somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্বাধীনতার কিছু চমকপ্রদ ঘটনা

২২ শে মার্চ, ২০০৯ দুপুর ১:১৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর জন্ম ১৯৬৪ সালে! অবাক ঠেকছে? তাহলে জেনে নিন, তারও আগে ১৯৫৮ সালে জামালপুরে স্বাধীনতার জন্য একটি গুপ্ত বিপ্লবী সংস্থা জন্ম নিয়েছিলো। ২৮ মার্চ ১৯৭১, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল নামে একটি রাজনৈতিক দলের জন্ম নেওয়ার কথা ছিলো। সবচেয়ে চমকপ্রদ হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ভারতে গিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় আগ্রহী ছিলেন না, কারণ তার আগের অভিজ্ঞতা সুখকর ছিলো না। ১৯৬২ সালের শুরুতে সুভাষ বোসের মতো দেশ স্বাধীনের ব্রত নিয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন শেখ মুজিব!

ক.
মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এটাকে টাইপিং মিসটেক বলে সংশোধন করতে বাধ্য করেছিলেন। ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ যখন লাহোর প্রস্তাব উত্থাপিত হলো, এতে পাকিস্তান নামে একটি রাষ্ট্রের বদলে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ একাধিক প্রদেশের উল্লেখ ছিলো যার অন্যতম পূর্ব বাংলা। কিন্তু বুড়ো বাঘ আবুল কাশেম ফজলুল হক থেকে শুরু করে মাথা গরম মুসলিম লিগার আবুল হাশিম পর্যন্ত বেকুব হয়ে গেলেন জিন্নাহর গোয়ার্তুমিতে। নতুন রাষ্ট্রে উর্দু গেলানোর অপচেষ্টা কিংবা স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত অর্থনৈতিক খাতসহ নানা বৈষম্যের শিকার বাঙালী তখনই বুঝে ফেলেছিলো এত সাধের 'লাড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান' শ্লোগানের শেষ শব্দটা পাল্টাতে হবে তাদের। মেছো-ভেতো বাঙালীর সঙ্গে প্রতারণা করেছে আর্য্য প্রজাতির পশ্চিমা মুসলমান ভাইয়েরা। তার প্রমাণ তাৎক্ষণিক মিলেছিলো ১৪ আগস্টের সেই মাহেন্দ্রক্ষণটিতে। নতুন দেশের প্রশাসনকে ঢিল ছুড়ে, মিছিলে-প্রতিবাদে বরণ করেছিলো বাঙালীরা। বিয়েটা যে টিকবে না, বুঝা গিয়েছিলো ও রকম তপ্ত মধুচন্দ্রিমায়।

খ.
পূর্ব-পশ্চিম মিলিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের সম্ভাবনা নিয়েও গুটি চালাচালি হয়েছে। তবে ততটা উচ্চকিত ছিলো না তা। ১৯৪০ থেকে ৪৬ এর মধ্যে বহুবার এর সম্ভাব্য জমাটিটা ভেস্তে গেছে মুসলিম লীগের ক্ষমতালোভী রাজনৈতিক নেতৃত্বের কারণে। '৩৭-এর নির্বাচনী বিজয়েই তারা বুঝে গিয়েছিলেন 'মুসলিম' শব্দটার মোজেজা। এটাই ক্ষমতার নিশ্চিত চাবিকাঠি। হলোই বা তা উর্দূভাষী জিন্নাহর নেতৃত্বে! পাকিস্তান গঠনে বাঙালী মুসলমানদের ভোট আদায়ে জান লড়িয়ে দেওয়া হোসেন শহীদ সোহরাওর্দী নিজেও চেয়েছিলেন এক বাংলা এক দেশ। কিন্তু ভারত চায়নি হিন্দুগরিষ্ঠ পশ্চিম বঙ্গ হাতছাড়া করতে।

দেশভাগের পর সোহরাওর্দী বিস্ময়ভরে দেখলেন খোদ পাকিস্তানেই ব্রাত্য তিনি! তার ডান হাত হিসেবে অনেক মুরুব্বিকে টপকে উঠে আসা শেখ মুজিবের জন্য এটি ছিলো একটি শিক্ষা। '৪৬ সালে কলকাতার দাঙ্গাতেই আসলে নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিলো এক বাংলার ভাগ্য। এ ঘটনার পর মুসলিম লীগের একদল তরুণ তুর্কি কলকাতায় বিচারপতি মাসুদের বাসভবনে 'স্বাধীন পূর্ব বাংলা' রাষ্ট্রের সম্ভাবনা যাচাইয়ে এক বৈঠকে বসেছিলেন। সেখানে সম্ভাব্য রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে সতীর্থদের পুরো সমর্থন ছিলো মুজিবের প্রতিই, সোহরাওর্দী নয়।

