somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সাক্ষী ছিলো শিরস্ত্রান (বুক রিভিউ-০১)

০৯ ই জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ১০:৪৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



কোনো এক অজানা কারনে তাজউদ্দিন আহমদ আমার ভীষন প্রিয় একজন মানুষ। শুধু প্রিয় নন, তিনি আমার কাছে “পিতাসম প্রিয়”। এদেশের মুক্তিযুদ্ধের যে কোনো বইতে তার উপস্থিতি অনিবার্য ভাবে রয়েছে। কিন্তু আমি চাইছিলাম এমন একটা বই যেটা লেখা হয়েছে কেবল তাজউদ্দিন আহমদকে নিয়ে। কেননা আমি তো ব্যক্তি তাজউদ্দিন কে জানতে চাই। হ্যাঁ, পেয়েও গেলাম। গতবছর শুদ্ধস্বর থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাজউদ্দিন আহমদকে নিয়ে লেখা সুহান রিজওয়ান এর বই “সাক্ষী ছিলো শিরস্ত্রান”। সুহান লেখক হিসেবে বেশ দক্ষতার সাথে উপন্যাসটিকে প্রাণবন্ত করেছেন ইতিহাসের বিভিন্ন তথ্যের মোড়কে। সুহানের সাড়ে তিন বছরের পরিশ্রমের ফসল এই বইটি, তার নাম লিখে দিয়েছে ইতিহাসে বাংলা সাহিত্যের পাতায়।

আমার কাছে তাজউদ্দিন এমন একজন যিনি আমাকে বড় করেছেন, বিকশিত করেছেন। অবিচল, পরিশ্রমী, সৎ, নিষ্ঠাবান, ধৈর্য্যশীল এই মানুষটার কথা আমি কোথা থেকে শুরু করবো বুঝতে পারছি না। তাকে যত পড়েছি তত কেঁদেছি। একজন মানুষ এতখানি নির্মোহ হতে পারে! কীভাবে সম্ভব। সাহসী, সাবলীল, বুদ্ধিদীপ্ত এই মানুষটা কোনো ভাবেই পলিটিশিয়ান ছিলেন না, ছিলেন একজন স্টেটসম্যান।

বঙ্গবন্ধু’র নির্দেশে ২৫ মার্চ আমীর-উল-ইসলামের সাথে ঘর ছাড়েন তাজউদ্দিন।সাথে নেন একটা ছোট্ট ব্যগে কয়েকটি কাপড় আর নিজের ব্যবহ্রত পিস্তলটা। ২৭ বছর ধরে যে বঙ্গবন্ধুর সাথে তিনি রাজনীতির পথ হাটছেন, তাঁর নির্দেশ অমান্য করা তাজউদ্দিনের পক্ষে সম্ভব নয়। তিনি পেছনে রেখে গেলেন, তার স্ত্রী জোহরা তাজউদ্দিন এবং তিন মেয়ে ও এক ছেলে কে। যাবার সময় শুধু বলে গেলেন, “ আমি আসি লিলি। তোমরা লুকিয়ে পড়ো কোথাও”। কিছু সময় পরে নেমে এলো বাঙ্গালী জাতি’র সেই ভয়ংকর কালরাত। যেটা নিয়ে ‘নিউ ইয়ার্ক টাইমস’ হেডলাইন করেছিল, “রক্তই যদি কোনো জাতির স্বাধীনতার অর্জনের দাম বলে বিবেচিত হয়, তবে বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই অনেক বেশি দাম দিয়েছে”। বন্দি হলেন শেখ মুজিবর রহমান। ৩০মার্চ সীমান্তের নো-ম্যানস ল্যান্ডের কাছে, জীবননগর, টঙ্গি খালে অপেক্ষা করছেন তাজউদ্দিন, ভারতে প্রবেশের অনুমতির।

