বহু..বহু...বছর পরের কোন এক দিন...(প্রথম খন্ড)
বহু..বহু...বছর পরের কোন এক দিন...(দ্বিতীয় খন্ড)
বহু..বহু...বছর পরের কোন এক দিন...(তৃতীয় খন্ড)
আচ্ছা, যদি কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করে তোমার বুয়েট জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন কি ? আমি নির্দ্বিধায় চোখ বন্ধ করে বলবো অসাধারণ কিছু বন্ধু, অসাধারণ কিছূ মেধাবীর সংষ্পর্শ যা আমাকে শিখিয়েছে অনেক কিছূ, সমৃদ্ধ করেছে আমার চিন্তা ও মেধাকে। যাদের কিনা আমি পৃথিবীর অন্য কোথাও গেলে পেতাম না। যাদের পরামর্শ ও বুদ্ধি ছাড়া আমি আজও কিছু করার কথা ভাবতে পারি না। আমার মনে থাকবে বিলম্বে যৌবনপ্রাপ্ত জেনানের কথা, যার সরল হাসি সবসময় আমাকে বিস্মিত করে। আর আমাদের ফার্স্ট বয় অল রাউন্ডার কল্লোল, জুতো সেলাই থেকে চন্ডীপাঠ যার নখদর্পণে। আমার ধারণা বুয়েটের যেকোন টিচারের থেকে সে যেকোন কিছু ভালো জানে। ইদানীং র্যাগ কর্ণারে তাকে বেশ আগ্রহ সহকারে টুয়ান্টি নাইন খেলতে দেখা যাচ্ছে। সব সময় হ্যান্ডসাম আহমেদ আলী (যদিও শেষের দিকে এসে কেমন যেন একটু উড়াধুরা হয়ে গিয়েছিল !)। ডিলডো আনিস, যার অষ্পষ্ট উচ্চারণ সবসময়ই আমাকে দ্বিধায় ফেলে, যার সকল চিন্তা চেতনা জুড়ে থাকে মানব জাতির আদিমতম অনুভূতি। মামুরের কথাতো আর বলার কিছুই নেই। রোবট আর রোবকনের কল্যাণে এশিয়া ঘুরে ফেলেছে। মেকানিক্যাল ফেস্টটিভ্যালের প্রতিটি ইভেন্টে তার প্রাণবন্ত উপস্থিতি আমার মনে প্রশ্ন জাগায়, ও আসলে কি পারে না ? সবসময় বিরক্তিতে ভ্র“ কুঁচকে থাকা ইয়াকুত। আমার কাছে ওর যতগুলো ছবি আছে সবগুলোতেই তার কেমন যেন একটা রাগত ভঙ্গি। সদাহাস্যময় জ্ঞানপাপী দিপু, যাকে কেন যেন সবাই...(বাকীটুকু বুইঝা ল)। ডবল সাইজ জাকারিয়া, যে কিনা স্যারের সব লেকচার শীট আমাদের জন্যে ফটোকপি করতে বিরামহীনভাবে পলাশী দৌড়ায়। টাকলা রুশো, তুচ্ছ আর সিরিয়াস, সব বিষয়ই যার কাছে সমান ফানি। রঙ্গ বেরঙ্গের কালিতে লেকচার তোলা অভি, যার খাতা প্রতি টার্মের শেষ ফটোকপি করা আমার জন্যে বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়ায়। হাসি মুখে, ঠাট্টার ছলে অশ্লীলভাবে জীবনের কোন গুঢ় কথা বলা ববি, যার তাৎপর্য কিনা অনেক পরে বোঝা যায়। আর কতজনের কথা বলবো? এবার না হয় আমাদের সবার কথা বলি। আমাদের অধিকাংশেরই দূর্বলতা হল নারীসঙ্গ। আমাদের প্রেমের শখ থাকলেও সাহস নেই। যদিও মুখে বলি “আরে এইসব ফাউল কামের টাইম কই ?” আমাদের সিনিয়র তাসনিম আপু (আই. পি. ই.-র এক জেমস বন্ডরে বিয়া করছে) কিংবা জুনিয়র ফারাহ সউদ (আর্কিটেক্চার) সবাই আমাদের দৃষ্টিতে পরম কাঙ্খিত। ই.