somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দক্ষিণ আফ্রিকার মুসলমানদের ঈমানদীপ্ত ইতিহাস

০৭ ই ডিসেম্বর, ২০১১ রাত ১২:০৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


দক্ষিণ আফ্রিকায় মুসলমানদের বিশেষ সম্মান আছে, আর সেখানে তাদের অবস্থানও খুব শক্তিশালী। এমন কি যখন বাংলাদেশের মত মুসলিম দেশে কাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষণা করার সাহস হয় না, তখন দক্ষিণ আফ্রিকায় মুসলমানদের মজবুত অবস্থানের কারণে সেখানে সেদেশের আদালত কাদিয়ানীদের অমুসলিম বলে ঘোষণা করেছে। ইতিহাস ঘাটতে গিয়ে তার একটি মুখ্য কারণ পেয়ে গেলাম।



কৃষ্ণাঙ্গরাই মূলত দক্ষিণ আফ্রিকার মূল অধিবাসী। সপ্তদশ খৃস্টাব্দে ডাচরা একদিকে দক্ষিণ আফ্রিকার উপর নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে,অপরদিকে সে সময়ই মালয় ও তার পার্শ্ববর্তী দ্বীপসমূহকে ঔপনিবেশবাদের পাঞ্জায় কষে ধরে। মালয় ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় মুসলমানরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ।সেখানে মুসলমানরা বারবার স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন করতে থাকে,আর ডাচরাও তাদের স্বভাবমাফিক এ সমস্ত আন্দোলনকে সবসময়ই জুলুম-নির্যাতনের মাধ্যমে দমন করে। সেখানকার অনেক মুজাহিদ মুসলমানকে বন্দী করে দাস বানিয়ে রাখা হয়। এতদসত্ত্বেও ডাচদের এই আশংকা ছিল যে, এরা যে কোন সময় বিদ্রোহ করতে পারে। তাই সরকার তাদেরকে দেশান্তর করে কেপটাউন পাঠিয়ে দেয়। যেন স্বদেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে অবস্থান করে তারা চরম অসহায় হয়ে পড়ে। সুতরাং মালয় ও আশেপাশের প্রায় তিন'শ মুজাহিদিকে দাস বানিয়ে পায়ে শিকল পরিয়ে কেপটাউন নিয়ে আসা হয়।




বন্দীন্দের প্রধান শায়খ ইউসুফ

কেপটাউনে মুসলমানদের দ্বারা খুব কষ্ট-সাধ্য কাজ নেয়া হত। ডাচ শাসকগোষ্ঠীর ভাল করেই জানা ছিল যে, তাদের স্বাধীনতা লাভের অদম্য স্পৃহা মূলত তাদের বক্ষ্যস্থিত প্রজ্জ্বলিত ঈমানের উত্তাপে উজ্জীবত। তাই তাদেরকে স্বধর্ম থেকে বিচ্যুত করতে ও তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ঈমানের নূর থেকে বঞ্চিত করতে সবধরণের প্রচেষ্টাই তারা চালায়। নমাজ পড়া তো দূরের কথা , ডাচ মনিবদের পক্ষ থেকে তাদের কালিমা পড়ার অনুমতিটুকুও ছিল না। অসহায় সেই মুসলমানদের থেকে সারাদিন চরম কষ্টসাধ্য কাজ করানো হতো। কোন ব্যক্তি নামাজ কিংবা অন্য কোন ইবাদাতে লিপ্ত হওয়ার দুঃসাহস দেখালে তাকে কঠিন শাস্তি দেওয়া হতো।