“লিলি (জোহরা তাজউদ্দিন), আমি চলে গেলাম।যাবার মুহূর্তে কিছু বলে আসতে পারি নাই, মাফ করে দিয়ো। পরিবার নিয়ে তুমি সাড়ে সাত কোটি মানুষের মাঝে মিশে যেয়ো। কবে দেখা হবে জানি না…… মুক্তির পর”। অসম্ভব আশাবাদী এই মানুষটার জন্ম ১৯২৫ সালের ২৩ জুলাই গাজীপুর জেলার কাপাসিয়ার দরদরিয়া গ্রামে। তাঁর পিতা মৌলভী মোঃ ইয়াসিন খান এবনহ মাতা মেহেরুন নেসা খান।৪ ভাই, ৬ বোনের মাঝে ৪র্থ তাজউদ্দীন আহমদের পড়াশোনা শুরু বাবার কাছে আরবি শিক্ষার মাধ্যমে। এই সময়ে ১ম শ্রেণীতে ভর্তি হন বাড়ির দুই কিলোমিটার দূরের ভূলেশ্বর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে৷ ১ম ও ২য় শ্রেণীতে ১ম স্থান অর্জন করেন৷ ৪র্থ শ্রেণীতে ভর্তি হন বাড়ি থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরের কাপাসিয়া মাইনর ইংলিশ স্কুলে। এরপর পড়েছেন কালিগঞ্জ সেন্ট নিকোলাস ইনস্টিটিউশন, ঢাকার মুসলিম বয়েজ হাই স্কুল ও সেন্ট গ্রেগরিজ হাই স্কুলে৷ তিনি ম্যাট্রিক (১৯৪৪) ও ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ থেকে অবিভক্ত বাংলার সম্মিলিত মেধাতালিকায় যথাক্রমে দ্বাদশ ও চতুর্থ স্থান (ঢাকা বোর্ড ) লাভ করেন। ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে বি.এ (সম্মান) ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৬৪ সালে রাজনৈতিক বন্দী হিসেবে কারাগারে থাকা অবস্থায় এল.এল.বি. ডিগ্রীর জন্য পরীক্ষা দেন এবং পাস করেন। তাঁর স্ত্রী সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দিন। তাঁদের ৪ সন্তান রয়েছে। বড় মেয়ে শারমিন আহমদ রিপি ; মেজো মেয়ে সিমিন হোসেন রিমি বিশিষ্ট লেখিকা ও এবং কনিষ্ঠা মেয়ে মাহজাবিন আহমদ মিমি। পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ সন্তান তানজিম আহমেদ সোহেল তাজ।

সৈয়দা জোহরার প্রথম বিয়েটার পরিসমাপ্তি ছিল অনাকাংক্ষিত। পরে তার বান্ধবী অনু এবনহ তার স্বামী ইসলাম সাহেবের মধ্যস্ততায় তাজউদ্দিন আহমেদ এর সাথ জোহরার বিয়ে হয়। তিনি জোহরা কে বিয়ে করতে চান। জোহরা অবাক হয়েছিলেন, প্রশ্ন রেখেছিলেন সাথে সাথেই। কেন? নিজে ব্যাচেলর হবার পরও একদা বিয়ে হওয়া কাউকে কেন পেতে চাইছেন তিনি? তাজ উদ্দিন কি জোহরা কে মহত্ত্ব দেখাতে চাইছেন, করুনা করছেন? চশমার আড়াল থেকে তাজউদ্দিন একটা কেমন দৃষ্টি দিয়েছিলেন জোহরার দিকে। সেই দৃষ্টি, যা বুঝিয়ে দিয়েছিল জোহরার আশংকা অর্থহীন, প্রশ্নটাও অপ্রয়োজনীয়। জোহরা বলেছিলেন, ‘সোনার গয়না লাগবে না আমার। আমার পছন্দ বেলি ফুল।বেলি ফুল দিয়েই বিয়ে হোক আমার’। তাজউদ্দিন হাসতে হাসতে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আচ্ছা, তাই সই!’ একরাশ বেলিফুল তাই সেদিন হয়ে উঠেছিল জোহরা আর তাজউদ্দিনের সঙ্গী।

