somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চারণ কবি মুকুন্দ দাসের ৮১তম মৃত্যুৃবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি

১৭ ই মে, ২০১৫ বিকাল ৪:৫০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


হাসি হাসি পরবো ফাঁসী
দেখবে জগৎ বাসী,
বিদায় দে মা ঘুরে আসি।

ক্ষুদিরামের ফাঁসী উপলক্ষে রচিত এই অমর গানের স্রস্টা যিনি, তিনি কবি মুকুন্দ দাস। যাকে চারণ কবি বলেও অভিহিত করা হয়। তার প্রকৃত নাম যজ্ঞেশ্বর দে। চারণ কবি মুকুন্দ দাস ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা। তিনি অন্ধ-কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙ্গে দেশ মাতৃকার সাধনায় জাতিকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। জেল-জুলুমের সমস্ত বেদনা হার মেনেছিল তার সংগ্রামী চেতনার কাছে। এই বাংলায় তিনি স্বাধীনতার স্বপ্ন বুকে নিয়ে জাগরণী গান শুনিয়ে সাধারণ জনগোষ্ঠীকে অনুপ্রাণিত করেছেন। মুকুন্দ দাস স্বদেশী ও অসহযোগ আন্দোলনের সময় বহু স্বদেশী বিপ্লবাত্মক গান ও নাটক রচনা করে খ্যাতি অর্জন করেন। গানে গানে অত্যাচারী ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে তুলেছিলেন ঝংকার। তার গানের এতই ধার ছিল যে ব্রিটিশরা তাকে তার গানের জন্য জেলে পুরতে বাধ্য হয়েছিল। তেজোদীপ্ত চারণ কবির কথা বিস্মৃত হয়েছে আমাদের বর্তমান রি-মিক্স প্রজন্ম। আজ চারণ কবি মুকুন্দ দাসের ৮১তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৩৪ সালের আজকের দিনে তিনি মৃত্যুৃবারণ করেন। মৃত্যুবার্ষিকীতে চারণ কবি মুকুন্দ দাসের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।


স্বদেশী যাত্রার প্রবর্তক মুকুন্দ দাস ১৮৭৮ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা জেলার বিক্রমপুর পরগণার বানরী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম গুরুদয়াল দে এবং মাতার নাম শ্যামাসুন্দরী দেবী। মুকুন্দ দাসের বাবার দেওয়া নাম ছিল যজ্ঞেশ্বর দে এবং ডাক নাম ছিল যজ্ঞা। তবে মুকুন্দ দাস নামেই তিনি খ্যাত হন। বরিশালে বৈষ্ণব সন্ন্যাসী রামানন্দ অবধূত যজ্ঞেশ্বরের গলায় হরিসংকীর্তন ও শ্যামাসঙ্গীত শুনে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে দীক্ষা দিয়ে তাঁর নাম রাখেন মুকুন্দদাস। এ ছাড়াও আসামের এক প্রতিষ্ঠান তাকে 'চারণসম্রাট' উপাধিতে ভূষিত করেছিল। মুকুন্দ দাসের পিতা গুরুদয়াল বরিশালে চাকরি করতেন। মুকুন্দ দাসের জন্মের পর বিক্রমপুরের বানরী গ্রাম পদ্মা নদীতে তলিয়ে গেলে তাঁরা সপরিবারে গুরুদয়ালের চাকরিস্থল বরিশাল শহরে চলে আসেন। শৈশব থেকে মুকুন্দ পিতার সঙ্গে বরিশালে ছিলেন। ফলে সেখানকার বাসিন্দারূপেই তিনি পরিচিত হন। বরিশালের ব্রজমোহন বিদ্যালয়ে মুকুন্দকে ভর্তি করানো হলেও পড়াশোনায় তেমন অগ্রগতি হয়নি। বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা দেশব্রতী অশ্বিনীকুমার দত্তের সঙ্গে কিশোর বয়সেই মুকুন্দের পরিচয় হয়। চাকরি থেকে অবসর নিয়ে গুরুদয়াল একটি ছোট মুদির দোকান দিয়েছিলেন। এই দোকানটি নিয়েই মুকুন্দের কর্মজীবন শুরু হয়। সে সময় বরিশালের নাজির ছিলেন বীরেশ্বর গুপ্ত। তিনি ছিলেন সুকণ্ঠ কীর্তনীয়া। তার কীর্তনের দল ছিল। মুকুন্দ তার দলে যোগ দেন ও শিগগিরই কীর্তন গায়করূপে সুখ্যাতি অর্জন করেন। বীরেশ্বর গুপ্ত মারা গেলে মুকুন্দ নিজেই কীর্তনের দল গঠন করেন ও নানা স্থানে কীর্তন পরিবেশন করতে থাকেন। তার গান রচনাও শুরু হয় সে সময় থেকেই। ১৯০৩ সালে 'সাধন সঙ্গীত' নামে মুকুন্দ দাসের একটি গানের বই বরিশাল থেকে প্রকাশিত হয়। তাতে শতাধিক গান স্থান পায়। এ হচ্ছে মুকুন্দ দাসের জীবনের প্রথম পর্যায়। দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয় কালীসাধক সনাতন চক্রবর্তী ওরফে সোনা ঠাকুরের প্রেরণায়। এই সময়েই তার মধ্যে প্রবল দেশাত্মবোধক প্রেরণা দেখা দেয়। দেশের মানুষকে পরাধীনতার বিরুদ্ধে ও নানা প্রকার সামাজিক দুর্দশার বিরুদ্ধে সচেতন করার উদ্দেশ্যে তিনি গান ও যাত্রা রচনায় মনোনিবেশ করেন।