কিন্তু এমন চরম নির্যাতনে ও নিপোড়নের মাধ্যমে তাদের অন্তর থেকে ঈমানের প্রদীপ্ত আলো নির্বাপিত করা সম্ভব হয়নি। জুলুম-নির্যাতনের যা৬তায় নিষ্পেষিত হওয়া সত্ত্বেও তারা নিজেদের দ্বীনকে বুকে ধারণ করে রাখেন। চরম অক্ষমতার অবস্থাতেও তারা নামযকে পর্যন্ত ছাড়েননি। সারাদিন কষ্টকর পরিশ্রম করার পর দৃড় সংকল্পী এই মুজাহিদগণ রাতে নিজেদের আবস্থানস্থলে ফিরে যেতেন;তখন ক্লান্তিতে নিথর হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও তাদের তত্ত্বাবধায়কদের ঘুমিয়ে পড়ার অপেক্ষা করতেন। তারা ঘুমিয়ে পড়লে মুজাহিদগণ রাতের অন্ধকারে চুপিসারে অবস্থানস্থল থেকে বের হয়ে একটি পাহাড়ে আরোহণ করে সারাদিনের নামাজ একসঙ্গে পড়ে নিতেন। বর্তমানে কেপটাউনের প্রত্যেক মুসলমান অধিবাসী যে জায়গা সম্পর্কে জানেন, যেখানে নিপীড়িত ও নিগৃহীত এ সমস্ত মুসলমান নিস্তব্ধ নিশীথে স্বীয় মনিবের সামনে সেজদায় লুটিয়ে পড়তেন। প্রাচীন শহর থেকে বেশ দূরে সেই পাহাড়টি। পাহাড়ের মাঝের প্রশস্ত একটি জায়গাকে নিরাপদ মনে করে নিজ প্রভুর সম্মুখে দাসত্বের সেজদাহ করার জন্য তারা নির্বাচিত করেছিলেন। সারাদিনের পরিশ্রমে ক্লান্ত শ্রান্ত মুসলমানদের এখানে এসে নামায পড়া এমন একটি সাধনা, যার কল্পনাও চোখকে করে অশ্রুসিক্ত। এখানকার পরিবেশে আল্লাহ-পাগল সেই মুজাহিদদের যিকির ও তাকবীরের সুরভি আজও অনুভূত না হয়ে পারে না।




প্রায় আশি বছর আল্লাহর এই নেক বান্দাগণ দাসত্বের শিকলে একইভাবে বন্দী থাকেন। দীর্ঘ এ সময়ে তাঁদের মসজিদ বানানো তো দূরের কথা একাকী নামাজ পড়ার অনুমতি ছিল না। অবশেষে এমন একটি সময় আসল,যখন ব্রিটিশরা কেপটাউনের উপর আক্রমণ করে ডাচ জাতি থেকে এ অঞ্চল ছিনিয়ে নিতে চাইল। তারা বিশাল এক সেনাবাহিনী নিয়ে 'উত্তমাশার' কূলে পৌঁছে গেল। এ যেন চোরের ঘরে বাটপারের আগমন। এমতাবস্থায় ডাচ শাসকদের এমন কিছু নিবেদিতপ্রাণ সৈনিকের প্রয়োজন পড়ল,যারা জান বাজি রেখে তাদের পথ রোধ করবে। প্রাণদানের জন্য ভিনদেশী মুসলমানদের চেয়ে অধিক উপযুক্ত কেউ ছিল না। সুতরাং ডাচ সরকার নির্যাতিত ও শোষিত এ সমস্ত মুসলমানের নিকট এ লড়াইয়ে ডাচ সরকারের পক্ষ হয়ে শুধু লড়াই করারই নয়,বরং ইংরেজদের মোকাবেলায় এদের অগ্রবাহিনীর দায়িত্ব পালনের দাবি জানায়।





এ পর্যায়ে এসে এই প্রথমবারের মতো ডাচ সরকারের কাছ থেকে কোন সুবিধা লাভের সুযোগ পেল। কিন্তু এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তারা কোন টাকা পয়সার আবদার করেননি কিংবা নিজেদের জন্য অন্য কোন সুবিধাও চায় চাননি। তারা এসবের পরিবর্তে ডাচ মনিবদেরকে বললেন,'আমাদের জন্য ইংরেজ কিংবা ডাচ শাসকদের মধ্যে যদিও কোন তফাৎ নেই।তবুও আমরা আপনাদের খাতিরে ইংরেজদের সাথে লড়াই করার জন্য প্রস্তুত আছি,যার জন্য আমরা নাজরানা সরূপ আমাদের জান কোরবান করতে পারি, তাহলো, এ লড়াই শেষ হলে আমাদেরকে কেপটাউনে একটি মসজিদ নির্মাণ করার ও সেখানে নিয়মিত জামাতের সাথে নামাজ আদায় করার অনুমতি দিতে হবে। ডাচ সরকার এই শর্ত মেনে নেয়। এভাবে বহু সংখ্যক মুসলমানের জানের বিনিময়ে এখানে একটি মসজিদ বানানোর অনুমতি লাভ করে। এটি ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম মসজিদ, যা ঐ সমস্ত নিপীড়িত, নিগৃহিত ও নির্যাতিত মুসলমানরা নির্মাণ করেন।