আমীর-উল-ইসলামের প্রস্তাবেই মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পক্ষে মত দেন তাজউদ্দিন আহমদ। রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবর রহমান, ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপরি সৈয়দ নজরুল ইসলাম।“কাপাসিয়ার ছোট্ট যে ছেলেটা গজারিবনের মাঝে দিয়ে হেঁটে যেত স্কুলে, মুজিব নগরের আম্রকানন দিয়ে ছুটতে থাকা জিপগাড়িতে বসে সে এই মুহূর্তে ভাবে, পথের শুরু হলো মাত্র, যেতে হবে আরও বহু দূর। যে ছেলেটি এতদিন ভুলেশ্বর প্রাইমারি স্কুলের ক্লাস ওয়ান থেকে টু’তে ওঠার সময় ফার্স্ট প্রাইজ দেড় পয়সার কালির দোয়াত আর সাড়ে আট পয়সার কলমকেই ভেবে রেখেছে তার জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন, বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হয়ে তিনি অনুভব করেন, স্বাধীনতা অর্জনের সাথে আর কোনো প্রাপ্তি-ই তুলনীয় নয়”। ভুট্টো’র “লিসেন। আই ডোন্ট গিভ আ ড্যাম অ্যাবাউট শেখ মুজিব,’ রক্তলাল চোখে চিবিয়ে চিবিয়ে বলেছলেন ভুট্টো। ‘ ইমোশনাল অ্যাপ্রোচে তাকে দমিয়ে ফেলা যায়। বাট… দ্যাট লিটিল ম্যান বিহাইন্ড হিম, দ্যাট লিটল নটোরিয়াস ম্যান, ফাইল হাতের ঐ তাজউদ্দিন, তাকে আটকানো বড় শক্ত। দিস গাই ইজ ভেরি থরো। দিস তাজউদ্দিন, আই টেল ইউ, উইল বিকাম ইউর মেইন প্রবলেম!” বলবেই বা না কেন, যুক্তির লড়াইয়ে এই ভুট্টোকে হার মানিয়েছে যে মানুষ তিনি তো তাজউদ্দিন।

বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী মন্ত্রীসভার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দিনের দুইশত ছেষট্টিদিনের যে পথ চলা তা মোটেও মসৃ্ন ছিলো না। প্রতিটি পদক্ষেপে তাকে কান্ডারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়েছিল। ভুট্টো যাকে আখ্যা দিয়েছিলেন ‘শেখের যোগ্য লেফটেন্যান্ট’ বলে, সেই ‘কথা কম কাজ বেশি’ মানুষটি হৃদয়ে আর মস্তিষ্কে ঝড় নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন শিলিগুড়িতে অনুষ্ঠিত ‘৭০’এর নির্বাচনে জয়ী জনপ্রতিনিধিদের” সভায়। ছাত্র নেতাদের রোষের মুখেই মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে বললেন “ স্বাধীন বাংলাদেশ মানেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। পরাধীন বাংলায় বঙ্গবন্ধু ফিরে আসবে না। আমরা যদি ভুল করে থাকি তবে দেশ স্বাধীন হলে আপনারা আমাদের বিচার করবেন এবং আপনাদের রায় আমরা মাথা পেতে নেব”।

যুদ্ধ তখন বেশ সংগঠিত। ২০ আগস্ট, বেলা ১১টা ৩০ মিনিটে করাচির মসরুর বিমানঘাঁটির রানোয়ে থেকে ‘টি বার্ড” বিমান টি হাইজ্যাক করেন সেফটি অফিসার মতিউর রহমান। কন্ট্রোল রুমের সাথে বেতার সংযোগ সম্পূর্ন বিচ্ছিন্ন হওয়ার আগে প্রথম এবং শেষবারের মতো কন্ট্রোল টাওয়ার শুনতে পেয়েছিলেন এক বিরক্ত স্বরের প্রত্যুত্তর, “রিমেম্বার মাই নেইম ক্লিয়ারলি, বাস্টার্ডস, ডোন্ট আস্ক মি অ্যাগেইন! দিস ইজ মতিউর রহমান।… অ্যান্ড আই অ্যাম গোয়িং হোম!”

