নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই দিনই আমি দোকানে গিয়ে হাজির হতাম । আমার বরাবরই চকবার খাওয়ার অভ্যাস । শীত কিংবা গরম বলে কোন কথা নেই । এই দোকান থেকেই কিনতাম ।
এই দোকানটার কথা ভাল করে মনে রাখার কারণ হচ্ছে এই দোকানের যে মালিক। আমার থেকে বয়সে কয়েক বছর বড় হবে সম্ভবত । দেখতে শুনতে বেশ চমৎকার ছিল সে। উচু লম্বা সুস্থ্যের অধিকারী । তবে তার থেকে চমৎকার ছিল তার মুখের ভাষা আর ব্যবহার । ঢাকা শহরে আমি যতদিন আছি খুব কম মানুষকেই তার মত শুদ্ধ ভাবে কথা বলতে শুনেছি । আর তার ব্যবহারও চমৎকার । মোলায়েম । শান্ত ধীর !
রোজার ভেতরে একদিন গেছি নাইমদের বাসায় । রোজায় তো দোকান থেকে আইসক্রিম কেনার দরকার পরত না । তাই যাওয়া হত না । সেদিন নাইমের কাছ থেকে শুনলাম কথাটা । সামনের দোকানের লোকটা মারা গেছে । আমি প্রথমে ঠিক বুঝতে পারি নি । ঐ দোকানের ঐ লোকটা ছাড়াও আরেক বৃদ্ধ বসতেন । আমার প্রথম ধারণাই হল যে ঐ বৃদ্ধ বুঝি মারা গেছেন । কিন্তু পরের কয়েকদিন পরে আমি ঐ বৃদ্ধকে দোকানের সামনে বসে থাকতে দেখলাম । খানিকটা অবাকই হলাম । নাইম তো মৃত্যু নিয়ে মিথ্যা কথা বলার ছেলে না । তখনই মাথার ভেতরে একটা সম্ভবনা দেখা দিল । নাইমের কাছে যখন আবার জানতে চাইলাম তখন সে আমাকে আরো ভাল করে জানালো যে মারা গেছেন ঐ বৃদ্ধ না, ঐ সুন্দর মানুষটি !
সত্যি বলতে কি একটা ধাক্কার মত খেলাম ! লোকটা আমার কাছের মানুষ না । এমন কি তার নাম পর্যন্ত আমি জানি না । অথচ এই মানুষটির মৃত্যু আমার মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে । কী অদ্ভুত !
নাইমের কাছ থেকেই শুনেছিলাম যে ভদ্রলোক সুস্থ স্বাভাবিক ছিলেন । সেদিন নাকি তার উত্তরা যাওয়ার কথা ছিল কোন এক অনুষ্ঠানে। যাওয়ার আগেই নাকি স্ট্রোক করে মারা যান । তার একটা ছোট মেয়ে রয়েছে ।
পরের কয়েকদিন ধরে দেখলাম দোকানটা বন্ধ । বন্ধ দোকান যখন খুলল তখন সেখান থেকে কেবল জিনিসপত্র সরিয়ে নিয়ে যেতে দেখলাম । রোজার পরে গেলাম সেই দোকানে । আইনক্রিম কিনতে । সেদিন সেই বৃদ্ধ ছিলেন । জানালেন যে আইসক্রিম নেই । আগে দুইটা ফ্রিজ ছিল দোকানে । দেখলাম একটাও নেই । বেশির ভাগ সেলফই খালি । দোকান ছেড়ে দিচ্ছে । তারপর কয়েকদিন বন্ধ রইল ।
গতকালকে দেখতে পেলাম যেই দোকানে নতুন কেউ উঠেছে । সেই সাইনবোর্ডের উপরে নতুন আরেকটা সাইনবোর্ড ! একটা বেকারির দোকান বসেছে এখানে । বেশ ভিড় দেখা যাচ্ছে । আমিও হয়তো যাবো কেক বা বিস্কুট কিনতে !
আচ্ছা ঐ লোকটার কথা কি মনে থাকবে?
হাস্যোজ্জ্বল চেহারার শুদ্ধ উচ্চারণের লোকটাকে হয়তো ভুলে যাবো আমি । আশের অন্য সবার মতই !
মাত্র কদিনের ভেতরে এই দোকানের স্থানে নতুন আরেকটা দোকান চালু হয়ে গেল । কদিন পরে এমন মনে হবে যে সেই লোকটা যে এখানে ছিল সেটা মনেই থাকবে না কারো ! জীবন আসলে এমনই । কেউ কারো জন্য বসে থাকে না । কারো জন্য কিছু আটকে থাকে না ।
একদিন আমি নিজেও মরে যাবো । আমার কাছের মানুষ গুলো হয়তো কিছুদিন শোক করবে তারপর তারাও নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়বে । এটাই আসলে জীবন !
Image by G.C. from Pixabay
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১১:৫৬