ফোনটা অনেক সময় ধরে বেজেই চলেছে । এই যুগে অফিস আদালত ছাড়া ল্যান্ড ফোনে মানুষ খুব একটা ফোন দেয় না । আমি ফোনটার দিকে তাকিয়ে একটু ইতস্ততঃ করতে লাগলাম । আমার এগিয়ে গিয়ে ফোনটা ধরা উচিৎ হবে না । মিমির কাছে জানতে চাইবো কি না ভাবছি এমন সময় মিমি রান্না ঘর থেকেই চিৎকারে বলে উঠলো
-ফোনটা ধর তো একটু !
আসলে এভাবে মিমির বাসায় এসে হাজির হওয়াটা আমার নিজের কাছে অন্য রকম লাগছে । কিন্তু মিমি যখন ওর বাসার আসার আমন্ত্রন জানালো তখন কোন ভাবেই মানা করতে পারলাম না । বিশেষ করে মিমি যখন বলল যে ও আজকে আমার জন্য রান্না করবে । আমি নাকি মেস বাসাতে কি না কি খাই । মাঝে মাঝে আমাকে খাওয়াতে পারলে ওর ভাল লাগবে তখন আমি আর মানা করতে পারি নি । যে কারনে অস্বস্তি লাগছিলো সেটা হল মিমি এই বড় বাড়িতে একদম একা থাকে ।
মোহাম্মাদপুরের বসিলার কাছে এই এলাকাটা দেখলে মনেই হয় না যে এটা ঢাকার ভেতরে । একেবারে আমাদের মফস্বলের শহরের মত । মিমি এই জায়গাতই একটা দোতলা বাসাতে থাকে । একদম একা । বাড়িটা চারিদিকে দেওয়াল দেওয়া । ভেতরে বেশ গাছ গাছালিতে ভর্তি । আমার বাসাটা খুব বেশি পছন্দ হয়ে গেল ।
এই ঢাকা শহরের মিমির মত মেয়ে একা একা এমন একটা বাসাতে থাকে, এটা শোনার পরে আমার কাছে একটু অবাকই লেগেছে । এমনটা খুব একটা হয় না সাধারনত । আমি আগে একবার জানতে চেয়েছিলাম ওর যে ওর বাবা মা কোথায় থাকে । মিমি সেই প্রশ্নের কোন জবাব দেয় নি । বরং এড়িয়ে গেছে । আমার কাছে মনে হয়েছে ও প্রশ্নের উত্তর দিতে চায় না । নিশ্চয়ই কোন ঘটনা আছে এই পেছনে । কোন অস্বস্থিকর ঘটনা । তাই আমি আর জানতে চাই নি ।
আজকে যখন ও বলল যে ওর বাসায় আমার দাওয়াত তখন আমার একটু অস্বস্থি লেগেছিল তবে না করতে পারি নি । মেয়েটা এমনিতেই আমার সাথে খুব মেশে । ক্লাস শুরুর পর থেকেই আমার সাথেই দেখি কথা বার্তা বলে বেশ ।
আমি উঠে গিয়ে ল্যান্ড ফোনের রিসিভারটা তুলে ধরলাম ।
-হ্যালো
ফোনের ওপাশ থেকে একটা হিসহিস আওয়াজ এল । মনে হল যেন ওপাশে খুব বাতাস কিংবা ঝড় হচ্ছে । আমি আবার বললাম
-হ্যালো !
বাতাসের আওয়াজ ছাড়া আর কোন আওয়াজ নেই । আমি অনেক টা সময় ফোনের রিসিভারটা কানে লাগিয়ে রইলাম । তারপর আওয়াজটা শুনতে পেলাম । যেন কেউ খুব দুর থেকে কোন কথা বলছে । কন্ঠটা বলল
-আমি মিমির বাবা বলছি । শুনছো ?