জিয়াউর রহমান এর জেড ফোর্স গঠন নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানী অভিযোগ করে বসলেন। পরিস্থিতি সামলাতে তখন তাজউদ্দিন কে খালেদ মোশররফের কে ফোর্স এবং শফিউল্লাহের এস ফোর্স গঠন করতে বলে দিলেন। খালেদ মোশাররফ ছিলেন গেরিলা ওয়ার এর পরিকল্পনা কারী। তার অধিনে মেজর হায়দার গেরিলা ওয়ার প্রশিক্ষন দিতেন। গড়ে উঠলো মুজিব বাহিনী, কাদের সিদ্দীকী বাহিনী। চিন্তিত হয়ে পড়লেন তাজউদ্দিন আহমদ। নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়াতে ফাক থেকে গেলে তো উদ্ভুত পরিস্থিতির সুবিধা নিবে পাকিস্থানী বাহিনী। সাথে সারাক্ষনই ছিল জেনারেল ওসমানীর পদত্যাগের হুমকি।

২৫ মার্চের ঠিক পাঁচ মাস পরে, গেরিলা অপারেশন সফল ভাবে শেষ করে বাসায় আসে রুমি। যে কিনা উচ্চ শিক্ষার্থে আমেরিকা যাবার বদলে যুদ্ধে চলে গিয়েছিল। বাসায় ফিরে নিজের রুমে শুয়ে রুমি ট্ম জোনসের “গ্রিন গ্রিন গ্রাস”টা বাজায়। মায়ের সাথে কথোপকথনের এক পর্যায়ে কেমন অদ্ভুদ বেদনার এক হাসি দিয়ে বলে, “মা বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন বলে একটা কথা আছে, জানো না? আমি জীবনের পুরোটা তোমাদের মতো দেখিনি সত্যি। কিন্তু মা, জীবনের যত মাধুর্য, যত তিক্ততা, সবকিছুরই আমি স্বাদ পেয়েছি। চলে যেতে হলে আমি কোনো আক্ষেপ নিয়ে যাব না”। সত্যি রুমি কোনো আক্ষেপ নিয়ে গেল না। ঘন্টা দুয়েক পরই একদল মিলিটারি এসে ধরে নিয়ে যায় রুমী আর তার বাবা শরীফ ইমামকে। শরীফ ইমাম ফিরে এসেছেন পরে, রুমী আর কখনো ফেরেনি জাহানারা ইমামের কাছে।

মোশতাক পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব পেয়ে কাজের কাজ যেটা করেছিলেন তা হলো আমেরিকার সাথে যোগশাযোগ। তিনি প্রতি মুহূর্তে তৎপর ছিলেন দুই পাকিস্থানকে আবারও এক বৃত্তে বাঁধতে। বাধা হয়ে দাড়ালেন তাজউদ্দিন। আমরা কেবল স্বাধীনতা অর্জনের পথে হাটবো অন্য কোনো পথে নয়। এই দৃঢ় মানসিকতার জন্য তাকে মারার জন্য তার থিয়েটার রোডের কার্যালয়ে লোক পাঠান এক প্রভাবশালী ছাত্র নেতা। যে ছাত্র নেতা শুরু থেকেই তার প্রধানমন্ত্রীত্ব মেনে নিতে চাননি। চাহিদা অনু্যায়ী অর্থ সরকারো কোষাগার থেকে না পেয়ে যিনি তাজউদ্দিন কে ইমপোষ্টার, প্রতারক বলে গালি পর্যন্ত দিতে কুণ্ঠাবোধ করেননি। তাতে সমান্যটুকুও ভেঙ্গে পড়েন নি তাজউদ্দিন। শুধু বলেছিলেন, এই ঘটনা যেন আর কেউ না জানে। তবে মুক্তিযুদ্ধের ঐক্যে ভাঙ্গন ধরতে পারে। মানুষ কে বিশ্বাস করতে তাজউদ্দিনের বড় ভালো লাগে।

