somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সুবোধ তুমি পালাবে কেন, আমরা আছি তোমার সাথে!

২২ শে আগস্ট, ২০১৭ দুপুর ১২:৫২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা, এখন সময় পক্ষে না’, ‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা তোর ভাগ্যে কিছু নেই’ কিংবা ‘সুবোধ এখন জেলে! পাপবোধ নিশ্চিন্তে করছে বাস মানুষের হৃদয়ে’ -এই কথাগুলো এখন লেখা দেখা যাচ্ছে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানের দেওয়ালে। শহরের দেয়াল থেকে উঠে আসা সুবোধ এখন ভার্চুয়াল জগতেও এক পরিচিত নাম। কে বা কারা আঁকছে এই সুবোধকে, তা নিয়ে কৌতুহলও কম না।
উসকো-খুসকো চুল-দাড়ির পাগলাটে চেহারার এক যুবক, উদ্ভ্রান্তের মতো দৃষ্টি যার চোখে। ছুটছে সে টকটকে লাল সূর্য নিয়ে। খাঁচায় বন্দী সেই সূর্যকে হাতে নিয়ে প্রাণপণে পালিয়ে বেড়াচ্ছে সে। আর চিহ্ন রেখে যাচ্ছে নগরের দেয়ালে দেয়ালে। কে সে? কে এই সুবোধ? কেন তাকে পালিয়ে যেতে বলা হচ্ছে? এই শহর থেকে নাকি সময় থেকে তাকে পালাতে বলা হচ্ছে? কিংবা কারাই বা এসব বলছে সুবোধকে? শহরের বিভিন্ন দেয়ালে দেয়ালে আঁকা এসব গ্রাফিতিতে দেখা যাচ্ছে, কখনো একজন লোক ছুটে যাচ্ছে, কখনো সে বন্দি আছে, কখনো দাঁড়িয়ে আছে খাঁচা হাতে, সেই খাঁচার ভেতর টকটকে লাল সূর্য। আর এই লোকটির নামই সুবোধ। গ্রাফিতিতে সুবোধের ছবির পাশে লেখা থাকে দু-একটি লাইন। মূলত মিরপুর এলাকাতেই সুবোধের গ্রাফিতিগুলো দেখা গেছে। এসব ছবির কোনো কোনোটিতে দেখা গেছে, সুবোধ তুই পালিয়ে যা, মানুষ ভালোবাসতে ভুলে গেছে, কোনটিতে লেখা ‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা তোর ভাগ্যে কিছু নেই’, সুবোধকে কারাগার বন্দি হিসেবে আকা ছবিতে লেখা ছিল, ‘সুবোধ এখন জেলে! পাপবোধ নিশ্চিন্তে করছে বাস মানুষের হৃদয়ে’ এমন নানা ধরনের লেখা দিয়ে সুবোধের ছবি আঁকা। আর ছবির নিচে লোগো আকারে দেখা গেছে- HOBEKI (হবেকি) লেখা।
সুবোধ চরিত্রটি এবং তার আঁকিয়েরা একটি রহস্যময় আবহ তৈরি করেছে অনেকের কাছেই। ‘সুবোধ’-এর এই দেয়ালচিত্র অনেক পথচলতি মানুষের আগ্রহের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এই দেয়ালচিত্রের মাধ্যমে কী বার্তা দেওয়া হচ্ছে, তা জানতেও কৌতূহলী হয়ে উঠছেন তাঁরা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকেও ছড়িয়ে পড়েছে এই চিত্রগুলো। সেখানে অনেকেই সুবোধ এবং এর আঁকিয়ে কিংবা আঁকিয়েদের পরিচয় জানতে কৌতূহলী হয়ে উঠেছেন। সুবোধকে নিয়ে এই গ্রাফিতিকে মাথায় রেখে গান আর কবিতাও লেখা হচ্ছে। অজানা এই শিল্পীর এই গ্রাফিতি কেন এভাবে সমাজের এক কোণে হলেও নাড়া দিল? কেন দেয়াল থেকে উঠে এল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বা সামাজিক ফোরামে, উঠে এল পত্রিকায় পাতায়, টেলিভিশনের পর্দায়। স্যোশাল মিডিয়ার নিজেকে জাহির করার এ যুগে কে বা কারা নিভৃতে সুবোধকে দেয়ালের পটে এঁকে যাচ্ছেন, তার খোঁজ জানেন না কেউ। লোকচক্ষুর আড়ালে থেকেই হয়তো মানুষের জন্য কথা বলতে ভালোবাসেন সুবোধের কারিগর। জনসম্মুখে এমন কাজ হয়তো তাকে সময়ের নিয়ন্ত্রকদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেবে। তাই অগোচরে থেকে তার এ প্রতিবাদ সাধারণের কাছে আরো ব্যঞ্জনাময় হয়ে ওঠে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দুনিয়াজুড়েই বাজারি শিল্পকলার বাইরে এই গ্রাফিতি বা দেয়ালচিত্র এবং নানান ধরনের ‘স্ট্রিট আর্ট’ বা পথশিল্প খুবই জনপ্রিয়। এর ইতিহাস এতই পুরোনো যে প্রাচীন মিসর, গ্রিস ও রোমান সাম্রাজ্যে এর নিদর্শন আছে। এই শিল্পকর্মগুলোর মূল উপজীব্য সমসাময়িক বিভিন্ন রাজনৈতিক কিংবা সামাজিক ঘটনা। ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের ভেতর দিয়ে কখনো এগুলোতে ফুটিয়ে তোলা হয় যুদ্ধবিরোধী বক্তব্য কিংবা শান্তির বার্তা। কখনো এটি হয়ে ওঠে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, প্রচলিত নীতি কিংবা সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের শৈল্পিক রূপ হিসেবে। কখনো হয়ে ওঠে নাগরিক অধিকার আদায়ের হাতিয়ার। গ্রাফিতি-শিল্পীদের কাছে পৃথিবীর সব দেয়ালই একেকটা ক্যানভাস। তবে চিত্রকলার এই ‘অপ্রথাগত’ মাধ্যমটির সমালোচনাও কম নয়। অনেক দেশে গ্রাফিতি নিষিদ্ধ।
প্রসঙ্গতঃ নব্বইয়ের দশকে, বিশেষ করে ঢাকা বিশ্বিবদ্যালয় এলাকায় ‘কষ্টে আছি—আইজুদ্দিন’—দেয়াল লেখাটি বেশ নজর কেড়েছিল। পরের দশকে দেখা গেল আরেকটি দেয়াল লিখন—‘অপেক্ষায়...নাজির’। তখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে মিলিয়ে অনেকে এগুলোকে ব্যাখ্যা করতেন।
গ্রাফিটিগুলো আঁকতে ব্যবহার করা হয়েছে স্টেনসিল। যুক্তরাজ্যের পথে পথে রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে স্যাটায়ারধর্মী গ্রাফিটি এঁকে প্রতিবাদ করেন ব্যাংকসি। তার গ্রাফিটিগুলো বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে অল্প সময়েই। গ্রাফিটি আঁকতে ব্যাংকসি স্টেনসিল ব্যবহার করতেন। এত জনপ্রিয়তার পরেও নিজের প্রকৃত নাম বা পরিচয় প্রকাশ করেননি ব্যাংকসি। শহরের দেয়ালে গ্রাফিটি আঁকা পৃথিবীর অনেক দেশেই নিষিদ্ধ। তাই ২০১৪ সাথে খবর এসেছিল, লন্ডন পুলিশ বাংকসিকে গ্রেফতার করেছে গ্রাফিটি আঁকার দায়ে। পরে জানা গিয়েছিল খবরটি সত্যি নয়! অনেকে সুবোধের এ গ্রাফিটিগুলোকে বিলেতের বিখ্যাত দেয়াল চিত্রকর ব্যাঙ্কসির গ্রাফিটিগুলোর সাথে তুলনা করতে চান। আঁকার মাধ্যমের ক্ষেত্রে অবশ্য তা মিলে যায়। ব্যাঙ্কসির আঁকা ছবিগুলো স্টেন্সিল ব্যবহার করে, সুবোধেরও তাই। কিন্তু মূল্যবোধ আর প্রতিবাদের প্রশ্নে তারা ভিন্ন। ব্যাঙ্কসি রাষ্ট্রকে ব্যঙ্গ করে ছবিগুলো আঁকতেন। সামাজিক এবং অর্থনৈতিক বিভিন্ন ইস্যুতে দেয়ালের পটে তিনি নিজস্ব প্রতিবাদ গড়ে তুলতেন। অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে তার গ্রাফিটিগুলো চিৎকার করতো।

