কোরবানীর ঈদের দুটি দিন কাটল মাংস ও নানা ফরমালিটিস্ নিয়েই। কোথাও তেমন ঘোরাঘুরি করা হয়ে উঠেনি। কাল রাতে বন্ধুরা মিলে ভাবছিলাম কোথায় যাওয়া যায়। একজন পরামর্শ দিল সোনারগাঁতে বাংলার তাজমহল উদ্বোধন হয়েছে। অনেকের মুখেই শোনা যাচ্ছে, আমাদেরও উচিত একটা ঢুঁ দিয়ে আসা। বুদ্ধিটা ভালই লাগল, সবাই রাজি হয়ে গেলাম। তাছাড়া যুক্তি ছিল, যেহেতু একদিন আগেই উদ্বোধন হয়েছে, তাই এখন গেলে তেমন ভীড় হবে না, কারন অনেকের কাছেই জায়গাটা অচেনা।
ঠিক হল, আজ সকালে দশটায় যাত্রাবাড়ী থেকে বাসে উঠব। বাঙালি হিসেবে ঠিক সময়ে যাত্রা শুরু করাটা স্বভাবে নেই, আমরা তাই যাত্রা শুরু করলাম দুপুর ১২ টায়। তিনবন্ধু গেলাম যাত্রাবাড়ি বাস স্টান্ডে। এদিকে কোন বাসেই সিট নাই, অনেক মানুষ, ঝুলে যেতে হবে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে বুঝতে পারলাম, বসে যাবার আশা ত্যাগ করতে হবেই। ঝাপিয়ে লোকাল বাসে উঠে গেলাম গন্তব্য বড়পা। বিশাল জ্যামে বাসে ঝুলতে ঝুলতে পৌছলাম বড়পা, বাসে প্রত্যেকের ভাড়া নিল ১৫ টাকা। বাস কাউন্টারে জিজ্ঞাসা করলাম, তাজমহল কতদূর? ওরা বলে, বড়পা বাস স্ট্যান্ড থেকে ১৫ টাকা রিক্সা ভাড়া, আমগাঁও সুটিং স্পট। প্রথমে বড়পা বাজারে একটা ছোট্ট রেস্টুরেন্টে হালকা খাওয়া দাওয়া সেরে নিলাম।
কিন্তু হায়! কোন রিক্সাই ৪০ টাকার কমে যেতে রাজি না। এক বেবিট্যাক্সি ওয়ালা বলে জনপ্রতি ১০ টাকা নিবে, যতদূর জ্যাম ছাড়া যাওয়া সম্ভব ততদূর যাবে। এর বেশি যেতে পারবে না, হাটতে হবে। বড়পা বাজারে দেখি এ্যারো দিয়ে চিহ্নিত করা “তাজমহল, দুই কিলোমিটার”। আমরা ভাবলাম, প্রতিদিন কতই না টৈ টৈ করি, দুই কিলোমিটার আর কি! তিনজনেই হাটা শুরু করলাম, তাজমহলের উদ্দেশ্যে। রাস্তায় প্রচুর লোক, আমাদের ধারণা ভুল ছিল। হুজুগে বাঙালি তাজমহলের হুজুগে ঢল নামিয়েছে বড়পাতে আমাদেরই মত। কিছুদূর গিয়ে বুঝলাম হেটে আসাটাই সবচাইতে ভাল কাজ হয়েছে। এত জ্যাম যে এখানে দুই কিলোমিটার রিক্সায় পার করতে ১ ঘন্টার বেশি সময় লাগত। হেটে যাবার আর একটা সুবিধা ছিল এই যে, অনেকের কমেন্ট শুনতে পারছিলাম। লোকের বিরক্তি আর রাগ দেখে বুঝলাম, তেমন আহামরি কিছুই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে না।
দূর থেকে
বাইরে থেকে
অবশেষে পৌছলাম কাঙ্খিত গন্তব্যে, গ্রামের নাম পেরাবো। তাজমহল নামের তামাশা সেখানে দাঁড়িয়ে আছে, বাইরে থেকেই দেখা যায়। ভেতরে ঢুকতে টিকেট ৫০ টাকা জনপ্রতি। বাইরে থেকে দেখেই ইচ্ছা মিটে গেল, তবুও এতদূর যখন এসেছি ভেতরে গিয়েই দেখা যাক এই সিদ্ধান্ত নিয়েই তিনজনে টিকেট নিতে গেলাম। মানুষের এত চাপ যে টিকেট সংকটে ভুগছে কর্তৃপক্ষ। আমাদের তিনজনকে একটা টিকেট দিয়ে উপরে তিন লিখে দিল। যাইহোক, ঢুকলাম কম্পাউন্ডের ভেতর।
প্রবেশ পথে মানুষের ভীড়
কার পার্কিং (নিকটস্থ দোকান হতে রশিদ নিতে হবে, কি অদ্ভুত!!)