সারাদিন অফিসের ফাইলে ব্যস্ত মানুষ টা যুদ্ধের নয় মাস স্ত্রী সন্তানের কোনো সুখ সুবিধার খোঁজ নেন নি। ডিআইটি রোডের এক সরকারী বাসাতে তার পরিবার কেবল থেকেছে। তাজউদ্দিন খুব স্পষ্ট করে তার স্ত্রী কে জানি দিয়েছিলেন “আমরা মন্ত্রীসভার সদস্যরা শপথ নিয়েছি, দেশ স্বাধীন না করে আমরা কেউ পরিবারের সাথে মিলিত হবো না”। নিজের একমাত্র সাদা শার্টটা তিনি রাতে নিজ হাতে ধুয়ে শুকিয়ে পরের দিন সেটা পরে মিটিং করেছেন দিনের পর দিন। খরচ বাচাতে নিজ হাতে অফিসের পাশের ছোট্ট থাকের রুমে রান্নার ব্যবস্থা করেছিলেন।

ঈদের দিন তাজউদ্দিন ছুটে গেলেন মুক্তাঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে। মুক্তিযোদ্ধারা তাকে অজানা ফুলের সাথে লতা জুড়ে বরন করে নেন। তাজউদ্দিন বলেন, মালা তো আমি নিইনা! আমার জন্য মালা কেন? মালা তো পড়বেন বঙ্গবন্ধু! আমাকে বরন করার তো কিছু নাই। তবে আজকের এই মালা আমি নিলাম। এই মালস নেবার পর মরে গেলেও আমার আক্ষেপ থাকবে না। আমি জানব, মুক্ত বাংলার মাটিতে জন্মানো একটি ফুলের মালা একদিন আমার গলায় ছিল…। তিনি যখন-ই কোনো ক্যাম্পে যেতেন মুক্তিযোদ্ধারা আরো বেশি অনুপ্রাণিত হতেন। তিনি প্রোটোকলের তোয়াক্কা না করের সবার সাথে হাত মেলাতেন। বুকে জরিয়ে নিতেন। তার জন্য বিশেষ খাবার রেখে চুপিসারে উঠে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে মাটিতে টিনের থালায় খাবার নিয়ে বসে যেতেন। নিজের প্লেটের খাবার তুলে দিতেন পরম মমতায়।

এরপর শুরু হলো আকাশ যুদ্ধ। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী স্বীকৃ্তি দিলেন বাংলাদেশকে। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলো। আকাশ বানী কলকাতা কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তাজউদ্দিন বললেন, মুজিব নগর সরকার দেশ স্বাধীন করে নাই। বাংলাদেশ স্বাধীন করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দেশে ফিরে এলেন বঙ্গবন্ধু। নতুন সরকার গঠন করে প্রধানমন্ত্রীত্ব নিলেন। তাজউদ্দিন কে করলেন অর্থ মন্ত্রী। খুব আক্ষেপ নিয়ে একদিন বললেন , মানুষ পায় সোনার খনি, তেলের খনি আর আমি পাইছি চোরের খনি। দেখ জুড়ে বিশৃংখলা আর অবরাজকতা।গঠন করা হলো রক্ষী বাহিনী। কিছু সুবিধাবাদী মানুষের হাতে চলে গেল পাকিস্তানী বাহিনীর ফেলে যাওয়া অস্ত্র। লতিফ সিদ্দীকী দখল করে নিলেন কাদের সিদ্দীকীর বাড়ী। চারপাশ নিয়ন্ত্রনে বঙ্গবন্ধুকে বেশ বেগ পেতে হলো। বন্যা-খরা দুর্ভিক্ষ কি না হলো। পাকিস্থান বৈদেশিক রিজার্ভের এক পাই পয়সাও দিলো না। একটা মেরুদন্ড ভাঙ্গা জাতির কান্ডারি তখন দিশেহারা। অর্থমন্ত্রী সাহায্যের জন্যে ছুটেছেন দেশ থেকে দেশে।

বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ম্যাকনামারা এলেন বাংলাদেশ সফরে, জানতে চাইলেন “অর্থনৈতিক পূনর্বাসনে কী কী সাহায্য দরকার বাংলাদেশের?” তাজউদ্দিন গভীর স্বরে জবাব দিলেন “আমাদের যা দরকার তা আপনি দিতে পারবেন কি না, এই নিয়ে সন্দেহ আছে, মিস্টার ম্যাকনামারা”। গলার স্বর হিমাংকে নামিয়ে বলেন, “ আমাদের প্রথম চাহিদা হচ্ছে গরুর দড়ি আর গরু।কৃ্ষিভিত্তিক দেশ আমাদের তাই সবার আগে দরকার গরু আর সেই গরুগুলো বেঁধে রাখার জন্য দরকার শক্তপোক্ত দড়ি”।

২৬ অক্টোবর ১৯৭৪ তাজউদ্দিন কে অর্থমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তোফা দিতে নির্দেশ দেন শেখ মুজিবুর রহমান। বিনা বাক্য ব্যয়ে তাজউদ্দিন ইস্তোফা দেন। তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল আপনি দেশ এবং শেখ মুজিবের মধ্যে কাকে বেশি ভালো বাসেন? তাজউদ্দিন কোনো কালক্ষেপন না করেই বলে ছিলেন বঙ্গবন্ধু কে বেশি ভালো বাসি।

১৫ আগষ্টে জাতি দেখলো ইতিহাসের নৃ্সংশতম হত্যা কান্ড। গৃহবন্দী হলেন তাজউদ্দিন। খুব আক্ষেপ নিয়ে বললেন, বঙ্গবন্ধু মারা যাওয়ার আগে জেনেও যেতে পারলেন না, কে তার বন্ধু আর কে শত্রু। কয়েকদিন পরে তাকে সহ চার নেতাকে নেয়া হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। ক্ষমতায় বসেন মোশতাক। তাজউদ্দিনের চির শত্রু মোশতাক। ৩ নভেম্বর ভোরে লেফটেনেন্ট কর্নেল ফারুকের নির্দেশে, নব নিযুক্ত রাস্ট্রপতি মোশতাকের ইতিবাচক সহযোগীতায় ক্যাপ্টেন রিসালদার মোসলেম উদ্দিন সহ চার অস্ত্রধারী নতুন জেলখানার ১ নং কক্ষে ৫০-৬০ টি গুলিতে ইতিহাসের একটা গর্বিত অধ্যায় কে মুছে দেন লাল কালিতে। বড় অদ্ভুত লাগে এই মানুষ গুলোর জন্য যারা স্বাধীনতা এনেছিল তারাই স্বাধীনতার বলি হলে নিজ দেশে। স্বাধীন দেশে!

