মধুর নাম! এসব তোর গরু খাওয়া মাথায় ঢুকবে না রমজান! মাথা নাড়তে নাড়তে একটু গর্বের সাথেই বললো হরষিত।
রমজান আলী মুসলমান ঠিকই। রহমতপুর মসজিদে ঈমামতীও করছে বেশ কয়েক বছর ধরে। কিন্তু পাশের গ্রামের হিন্দুদের সাথে তার কোন বিরোধ নেই। বরং হরষিতের মতো অসংখ্য হিন্দু ক্লাসমেটের সাথে এখনও তার বেশ ভাব আছে। কিন্তু হরষিতের কথার ভঙ্গি এবং ধর্মীয় দাবী কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না রমজান। সে মনোযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করলো, আসলে পাখিটা বলছে কি! না! এ পাখি তো কৃষ্ণ নাম করছে না! এ তো নির্ঘাত আল্লার নাম করছে।
একটু জোর দিয়েই বললো রমজান- ঐ ব্যাটা হরষিত? ভাল করে শোন! ঐ পাখিটা বলছে কি! আমি তো স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি পাখিটা বলছে ‘আল্লা-রসুল-খোদা’! ঐ... ঐ যে শোন! আল্লা...... রসুল......... খোদা! একেবারেই মানষের মতো বলছে। মুসলমানদের মতো! হায় আল্লা, মাবুদ...! তুমি শেষ পর্যন্ত পাখিরে দিয়েও তোমার নাম লওয়াইতেছো!
এদিকে রমজানের কথাবর্তাতে হরষিতের মেজাজ বেশ খারাপই হচ্ছিল! দাঁড়িওয়লাটায় কয় কি? শালায় কালা নাকি? বেশ রুক্ষ মেজাজেই বললো হরষিত- হ্য! পাখির আর খাইয়া কাম নাই... আল্লার নাম নিবো! তাইলে তো তোরে দেখেই তারপর ও ডাক শুরু করতো। আবার একটু মুরব্বিয়ানা ভঙ্গিতে বললো, আমারে দেখে ও নিশ্চয়ই বুঝতে পারে... আর আমি আমার জপমালায় হাত দিয়ে যেই নামজপ শুরু করেছি সাথে সাথে পাখিটাও কৃষ্ণ নামে মধুর ডাক শুরু করেছে। তোর মতো কালা তো উল্টাই শুনবে। কথাগুলো বলে একটু হাসারও চেষ্টা করলো হরষিত। কিন্তু হাসিটা তেমন ফুটলো না, শুধু ঠোটের কোনে এক ঝলক বিদ্রুপের হাসি ফুটে উঠলো।
হরষিতের বিদ্রুপের হাসি দেখে রমজান আলীর মাথায় যেন রক্ত উঠে গেলো। বেশ গলা চড়িয়েই বললো- তোর মতো গাধাই ওই কেষ্ট নাম জপে, পাখিটা বলছে আল্লার নাম! আল্লার নাম! তুই কানে কালা............ আল্লার বিরুদ্ধে কথা বলিস...... বিধর্মী কোথাকার..... তুই কোন বন্ধুই না.......!
তর্কের সুর ক্রামান্বয়েই চড়তে থাকে দু’জনেরেই। তর্কাতর্কীর এক পর্যায়ে প্রথমে ধাক্কা-ধাক্কি পরে হাতা-হাতি শুরু হয়ে গেলো। একে অন্যকে হাত-পা ছুড়ে আঘাত করার চেষ্টা করছে। গালি দিচ্ছে দুজনই। বাপ-মা তুলতেও ছাড়ছে না।
ঘটনা লক্ষ্য করে একটু জোরেই পা চালালো মোকসেদ ব্যাপারী। ছোট ব্যবসা তার। শহর থেকে নানান জিনিস কিনে গ্রামে বিক্রি করেই তার সংসার চলে। সারা দিন ঝাঁকা মাথায় নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরলেও ঈমাম আর ব্রাহ্মণের হাতাহাতির মতো আজব কান্ড সে দ্যাখেনি কখনও। কাছে এসেই দ্রুত ঝাঁকাটা নামালো মোকসেদ। মাথায় পাগড়ী করা গামছাটা এক টান দিয়ে খুলে মাজায় বেঁধে নিলো সে। তারপর একেবারে সোজা গিয়ে দুই হাত দিয়ে দু’জনকে দুইদিকে এক ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। খেটে খাওয়া দিনমজুরের শক্ত হাতের এক ধাক্কাতেই ব্রাহ্মণ-ঈমাম দুজনই বুঝে গেলো- না! মারামারিতে জড়ানোটা ঠিক হয় নি। কিন্তু রাগ তখনও আছে। একে অন্যের দিকে দাঁড়িয়ে ফুসছে! নিঃশ্বাসের ওঠানামা দুর থেকেই শোনা যাচ্ছে।
মোকসেদ ব্যাপারী বেশ খেকিয়ে উঠলো। পূজাও পড়ান আপনারা আবার নামাজও পড়ান! কিন্তু পথের মাঝে মারামারি! এটা কি? আমরা না হয় মুখ্যু মানুষ? কিন্তু আপনারা তো শিক্ষিত??
হরষিত ব্রাহ্মণ ফুঁসতে ফুসতেই বলে ওঠে- আল্লার নাম? বলে নাকি আল্লার নাম বলছে পাখি? ওই তো তুইই শোন মোকসেদ। তুইও তো মুসলমান! বল দেখি পাখিটা কি বলছে? নিশ্চয়ই তোর শুনতে কষ্ট হচ্ছে না যে ও বলছে শ্রী-কৃষ্ণ-রাধা।
না! একদম না! ও বলছে আল্লা-রসুল-খোদা। হরষিতের মুখের কথা কেড়ে নিয়েই বললো রমজান। মুসলমান হিসাবে মোকসেদ তুই কিন্ত সত্যি কথা বলবি। পাখি বলছে আল্লার কথা আর হিন্দুটায় কয় কি!আল্লার কিরা মোকসেদ, সত্যি কথা কবি!
পাখিটা তখনও সমানে ডেকে যাচ্ছে। মোকসেদ ব্যাপারী এতক্ষণে মারামারির কারণটা বুঝতে পেরেছে। ধমক দিয়ে দু’জনকেই থামিয়ে দিয়ে শোনার চেষ্টা করলো পাখির কন্ঠস্বর। না! পাখিতো ওদের কথা বলছে না! পাখি তো তার কথাই বলছে। সারাদিন মোকসেদ ব্যাপারী গ্রামে গ্রামে হাক ছাড়ে- পিয়াজ-রসুন-আদা...?? পাখিটা তো ঠিক তার কথাই বলছে। হ্যা! তার মতোই বার বার বলছে- পিয়াজ-রসুন-আদা.... পিয়াজ-রসুন-আদা...... পিয়াজ...
ধমক দিয়ে উঠলো মোকসেদ ব্যাপারী। হরষিত এবং রমজান তখনও হাপাচ্ছে। ওই মিয়া-মশায় আপনাগো দু’জনেরই কানে সমস্যা আছে না কি?? মানষের বাড়ীতে গিয়ে ভালডা খাইতে তো ছাড়ো না, তাও আবার ফাউ। তারপরও কানে সমস্যা??
(চলবে.....)
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে আগস্ট, ২০১৩ দুপুর ১:২৩