গ.
স্বদেশীয়ানার প্রলেপ জড়ানো পূর্ব বাংলা মুসলিম লীগ, আওয়ামী মুসলিম লীগ হয়ে ১৯৪৯ সালে থিতু হলো আওয়ামী লীগে। স্বাধীনতার স্বপ্নের ভাঙ্গা টুকরোগুলো কুড়িয়ে জোড়া দিতে মুজিবের নতুন অভিযাত্রারও সেই শুরু। পূন্যভূমির স্বপ্নদ্রষ্টা মহাকবি ইকবালের কল্প-ভুগোল থেকে বিচ্যুত হওয়ার যাত্রা। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের যূথবদ্ধতা। হিন্দু-মুসলমান বাঙালী নির্বিশেষে চলে এলো এক পতাকার নীচে। প্রমাণ মিললো ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট একচেটিয়া জয় পেলো পূর্ব পাকিস্তানে।


কিন্তু আবারও আঘাত। শের-ই বাংলা ফজলুল হককে সরিয়ে দেওয়া হলো রাষ্ট্র বিরোধী ষড়যন্ত্রের অভিযোগে। নিউইয়র্ক টাইমসে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে তিনি নাকি ‘স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান’ গঠনের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন! পেশায় উকিল ফজলুল হক বুড়ো হতে পারেন, কিন্তু কোন কথা রাষ্ট্রদ্রোহিতা তা বোঝেন না-মানতে পারেন? হাস্যকর হচ্ছে এই রাষ্ট্রদ্রোহীকেই দায়িত্ব দেওয়া হলো স্বদেশের বিশ্বাসঘাতকদের শায়েস্তার। সাবেক মুখ্যমন্ত্রী দায়িত্ব পেলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের।

ঘ.
দুদিন পর পর জেল খেটে বেরানো সোহরাওর্দী তখনও সাচ্চা পাকিস্তানী। অনুগত মুজিব তার ছায়াসঙ্গী। ১৯৫৮ সালে সোহরাওর্দী ক্ষমতার ভাগ পেয়েছেন। কিন্তু দলের মধ্যে প্রবল হয়ে উঠেছে জাতীয়তাবাদী চেতনা। কাগমারিতে যখন দল ভেঙ্গে বামপন্থী ন্যাশনাল আওয়ামী লীগ ও শুধু আওয়ামী লীগে ঠেকলো, মুজিব হাতা গুটিয়ে মারপিটও করেছেন সাবেক কমরেডদের সঙ্গে। ততদিনে দৃশ্যপটে চলে এসেছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। ব্লাডি সিভিলিয়ান রাজনীতিবিদদের কবল থেকে দেশকে বাঁচানোর উপায় একটাই, ক্ষমতা দখল। ঐতিহ্যের সেই শুরু!

এই গুরুত্বপূর্ণ পালাবদলের সূচনায় মঞ্চে প্রবেশ মোয়াজ্জেম আহমেদ চৌধুরীর। দেশভাগের আগে কলকাতায় সেই গোপন বৈঠকে ছিলেন মুজিবের ঘনিষ্ঠ বন্ধু এই সিলেটি। চল্লিশের দশকে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র সংগঠনকে নেতৃত্ব দেওয়া মোয়াজ্জেম দলীয় নির্দেশে যোগ দেন মুসলিম লীগে। দেশভাগের পর থেকেই ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার সাহায্য নিয়ে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার জন্য কাজ করছিলেন তিনি। সঙ্গী ঘনিষ্ঠ তিন বন্ধু। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র মডেলে দেশ স্বাধীনের পরিকল্পনায় মুজিবকে উদ্বুদ্ধ করলেন তিনি। পরিকল্পনা হচ্ছে মুজিব ভারতে চলে যাবেন, সেখান থেকে লড়াইয়ের ডাক দেবেন। আর তার অনুগতরা সেই নির্দেশনা মেনে বিদ্রোহ সামিল হবে। দল ভাঙার আগে মাসকয়েক কলকাতায় কাটিয়েছেন তিনি। পরিকল্পনার নানা দিক বিশ্লেষণ করেছেন। তার ইচ্ছে একবার জওহর লাল নেহেরুর সঙ্গে মুজিবের সাক্ষাত ঘটাবেন। আর তাতেই কেল্লা ফতে। তাতো হলোই না, বরং আওয়ামী কেল্লাটা দুভাগ হয়ে গেলো।