চার নেতার দেহ গুলো মেঝে তে পড়ে রইলো সরকারী নির্দেশের অপেক্ষায়।“গভীর রাতে রক্তমাখা ঘড়ি, জামা, জুতো আর গুলিতে ছিদ্র হয়ে যাওয়া টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে ফিরে আসেলেন মানুষটি। নিজ পরিবারের কাছে। তিনি একদিন তার স্ত্রী কে বলেছিলেন, আমরা একটা দেশের জন্মের ইতিহাস লিখছি। ইতিহাস এমন ভাবে লিখতে হবে সেখানে যেন কেন লেখককে খুঁজে না পান। সেই লেখক কি আসলেই হারিয়েছেন। আপনার আমার স্মৃতি থেকে, ভালোবাসা থেকে, শ্রদ্ধা থেকে, চেতনা থেকে………… শেষের একবছর তাজউদ্দিন একটা লাল মলাটের কালো বর্ডারের ডাইরী লিখেছিলেন। মৃত্যুর কয়েকদিন আগে তিনি সেতা লিখে শেষও করেছিলেন। কিন্তু জাতির দুর্ভাগ্য সেই ডাইর একব্যক্তি মানুষের কারসাজিতে আর আলোর মুখ দেখেনি।

বইটি আমি বেশ সময় নিয়ে পড়েছি। যত পড়েছি; জেনেছি আর কেঁদেছি। খুব ইচ্ছে করে বলে দেই, “তাজউদ্দিন আহমদ, আমি আপনাকে অনেক ভালোবাসি। না থেকেও আপনি পুরোটা জুড়েই রয়ে গেলেন”।

সুহান রিজওয়ানের লেখা “সাক্ষী ছিল শিরস্ত্রাণ” বইটির প্রকাশ শুদ্ধস্বর। মূল্য- ৬০০/টাকা ।


সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা জানুয়ারি, ২০২১ রাত ১:১০
৩০টি মন্তব্য ২৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় দেশনায়ক তারেক রহমানকে সম্পৃক্ত করার নেপথ্যে  

লিখেছেন এম টি উল্লাহ, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:০৮


আগেই বলেছি ওয়ান ইলেভেনের সরকার এবং আওয়ামীলীগের যবনায় জনাব তারেক রহমানের বিরুদ্ধে পৌনে একশ মামলা হলেও মূলত অভিযোগ দুইটি। প্রথমত, ওই সময়ে এই প্রজন্মের নিকট উপস্থাপন করা হয়েছিল দেশনায়ক তারেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্পকে নিয়ে ব্লগারদের রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১০



**** এডমিন টিমের ব্লগারেরা আমাকে বরাবরের মতোই টার্গেট করে চলেছে, এভাবেই সামু চলবে। ****

ট্রাম্পের বিজয়ে ইউরোপের লোকজন আমেরিকানদের চেয়ে অনেক অনেক বেশী শংকিত; ট্রাম্প কিভাবে আচরণ করবে ইউরোপিয়ানরা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্পের বিজয়, বিশ্ব রাজনীতি এবং বাংলাদেশ প্রসংগ

লিখেছেন সরলপাঠ, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:২১

ট্রাম্পের বিজয়ে বাংলাদেশে বা দেশের বাহিরে যে সব বাংলাদশীরা উল্লাস করছেন বা কমলার হেরে যাওয়াতে যারা মিম বানাচ্ছেন, তারাই বিগত দিনের বাংলাদেশের ফ্যাসিস্টের সহযোগী। তারা আশায় আছেন ট্রাম্প তাদের ফ্যাসিস্ট... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঠেলার নাম বাবাজী !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৬ ই নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৩১

এক গ্রামীণ কৃষক জমিদার বাড়িতে খাজনা দিতে যাবে। লোকটি ছিলো ঠোটকাটা যখন তখন বেফাস কথা বা অপ্রিয় বাক্য উচ্চারণ করে ক্যাচাল বাধিয়ে ফেলতে সে ছিলো মহাউস্তাদ। এ জন্য তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

শীঘ্রই হাসিনার ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৭ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৩৮


পেক্ষার প্রহর শেষ। আর দুই থেকে তিন মাস বাকি। বিশ্ব মানবতার কন্যা, বিশ্ব নেত্রী, মমতাময়ী জননী, শেখ মুজিবের সুয়োগ্য কন্যা, আপোসহীন নেত্রী হযরত শেখ হাসিনা শীগ্রই ক্ষমতার নরম তুলতুলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×