সিস্টার সোনিয়া প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে আমাকে ইন্টারকমে ফোন দেয়। “স্যার এভাবে চলে না। সকাল দশটায় ছিল মার্জিয়ার শিডউল। এখন বারোটা বাজে। এখনো আসার নাম নেই। দুই ঘন্টা ধরে মেশিন খালি পড়ে আছে। অন্য কোন পেশেন্টকেও দেওয়া যাচ্ছেনা। আই সি ইউ তে একটা পেশেন্ট ছিল, আগে জানলে এই দুই ঘন্টায় ওটাকে দেওয়া যেত। কোন মানে আছে? এমনিতেই মেশিন অনুযায়ী পেশেন্ট বেশী। রোগীরা নিয়ম না মানলে কি ডায়ালাইসিস ইউনিট শান্তি মত চালানো যায়! ” আমি মার্জিয়ার বাবার মোবাইলে রিং দিলাম।ফোন যায়না, মোবাইল ক্যান নট বি রিচ্ড.....যান্ত্রিক কন্ঠটি শোনা যায়। মনে পড়ে গেল গত সপ্তায় মার্জিয়ার বাবা তার মোবাইল ফোনটি বিক্রি করে দিয়েছে মেয়ের ডায়ালাইসিসের খরচ জোগানোর জন্য। কিন্তু এ সপ্তায় এখনো আসছেনা কেন? হয়তো আবারো টাকার সমস্যা। সিস্টার সোনিয়া আবারো অসহিষ্ঞু হয়ে ওঠে- -স্যার কি করবো? মেশিন কি আই সি ইউ তে নিব?
-আর একটু ওয়েট করেন ।
আমার অস্থির লাগতে থাকে। নিয়তির মতো বিনা নোটিশে একরকম চেপে বসেছে এই ডায়ালাইসিস ইউনিটটা আমার ঘাড়ে। সেটা আরেক গল্প। এখন এর সাথে জড়িয়ে গেছি । ফেলতে পারছিনা, আবার এর লোড ও নিতে পারছি না। দায়িত্ব নিতে আমি ডরাই না । সমস্যা আমার ইমোশনাল লোড নিয়ে। গত সাড়ে তিন বছরে কত রোগীকে চলে যেতে দেখলাম। জুয়েল, শাহানশাহ চাচা, ফারুক ভাই, মনিরুজ্জামান সাহেব -আরো কত নাম! সব এখন মনে ও পড়ছেনা। ডাক্তার হওয়ার অনেক যণ্ত্রণা। জুয়েলের নিষ্পাপ মুখটা এখনোর ভুলতে পারি না। মাত্র বাইশ বছরের একটা ছেলে ......সৌদি আরব গিয়েছিল ওই বয়সে ....বাপ মায়ের দুঃখ ঘোচাবে বলে। ছ মাস পরে ফিরে এসেছে বাপ মায়ের বোঝা হয়ে। ফারুক ভাই সন্ত্রাসী থেকে হয়ে উঠেছিল ভালো মানুষ। চাকরি ও করছিল একটা । হঠাৎ ধরা পড়লে কিডনী ফেইল । সবাই এরকম একেকটি করুন গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র। আমি মাঝে মাঝে সত্যিই ক্লান্ত হয়ে পড়ি।
আমি করিডোরে হাঁটাহাঁটি করতে থাকি। মার্জিয়ার কিছু হলোনা তো! বারোটা বিশ বাজে। হঠাৎ দেখি মার্জিয়া আসছে তার বাবার হাত ধরে । মুখ-চোখ ফোলা , পুরো শরীরেই পানি জমে ঢোল্ হাপাচ্ছে মেয়েটি। আহারে! কিছুদিন আগেও মেয়েটি এই হাসপাতালেরই সিস্টার ছিল। পরম মমতায় সেবা দিয়ে সারিয়ে তুলতো রোগীদের। আর আজ....।
মার্জিয়ার বাবা অপরাধীর মতো মুখ করে আমাকে বললো “ স্যার দেরী হইয়া গেল। একটা গাছ আছিল। বেইচ্চা পাচ হাজার ট্যাকা পাইলাম হ্যারপর আইলাম।’’
(রি পোস্ট)
আমি মার্জিয়ার দিকে তাকালাম। মেয়েটা হাঁপাচ্ছে, শ্বাস কষ্ট হচ্ছে। আমি বললাম, তাড়াতাড়ি ইউনিটে যাও। সোনিয়া মেশিন রেডী করে বসে আছে।
মার্জিয়া চলে গেল। হঠাৎ ওর বাবা একরকম কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে আমার হাতটা ধরে ফেললো। “ স্যার আমার মাইয়াডারে বাচান। চোখের সামনে মাইয়াডা মইরা যাইব....বাপ হইয়া চাইয়া দেখুম। কিডনীডা স্যার পাল্ডানোর ব্যবস্থা কইরা দেন । আমি স্যার আপনের পাও ডা ....”।
“আরে আরে করছেন কি!! ..দেখি কি করা যায়।”আমি এরকম সবাইকেই বলি। শেষ পর্যন্ত আসলে তেমন কিছুই করতে পারিনা। কি আর করার আছে আমার! কিডনী ট্রান্সপ্লান্ট করতে লাগে পাঁচ লাখটাকা। আমি একজন সামান্য বেতন ভুক্ত ছোট ডাক্তার কি আর করতে পারি? বড় জোর ব্লগে একটা পোস্ট দিতে পারি ....যদি কেউ পড়ে , কারো দয়া হয়। কেউ যদি কিছু করতে চায়। এছাড়া আমার আর কিইবা করার আছে ?
(পুনশ্চঃ এখানে আমার ফোন নাম্বার টাও দিলাম, যদি কেউ কিছু করতে চান তো ফোন করতে পারেন এই আশায়- ০১৯১৩৫০০৭২৬)