আমি কি বলব খুজে পেলাম না । আমি আজকে মিমির বাসায় এলাম আর এসেই মিমির বাবার ফোন । কি বলব প্রথমে বুঝতে পারলাম না । আমি সালাম দিলাম । কিন্তু কোন জবাব পাওয়া গেল না । ওপাশের ঝড়টা যেন আরও বেড়েই চলেছে । তারপর আবারও আওয়াজ শুনতে পেলাম ।
-খেও না । কিছু খেও না ।
-কি বলছেন ? আমি ঠিক শুনতে পাচ্ছি না । আমি কি মিমিকে ডেকে দিবো ?
আবারও সেই একই কথা ।
-খেও না । কিছু খেও না ।
আওয়াজটা যেন দুরে চলে যাচ্ছে । আবারও সেই ঝড়ের আওয়াজটা বাড়তে লাগলো । তারপর আস্তে আস্তে সেটা কমে এল । আমি আরও কিছুটা সময় ফোনটা কানে কানে লাগিয়ে বসে রইলাম । একটা সময় ফোনটা রেখে দিলাম ।
মিমি ততক্ষনে টেবিলে খাবার সাজাতে শুরু করেছে । আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-কে ফোন করেছিলো ? বাবা ?
-হ্যা । তাই তো বলল । কিন্তু কি সব বলল যেন । বুঝতে পারলাম না । মনে হচ্ছে উনি যেখানে আছেন সেখানে কোন প্রকৃতিক দুর্যোগ হচ্ছে । কিন্তু এই সময়ে কোথায় ঝড় হয় বুঝলাম না । তোমার বাবা কি দেশে নেই ? বাইরে থাকে ?
মিমি আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে হাসলো । তারপর বলল
-এসো খেতে বসো ।
আমি টেবিলের সামনে এসে দাড়ালাম । দেখি টেবিল ভর্তি নানা পদের খাবার । এই মেয়েটা আমার জন্য এতো কিছু করেছে ভাবতেই অবাক লাগছে । মিমি যে আমাকে পছন্দ করে সেটা আমি আগে থেকেই জানি । আমি নিজেও ওকে খুব পছন্দ করি । আজকে ওকে মনের কথাটা বলে দেওয়া যাবে !
টেবিলে বসে মিমিই আমাকে সব কিছু এগিয়ে দিতে লাগলো । সত্যি বলতে কি এতো স্বাধের খাবার আমি অনেক দিন খাই নি । ঢাকাতে আসার পর থেকে হোটেল আর বুয়ার রান্না খেতে খেতে পেটে পাথর পড়ে গেছে । সেখানে আজকে আজকে এতো ভাল খাবার ! আমি পেট ভরে খেলাম । মিমি অবশ্য কিছুই খেল না । কেবল আমাকে এগিয়ে দিতে লাগলো । বলল যে ও আমার খাওয়া দেখছে । আমার খাওয়া দেখার মাঝেই ওর শান্তি !
খাওয়া শেষ করে মিমি একটা মাংসের বাটি এগিয়ে দিল । বলল
-এটা খাও দেখি ।
বাটি থেকে একটু মুখে দিলাম । স্বাধটা যেন একটু মিষ্টি মিষ্টি লাগলো । মিমি আমার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে । আমি বললাম
-এটা কিসের মাংস বলতো ? কলিজা তাই না ? কিন্তু কিসের ?
মিমি বলল
-খেতে কেমন লাগছে ?
-একটু মিষ্টি মিষ্টি তবে মজার । এর আগে কোন দিন খাই নি ।
-খাবেও না জানতাম । বলতো এটা কি ?
-বলতে পারছি না । বল কিসের মাংস !
মিমি আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-এটা আমার রাফার কলিজা !
আমি খানিকটা চমকে উঠলাম । রাফা মানে ? কোন রাফা ! আমি কোন মতে বললাম
-রাফা মানে ? কোন প্রাণী ?
