পুরো ব্যাপারটা দিল্লী পর্যন্ত গড়ায় এবং ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটে। একই সঙ্গে মুজিবের এডভেঞ্চারও। তিক্ত অভিজ্ঞতা সম্বল করে দীর্ঘ পথ হেটে দেশে ফেরেন তিনি। ফোলা পা নিয়ে ক্ষুব্ধ মুজিব জানান- ভারতীয়রা তাদের সিরিয়াসলি নেয়নি। ব্যাপারটা গোপন থাকেনি। কিছুদিন পরই গ্রেপ্তার করা হয় তাকে। তবে রাষ্ট্রদোহিতার অপরাধে তাকে ঝোলানোর মতো প্রমাণও পায়নি পাকিস্তান সরকার।
অনেক বছর পর ঢাকা যখন জ্বলছে তখন মোয়াজ্জেম একই প্রস্তাব দিয়েছিলেন বন্ধুকে। ‘৭১-এর ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুর শেষ দর্শনার্থীদের একজন ছিলেন মোয়াজ্জেম। ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়ার প্রস্তাবটা হেলায় সরিয়ে দেন মুজিব। বলেন, ‘আমাকে না পেলে ওরা আমার খোঁজে গোটা শহর জ্বালিয়ে দেবে। তাছাড়া ওদের আমি পুরোপুরি বিশ্বাসও করি না, গতবারের কথা মনে নেই তোমার!’ অনুমানটা যে সঠিক ছিলো তার প্রমাণ মিলেছে বিখ্যাত সাংবাদিক মুসা সাদিকের নেওয়া টিক্কা খানের সাক্ষাতকারে। মুজিবকে না পেলে তারা কি করতেন জানতে চাইলে ঠিক বন্ধনীর প্রথম লাইনটাই আউরেছিলেন গণহত্যার সে রাতে সার্বিক দায়িত্বে থাকা ‘বেলুচিস্তানের (পরে বাংলারও) কসাই’ নামে কুখ্যাত এই জেনারেল। যোগ করেন, ‘তবে আমাদের বিশ্বাস ছিল তার ওপর। উনি পালানোর লোক নন।’
ড.
স্বাধীনতার ব্যাপারে ধর্মের ওপর জাতীয়তার ঐক্য যেমনি, তেমনি সমঝোতা ঘটেছিল রাজনৈতিক খাতেও। সমাজতন্ত্রীরাও এ লক্ষ্যে পিছিয়ে থাকেনি। সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে দেশ স্বাধীনে উচ্চকিত মোহাম্মদ তোয়াহা পঞ্চাশের শুরুর দিকেই একটি রাজনৈতিক রচনা লিখেছিলেন লাহোর প্রস্তাবের বিশ্লেষণে যাতে ইঙ্গিতটা সুস্পষ্টই দিয়েছিলেন ভাসানীর একসময়কার ডানহাত। ষাটের দশকের শুরুতেই স্বাধীন দেশের প্রশ্নে জাতীয়তাবাদী ও সমাজতান্ত্রিক দলগুলো নীতিগতো সমঝোতার সবচেয়ে কাছাকাছি এসেছিলো।
তবে তত্ববাদে মস্কো-পিকিং দ্বিধা এই একমুখী ধারাগুলোকে বইয়েছিলো ভিন্ন অবস্থানে রেখে। পিকিং পন্থী কমিউনিস্টরা স্বাধীনতার পক্ষে সায় দিলেও আওয়ামী লীগের চরম বিপক্ষে। কাগমারী সম্মেলনে তেড়িয়া মুজিবের গুন্ডাগিরিই একমাত্র কারণ নয়। রাজনৈতিক ঈর্ষাবোধও। কারণ চোখের সামনে তাদের জানি দুশমন নিজেকে বাঙালীর অপরিহার্য নেতা হিসেবে ক্রমশই এক অস্পৃশ্য উচ্চতায় তুলে নিচ্ছিলেন তখন। তাই গোপন বৈঠকে স্বাধীনতার সপক্ষে যখন সদস্যদের চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে তখন একইসঙ্গে তারা শপথ নিচ্ছিলেন মুজিবকে ঠেকানোরও। বঙ্গবন্ধু ছয় দফা দাবি উত্থাপনের পর এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিলেন আবুল বাশার। যুক্তি দিয়েছিলেন এটি মেহনতী মানুষের কোনো উপকারে আসবে না।
ঢ.
