somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দালাল আইন / রাজাকারদের ক্ষমা : বঙ্গবন্ধুর কস্টলি ভুল 1

২৯ শে আগস্ট, ২০০৬ রাত ১২:৪২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


মুক্তিযুদ্ধের 35 বছর পর আজ ফের রাজাকার ও তাদের সুযোগ্য উত্তরসূরীদের প্রতাপে কাঁপছে বাংলা। এতটাই যে ঘরের এক কোণে ঘাপটি মেরে থাকা চারাটা নিজের মতো করে বড় হয়ে আজ ডালপালা ছড়িয়ে দিয়েছে। সেই ডালের আঘাতে বাড়ির দরজা-জানালা চূর্ন, শেকড় ঢুকে পড়েছে ভিটেয়- ফাটল আজ দেয়ালে। বাঙালীর মুখ থেকেই তারা বলিয়ে নিতে চায় একাত্তরে তাদের ভুল হয়নি।
ভুলটা কার? বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের। ফিদেল কাস্ত্রোকে অভিভূত করেছেন। কিউবার বিপ্লবী নেতা আলজিয়ার্সে তাকে জড়িয়ে বলেছিলেন, 'আপনাকে দেখি আর মুগ্ধ হই। আপনি জেলখানায় বন্দী, আর আপনার নামে স্বাধীন হয়ে গেল একটা গোটা দেশ!' একাত্তরে ঠিক তাই হয়েছে। 16 ডিসেম্বরের সামরিক বিজয়ের পর পূর্ণাঙ্গ বিজয় হিসেবে বাঙালী মেনেছে 10 জানুয়ারি 1972 কে। সেদিনই পাকিস্তানের কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। যে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। তারই বাস্তবায়নের প্রত্যয় শোনা গেল তার মুখে।
যুদ্ধোত্তর এবং লাশের স্তুপে ও গন্ধে বিদীর্ন এ বাংলায় তখন কোনো বিদেশী সাহায্য আসেনি ভারত ও রাশিয়া ছাড়া। এক ধরণের নিষেধাজ্ঞার ঘেরাটোপেই বন্দী থাকা। হাজার হোক মার্কিনিদের চটানো যাবে না, চীনকেও না। আরব দেশগুলো আছেই। বাংলাদেশ তাদের কাছে স্বীকৃত নয়। কেন রাজাকারদের ক্ষমা করা হয়েছিল জানতে চাইলে অনেক ধরণের বিবৃতি পাওয়া গেছে তখনকার নেতাদের কাছ থেকে। কেউ বঙ্গবন্ধুর মহানুভবতাকে তুলে ধরেছেন। তিনি আর হত্যা চাননি। ভেবেছেন, এরা দেশেরই সন্তান- ক্ষমা পেলে ঠিক শুধরে যাবে। কুটনৈতিক বিশ্লেষণে গেছেন কেউবা। তখনও পশ্চিম পাকিস্তানে বন্দী আমাদের লাখো বাঙালী। সেনা অফিসার থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ ও তাদের পরিজন। এদের ফিরিয়ে আনতে এই পদক্ষেপ। পাল্টা যুক্তি ছিল 96 হাজার বন্দী পাকিস্তানী আর্মির সঙ্গে এই বিনিময় কেন হলো না? এইখানে ভারতের কূটনীতির কাছে মাথা নোয়াতে হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে। কারণ বন্দী পাকিদের তারা নিজেদের বন্দী বলেই মেনেছে, দর কষাকষিটাকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে। সেটার বিনিময়ে মুজিব যা করতে পেরেছেন তা হলো মার্চের মধ্যেই বাংলাদেশ থেকে সর্বশেষ ভারতীয় সেনাটির প্রত্যাহার। গোটা বিশ্বকে অবাক করেই।
এই কৃতিত্ব এবং শত সীমাবদ্ধতাতেও তার ভুলটি ছিল ক্ষমার অযোগ্য ভুল। যার মূল্য এখন প্রতিদিন চুকোতে হচেছ আমাদের। হাসান আজিজুল হক ও জাফর ইকবালের মতো সর্বজন শ্রদ্ধেয় বাঙালীকে আঙুল তুলে হুমকি দেয়া হয় কেটে ভাসিয়ে দেওয়ার! সব কিছুর মুলেই ওই যে সাধারণ ক্ষমা।
16 ডিসেম্বর '71। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই শুরু হয়ে যায় ঘাতক-দালালদের বাচানোর খেলা। রাজনীতি ব্যাপারটা কত জঘন্য হতে পারে এবং শ্রেণী স্বার্থ, ব্যক্তিগত মোক্ষ ও লোভ কীভাবে আদর্শচু্যত করে মানুষকে- এর প্রমাণ দিয়েছিলেন তখনকার প্রভাবশালী বেশ কিছু আওয়ামী লিগ নেতাই। মুজিবকে ঘিরে ছিলেন এরাই, এদের ধান্দাবাজি না বুঝে তোষামুদিতেই তুষ্ট মুজিব ঠিকাছে ঠিকাছে বলে সায় দিয়ে গেছেন। মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায় ও ব্যাপক যুদ্ধে বাঙালীর হার শুরু তখন থেকেই।