(বরিশালের প্রাণকেন্দ্র নথুল্লাবাদে চারণ কবি মুকুন্দ দাস প্রতিষ্ঠিত কালিবাড়ি)
বরিশালের অশ্বিনীকুমার দত্তের সংস্পর্শে রাজনীতিতে আকৃষ্ট হন মুকুন্দ দাস। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বরিশালে তুমুল ইংরেজবিরোধী বিক্ষোভ দেখা দেয়। মুকুন্দ দাস নিজে এই বিক্ষোভে অংশ নেন ও ইংরেজবিরোধী বক্তব্য প্রকাশ করে এবং একের পর এক গান, কবিতা ও নাটক রচনা করে বাঙ্গালীর জাতীয় জীবনে নূতন উদ্দীপনার সঞ্চার করেন। তিনি অশ্বিনীকুমারের আগ্রহে মুকুন্দদাস মাতৃপূজা নামে একটি নাটক রচনা করেন। দুর্গাপূজার মহাসপ্তমীতে নবগ্রামে এই নাটকের প্রথম প্রকাশ্য যাত্রাভিনয় হয়। সুঅভিনেতা মুকুন্দ নিজেই স্থানে স্থানে এই পালা অভিনয় করে বেড়াতে থাকেন। ইংরেজদের বিরুদ্ধে জনগণকে ক্ষেপিয়ে তোলার অভিযোগে ইংরেজ সরকার এই পালা রচনা ও প্রচারের জন্য মুকুন্দ দাসকে প্রেপ্তার কর এবং সরকার মাতৃপূজা নাটকটি বাজেয়াপ্ত করে। বিচারে মুকুন্দ দাসের তিন বছরের সশ্রম কারাদন্ড হয়। কিছু দিন বরিশাল জেলে রাখার পর মুকুন্দ দাসকে দিল্লি জেলে স্থানান্তরিত করা হয়। মুকুন্দ দাস কারাবসে থাকাকালীন তাঁর স্ত্রী সুভাষিণী দেবীর মৃত্যু ঘটে।


