সাজ্জাদ সাহেব আমার দিকে কিছুক্ষন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন । একবার হাতে ধরা কাগজটার দিকে আরেক বার আমার দিকে তাকালেন বার কয়েক ! তারপর বলল
-আপনি কি সিরিয়াস ?
-জি !
-কিন্তু কেন ?
একবার মনে হল বেটার কলার চেপে ধরে বলি বেটা বদের বদ ! আসল দোষ তোর ! তোরে তো তাড়াইতে পারতাছি না তাই নিজেই চলে যাচ্ছি !
কিন্তু চাইলেই তো সব কথা বলা যায় না ! আমি হাসি মুখে বললাম
-ভাল লাগছে না এখানে কাজ করতে !
-ভাল লাগছে না ! কোন সমস্যা হলে বলুন ! আমি দেখছি সেটা !
-না সেটা কোন সমস্যা না , কদিন ব্রেক নেব ভাবছি ! ব্যস্ততা থেকে দুরে !
-তা নিন ! কিন্তু চাকরী ছাড়ার দরকার কি ! এক মাসের ছুটি নিয়ে নিন ! আমি ছুটি দিয়ে দিচ্ছি !
-না । স্যার ! থ্যাঙ্কিউ !
আমি অফিস থেকে চলে যেতে পারলে বাঁচি কিন্তু সাজ্জাদ সাহেব আমাকে ছাড়বে বলে মনে হচ্ছে না ! আরও কয়েকটা কথা বলতে যাবেন ঠিক তখনই ঈশিতা এসে ঢুকলো রুমে !
সাজ্জাদ সাহেব সেদিকে তাকিয়ে বলল
-ঈশি দেখো সুমন সাহেব কি করছে ?
-কি করছে ?
-চাকরি ছেড়ে দিচ্ছে !
ঈশিতার দিকে তাকিয়ে দেখলাম ও বেশি চমকালো না ! আমার কেন জানি মনে হল ইশিতা আগে থেকেই এমন কিছু একটা ধারনা করে রেখেছিল যে আমি মনে হয় আর এখানে থাকবো না ! তবে এটো জলদি চাকরী ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিবো এটা মনে হয় ঈশিতা ভাবতে পারে নাই ! মুখটা একটু বিষন্ন হল ! আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-মানুষজন আর ভাল লাগছে না ? নাকি চাকরি ?
-না অন্য কারন !
অন্য কেউ হলে হয়তো জিজ্ঞেস করতো কিন্তু ঈশিতা করনটা জিজ্ঞেস করলো না ! কারনটা সে জানে ! খুব ভাল করেই জানে । কারন টা সে নিজে !
গত সপ্তাহে লাঞ্চ আওয়ারে হঠাৎ করেই ঈশিতাকে বললাম
-আজকে কি আমার সাথে বের হওয়া যাবে ?
একটু অবাক হলেও ঈশিতা বলল
-কোথায় যাবেন বলুন ?
-কোথায় না ! সামনের পার্কে ! কয়েকটা কথা বলতাম ! ১০/১৫ মিনিট !
-হুম ! চলুন !
-সাজ্জাস সাহবে রাগ করবে না তো ?
-না ! রাগ করবে কেন ?
-না মানে তার হবু বউকে নিয়ে পার্কে যাচ্ছি ! রাগ তো করতেই পারে !
-জি না ! ভয় নেই ! ও কিছু মনে করবে না !
পার্কের বেঞ্চে বসে নিজ নিজে প্রথমে গুছিয়ে নিলাম কি বলবো !
-কই কি বলবেন বলছিলেন ?
-আসলে ? আপনাকে অনেক দিন থেকেই কথাটা বলবো বলবো ভালছিলাম ! কিন্ত শেষে দেরি হয়েই গেল !
-দেরি ?
-আজ বলবো কাল বলবো করে প্রায় বছর পার হয়ে গেল ! আমরা তো প্রায় বছর খানেক হল কলিগ, তাই না ?
-হুম । বছর খানেক তো হবেই !
-এক বছর এগারো দিন সাড়ে বারো ঘন্টার মত !
এই কথা শুনে ঈশিতা একটু যেন অবাক হল ! আমার চোখের দিকে তাকিয়ে একটু চমকে উঠলো ! চোখ সরিয়ে নিল পরক্ষনেই !
আমি বললাম
-একবার ভেবেছিলাম যে আপনাকে কথা টা কোন দিন বলবোই না আর । কিন্তু নিজের কাছে শান্তি পাচ্ছিলাম না কিছুতেই ! তাই বলতে এলাম !
-বলুন !
-প্লিজ আপনি সিরিয়াস নেবেন না ! এখানে আপনার কোন হাত নেই আমার দোষ সম্পূর্ন ! আমি যে আপনাকে ভালবাসি এই কথাটা আমি বলতে পারি নি অন্য কেউ বলেছে এটা আমার ব্যর্থতা !
ঈশিতা আবারও আমার দিকে তাকিয়ে রইলো ! আমি আবার বললাম
-সেই শুরু থেকেই আপনাক এতো পছন্দ করি যে বলে বোঝাতে পারবো না ! আমি আমি....
কিছুক্ষন নিরবতা !