ঙ.
এসব ঘটনা যখন ঘটছে, তখন সমান্তরালে একই উদ্দেশ্য নিয়ে সংগঠিত হচ্ছেন বাঙালী কিছু সেনা কর্মকর্তা। এদের নেতা আরেক মোয়াজ্জেম। লেফটানেন্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন চৌধুরী। ১৯৫০ সালে ব্রজমোহন কলেজে পড়ার সময়ই পাকিস্তান নৌবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। সেবছরই সুযোগ পান বৃটেনে রয়েল নেভীতে প্রশিক্ষণের। সেখান থেকে দেশে ফিরে মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে আবার যান বিলেতে। প্রবাসের এই সময়টাতেই মনোরা দ্বীপের হিমালয়া নৌঘাটিতে বসে লাহোর প্রস্তাবের উপর ভিত্তি করে বাংলা স্বাধীনতা আন্দোলনের পরিকল্পনা করেন তিনি। তৈরি করেন রাজনৈতিক ও সামরিক রণকৌশলের নকশা।
১৯৫৮ সালে একটা সশস্ত্র বিদ্রোহের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন করার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেন কমান্ডার মোয়াজ্জেম। প্রস্তুতি পর্বে শুধু বাঙালী সামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যেই ছিলো এই পরিকল্পনা, এতে কোনো রাজনীতিবিদকে যুক্ত করেননি তারা। পরবর্তীতে শেখ মুজিব, মওলানা ভাসানী, কর্ণেল (অবঃ) ওসমানীর সঙ্গে যোগাযোগ হয় তাদের। স্বাধীন দেশের পতাকা থেকে শুরু করে শাসনতন্ত্র পর্যন্ত ঠিক করে ফেলেছিলেন কমান্ডার মোয়াজ্জেম। এরপর সামরিক ছাউনিগুলোতে এর স্বপক্ষে গোপন প্রচারণা চালাতে থাকেন। ১৯৬৪ সালে তিনি গঠন করলেন বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনী নামে একটি গুপ্ত বিপ্লবী সংগঠন। কয়েকটি বিদেশী দুতাবাসের কাছ অস্ত্র সাহায্যের জন্য যোগাযোগ করলেও এ ব্যাপারে সবুজ সংকেত পান তিনি ভারতীয় দুতাবাসের প্রথম সেক্রেটারি পিএন ওঝার কাছ থেকে। (চলবে)

তথ্যসূত্র : আফসান চৌধুরী ও কমান্ডো মোহাম্মদ খলিলুর রহমান
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মার্চ, ২০০৯ সকাল ৭:৫৮
২৩টি মন্তব্য ১৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পাশ্চাত্যের তথাকথিত নারীবাদ বনাম ইসলাম: বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটি সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ

লিখেছেন নতুন নকিব, ০৩ রা মে, ২০২৫ বিকাল ৪:২৪

পাশ্চাত্যের তথাকথিত নারীবাদ বনাম ইসলাম: বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটি সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ

ছবি কৃতজ্ঞতা এআই।

ভূমিকা

নারীর অধিকার নিয়ে আলোচনা ইতিহাসের এক দীর্ঘ অধ্যায়। পাশ্চাত্যে নারী আন্দোলন শুরু হয় ১৮শ শতকের শেষভাগে, যার ফলশ্রুতিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি স্মার্ট জাতির অন্তঃসারশূন্য আত্মজৈবনিক !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৩ রা মে, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:৩৪


একটা সময় ছিল, যখন জাতির ভবিষ্যৎ বলতে বোঝানো হতো এমন এক শ্রেণিকে, যারা বই পড়ে, প্রশ্ন তোলে, বিতর্কে অংশ নেয়, আর চিন্তা করে। এখন জাতির ভবিষ্যৎ মানে—ইনফ্লুয়েন্সার। তারা সকাল ১০টায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক্ষমতায় যাবার আগেই নারী বিদ্বেষ শুরু

লিখেছেন অপলক , ০৩ রা মে, ২০২৫ রাত ১০:১১

সংবাদ সম্মেলন থেকে বের করে দেওয়া হলো নারী সাংবাদিককে, যা বললেন মুফতি ফয়জুল করিম

বরিশালে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করিমের এক নারী সাংবাদিক মনিকা চৌধুরীকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামী দলগুলো নারী বিদ্বেষী - এটা একটি মিথ্যা প্রোপাগান্ডা

লিখেছেন সত্যপথিক শাইয়্যান, ০৩ রা মে, ২০২৫ রাত ১১:২৯

আরবের দেশগুলোকে আমাদের দেশের নারী আন্দোলনের নেত্রীরা দেখতে পারেন না হিজাব ইস্যুর কারণে। অথচ, আরব দেশ কাতার বি,এন,পি'র চেয়ারপারসনকে চার্টারড প্ল্যানে করে দেশে পাঠাচ্ছে। আরো কিছু উদাহরণ দেই। আওয়ামী লীগ... ...বাকিটুকু পড়ুন

নারী কমিশন বিতর্ক: সংস্কারের ভাষ্যে প্রান্তিকতার অনুপস্থিতি ও বিশ্বাসের সংঘাত

লিখেছেন মুনতাসির রাসেল, ০৪ ঠা মে, ২০২৫ ভোর ৪:০৬


বাংলাদেশে নারী-অধিকার প্রশ্নে বিতর্ক নতুন নয়, তবে নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের সাম্প্রতিক প্রস্তাবনা যেন একটি আগুনের স্ফুলিঙ্গ ছুড়ে দিয়েছে। বাল্যবিবাহ, পারিবারিক আইন, নারী-পুরুষের ভূমিকা ও ধর্মীয় বিধানের নতুন ব্যাখ্যা নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×