চ.
প্রাসঙ্গিক হিসেবে একটা চমকপ্রদ উপাত্ত যোগ করা যেতে পারে। দুতাবাসগুলোতে প্রায় প্রতিদিনই সম্ভবত কেউ না কেউ বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে যোগাযোগ করতো, এখনও করে। কেউ তথ্য বিক্রি করে, কেউবা মিথ্যে তথ্য যোগান দিতে চায়, কেউবা অন্য ধান্দায়। এমনই একজন জনাব সাঈদ বাঙাল। পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন করার জন্য অর্থ সাহায্য চেয়ে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসে যোগাযোগ করেছিলেন তিনি। ১৯৬৭ সালের ২১ নভেম্বর ঢাকা থেকে পাঠানো তারবার্তায় দুতাবাস কর্তৃপক্ষ তাকে চিহ্নিত করেছে তৃতীয় শ্রেনীর একজন উপনাস্যিক হিসেবে।
জনাব সাঈদ উল্লেখিত তারিখে দূতাবাসে গিয়ে 'মুসলিম ব্রাদারহুড পার্টি' নামে একটি রাজনৈতিক দলের কর্ণধার হিসেবে নিজেকে দাবি করেন, যাদের লক্ষ্য প্রদেশ থেকে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের কর্তৃত্ব উৎখাত করে স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান কায়েম। বাংলাদেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সমর্থন নিয়ে তার দল প্রাদেশিক পর্যায়ে খুবই সুসংগঠিত দাবি করে সাংগঠনিক তৎপরতাকে আরো ব্যপ্তি দিতে সাঈদ ৫৫ লাখ রূপির আর্থিক সাহায্য চান। পাশাপাশি ভবিষ্যতে তাদের গোলা-বারুদও লাগবে বলে জানান। দুতাবাসের কর্মকর্তা তাকে এক কথায় নিরাশ করেন যে যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরণের কোনো তৎপরতায় জড়িত হওয়ার ইচ্ছে নেই বলে।
ছ.
‘বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনী’র হয়ে কমান্ডার মোয়াজ্জেমের ভারতীয় দুতাবাসে যোগাযোগটাও সমসাময়িক। এর আগে ‘৬৫ সালের জানুয়ারিতে শেখ মুজিবের সঙ্গে দ্বিতীয় দফা সাক্ষাত হয় তার। এরপর আরো কয়েকটি বৈঠকে প্রতিবারই মুজিব তাকে সবধরণের সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। দুজনের পরবর্তী সাক্ষাত ঢাকা সেনানিবাসে তৃতীয় পাঞ্জাব মেসের বন্দীশালায়। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী হিসেবে পাশাপাশি রুমে থাকতেন তারা। এই আগরতলার ব্যাপারটা অনেকেই হয়তো সঠিক জানেন না। ঘটনা হচ্ছে পিএন ওঝার সবুজ সংকেত পাওয়ার পর ১৯৬৭ সালের ১২ জুলাই স্টুয়ার্ড মুজিবর রহমান ও আলী রেজা মুক্তিবাহিনীর প্রতিনিধি হিসেবে আগরতলা যান। সেখানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন কর্ণেলের সঙ্গে অস্ত্র সাহায্যের ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করেন তারা। এই গোপন বৈঠকটা কোনোভাবেই আর গোপন থাকেনি। যার সূত্র ধরে সে বছর ৯ ডিসেম্বর সিদ্ধেশরীতে ছোটভাইর বাসা থেকে গ্রেপ্তার হন কমান্ডার মোয়াজ্জেম।
এর আগেই গ্রেপ্তার হয়েছিলেন মুজিব। তবে এই মামলায় শুরুতে তার সম্পৃক্ততা পায়নি পাকিস্তান সরকার। স্বাধীনতার পর পরাজয়ের কারণ খুঁজতে পাকিস্তান সরকারের প্রকাশিত এক গোয়েন্দা নথিতে এর কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে যে মুজিব কে একটি বিশেষ সাংকেতিক নামে সম্বোধন করতো ষড়যন্ত্রকারীরা। লেখা হয়েছে- Pending a decision on this question the suspects were held in preventive detention, in the list of the persons so held one name, which was to figure prominently later on, was absent namely that of Sheikh Mujibur Rahman. One explanation that has been offered is that there was no evidence at that time to connect him with the crime or, to put it more accurately, in the evidence, till then discovered he was referred to by a code name and it had not till then been discovered that the code name referred to him. When on subsequent investigation this was found to be the case, another notification was issued in which Shaikh Mujib's name did appear.
জ.
একই নথিতে আরো চমকপ্রদ একটি বক্তব্য রয়েছে। পাকিস্তানীদের সন্দেহ আওয়ামী লীগে শিক্ষিত নেতার এতই অভাব যে ছয় দফা দাবি কোনোভাবেই তারা লিখতে পারে না। এটা কোনো পশ্চিম পাকিস্তানী লিখে দিয়েছে এবং সন্দেহভাজন ব্যক্তিটির নাম আলতাফ গওহর। আর এই ছয় দফার মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদের গন্ধ নাকি প্রথম পেয়েছিলেন দুজন বাঙালী- নুরুল আমিন ও মাহমুদ আলী। দুজনকেই স্বাধীনতার পর ক্ষমতার অংশীদার করেছিলেন প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো। মূলত তারই নির্দেশে বাঙালী বিচারপতি হামুদুর রহমানকে প্রধান করে গঠিত এই কারণ খুঁজো কমিশনে ইয়াহিয়া খানকে ভিলেন বানানোর সবধরণের প্রয়াসই নেওয়া হয়েছিলো যাতে তাকে মুজিবের বন্ধুমানুষ হিসেবেই বর্ণনা করা হয়েছে। প্রমাণ করার প্রয়াস নেওয়া হয়েছে যে স্রেফ রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য এমন একটি চাঞ্চল্যকর মামলা থেকে মুজিবসহ বাকিদের অব্যহতি দিয়েছিলেন ইয়াহিয়া।
ঝ.