আমি যেন খুব মজার কথা বলেছি । মিমি হেসে উঠলো খুব জোরে । তারপর বলল
-রাফা হচ্ছে আমার আগের বয়ফ্রেন্ড । সেও তোমার মত আমার প্রেমে পাগল ছিল । তাকেও এভাবে এই বাড়িতে ডেকে নিয়ে এসেছিলাম । তুমি যেখানে বসে আছো ঠিক এক মাস আগে রাফাও এখানে বসে খাবার খাচ্ছিলো ।
-তুমি ইয়ার্কি মারছো আমার সাথে ?
তখনই আমি মিমির চোখের দিকে তাকালাম । ওর চোখের মোলায়েম ভাবটা কেটে গেছে । সেটা যেন জ্বলছে । আমার বুকের ভেতরে কেমন কেঁপে উঠলো । আমার বুঝতে কষ্ট হল না যে মিমি যা বলছে তা সত্যি । আমাকে একটু আগে ও কোন মানুষের কলিজা খাইয়েছে । আমি উঠে পড়তে চাইলাম তখনই আমার মাথার ভেতরটা চক্কর দিয়ে উঠলো । আমি শরীরে একদম বল পেলাম না । মিমি আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-নাহ ! সোনা পাখি এই কাজটা তুমি করতে পারবে না । তোমার খাবারে কড়া ঔষধ মিশিয়ে দিয়েছি । তুমি খুব বেশি সময় বেঁচে থাকবে না আর । ঘুমের মধ্যেই তোমার মৃত্যু হবে । যন্ত্রনাহীন মৃত্যু । বুঝেছো ।
আমি কোন মতে বললাম
-ক্যাক-কেন ?
-তুমি বেঁচে থাকার জন্য কি কর ? খাওয়া দাওয়া কর, আমি তো তাই । আমার মানুষ ছাড়া চলে না । তাই তো এই ব্যবস্থা । নাথিং পারসোনাল । তুমি কিছু মনে কর না । তবে তোমাকে কিন্তু বাবা সাবধান করেছিল কিছু না খেতে । তবুও তুমি খেলে । আসলে বাবাকে মেরে ফেলার পর থেকে আমি যাকেই ধরে নিয়ে আসি না কেন বাবা তাদেরকে ফোন করে সাবধান করার চেষ্টা করে । আমি প্রথমে একটু অবাক হতাম, একট ভয়ও পেতাম পরে এটা একটা মজা হিসাবে নিয়েছি । যদি বাবা কথা শুনে তুমি না খেতে তাহলে তুমি বেঁচে যেতে । এখন যেহেতু খেয়েই ফেলেছো তাই আর কিছু করার নেই ।
আমার অবাক হওয়ার ক্ষমতা পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে । আমার কাছে কেবল মনে হচ্ছে যা দেখছি সব স্বপ্ন দেখছি । এসব সত্য হতে পারে না । আমি নিজের চোখ দুটো খোলা রাখতে পারছিলাম না । আমার পুরো হাট পা অবশ হয়ে আসছিলো । মিমির বাবা এই জন্যই বারবার বলছিলো খেও না কিন্তু আমি সেটা কানে নেই নি । ফল স্ব রূপ আমাকে এই পরিনতি মেনে নিতে হচ্ছে । চোখে পুরোপুরি অন্ধকার নেমে আসার আগে মুহুর্তে আমি মিমিকে দেখতে পেলাম । শান্ত আর ভয়ংকর চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে ! সে চোখে খুনের নেশা !
পরিশিষ্টঃ
মিমি মাটিতে পড়ে থাকা আদনানের দেহটার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুটা সময় । আগামী মাসখানের খোরাক আপাতত জমে গেছে । এখন নিশ্চিন্তে কিছুটা সময় পার করা যাবে । তারপর আবার নতুন কাউকে খুজে বের করতে হবে । ব্রিটিশ কাউন্সিলে গত সপ্তাহে ভর্তি হয়েছে ও । দুদিন ক্লাস করতে না করতেই রিফাত নামের একজনের সাথে পরিচয় হয়েছে । রিফাতের চোখের চাহনীর দেখেই মিমির বুঝতে কষ্ট হয় নি সামনে ওর শিকার কে হতে চলেছে !