সাউথ আফ্রিকার প্রথম মসজিদ আওয়াল মসজিদ

প্রায় তিন'শ বছর পূর্বে নির্মিত এই মসজিদটি এখনো সেই অবকাঠামোতেই রয়েছে,যে অবকাঠামোতে নিবিদিতপ্রাণ নির্মাতাগণ তা নির্মাণ করেছিলেন। মেহরাব এখনও পূর্ববৎ রয়েছে। তার দ্বার-প্রাচীর থেকে তার নির্মাতাদের এখলাসের সাক্ষ্য মেলে। ঘটনাক্রমে কেপটাউন অনেক উন্নতি করলেও এ মসজিদটি পূর্বের সেই সাদামাটা অবস্থায় রয়েছে। এখানকার ইমামগণ আজও সেই বংশ থেকেই নিযুক্ত করা হয়, যাদেরকে মসজিদ নির্মাণের সময় ইমাম বানানো হয়েছিল। একটি মাত্র পার্থক্য এই সৃষ্টি এই হয়েছে , যে সমস্ত সহায়সম্বলহীন মুসলমান এই মসজিদ বানিয়েছিলেন,তাঁদের নিকট কেবলার সঠিক দিক জানার উপযুক্ত কোন যন্ত্র ছিল না,তাই সম্ভবতঃ তারা অনুমানের ভিত্তিতে কেবলার দিক নির্ধারণ করে মেহরাব তৈরি করেন। এখন এখন দিক-নির্ণয়ক যন্ত্রের মাধ্যমে জানা যায় যে, মেহরাব কেবলার সঠিক দিক থেকে বেশ সরানো। তাই এখন নামাজের কাতার মেহরাবের দিক না করে বাঁকা করে কেবলার সঠিক দিকে করা হয়।


আওয়াল মসজিদের প্রথম ইমাম আবদুল্লাহ ইবনে আবদুসসালামের(Tuan Guru Imam Abdullah ibn Qadi Abdussalam) ঢাল-তলোয়ার

এই হলো দক্ষিণ আফ্রিকায় মুসলমানদের অনুপ্রবেশের সূচনা। প্রথম দিকে এখানে মালয় মুসলমানগন আবাদ হন,যাদের বেশিরভাগ কেপটাউনেই বাস করেন। দেশের উত্তর দিকের ট্রান্সুয়াল ও নাটাল প্রদেশে তাদের সংখ্যা ছিল খুব কম।কিন্তু পরবর্তীতে ভারত ,বিশেষ করে সুরাট ও গুজরাটের মুসলমানগণ ব্যবসার উদ্দেশ্যে এখানে আসেন। তারা ট্রান্সুয়াল ও নাটালে বিশেষভাবে অভিবাস গড়ে তুলেন। এভাবে বহু সংখ্যক মুসলমান সমগ্র দক্ষিণ আফ্রিকায় ছড়িয়ে পড়েন। তারপরেও দক্ষিণ আফ্রিকাতে মুসলমানদের সংখ্যা মোট অধিবাসীর তুলনায় পাঁচ-ছয় শতাংশ হবে। তবে এত সামান্য হারের সংখ্যালঘু হওয়া সত্ত্বেও দক্ষিণব আফিকার মুসলমানগণ নিজেদের ধর্মীয় স্বকীয়তা যেই সূক্ষ দৃষ্টির সাথে সংরক্ষণ করেন,তা শত প্রসংসার যোগ্য।


