বিশ্বের ইতিহাসে বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যার স্বাধীনতার এক দশক না পেরুতেই এর শাসনভার চলে গেছে একাত্তরের দালালদের হাতে। নয় মাসের দীর্ঘ যুদ্ধক্ষেত্রে সে অর্থে কোনো রাজনৈতিক নেতৃত্ব কাজ করেনি। কথিত আছে আওয়ামী লিগ নেতারা কলকাতায় গিয়ে ভারতীয় ভাতায় মৌজ ফুর্তি করেছেন। দেশে ফিরে এই মাঝারিপাল্লার নেতারাই কেউকেটা হয়ে নতুন দালালি নিয়েছেন। সেই দালালিটা একাত্তরের দালালদের বাঁচানোয় মধ্যস্ততার ভূমিকা পালনের। মুজিব যখনই তার রাজনৈতিক সহকর্মীদের নিয়ে এ ব্যাপারে আলোচনা করতে গিয়েছেন, তখন আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটের দোহাই দিয়ে তাকে নমনীয় হতে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। 18 ডিসেম্বর স্টেডিয়ামে কাদের সিদ্দিকীর দুষকৃতিকারী মুক্তিযোদ্ধা হত্যার (এব্যাপারে আগে পোস্ট দেওয়া হয়েছে) সরাসরি সমপ্রচার, দেশের বাইরে থাকা গোলাম আযম ও অন্যান্য স্বাধীনতাবিরোধীরা বাংলাদেশের নেতিবাচক প্রচারণায় সফলভাবে ব্যবহার করে।
এবং সেই যুক্তি দেখিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের নিরস্ত্র করা ও পাইকারী দালাল হত্যার মতো সিদ্ধান্তগুলো নিতে মুজিবকে প্ররোচিত করা হয়। এখানে বড় একটা ভূমিকা ছিল খন্দকার মোশতাক আহমেদের। আর অদ্ভুত এক কৌশলে নজরুল ইসলামের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর একটা দূরত্ব সৃষ্টি করা হচ্ছিল। যুদ্ধকালীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান নজরুল ইসলাম যখন বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার আগেই অপরাধীদের শাস্তির ঘোষনা দিয়ে তদন্ত কমিশন গঠনের সব আয়োজন সেরে ফেলেছেন, তখন তাতে নানান খুত বের করে তা পরিবর্তন করতে বাধ্য করা হয়।
মুজিবের কথা ও কাজে যে পরিবর্তন আসছে তার প্রথম প্রমাণ মেলে '72 সালের মাঝামাঝি। 6 মে আমেরিকান ব্রড কাস্টিং কর্পোরেশন (এবিসি)তে এক টিভি সাক্ষাৎকারে তিনি যুদ্ধাপরাধীদের প্রসঙ্গে বলেন, 'আমি অবশ্যই তাদের বিচার করব, এ ব্যাপারে কোনো বিতর্কের অবকাশ নেই। যেখানে তারা ত্রিশ লাখ লোককে হত্যা করেছে সেখানে কোনো দেশ কী তাদের ছেড়ে দিতে পারে?' একই সাক্ষাৎকারে একই প্রসঙ্গে আবার নমনীয় এবং ভিন্ন সুর মুজিবের, 'দালালদের কেসগুলো একটি তদন্ত কমিশন কতর্ৃক বিবেচিত হবে। আমরা তদন্ত করছি এবং নির্দোষ লোকদের ছেড়ে দিচ্ছি। অবশ্য যারা অপরাধ সংঘটনের জন্য দায়ী তাদেরকে নিশ্চিতভাবেই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হবে।' (আজাদ, 15 মে '72)
শেখ মুজিব ও তার সতীর্থরা যখন বক্তৃতাবাজি চালাচ্ছেন তখন অন্যদিকে চলছে দালালদের সুরক্ষার আয়োজন। চারদিক থেকে তখন সরব আওয়াজ উঠছে সংক্ষিপ্ত আদালত গঠন করে দ্রুত বিচারের। কিন্তু 24 জানুয়ারি সেসব দাবিকে উপেক্ষা করে জারি হলো 'বাংলাদেশ দালাল (বিশেষ ট্রাইবুনাল) অধ্যাদেশ 1972'। অভিযুক্ত প্রমাণ হলে 2 বছর কারাবাস থেকে সর্বোচ্চ মৃতু্যদন্ড হলো শাস্তি। আসামীদের হাইকোর্টে আপিল করার সুযোগ থাকল, যদিও কেড়ে নেওয়া হলো অন্য কোনো আদালতে বিচার চাওয়ার অধিকার।
অনেক ফস্কা গেড়ো। সবচেয়ে বড় ছিল 7ম ধারাটি। বলা হয়েছে থানার ওসি যদি কোনো অপরাধকে অপরাধ না বলেন তবে অন্য কারো কথা বিশ্বাস করা হবে না, অন্য কারো অভিযোগের ভিত্তিতে বিচার করা হবে না এই ট্রাইবুনালে। অন্য কোনো আদালতেও মামলা করা যাবে না। মামা বাড়ির আব্দার যাকে বলে আর কী! দালাল যারা তাদের তো অঢেল অর্থকড়ি। ওসি কিনতে আর কত লাগে? সেটা স্বজনহারানো শোকপিড়িত সবখোয়ানো দরিদ্র জনগনের ছিল না তো।
28 মার্চ নাগাদ মোট 73টি এ ধরণের ট্রাইবুনাল গঠিত হয়। সারাদেশের সমস্ত জেলা ছিল এর আওতায়। এবং অন্য কোনো আদালতের এতে নাক গলানোর অধিকার রইল না বিশেষ অধ্যাদেশে। এপ্রিল মাসে শুরু হলো বিচার। আর স্পষ্টই বোঝা গেল দালাল আইন দালাল ধরতে নয়, দালালদের বাঁচাতেই প্রণয়ন করা হয়েছে। 30 নভেম্বর 1973 সালে কুখ্যাত সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আগে 31 অক্টোবর পর্যন্ত 37 হাজার 471 জন অভিযুক্তের মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছিল 2 হাজার 848 জনের মামলা। এদের মধ্যে দন্ডাদেশ পেয়েছে 752 জন, বাকি 2 হাজার 96 জনকে দেওয়া হয় বেকসুর খালাস। মৃতু্যদন্ডে দণ্ডিত হয় মাত্র একজন রাজাকার! (চলবে)
ছবি : বঙ্গবন্ধুর খুনী ফারুকের সঙ্গে গোলাম আযম
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই জুন, ২০০৮ ভোর ৪:৫৪