-হ্যালো ! আমি ছদরুল বলছি !
-ছদরুল ? কোন ছদরুল ?
ওপাশ থেকে কিছুটা সময় নিরবতা ! আমি অপেক্ষা করতে থাকি । তার সাথে মনের ভিতর ছদরুল নামটা খুজতে থাকি ! এমন সময় ওপাশ থেকে আবার ভেসে আসে
-কে তানভীর না ?
-হ্যা তানভীর বলছি ! আপনি কে বলছেন ?
-আরে আমি ছদরুল ! আন্তর্জাতিক ছদরুল !
আন্তর্জাতিক ছদরুল নামটা কানে আসতেই স্মৃতির পাতায় একটা চেহারা জ্বলজ্বল করে উঠলো । চট করেই সব কিছু মনে পড়ে গেল ! আমি কিভাবে একে ভুলে গেলাম ঠিক বুঝলাম না । আর যাই হোক একে তো ভুলে যাওয়ার কথা না !
আমি অতিদ্রুত বললাম
-হ্যা বল ! ছদরুল ! তুই এতো দিন পরে ? কোথায় আছিস ?
-আরে, আমি তোর বাসা টা খুজে পাচ্ছি না ! ঠিক মত ঠিকানা টা বলতো দেখি ! বেটা রনি তোর ঠিকানা দিল কিন্তু একটা আন্তর্জাতিক মানের ঠিকানা দিতে পারলো না ! বেটা কোন কাজেরই না !
খাইছে ! এই পাবলিক এই খানে কি করে ? বলা নেই কওয়া নেই ছদরুল হঠাৎ আমার বাসায় এসে হাজির !! একবার মনে হল এখনই ফোন রেখে দিয়ে মোবাইল বন্ধ করে দেই । এতো বড় পেইন কিছুতেই সহ্য করা ঠিক হবে না । কিন্তু যেহেতু ঢাকায় চলে এসেছে তাই ফোন বন্ধ করেতে মন সায় দিল না । আমি ফোনে ওকে আমার বাসার ঠিকানা বলে দিলাম ।
ফোন রাখার পরে রনিকে চিবিয়ে খেতে মন চাইলো । বেটা তুই আর কারো ঠিকানা দিতে পারিস নাই । এই ঝামেলা আমার গলায় পড়িয়ে দিছিস !
দাড়া তোকে একবার সামনে পাই তোর খবর আছে ! কিন্তু আমি একবার শুনেছিলাম ওর নাকি কি এক মানষিক সমস্যা দেখা দিয়েছে । কোন হাসপাতালে আছে নাকি ।
তারপর পর কি খবর কে জানে !
ছদরুল আমার বন্ধু নাকি বন্ধু না এই কথা কোন ভাবেই নিশ্চিত ভাবে বলা যাবে না । ছোট বেলা থেকেই আমরা একই গ্রামে থাকি একই স্কুলে কলেজে পড়ালেখা করেছি । খেলাধুলাটাও একই মাঠে করেছি ।
বলতে গেলে অন্য সবার থেকেই আমার সাথে ওর যোগাযোগ হত বেশি । অন্য কেউ তো ওকে দুচোক্ষে দেখতে পারতো না । তার অবশ্য উপযুক্ত কারনও ছিল !
ছদরুলের আবার সব কিছুতে অতি নিরপেক্ষতার সাথে সাথে সেটার মান নিয়ে প্রশ্ন করার অভ্যাস আছে । ওর বাবা ছিল একজন উকিল ! উনিও প্রায়ই প্রায়ই কোন কেইসে হেরে গেলে সবাইকে বলে বেড়াতো এই কেইসে আন্তর্জাতিক মানদন্ড রক্ষা করা হয় নাই । কেউ নিরপেক্ষ ছিল না । বাবার স্বভাবও কি না পেয়েছে সব কিছুতেই ছদরুল আন্তর্জাতিক মান, নিরপেক্ষ বলার একটা অভ্যাস দাড়িয়ে গেছে ।
প্রথম প্রথম কেউ এটা গা না করলে বয়স বাড়ার সাথে সাথে ছদরুলের এই অভ্যাসটা দিনে দিনে বাড়তেই লাগলো ! কোন খেলায় হেরে গেলেই সে চিৎকার করে বলতো তার সাথে নিরপেক্ষতা বজায় রাখা হয় নাই । এই খেলা আন্তর্জাতিক মানের হয় নাই । খেলার আগে কোন কথা নেই । শুরু সময় সে ঠিকই চুপচাপ থাকে । কিন্তু হেরে যাওয়ার পরেই প্রতিদিনের প্যান প্যান শুরুখয় !
প্রতিদিন খেলার হারার পরে তার মুখ থেকে এইকথা শুনে শুনে পাড়ার ছেলেরা বেশ বিরক্ত হয়ে গেল । তাকে আর কেউ খেলায় নিতে চাইতো না !
এদিকে পরীক্ষার খাতায় কম নাম্বার পেলেই স্যারের সামনে চিৎকার করে বলতো স্যার তার খাতা নাকি নিরপেক্ষ ভাবে দেখেনি । খাতা দেখার মান আন্তর্জাতিক মানের হয় নি ! সব স্যার টুকটাক ধমক দিলেও আমাদের জহির স্যার ছিলেন খুব রাগি । তার সামনে এই কথা বলার পরে একদিন এমন মাইর দিলেন যে ছদরুল ঠিক সোজা হয়ে দাড়াতো পারলো না ! যখন স্কুল থেকে হেটে হেটে বাড়ি যাচ্ছিল পেছন থেকে ক্লাসের পুলাপাইন হাসতে হাসতে বলতে লাগলো
-কি রে ছদরুল মাইর খানা আন্তর্জাতিক মানের হইছে তো ?