পৃথিবীজুড়ে এখন এক অদ্ভুত অাঁধার নেমেছে। অনেক বেশি অন্ধকার, অনেক গাঢ় অন্ধকার। এ অন্ধকারে কেবল মৃত, গলিত, পচা এইসব নষ্টে ভরে থাকে নগরীর রাস্তা। তাদের কাছ থেকে সুবোধ পালতে পারে। এই অাঁধারে বুড়ো প্যাঁচারাও নেমে গেছে শিকারে। তাদের সামনে সুবোধ আর ইঁদুর এক হয়ে গেছে। তারা ধর্মের নামে উন্মাদ, তারা নারী লোলুপ, নারীর কথা বলতে তাদের মুখ দিয়ে লালা আসে। অথচ তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর মনোজগতটি এ মুহূর্তে মৃত। তাদের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ হচ্ছে তা শুধু স্বার্থের লড়াই; সত্য ও সুন্দরকে প্রতিরক্ষার লড়াই নয়। তাই সে পালাচ্ছে কারণ সময় এখন পক্ষে না।’ কিন্তু পালিয়ে যাওয়াতে কোনও সমাধান নেই। সুবোধকে এই শহরে, এই দেশেই রয়ে যেতে হবে। সুবোধ যদি পালিয়ে যায়, আইজুদ্দিন যদি দেশান্তরি হয় তবে এই শহর, দেশ যে আর মানুষের রইবে না। সব চলে যাবে নষ্টের দখলে, রাজ্য হবে নষ্টদের। আমরা সুবোধকে পালাতে দিতে পারি না। আমরা বরং প্রেমার্ত আত্মার আর্তিতে চিৎকার করে বলতে চাই, সুবোধ তুই থাম, ফিরে আয়, ঘুরে দাঁড়া! নষ্টদের রুখে দাঁড়াতে নষ্টামির প্রতিরোধ করতেই সুবোধকে বলতে হবে- পালাবে না সুবোধ, রুখে দাঁড়াতেই হবে।
তবে আশার কথা আমাদের বর্তমান সুবোধ পালালেও সে আশা জাগানিয়ার বার্তা দিয়ে পালায়। সে তার নিজের খাঁচায় করে একটি সূর্যকে নিয়ে পালায়। এই খাঁচাও আসলে শিল্পীর নিজের মন। যে মনের খাঁচাতে তিনি সূর্যকে নিয়ে যাচ্ছেন। আপন বুকের ভেতর গোটা সূর্যের আলোটাকে নিয়ে কোনো এক অজানার পথে পালাচ্ছেন। সুবোধ জানে কোনো রাত্রি চিরকালের জন্য আসে না। সূর্য যখন সঙ্গে, শেষ অবধি সুবোধের চোখেই তো দেখা যাবে সূর্য উঠেছে, নতুন ভোর এসেছে। পালিয়ে যাওয়াতে কোনও সমাধান নেই। তাই পালায়ন নয় হোক প্রতিরোধ।