কার পার্কিং (যে যার ইচ্ছে মত টাকা নিচ্ছে)
এন্ট্রি পথে টিকেটের দাম; ৪০০ কোটির (!) স্থাপনায় সাইনবোর্ডে বানান দেখুন
তিনজনের এক টিকেট
কিছুই না দেখবার মত। শুভ্র তাজমহলের সোকলড রেপ্লিকা বানিয়েছে সাদার মাঝে নানা রঙ্গের টাইলস দিয়ে। সংবাদপত্রে কত কিছুই না পড়লাম। খরচ ৪০০ কোটি টাকা, ইতালি থেকে আনা মুল্যবান পাথর ও টাইলস্, বেলজিয়াম থেকে আনা ১৭২ টি হীরক খন্ড, গম্বুজের উপরে চারমন ওজনের ব্রোঞ্জ, কোথায় এসব??? ৪০০ কোটি টাকা কি পান্তা ভাত নাকি! নরমাল ইট-সিমেন্টের একটা স্ট্রাকচারের উপরে দেশী টাইলস্ (আমার বন্ধু বাড়ির কাজকর্ম ভাল বোঝে, তার মতে টাইলস গুলো দেশী) বসানো। এমন কি টাইলসের কাটাও ঠিক মত হয় নাই, আনাড়ি হাতের কাজ। এখনও ফিনিশিং সম্পূর্ণ হয় নাই। ইতালির পাথর যদি পরে বসাবার ইচ্ছাও থাকে তবে কোথায় বসাবে?
কম্পাউন্ডের ভেতর থেকে
ক্লোজ শট।
বাংলার তাজমহলের বাইরের অংশ
ভেতরের দৃশ্য
দর্শনার্থিরা সবাই বিরক্ত এবং নিজেদের প্রতারিত ভাবছেন। এক ছেলে বলে, “টিভির খবরে গতকাল প্রতিবেদন দেখে খুব সুন্দর লেগেছিল। কিন্তু একি দেখলাম এসে?” সকালে নাকি এক টিভির রিপোর্টার এক মেয়ে দর্শনার্থিকে জিজ্ঞাসা করেছিল ক্যামেরার সামনে, ‘কেমন লাগছে বাংলার তাজমহল?’। মেয়ে উত্তরে বলল, “খুব সুন্দর”। চারিদিকের লোকজন নাকি, ভূয়া ভূয়া বলে মেয়েটাকে চুপ করিয়েছে। একলোক বর্তমান ভারতের শাহজাহানের তাজমহল দেখেছিলেন, উনি বললেন এটা তাজমহলের ধারে কাছেও নাই। বাংলার তাজমহলের ভেতরে ঢুকলাম, সেখানে এখনও কাজ কিছুই হয় নাই। কাপড় দিয়ে ঢেকে রেখেছিল প্রবেশ পথ। জনগন কাপড় ছিড়ে ভেতরে ঢুকেছে, রাগে নিজেরাই ইট পাটকেল ছুড়ছে।
টাইলসের কিছু হালকা কারুকাজ
ইট সিমেন্টে গাথুনি, মার্বেল কোথায়?
৪০০ কোটি টাকা গাছে ধরে না। কোন প্রকার সুব্যবস্থাই নেই। গতকাল নাকি লোকজন টয়লেট এবং পার্কিং এর জন্য অনেক ঝামেলায় পড়েছে। আজ দেখলাম আশে পাশের লোকজন নিজ ক্ষেতে, বাড়ির উঠানে পার্কিং এর ব্যবস্থা করেছে। সাইনবোর্ডে গাড়ি প্রতি পার্কিং চার্জ লিখে বলা হয়েছে কাছের দোকান থেকে রশিদ নিতে! এলাকাবাসী কেউ কেউ হুজুগে পেরাবো গ্রামে জড়ো হওয়া ঢাকাবাসীর পাগলামী দেখছে, কেউ কেউ জুড়ে বসেছে জমজমাট ব্যবসা। তাজমহলের (!) পাশেই চটপটি, বিরিয়ানি ও অনান্য সামগ্রি বিক্রি হচ্ছে চড়া দামে। প্রবেশ ও বের হবার পথে মোট তিনজন গার্ড এবং টিকেট কাউন্টারের লোক ছাড়া আর কোথাও কোন নিরাপত্তা কর্মী দেখা গেল না। কম্পাউন্ডের ভেতরে টেবিলের উপর সফটড্রিংকস্, চিপস ইত্যাদি খুব সম্ভবত কর্তৃপক্ষই বিক্রি করছেন।