রেসকোর্সে পাকবাহিনী যখন আত্মসমর্পন করছে, দেশে ফেরা আওয়ামী নেতাদের সঙ্গে তখন শীর্ষ দালালদের জব্বর বৈঠক ও দরকষাকষি। পরিস্থিতির কারণেই একমাত্র সমাধান ছিল গ্রেপ্তার ও কারাগার। ছবিটা অনেকটা এরকম। একজন ছিনতাইকারী অথবা খুনী প্রকাশ্যে হত্যার পর জনগণের হাতে ধরা পড়ল। সে ধোলাই খেল। পুলিশ তাকে উদ্ধার করল ও থানায় নিয়ে গেল। সেখান থেকে সে আরামে শিস দিতে দিতে বেরিয়ে গেল। একাত্তরেও তাই ঘটেছিল। দালালরা তাৎক্ষণিক আশ্রয় হিসেবে মানল কারাগারকেই। আওয়ামী প্রশাসনে প্রায় 11 হাজার দরখাস্ত পড়েছিল সে সময়, যাতে আবেদনকারী দালালরা আকুতি জানিয়েছিল তাদের গ্রেপ্তার ও জেলে পুরতে। আর বিচারে শুরু হয় কালক্ষেপন।
1 জানুয়ারি 1972 সালেই অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম তার মন্ত্রী পরিষদ নিয়ে এক বৈঠকে গনহত্যা তদন্ত কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত নেন। হাইকোর্টের কর্মরত কিংবা অবসরপ্রাপ্ত কোনো বিচারপতি বা সমপর্যায়ের কোনো মনোনীত ব্যক্তির নেতৃত্বে কমিশন পাকবাহিনী ও তাদের দালালদের হাতে ক্ষতিগ্রস্থদের মৌখিক ও লিখিত সাক্ষাৎকার নিয়ে তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করবেন বলে ঘোষণা দেওয়া হয়।
10 জানুয়ারি দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু রমনায় কেদেকেটে বললেন, 'বিশ্বকে মানব ইতিহাসের এই জঘন্যতম হত্যাকান্ডের তদন্ত অবশ্যই করতে হবে। একটি নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক দল এই বর্বরতার তদন্ত করুক তাই আমার কামনা।' (দৈনিক বাংলা 11 জানুয়ারি '72)। এরপর মিডিয়া এবং যে কোনো বক্তব্যেই যে কোনো সাক্ষাৎকারেই আপোষহীন স্বরে জানিয়েছেন বাংলার মাটিতে দালালদের বিচার অনুষ্ঠানের প্রত্যয়ের কথা। সেদিনের জনসভার ভাষণেই ছিল, 'যারা দালালী করেছে, আমার শত শত দেশবাসীকে হত্যা করেছে, মা-বোনকে বেইজ্জত করেছে, তাদের কী করে ক্ষমা করা যায়? তাদের কোনো অবস্থাতেই ক্ষমা করা হবে না। বিচার করে তাদের অবশ্যই শাস্তি দেওয়া হবে।' এই দায়িত্ব তার সরকারের হাতে ছেড়ে দিতে আবেদন জানান মুজিব, 'আমরা দেখিয়ে দিতে চাই শান্তিপ্রিয় বাঙালীরা স্বাধীনতার জন্য রক্ত দিতে জানে, তেমনি শান্তিও বজায় রাখতে জানে।'
দুদিন পর আনুষ্ঠানিকভাবে প্রধানমন্ত্রীর শপথ নেওয়ার পর একটু একটু করে বদলাতে শুরু করে মুজিবের ভাষার শব্দ চয়ন। দালালদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক তৎপরতার বিরোধিতা শোনা যায় তার মুখে, 'লোমহর্ষক হত্যাকান্ডের কথা আমি শুনেছি, তবু বাংলার মানুষ এত নিচে নামবে না। বরং যা মানবিক তাই করবে, তবে অপরাধীদের আইনঅনুযায়ী বিচার অবশ্যই হবে।' (দৈনিক বাংলা 13 জানুয়ারি '72)। পরদিন আওয়ামী লিগ অফিসে দলের নেতাকর্মীদের প্রতিশোধ নেওয়ার পথ থেকে সরে আসার জন্য বিশেষভাবে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, 'দালালদের অবশ্যই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হবে।'
এবং এ সময় তার প্রতিটি ভাষণ বিবৃতিতে ঘুরে ফিরে এসেছে কথাগুলো। এই বলছেন ক্ষমা করব না, এই বলছেন ওদের আইনি বিচার হবে। 6 ফেব্রুয়ারি কলকাতা প্যারেড গ্রাউন্ডে বললেন, 'যারা গনহত্যা করেছে, তারা সমগ্র মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে, এদের ক্ষমা করলে ইতিহাস আমাকে ক্ষমা করবে না।' (দৈনিক বাংলা 7 ফেব্রুয়ারি '72)। 21 ফেব্রুয়ারি বললেন, 'বাংলার মাটিতেই খুনীদের বিচার হবে।' 30 মার্চ চট্টগ্রামে ঘাতকদের নমরুদ বিশেষণ দিয়ে জনতার কাছে জানতে চাইলেন দালালদের ক্ষমা করা হবে কীনা। সবাই হাত তুলে বলল 'না, না'। (পূর্বদেশ 31 মার্চ, '72)। (চলবে)
তথ্যসূত্র : একাত্তরের ঘাতক দালালরা কে কোথায়,
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই জুন, ২০০৮ ভোর ৪:৫২
২১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ঈশ্বরের ভুল ছায়া – পর্ব ৩ | ভূমিকা-ব্রীজ