সম্পাদনাঃ নূর মোহাম্মদ নূরু
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে আগস্ট, ২০১৭ দুপুর ২:৪৬
১৫টি মন্তব্য ১২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হাসান মাহমুদ গর্ত থেকে বের হয়েছে

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১২


যুক্তরাষ্ট্রের একটি বাংলা টেলিভিশন চ্যানেল হাসান মাহমুদের সাক্ষাৎকার প্রচার করেছে। আমি ভাবতেও পারি নাই উনি এতো তারাতারি গর্ত থেকে বের হয়ে আসবে। এই লোকের কথা শুনলে আমার গায়ের লোম... ...বাকিটুকু পড়ুন

দারিদ্রতা দূরীকরণে যাকাতের তাৎপর্য কতটুকু?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১৮



দরিদ্র দূরীকরণে যাকাতের কোনো ভূমিকা নেই।
যাকাত দিয়ে দারিদ্রতা দূর করা যায় না। যাকাত বহু বছর আগের সিস্টেম। এই সিস্টেম আজকের আধুনিক যুগে কাজ করবে না। বিশ্ব অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

শেখস্তান.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:১৫

শেখস্তান.....

বহু বছর পর সম্প্রতি ঢাকা-পিরোজপু সড়ক পথে যাতায়াত করেছিলাম। গোপালগঞ্জ- টুংগীপাড়া এবং সংলগ্ন উপজেলা/ থানা- কোটালিপাড়া, কাশিয়ানী, মকসুদপুর অতিক্রম করার সময় সড়কের দুইপাশে শুধু শেখ পরিবারের নামে বিভিন্ন স্থাপনা দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের বিয়ের খাওয়া

লিখেছেন প্রামানিক, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৪৮


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

১৯৬৮ সালের ঘটনা। বর আমার দূর সম্পর্কের ফুফাতো ভাই। নাম মোঃ মোফাত আলী। তার বিয়েটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। বাবা ছিলেন সেই বিয়ের মাতব্বর।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিএনপি-আওয়ামী লীগের মধ্যে মৈত্রী হতে পারে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০০


২০০১ সাল থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত আওয়ামী লীগের ওপর যে নির্যাতন চালিয়েছে, গত ১৫ বছরে (২০০৯-২০২৪) আওয়ামী লীগ সুদে-আসলে সব উসুল করে নিয়েছে। গত ৫ আগস্ট পতন হয়েছে আওয়ামী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×