একঃ
২০১১ সালের ডিসেম্বরের শেষের দিকে প্রথম আলোতে একটি ছবি দেখলাম; আগুনে পুড়ছে একটি বাস এবং জানালা দিয়ে বের হয় আছে একটি পুড়ে যাওয়া মানুষের জুতো পড়া একজোড়া পা। ছবিটি দেখে কিছুক্ষণের জন্য হলেও চিন্তাশূণ্য হয়ে গিয়েছিলাম। চোখের সামনে ছবির মত ভেসে উঠলো কিছু দৃশ্য। হয়তো খুব সাধারণ দিনের মতই শুরু হয়েছিল তার দিনটি। স্ত্রীর সাথে হয়তো নাস্তার টেবিলে টুকটাক কথাও হয়েছিল। তার সন্তানটি হয়তো তখনও ঘুম থেকে উঠেনি বা উঠেছিল। তার হয়তো কোনও নিরীহ আবদারও ছিল বাবার কাছে। এই সন্তানকে নিয়ে তার নিশ্চই কোন স্বপ্নও ছিল; যা তিনি সবাইকে বলতেন, স্ত্রীর সাথে এ নিয়ে তার খুনসুটি লেগেই থাকতো। স্বভাবিকভাবেই হয়তো তিনি তার সারা দিনের একটি কাজের ছক করেছিলেন। তার নিশ্চই ফিরে আসার কথা ছিল নিজ বাসায়।
কিন্তু, তিনি উঠেছিলেন একটি ভুল বাসে, একটি ভুল সময়ে, যাচ্ছিালেন একটি ভুল জায়গায়। জীবনের সমস্ত স্বপ্ন শেষ হলো পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়া পদযুগলে। কোন কারণ নেই, কোন অপরাধও নেই...তারপরও মৃত্যু। মৃত্যুর সময় কি ছিল তার মনে; ক্রোধ, দুঃখ, হতাশা ? আমি ধাবণা করি, ছিল বিষ্ময়! জীবনের এই আচমকা-অর্থহীন সমাপ্তিতে নিশ্চই ছিল বিষ্ময়।
দুইঃ
কিছুদিন আগে দেখলাম হরতালের আগের রাতে বাসে আগুন দেয়ায় পুড়ে মারা গেছেন একজন ব্যাংকের নিরীহ কর্মকর্তা। যেন খুবই সাধারণ, খুবই স্বভাবিক একটি ঘটনা। এমনভাবে পড়ে নিলাম খবরটা। কিন্তু আমার অবচেতন মনে ঠিকই ছাপ ফেলে গেল।
ব্যাংকের চাকরী নিশ্চই মানুষটির কোনকালেই ভালো লাগতো না। এখানে অফিস টাইমের শুরু আছে, শেষ নেই। হয়তো সারাদিনের কাজের চাপ শেষে নিজের বাসায় ফিরে আসছিলেন তিনি। আগামীকালের হরতালে কিভাবে অফিসে আসবেন সেটা নিয়েও হয়তো তার একটা চিন্তা ছিল। ঘরে ফিরে তার একমাত্র ছোট্ট শিশুটিকে কোলে নেবেন, তার আকুতিও ছিল। সকালে হয়তো ভালোভাবে স্বামীকে বিদায় জনানো হয়নি। এ নিয়ে কিছুটা আক্ষেপও স্ত্রীর মনে ছিল। তিনি সিশ্চই স্বামীর জন্য চা-নাস্তা বানিয়ে অপেক্ষায় ছিলেন, আজ সন্ধায় বাসায় এলে স্বামীর পশে বসে কিছুক্ষণ গল্প করবেন। আার ঠিক সেই সময়টাতে ওই মানুষটা পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছিলেন। স্ত্রীর চুম্বন করা গাল, সন্তানকে কোলে নেবার হাত...সবই কয়লা হচ্ছিল। সাথে সাথে শেষ হয়ে যাচ্ছিল একটি স্বপ্ন, একটি সম্ভাবনা, একটি ভবিষ্যত। ছাই হয়ে বাতাসে উড়ে যাচ্ছিল একটি জীবন। মৃত্যুকালে কি মনে হয়েছিল তার? নিষ্চই প্রিয়তমা স্ত্রীকে দেখতে ইচ্ছা করছিল কিংবা সন্তানটিকে কোলে নেবার তীব্র আকাঙ্খা ছিল। তার সামনে কি ভেসে উঠেছিল তার সমগ্র যাপিত জীবন? তা দেখে নিশ্চই তার আফসোস হবে...কেননা পুরো জীবনটাই তো এখন ছাই হয়ে রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকবে।
তিনঃ
মাত্র কিছুদিন আগে হাতিরঝিলে হরতালের আগের রাতে প্রাইভেট কারে পেট্রল বোমা মেরে আগুন ধরিয়ে দেয়া হল। মানুষ ছিল তাতে, না তারা মারা যান নি। বেঁচে গেছেন। খালি রাস্তায় হাতিরঝিলের আলো দেখতে দেখতে নিশ্চই তারা যাচ্ছিলেন। হয়তো বা গানও শুনছিলেন। অথচ, কোন কারণ ছাড়াই তারা ঝলসে গেলেন। একজন আশংকাজনক অবস্থায় হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন। তারা কেউ কি ভেবেছিলেন এই পরিণতি?
পরিশিষ্টঃ
যখন ছোট ছিলাম তখন এই ধরণের খবর দেখলে বা শুনলে আমার বাবাকে দেখতে পেতাম। ভয় পেতাম, আমার বাবার যদি এই অবস্থা হয়। বাবার জন্য ভয় লাগতো। আজও বাবা আছেন, আমিও আছি, আমার পরিবারও আছে। আজ ভয় হয় নিজের জন্য। আমি তো তাদের মতই একজন, তাদের মতই সাধারণভাবেই শুরু হয় আমার দিন, শেষ হয় আমার রাত। প্রতিটি মূহুর্ত পার করছি...একটি ভুল সময়ে, একটি ভুল জায়গায়, ভুল মানুষ হবার তীব্র আশংকায়।
বেঁচে আছি একটি ভুল দেশে। এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ হতে পারে না।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জানুয়ারি, ২০১৪ দুপুর ২:৩৩