তিন বছর পর জেল থেকে মুক্তিলাভের পর মুকুন্দ দাস বরিশালে ফিরে আসেন। এ সময় চিত্তরঞ্জন দাশ ও সুভাষচন্দ্র বসুর অনুপ্রেরণায় নতুন করে যাত্রার দল গঠনে উদ্যোগী হন এবং পুনরায় পালা রচনায় মনোনিবেশ করেন। ১৯১৬ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের আমন্ত্রণে মুকুন্দ দাস তার যাত্রার দল নিয়ে কলকাতা যান। কলকাতা ইউনিভার্সিটি ইন্সটিটিউট হলে সে দলের অভিনয় হয়। মহাত্মা গান্ধী আহূত অসহযোগ আন্দোলনের সময় মুকুন্দ দাস মাতৃপূজা কর্মক্ষেত্র, পল্লীসেবা প্রভৃতি যাত্রাপালা রচনা করেন। এছাড়াও মুকুন্দদাসের রচনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলঃ সমাজ, আদর্শ, সাথী, ব্রহ্মচারিণী, পথ ইত্যাদি। মুকুন্দ দাসের এসব যাত্রাপালাকে বাংলা নাট্যসাহিত্যে সংগ্রামী সংযোজনরূপে গণ্য করা হয়। দেশ বিখ্যাত চারণ কবি ও স্বদেশী পল্লী অঞ্চলের তৃণমূল মানুষের সুখ দুঃখের কাহিনীর গান ও ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের কবি মুকুন্দ দাশ এর অবদান অপরিসীম। মানুষের মধ্যে দেশপ্রেম জাগাতে, দেশের পরাধীনতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার প্রেরণা জোগাতে তিনি গান গেয়ে ও যাত্রাভিনয় করে স্থানে স্থানে ঘুরে বেড়িয়েছেন। মুকুন্দ দাস কলিকাতা থাকাকালে একবার বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার সঙ্গে দেখা করেন।তিনি তাকে গান গেয়ে শোনান ও তার লেখা কয়েকটি বই উপহার দেন।


১৯৩৪ সালের ১৮ মে কলকাতায় যাত্রা পরিবেশন করতে গেলে মুকুন্দ দাস হঠাৎ অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিলো ৫৬বছর বছর। আজ চারণ কবি মুকুন্দ দাসের ৮১তম মৃত্যুবার্ষিকী। ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ কবি মুকুন্দ দাসের মৃত্যুবার্ষিকীতে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই মে, ২০১৫ সকাল ১০:৫০
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ভারতীয় পতাকার অবমাননা

লিখেছেন সরলপাঠ, ০২ রা ডিসেম্বর, ২০২৪ ভোর ৪:৪৩

বাংলাদেশের ২/১টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতীয় পতাকার অবমাননা আমার কাছে ছেলেমী মনে হয়েছে। ২০১৪ সাল থেকে ভারত বাংলাদেশের রাজনীতিতে সরাসরি হস্তক্ষেপ করার কারণে বাংলাদেশের মানুষের মনে প্রচন্ড রকমের ভারত বিদ্বেষ তৈরি হয়েছে।

কিন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভিসা বন্ধ করায় ভারতকে ধন্যবাদ।

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০২ রা ডিসেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩



ভারত ইদানীং ভিসা দিচ্ছেনা; তারা ভিসা না দিয়ে আমাদেরকে শিক্ষা দিতে চায়! তাদের করদ রাজ্য হাতছাড় হওয়া খুবই নাখোশ, এতোই নাখোশ যে মোদী মিডিয়া দিনরাত বয়ান দিচ্ছে এই দেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতের চিকিৎসা বয়কট এবং

লিখেছেন পবন সরকার, ০২ রা ডিসেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:৫৬


ভারতের এক হাসপাতাল ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশের কোন রুগিকে তারা চিকিৎসা দিবে না। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো যে হাসপাতাল থেকে এই ঘোষণা দেয়া হয়েছে সেই হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়ার জন্য বাংলাদেশের... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। চামচা পুঁজিবাদ থেকে চোরতন্ত্রে পরিণত হয়েছিল দেশ

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০২ রা ডিসেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৩:১৩






চামচা পুঁজিবাদ থেকে দেশ চোরতন্ত্রে পরিণত হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনৈতিক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, আমলা, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা মিলে চোরতন্ত্র করেছে।

সোমবার... ...বাকিটুকু পড়ুন

শেখ হাসিনাকে ভারত ফেরত পাঠাবে তবে............

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০২ রা ডিসেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৩:৪২


শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে বিচারের জন্য ভারতের কাছে ফেরত চাইতে হলে অবশ্যই বাংলাদেশকে প্রতিহিংসামূলক বিচারপদ্ধতি বাদ দিতে হবে। বিচারে শেখ হাসিনা যাতে ন্যায় বিচার পান বাংলাদেশকে আগে তা নিশ্চয়তা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×