প্রায় ১০ মিনিট দেখবার পরেই বুঝতে পারলাম আমাদের জন্য ভেতরে আর কিছুই নেই। বেরিয়ে হাটা ধরলাম। পথে অনান্য দর্শনার্থিদের সাথে কথা হল, সবার একই উত্তর “ভূয়া”। কোন রিক্সা/ক্যাব না পেয়ে হাটতে হাটতে পৌছলাম নিকটবর্তী আমতলা বাজারে। হঠাৎ এক ফার্মেসীর দোকান থেকে কিছু লোক আমাদের তিনজনকে ডাকলেন। বয়স্ক একজন জিজ্ঞাসা করলেন, “কোন খান থেকে আসছেন? এইখানের তাজমহল কেমন দেখলেন?” আমাদের যথারীতি উত্তর, “ভূয়া”। তারাই বললেন কিছু কথা। গতকাল নাকি আরো অনেক ভীড় হয়েছিল। এই তাজমহলের প্রতিষ্ঠাতা আহসানউল্লাহ মনি ঐ এলাকার লোক। ঢাকার কাকরাইলের রাজমনি সিনেমা হল সহ আরো কয়েকটা সিনেমা হলের তিনি মালিক। উনি বাজারের দোকানে মাঝে মাঝে চা খেতে আসে। দোকানের ওরা নাকি তাকে গতকাল জিজ্ঞাসা করেছিল, “এই যে একটা তাজমহলের হুজুগ তৈরি করলেন, এত মানুষ আসল, একটা টয়লেট-গাড়ি পার্কিং এর জায়গা না পেয়ে আপনাকে বাপ-মা তুলে গালাগালি করে গেল, লাভটা কি হল”। মনি সাহেবের উত্তর নাকি, “আমি কি জানতাম নাকি এত লোক হবে!!”।
এলাকাবাসী (যাদের সাথে কথা হল)
এই হল আমার আজকের বাংলার তাজমহল দর্শনের অভিজ্ঞতা। অবাক লাগল এই যে দেশের শীর্ষ স্থানীয় পত্রিকা গুলো কিভাবে কোন রকম খোজ খবর ছাড়াই ৪০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ, ১৭২ টি হীরক খন্ড, ইতালির টাইলস/পাথরের ভূয়া খবর ছাপালেন। ৪০০ কোটি টাকা কি কম? এত টাকার বিনিয়োগে, একটি বিখ্যাত স্থাপনার রেপ্লিকা তৈরি ব্যাপারে তারা কি সরোজমিনে একবারও ঘুরে দেখে আসবার সময় করতে পারলেনা। ঢাকা থেকে নারায়নগঞ্জের, সোনারগাঁয়ের পেরাবো গ্রামে যেতে বড়জোর এক দেড় ঘন্টাই লাগত!! এই দেশে কি খবরের অভাব আছে? নাকি টাকা দিলেই খবর ছাপানো যায়। খুব বেশী হলে এই স্থাপনাতে ৩/৪ কোটি টাকার মত খরচ হয়েছে। ৩৩,০০০ কোটিপতির বাংলাদেশে এইটাকা কোন ব্যাপার না।
প্রথম আলোর লিংক Click This Link
ডি ডাব্লিউ ওয়ার্ল্ডের লিংক Click This Link
আমাদের তিনজনের ১৫০ টাকার টিকেট বৃথা যায় নাই। ফিরতি পথে নানা লোকের মজাদার মন্তব্যে পুরো টাকা উঠে এসেছে। কিছু এইখানে শেয়ার করলাম।
একজন ফোনে এই তাজমহল দেখতে ইচ্ছুক পরিচিত জনকে বলছিলেন, “কষ্ট কইরা এইখানে আহনের চাইতে, সায়দাবাদী হুজুরের মসজিদ দেইখা নেন’’।
যুবক, পোলাপান তুচ্ছার্থে বলছিল, “সেই রকম” বা “ভূয়া ভূয়া ভূয়া”।
পথে যারা তখনও দেখতে আসছিলেন তাদের উদ্দেশ্যে বলা হচ্ছিল, “খুব সুন্দর দেইখ আসেন, যান যান”।
সো কলড এই তাজমহলের আশে পাশে চাষের ক্ষেত বা ডোবা। তার মাঝে কিছু সরিষা ক্ষেত ছিল। কয়েকটা মেয়ে সেখানে ছবি তুলে এসে বলল, আজকে বিনোদন এই সরিষার ক্ষেতে ছবি তোলা।
একছেলে ফিরতি পথে অন্যদের বলছিল, “ভেতরে বিশাল বিশাল হিরা, একএকটা তুলতে দুই জন লাগে’।
এই সোকলড তাজমহল ঘুরে ঘুরে তিন মিনিটের একটা ভিডিও করেছিলাম। ইচ্ছা হলে দেখতে পারেন।
ইয়ুটিউবে সামহোয়ারের ভারতীয় ব্লগার কৌশিক বিশ্বাসের ভিডিও প্রেজেন্টেশনটা দেখুন। মনির জন্য বাংলাদেশের এই চরম অপমানের কোন জবাব দেবার মুখও আমাদের নাই
পোস্টের সাথে সম্পর্কহীন মন্তব্য এখানে করুন।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ বিকাল ৪:২৪