দক্ষিণ আফ্রিকায় শায়খ ইউসুফের নামে ইস্যুকৃত স্ট্যাম্প

শত ঘাত-প্রতিঘাতেও তাঁদের হৃদয়ে ঈমান পায় শোভা
শত আঁধারের মাঝেও দৃষ্টি কাড়ে সেই ঈমানের প্রভা।
এরা আল্লাহর সাচ্ছা বান্দা, তাঁরই ইশকে এরা পাগল
কোন কিছুই এ প্রেমের পথে হতে পারে নি অর্গল।
শত অত্যাচারেও তাঁরা আল্লাহকে যায়নি কো ভুলে
হে খোদা! রেখো তাঁদের তুমি, তোমার রহমতের আঁচলে।

তথ্যসূত্রঃ
1)History of Muslims in South Africa: A chronology -Ebrahim
Mahomed Mahida
2)http://ancestry24.com/first-mosques-at-the-cape/
3)http://v1.sahistory.org.za/pages/places/villages/westernCape/capetown/index.php?id=6
4)জাহানে দিদাহ- শাইখুল ইসলাম আল্লামা তাকী উসমানি (দা.বা)
5) Wikipedia
6)Encyclopedia Britannica
১৭টি মন্তব্য ১৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

গল্প: অপেক্ষা (১ম পর্ব)

লিখেছেন শামীম মোহাম্মাদ মাসুদ, ১৫ ই এপ্রিল, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:৪৭

ফকির আবদুল হাই সাহেবের সাথে পরিচয় হয় যখন আমি অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি তখন। খুবই আধ্যাত্মিক আর রহস্যময় মানুষ। পেশায় একজন অধ্যাপক। অধ্যাপনা ছেড়ে আধ্যাত্মিকতা করেন, ফকির নামটি তার নিজস্ব... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেন বিএনপির বিরুদ্ধে অপপ্রচার.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ১৫ ই এপ্রিল, ২০২৫ রাত ৯:০৮

কেন বিএনপির বিরুদ্ধে অপপ্রচার.....

হোয়াটসঅ্যাপে আমাদের ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক এবং অরাজনৈতিক ১০ জনের একটা গ্রুপ আছে। আমরা বেশীরভাগ সময়ই সমসাময়ীক বিষয় নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করি। গত তিনদিনের আলোচনার বিষয়বস্তু ছিলো বিএনপির... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের মডেল মসজিদ প্রকল্প: রাজনীতি, প্রতারণা ও সমাজের প্রতিচ্ছবি

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৫ ই এপ্রিল, ২০২৫ রাত ১০:২৪


২০১৪ সালের প্রহসনের নির্বাচনের পর শেখ হাসিনার সরকার একটি কৌশলগত সিদ্ধান্ত নেয়। ইসলামপন্থীদের সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে তারা ধর্মীয় আবেগকে কাজে লাগানোর পথ বেছে নেয়। ২০১৩ সালের শাপলা চত্বরের ঘটনা সরকারকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মনের অসুখ

লিখেছেন দানবিক রাক্ষস, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৫ সকাল ৯:১৮

আমার মনে অসুখ ধরেছে
নদীর ওপারে কাশফুল ফুটেছে,
কলাহলের মাঝে একলা আমি,
নিরজন রাতে স্বপ্নের আত্মহুতি,

স্মৃতির জোয়ের আবেগী আমি,
যেথায় শুধু তুমি আর আমি!

চোখে আমার ছানি পড়েছে,
অস্পষ্ট এখন সবই লাগে,
কোমাতে এখন স্বপ্ন,
যা দেখেছিলাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে বিএনপি সন্তুষ্ট না

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৫ বিকাল ৩:০২




নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ জানার জন্য বিএনপি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সংগে বৈঠক করে বলেছে ডিসেম্বর নির্বাচনের কাট অফ সময়। প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো রোডম্যাপ না দেওয়ায় অসন্তুষ্ট... ...বাকিটুকু পড়ুন

×