হামুদুর রহমান কমিশনের সেই তদন্তে চমক আছে আরো। একই মামলায় সার্জেন্ট জহরুল হকের হত্যাকাণ্ডকে নিয়ে। ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম এই আসামীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। সরকারী কারণ হিসেবে বলা হয়েছে পালাতে চেষ্টা করায় তাকে গুলি করা হয়। কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে : There are several matters which make it difficult to accept this explanation. In the first place a stage had already come when the Tribunal was becoming convinced that against some of the accused persons at least there would not be sufficient ground to justify conviction and indeed, immediately before this incident the Prosecutor had agreed to make a statement in Court of the names of the persons against whom he no longer intended to proceed. Sergeant Zahoorul Haq was one of those persons and it must surely have been obvious to counsel for defence that his name was at least likely to figure on this list. Quite apart from the fool-hardiness of the attempt to escape, therefore, Sergeant Zahoorul Haq was one of the accused persons who had, at that particular stage the least incentive for making such an attempt.
অর্থাৎ জহুরুল হকের বিরুদ্ধে মামলা না চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো রাষ্ট্র, তাই তার পালানোর প্রশ্নই ওঠে না। নিহত জহুরুল হকের লাশ নিয়ে এরপর প্রকাশ্যে মিছিল হয় ঢাকায়। মামলার প্রধান বিচারপতি এস এ রহমানের বাসভবনে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। খালি পায়ে শুধু পাজামা পড়ে নাকি প্রাণ নিয়ে পালান তিনি।
ঞ.
এ সম্পর্কে আরো আমলে নেয়া যেতে পারে দুটো ভিন্ন গোয়েন্দা প্রতিবেদন : ব্রিটিশ হাইকমিশনার এ এ হ্যালিলে ২০ নভেম্বর ১৯৬৮তে পাঠানো টেলিগ্রামে লেখেন : The Government for its part is said to be disillusioned about the course of the Trial so far. Some prosecution witnesses have recanted and statements have been made by approvers alleging the use of force to induce them to produce false evidence; newspaper accounts of the proceedings with the attendant repetition of the Opposition platform, are crystalising the dissatisfaction that many Bengalis feel with their lot. সেখানে আরো লেখা হয় : From conversations I have had with Pakistanis the opinion seems fairly widespread that the Government made a serious tactical error in adopting this ponderous procedure which has given the Awami League so much publicity.
একই বছর ৭ আগস্ট মার্কিন দুতাবাস থেকে সরকারকে পাঠানো প্রতিবেদনে লেখা হয় : The Government of Pakistan's inept handling of the "Agartala Conspiracy Case" is fanning resentment among East Pakistanis. Far from discrediting the popular East Pakistani leader, Sheikh Mujibur Rahman, the trial currently underway appears likely to enhance his political potential as a martyr for East Pakistani rights. এক অর্থে রাষ্ট্রদ্রোহিতার এই ষড়যন্ত্রে মুজিবকেও অন্তর্ভূক্ত করে প্রকারান্তরে তার উপকারই করে পাকিস্তান সরকার।
ট.
চমকপ্রদ হচ্ছে মুজিবের সংশ্লিষ্ঠতা একেবারেই উপেক্ষা করার মতো নয়। বরং পাকিস্তানী নথিপত্রে যা নেই, স্বাধীনতা যুদ্ধ পূর্ববর্তী নানা দলিল ঘেটে এবং সংশ্লিষ্ঠদের সঙ্গে কথা বলে তাই জানিয়েছেন বিশিষ্ট সাংবাদিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক আফসান চৌধুরী। আর এ পর্যায়েই আবার ফিরিয়ে আনছি মোয়াজ্জেম হোসেনকে। ১৯৬১ সালে সফল হলেন তিনি। ভারতীয় হাইকমিশনে যোগাযোগ করে মুজিবের সীমান্তপাড়ির ছাড়পত্র যোগালেন। মতান্তরে ঘটনাটা ঘটেছিলো ১৯৬২ সালের শুরুতে। মোয়াজ্জেমের ভাতিজা রেজা আলী গাড়ি চালিয়ে মুজিবকে নিয়ে যান তেজগাও রেল স্টেশন। সেখান থেকে সাবেক মন্ত্রী জাকির খান চৌধুরীকে (আরেক মন্ত্রী ও মুক্তিযোদ্ধা জাকারিয়া চৌধুরীর ভাই) সঙ্গী করে রওয়ানা দিলেন সিলেট। সেখানে মওলানা ভাসানীর অনুগত সমর্থক সায়উদুল হাসানের চা-বাগানে আতিথ্য নিলেন। তার স্ত্রীর দেওয়া একটা বেঢপ কোট চাপিয়ে সীমান্ত পাড়ি দিলেন মুজিব। এখানে একটা ভুল বুঝোবুঝি হয়েছিলো। মুজিব যাচ্ছেন ও কি উদ্দেশ্যে যাচ্ছেন এটা সময় মতো উচু মহলে জানাতে পারেনি ভারতীয় দূতাবাস। তাই সীমান্তপারের থানায় যখন রাষ্ট্রনায়কের অভ্যর্থনা আশা করছিলেন তিনি, উল্টো দেখলেন অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাকে! (চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মার্চ, ২০০৯ ভোর ৫:১২