কাজী জাফর আহমেদ ও তার মতো তরুণ তুর্কিরা আবার মুজিবের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলতেন। এ প্রসঙ্গে একটি ইন্টেরেস্টিং তথ্য শেয়ার না করে পারছি না। বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবি হত্যার নাটের গুরু ও অপারেশন সার্চলাইটের জনক প্রয়াত মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর একটি ডায়েরি পাওয়া গিয়েছিলো গভর্নর হাউজে। সেখানে একটা পাতায় লেখা ছিলো ‘দ্য গ্রিন অব ইস্ট পাকিস্তান উইল হ্যাভ টু বি পেইন্টেড রেড’। আন্তর্জাতিক আদালতে ফরমানের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের মামলা দায়েরে জন্য এটি ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো বাংলাদেশ। মুজিব আইওসি সম্মেলনে এটির ফটোস্ট্যাট কপি দেন ভুট্টোকে। কিন্তু হামুদুর রহমান কমিশনের জিজ্ঞাসাবাদে ফরমান জানান এটি ১৯৭০ সালের জুনে পল্টন ময়দানে এক ভাষণে বলেছিলেন মোহাম্মদ তোয়াহা। আপত্তিকর মনে হওয়ায় তিনি নাকি সেটা ডায়েরিতে তোলেন। পরে তোয়াহার কাছে জানতে পারেন কথাগুলো নাকি কাজী জাফর ও রাশেদ খান মেননের (যৌথ প্রযোজনা?)। তারা বাংলাদেশকে কমিউনিস্ট দেশ বানাতে চায় বলে এমন কথা বলেছেন। কমিশন তার যুক্তিতে সন্তুষ্ট হয়েছিলো!
কাগমারীতে সাম্যবাদীদের সঙ্গে সম্পর্ক টুঁটলেও আওয়ামী লীগ কিন্তু বারো মতের নেতা নিয়েই এগিয়ে গেছে। খন্দকার মুশতাক আহমেদের মতো চরম রক্ষণশীলদের সঙ্গে ভারসাম্য রেখেই দলের শীর্ষ নেতৃত্বে উঠে এসেছিলেন বামপন্থী তাজউদ্দিন আহমেদ। লক্ষনীয় হচ্ছে স্বাধীনতা যুদ্ধে এই বামঘেষারাই সবচেয়ে উজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছেন। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের রাজনীতিকে টালমাটাল করে দেয়া তান্ত্রিকখ্যাত সিরাজুল আলম খান ছাত্রলীগকে স্বাধীনতার প্রশ্নে আপোষহীন থাকার জন্য অবিরাম চেষ্টা চালিয়েছেন, সফলও হয়েছেন। এই অংশটা সরাসরি শেখ মুজিব ও তার বোনের ছেলে শেখ মনির আশীর্বাদপুষ্ট ছিল বলেই কখনো কোনঠাসা হয়নি।
ণ.
সে চেষ্টা যে চলেনি এমন নয়। যুদ্ধকালে খন্দকার মুশতাক আহমেদ যে কঠিন ষড়যন্ত্র চালাচ্ছিলেন তাতে সফল হলে গোলাম আযম নয়, বাঙালীর অলটাইম হেটবুকে মীর জাফরের পর তার নামটাই থাকতো। তাজউদ্দিনকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে পারেননি তিনি। এরপর কলকাতায় কুমিল্লার সাংসদ জহিরুল কাইয়ুমকে দিয়ে মার্কিন দুতাবাসের মাধ্যমে যোগাযোগ করেন ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে। আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সাংসদদের মধ্যে তার অনুগত অংশকে নিয়ে আপোষের প্রস্তাব দিয়েছিলেন মুশতাক। তার পরিকল্পনা ছিলো জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের নেতা হিসেবে যাওয়ার পর মুজিব নগর সরকারের বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়ে পক্ষবদল করার। কিন্তু ঘটনাটা ফাঁস হয়ে যায়, মুশতাক পররাষ্ট্রমন্ত্রী পদে থাকলেও কার্যত গৃহবন্দী থাকেন। এ ঘটনা নিয়ে আলাদা পোস্ট দেয়ার ইচ্ছে আছে বলেই বিস্তারিত আলোচনায় যাচ্ছি না।
অন্যদিকে মস্কোপন্থীদের সংশয়ের কারণ ছিলো ভিন্ন। ভারতে ব্যর্থ অভিযান শেষে ফেরার কিছুদিন পর মুজিব দেখা করেন কমিউনিস্ট পার্টির নেতা খোকা রায়ের সঙ্গে। স্বাধীকার আদায়ের আন্দোলনে তাদের সহযোগিতা চান তিনি। ‘পাঞ্জাবী বেনিয়াদের সঙ্গে আর নয়’- মুজিবের মুখে এমনধারা কথা শুনে নাকি বেশ চমকেছিলেন খোকা রায়। কারণ হিসেবে জানিয়েছেন পাকিস্তানের প্রতি আমৃত্যু অনুগত ও সমাজতন্ত্র নির্মূলে এক সময় জেহাদে নামা হোসেন শহীদ সোহরাওর্দীর ডানহাত হিসেবেই সবাই জানতো মুজিবকে। অর্থাৎ পার্টি পঠনে চরম প্রতিক্রিয়াশীল। প্রস্তাবটায় গা বাচিয়ে সায় দিয়েছিলেন কমরেড খোকা। মস্কো ব্যাপারটা কিভাবে দেখবে- এই অনিশ্চয়তা সঙ্গী করে তিনি জানান গনতান্ত্রিক আন্দোলনে কমিউনিস্ট পার্টিকে পাশে পাবেন মুজিব।
ত.