আমরা ভেবেছিলাম এর পর থেকে মনে হয় ছদরুলের আন্তর্জাতিক মনভাবের কিছুটা সুমতি হবে কিন্তু আরও যেন বেড়ে গেল ! এর পর থেকে সব কিছুতেই আন্তর্জাতিক মান খুজতে লাগলো !
ত্যাক্ত বিরক্ত হয়ে তার বাবা তাকে কম বয়সেই বিয়ে করিয়ে দিল । ভেবেছিল নতুন বউ আসলে মনে হয় তার নিরপেক্ষতা, আন্তর্জাতিক মান এসবের ব্যাপারে ঝামেলা কমে যাবে ।
কিন্তু ঝামেলা বেঁধে গেল বিয়ের প্রথম দিনেই । মানে বাসর রাতেই । বাসর রাতে ছদরুলের বউ যখন ছদরুলের জন্য অপেক্ষা করছিল তখন ছদরুল দরজার সামনে দাড়িয়ে মনে মনে বিয়ের মান নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছিল । এক সময় সন্দেহ নিয়ে বাসর রাতে ঢুকলো ! বাসর রাতে বউ যখন ছদরুলে কাছে আসতে চাইলো ছদরুল তখন বিছানা ছেড়ে উঠে দাড়িয়ে বলল
-না না না !
নতুন বউ খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল
-কি ?
-এ হতে পারে না !
-কি হতে পারে না ?
-এই বিয়ে নিরপেক্ষ আর আন্তর্জাতিক মানের হয় নাই ! এই বিয়ে আমি মেনে নিতে পারি না !
নতুন বউ কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল
-তুমি এই সব কি বলছো ? আন্তর্জাতিক মান মানে ? নিরপেক্ষতা মানে কি ?
-আমি ওসব জানি না ! তবে আমার কাছে মনে হচ্ছে আন্তর্জাতিক মান দন্ড মেইনটেইণ করা হয় নাই ! আমি মানি না !
বউ আরও কিছুক্ষন বুঝানোর চেষ্টা করলো । কিন্তু ছদরুল কিছুতেই বুঝতে চাইলো না । শেষে বিরক্ত হয়ে ছদরুলের পিছনে লাথি মেরে ওকে ফেলে চলে গেল বাসর রাতেই !
আন্তর্জাতিক মান দন্ড নিয়ে ছদরুল একা একা নিজের বাসর রাত কাটালো । তারপর থেকে নাকি ছদরুলের মাথায় সমস্যা আরও বেড়ে যায় ।
তারপর আমি ঢাকায় চলে আসি পড়া লেখার জন্য । এক সময় পড়ালেখা শেষও হয়ে যায় ! চাকরীবাকরী ব্যস্ততার কারনে ছদরুলের খবর আর রাখা হয় নি । আজকে এতোদিন পরে ছদরুলের খবরা খবর পেয়ে পুরানো অনেক কথাই মনে পড়ে গেল !
আমি ছদরুলের আসার জন্য অপেক্ষা করতে থাকি । ঠিক এমন সময় আমার ফোনে আবার একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন এসে হাজির !
আমি হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে একজন বলে উঠলো
-তানভীর রহমান বলছেন ?
-জি । কে বলছেন ?
-দেখুন আমরা আলো দিশা মানষিক হাসপাতাল থেকে বলছি !
-জিু বলুন !
-আমাদের কাছ থেকে একজন মানষিক রোগী পালিয়েছে আজ সকালে ! তার রেখে যাওয়া কিছু কাগজ পত্র থেকে আপনার নাম্বার টা পেয়েছি !
আমি খানকিটা সঙ্কিত গলায় বললাম
-রোগীর নাম কি ?
-রোগীর নাম ছদরুল আহমেদ !
-আন্তর্জাতিক ছদরুল ?
-জি জি ! এই নামেই আমরা ওকে ডাকতাম । সব কিছুতেই আন্তর্জাতিক মান, নিরপেক্ষতা খুজে বেরায় ! আমরা সম্ভব সব জায়গায় সবার সাথে যোগাযোগ করেছি ! আপনার সাথে কি সে যোগাযোগ করেছে ?
আমি কি করবো কিছু সময় ঠিক বুঝতে পারলাম না । যডি বলি যোগাযোগ করেছে তাহলে নিশ্চই এরা এসে ছদরুল ধরে নিয়ে যাবে । পাগলা গারদে নিয়ে আন্তর্জাতিক মানের ট্রিটমেন্ট দিব ! কিন্তু যদি না বলি তাহলে বাইরের লোকজন কে জ্বালিয়ে মারবে । আন্তর্জাতিক মান দন্ড আর নিরপেক্ষতা নিয়ে বিচার করলে তো মনে হয় সত্য কথাই বলা উচিৎ ! আমি বললাম
-জি করেছিল !
-আপনি আপনি দয়া করে যে কোন ভাবে তাকে কিছুক্ষন আটকে রাখেন আমাদের আসা পর্যন্ত ! বেটা আমাদের বেশ ভুগিয়েছে । এবার কাছে পেয়ে নেই আন্তর্জাতিক মানের ইলেক্টিক শক না দিলে বেটা ঠিক হবে না ! আপনার বাসার ঠিকানা টা বলুন জলদি ! আমরা আসছি !
আমি বাসার ঠিকানা বলে অপেক্ষা করতে থাকি ! আজকে ছদরুলের জন্য আন্তর্জাতিক মানের ইলেক্ট্রিক শক অপেক্ষা করছে !
(আলিম আল রাজি ভাইয়ের আন্তর্জাতিক মানের বাসর রাতের গল্প থেকে এইটা লেখার উৎপত্তি)