লিখেছেন শাম্মী নূর-এ-আলম রাজু, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৫ রাত ৯:০৮



"তুমি যদি বাতাসকে ভালোবাসো, তাকে বশ করো না—তার সুর বোঝো। কারণ বাতাস একবার থেমে গেলে, তার কণ্ঠ আর কখনো শোনা যায় না।"

“ঈশ্বরের ভুল ছায়া” সিরিজ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসরায়েলি প্রতিরক্ষার ভবিষ্যৎ ভারতে নিহিত ইসরায়েল ও ভারতের ইসরায়েলি প্রতিরক্ষার ভবিষ্যৎ ভারতে নিহিত

লিখেছেন ঊণকৌটী, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৫ রাত ১০:১৩


উভয় বাজারে নেতৃস্থানীয় শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলির যৌথ প্রকল্পের মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটছে। এটি ইসরায়েলকে পশ্চিমাদের উপর নির্ভরতা কমাতে সহায়তা করছে, যা ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের যুদ্ধে সমস্যাযুক্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

সবার কমন শত্রু আওয়ামী লীগ

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৫ রাত ১১:৫৮


শেখ হাসিনা সবসময় তেলবাজ সাংবাদিকদের দ্বারা বেষ্টিত থাকতেন। তেলবাজ নেতাকর্মীরাও বোধহয় তার পছন্দ ছিল। দেশে কী হচ্ছে, না হচ্ছে, সে সম্পর্কে তার ধারণাই ছিল না। সামান্য কোটাবিরোধী আন্দোলন উনার পক্ষে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক কনফ্লিক্ট জোনে পরিণত করলো ড. ইউনুসের অবৈধ দখলদাররা ‼️

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৫ রাত ২:২১



শেষ পর্যন্ত ড.ইউন তার আন্তর্জাতিক সক্ষমতা প্রদর্শন করে দেখালেন! উনি বাংলাদেশের মানুষের জন্য কখনোই কোন কাজ করেননি ।আমাদের কোনো দুর্যোগে কখনো পাশে দাঁড়িয়েছেন তার কোনো দৃষ্টান্ত নেই । যে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারত একটি মানবিক দেশ

লিখেছেন রাজীব নুর, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৫ দুপুর ১:৩৮



যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন আমরা ভারতবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকব।
ভারতের মানুষের সঙ্গে আমাদের কোনো শত্রুতা নেই। আমরা বাংলাদেশি তোমরা ভারতীয়। আমরা মিলেমিশে থাকতে চাই। ভারতের বাংলাদেশের সাথে সাংস্কৃতিক,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×