আর এই মেলবন্ধনে সবচেয়ে বড় প্রভাব ফেলেছিলো ১৯৫৮ সালে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখল। সে বছর জামালপুরে দেশ স্বাধীনের ব্রত নিয়ে কিছু তরুণ একাট্টা হন জনৈক আলী আসাদের নেতৃত্বে। তথ্যপ্রমাণে স্বাধীনতার লক্ষ্য নিয়ে সেটিকেই প্রথম সংগঠনের মর্যাদা দেওয়া যায়। মূলত স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির কর্মীরাই যোগ দেন এতে। সদস্যদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব হচ্ছেন ওস্তাদ ফজলুল হক ও রাজনীতিবিদ আব্দুর রহমান সিদ্দিকী। লক্ষ্যে পৌছতে সংগঠনটি সিদ্ধান্ত নেয় মাওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবের মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের সমর্থন আদায়ের। সেজন্য আবুল মনসুর আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন তারা তাদের বার্তাটি মুজিবকে পৌঁছে দিতে। সম্মতি মেলে। পাশাপাশি দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াসহ প্রভাবশালী নেতাদের সঙ্গে দেখা করেন তারা।
কর্মী ও সমর্থক থাকলেও ঠিক আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন বলা যাবে না তাদের। পার্টিও তাদের সাদর সম্ভাষণ জানায়নি। বরং তাদের উপদেশ দেয়া হয় সীমান্ত পেরিয়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা করতে। যোগাযোগের কোনোরকম নির্ভরযোগ্য সূত্র ছাড়াই ভারতে যান আলী আসাদ ও তার সঙ্গীরা। সেদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের আসেপাশে যেতে ব্যর্থ হলেও ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য কিছু পরিচিত মুখের দেখা পেয়ে যান। ভাগাভাগির পর দেশত্যাগী হওয়ার আগে জামালপুরেই বাসিন্দা ছিলেন তারা। ভারত আসার কারণ শুনে সমব্যথী দেশী ভাইয়েরা তাদের জন্য চাঁদা তোলেন। সেই টাকায় পোস্টার এবং লিফলেট ছাপানো হয়। দেশে ফিরে এগুলো তারা চোখে পড়ার মতো জায়গায় লাগাতে শুরু করেন। লিফলেটের বান্ডিল ছোড়া হতো সিনেমা হলে, অন্ধকারে দর্শকদের হতভম্ব করে। মাসখানেকের মধ্যেই অবশ্য গ্রেপ্তার হয়ে যান বেশীরভাগ সদস্য। স্বাধীনতার পর পাকিস্তান সরকারের গোপন দলিলপত্রে এই ঘটনার উল্লেখ মিলেছে। এদের বেশীরভাগই বেঁচে নেই। স্বদেশীয়ানার মন্ত্রে দিক্ষিত বিপ্লবী আলী আসাদেরও খোঁজ মেলেনি। ঘনিষ্ঠ একজন সর্বশেষ তাকে দেখেছেন কলকাতা বিমানবন্দরে দিল্লীগামী বিমানের অপেক্ষায়।
থ.
কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনের পরিকল্পনায় নানা ভাবেই অংশ নিয়েছেন মোয়াজ্জেম চৌধুরী। বিশেষ করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায়। তবে আগেই বলেছি এটি ছিলো ‘শেখ মুজিবের শো’। মামলায় নিজের সমর্থনে যে জবানবন্দী তৈরি করেছিলেন তাতে নিজেকে ব্যক্তি নয়, জনগন হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। আর তা এত ব্যাপক প্রচার পেয়েছিলো যে সত্তরের নির্বাচনে নিজেদের অবিসংবাদিত নেতাকে সনাক্ত করতে দু’বার ভাবেনি বাঙালী। সেই লেখনীর প্রতিটি ছত্রে ছিলো তাদের মনের কথা! এই ব্যাপারটা নিশ্চিতভাবেই প্রভাবিত করছিলো কমান্ডার মোয়াজ্জেমকে। স্বাধীনতার জন্য শুধু সামরিক শক্তিই যথেষ্ট নয়, জনসমর্থনও প্রয়োজন বুঝে যান তিনি। মামলা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর কমান্ডার মোয়াজ্জেম রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। শুরুতে চেয়েছিলেন দেশের সব রাজনৈতিক দলগুলোকে স্বাধীকার আদায়ের লড়াইয়ে একজোট করতে। স্বাভাবিকভাবেই ব্যর্থ হয়েছেন তিনি। এরপর সিদ্ধান্ত নেন একক রাজনৈতিক দল করার । জাতীয়তাবাদী দল নামে রাজনৈতিক দলটির আত্মপ্রকাশের তারিখ ছিলো ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ। কিন্তু ২৬ মার্চ ভোরে পাকিস্তান আর্মি গুলি করে মারে তাকে। অপারেশন সার্চলাইটের অডিও টেপে উল্লেখ আছে তার। (চলবে)