-এই কয়দিনে আমি সারা সময় কেবল ভেবেছি যে এমন একটা দিন আসবে যখন সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই আপনার ঘুমন্ত মুখ দেখতে পাবো ! বলতে গেলে এই স্বপ্ন টা আস্তে আস্তে গড়ে তুলেচিলাম ! কিন্তু ...।
ঈশিতা কোন কথা বলল না ! আমিও কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বললাম !
-চলুন যাওয়া যাক !
-হুম চলুন ! চুপচাপ হেটে চলে এলাম !
গত দিন দিন গুলোতে ভেবেছি কেবল এই কথা ! একই অফিসে চাকরী করা কিছুতেই সম্ভব না ! ঠিক করেছি চাকরী ছেড়ে দিবো ! আজকে সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চাকরী ছাড়লাম ! ঈশিতার মুখ দেখে একটু খারাঐ লাগছিল । এই মুখটা আর দেখতে পাবো ভেবেই খারাপ লাগছে !
-আপনি চাকরি টা না ছাড়লেও পারতেন !
-হুম ! হয়তো ! কিন্তু ....
ঈশিতা বলল
-কিন্তু কি ?
-কিছু না !
-কোথায় যাবেন এখন ? অন্য কোন অফিস ?
-আপাতত না ! ঢাকা ছাড়বো ভাবছি ! এখানে কেমন দম বন্ধ হয়ে আসতেছে ! চোখের সামনে আপনি অন্য কারো হয়ে যাবেন ভাবতে পারছি না ! তাই চলে যাবো ভাবছি !
ঈশিতা আর কথা বলল না ! চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালে আমি বললাম
-ঈশিতা !
-হুম !
-এই শহরে আমার কাছের মানুষ বলতে কেউ নেই ! আমার একটা ইচ্ছা কি রাখবেন ?
-কি বলুন ?
-কালকে কি একটু স্টেশনে আসবেন ? আমি চাই যে ঢাকা ছাড়ার আগে শেষ যে পরিচিত মুখ টা দেখি সেটা আপনার হোক ! আসবেন ?
-ট্রেন ছাড়তে কত বাকী ?
-এই ৫/১৫ মিনিট !
-চলে যাবেনই তাহলে ?
-হুম ! আপনি যাবেন আমার সাথে ?
ঈশিতা কিছু না বলে অন্য দিকে তাকিয়ে রইলো ! আমি বললাম
-একটা কথা বলি ?
-বলুন ?
-ঐ দিনের পর আপনি আমার কথা কতবার ভেবে ছেন ?
-জানি না !
-জানি না নাকি জানতে চান না !
-দেখুন আপনি রিকোয়েস্ট করেছিলেন বলে আমি এসেছি ! এমন কথা বললে কিন্তু চলে যাবো !
-আপনি প্লিজ বলেন না আমার কথা কত টুকু ভেবেছেন ?
-জানি না !
-আমার কি মনে হয় জানেন ? আপনি ঐদিনের পর একটা মুহুর্তও আমার কথা না ভেবে থাকতে পারেন নি !
-জি না এমন কিছু না !
আমি আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলাম তখনই ট্রেনের হুইসেল দিয়ে দিল ! ঈশিতা উঠে দাড়াতে দাড়াতে বলল
-এবার যেতে হয় !
-চলে যাবেনই !
-জি । যেতে হবে !
-আমার এই পাশের সি টার টাকা দিয়ে যান তাহলে !
খনিকটা অবাক হয়ে ঈশিতা বলল
-মানে ?
-৩৫০ টাকা !
-কি বলছেন এসব ?
আমি বললাম
-আমি ভেবেছিলাম আপনি শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে যাবে আমার সাথে যাওয়ার জন্য ! তাই আগে থেকে ট্রেনের টিকেট কেটে রেখেছিলাম ! কিন্তু আপনি তো চলে যাচ্ছেন !
-জি আমি চলেই যাবো ! থাকবো নাকি ? আর আমি আপনাকে ট্রেনর টিকেট কাটতে বলি নি !
-সত্যি চলে যাবেন ?
-যেতে হবে !
-দেখুন আমি জানি সাজ্জাদ সাহেবের সাথে বিয়ে হলে আপনি সারা জীবন আমাকে মনে রাখবেন । সাজ্জাদের ঘর করবেন ঠিকই কিন্তু আমি জানি আপনি আমাকে ভুলতে পারবেন না ! কিন্তু আমার আমার সাথে আসলে সাজ্জাদের কথা কোন দিন মনেও করবেন না !
ঈশিতা দরজার কাছে গিয়ে থেমে গেল ! ফিরে তাকিয়ে বলল
-হয়তো !
-তাহলে ?
-মেয়েদের অনেক কিছু চিন্তা করতে হয় ! আপনি ভাল থাকবেন !
আপনি ভাল থাকবেন বলেও ঈশিতা চট করে নেমে গেল না ! তখনই ট্রেন টা ঝাকিয়ে চলতে শুরু করলো ! আমি আশা করে আছি ঈশিতা হয়তো শেষ পর্যন্ত নামবে না !
একবার মনে হল ঈশিতা শেষ পর্যন্ত নামবে না ! আরেকবার মনে হল নেমে যাবে । নেমে গিয়ে হাটা শুরু করবে ! একবারও পিছনে ফিরে তাকাবে না ! আর মাত্র কয়েক মুহুর্ত ! আমি সেই মুহুর্তটার জন্য অপেক্ষা করে থাকি !
ট্রেনটা আরেক বার হুইসেল দিয়ে উঠলো !