এম.ই-র চারতলা থেকে তীক্ষè দৃষ্টিতে আমরা আজও তাদের রেপ্লিকা খুঁজে বেড়াই। এদেরকে দূর থেকে দেখেই আমাদের সন্তুষ্ট থাকতে হয়। আমাদের প্রায় সবার মাঝেই রয়েছে একটু “ক্ষ্যাতভাবে” থাকার প্রবণতা। পয়সাপাতি খরচের ব্যপারে আমরা বরাবরই খুব সচেতন, খানাপিনার ব্যপারে উদার। আমরা সবসময়ই চাই ঝামেলামুক্ত থাকতে। যদিও এ অভ্যাসটা আমাদের কিছুটা আকেন্দ্রিক করে ফেলছে (এটা আমার ব্যক্তিগত মতামত)। আমাদের, বুয়েটের প্রতিটি শিক্ষার্থীর মাঝেই রয়েছে অপূর্ব দেশপ্রেম যা কিনা বাইরে থেকে দেখে বোঝা যায় না। আমরা দেশকে নিয়ে ভাবতে চাই এবং ভাবি। সেজন্যে হয়তো অনেক কিছুই সহজভাবে মেনে নিতে পারি না, যা কিনা অনেকের কাছে অস্বাভাবিক মনে হতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় জন-বিপাশার, সানসিল্ক মডেলদের আবেদনপূর্ণ বিলবোর্ড কিংবা বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণে “মোদের গরব” ভাষ্কর্যে গ্রামীণ ফোনের লোগো আমাদের ভীষণভাবে ব্যথিত করে। যদিও আমরা সবাই দেশ ছেড়ে যাবার জন্যে ব্যকুল, তারপরও আমি বলবো আমরা প্রত্যেকেই আমাদের অন্তরে লালন করি বাংলাদেশকে।
এত আনন্দের মাঝেও রয়েছে কিছু অপূর্ণতা, বেদনা আর হতাশা। ‘০২ সালের ৮ জুন বুয়েট ক্যাম্পাসে ক্রসফায়ারে সনির নিহত হওয়া, সে বিচারের রায় আজও কার্যকর না হওয়া, ওয়ার্ল্ড কাপ বা পি.এল. নিয়ে বরাবরের আন্দোলন আর পরীক্ষা পিছিয়ে যাওয়া...আর সব মিলিয়ে আমাদের চার বছরের কোর্স ছয় বছরে শেষ করা। আজ আমার অনেক কাছের বন্ধুরা প্রাইভেট ভার্সিটি থেকে পাশ করে দারুণ সব চাকুরী করছে। আর আমি করছি চোথা মুখস্ত ! ওরা যায় অফিসে আর আমি যাই টিউশনিতে ! থাক। আজ না হয় এসব কথা নাই বা বললাম। এখানে কোন দুঃখ বা বেদনার স্মৃতি রাখবো না। থাকবে শুধুই আনন্দের কথা। আজ থেকে বহু বহু বছর পর জীবনের শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে যখন মলিন হয়ে যাওয়া এই পাতাগুলো উল্টাবো তখন তা আমাকে মনে করিয়ে দেবে সেই আমার হরিয়ে যাওয়া তারুন্যদীপ্ত, আবেগী, স্বপ্নময় দিনগুলোর কথা। জীবনের প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির মাঝে হয়তো অনেকটা ফারাক থাকবে, হয়তোবা থাকবে না। তখন একটি দীর্ঘশ্বাস আর ঝাপসা দৃষ্টিতে মনে হবে “এই তো সেদিন...”। ঠিক আজ যেমনটি মনে হচ্ছে ...। সবকিছুই কিভাবে যেন স্মৃতি হয়ে হয়ে যাচ্ছে ! সময় কত দ্রুত ফুরিয়ে যায়, তাই না ?
শেষ
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে এপ্রিল, ২০১৩ সকাল ১১:১৯