শিক্ষা কি শুধু সনদ অর্জনের জন্য? ০৩
চাকুরির জন্য ১০-২০ লক্ষ টাকা না দিয়ে ব্যবসা করা অনেক ভালো। অামাদের শিক্ষা কারিকুলাম ব্যপক পরিবর্তন করা দরকার। অামাদের শিক্ষা ব্যবস্থার একমাত্র উদ্দেশ্য হলো চাকুরি। কারণ এখানে কোন বিকল্পো অপশান নেই। শিক্ষা কারিকুলামে যদি উদ্যোক্তা তৈরীর বিষয়টিকে গুরুত্ত্ব দেওয়া যায় তবে অামাদেরকে কারো কাছে টাকার বোঝা নিয়ে চাকুরির জন্য দৌড়ানর প্রয়োজন হবে না।প্রতেক চাকুরিতেই অভিজ্ঞতা চাই। অামরা কি অদৃশ্য ভাবে অভিজ্ঞতা লাভ করবো। একটা সুন্দর পরিকল্পোনা কাজের অর্ধেক। অাসুন অামাদের জনশক্তিকে জনসম্পদে পরিণত করি। দেশকে উন্নতির শিখরে নিয়েযেতে চেষ্টা করি।
উদ্যোক্তা হওয়া সহজ হতে পারে। কিন্তু সফল কিংবা অন্যদের চেয়ে আলাদা উদ্যোক্তা হয়ে ওঠা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। আর এ ক্ষেত্রে শুধু শ্রম, ভালো পরিকল্পনা কিংবা যথেষ্ট অর্থের জোগান থাকলেই চলবে না, থাকতে হবে আরো কয়েকটি বিষয়ে জানাশোনা। এ রকমই ছয়টি বিষয় থাকছে আজকের লেখায়।
১. ‘স্মার্টমানি’ খুঁজতে হবে
আপনি যে ব্যবসাই করতে যান না কেন, বিনিয়োগ লাগবে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই উদ্যোক্তারা বিনিয়োগকারী খোঁজেন। আর বিনিয়োগ পেলেই প্রথম চিন্তা করতে হবে, কিভাবে এই অর্থ ঝুঁকিমুক্ত রাখা যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, ব্যবসার ধরন, পণ্য এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বিনিয়োগকারীই একজন উদ্যোক্তার জন্য ‘স্মার্টমানি’।
২. বেরিয়ে আসার পথ
যিনি বিনিয়োগ করবেন, তাঁকে আশঙ্কামুক্ত রাখতে হবে। নিশ্চয়তা দিতে হবে, খারাপ কিছু হলেও তাঁর টাকা নষ্ট হবে না। অর্থাৎ ব্যবসা শুরুর আগে সেই ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার একটি রাস্তা আগে থেকেই মাথায় রাখতে হবে।
৩. মূল্যমান নিয়ে সচেতনতা
এমন উদ্যোক্তা দৃশ্যমান ঝুঁকির সঙ্গে মানিয়ে কাজ করেন। তাঁরা তাত্ক্ষণিক লাভের মুখ দেখতে চান না। তবে যত দ্রুত সম্ভব দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অর্জন করতে প্রস্তুত থাকেন। এমন কাঠামো দাঁড় করানোর চেষ্টায় থাকেন, যা আশানুরূপ ফল দেবে। এতে ব্যবসা প্রসারের সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
৪. তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ
একজন সফল উদ্যোক্তা সংশ্লিষ্ট খাতের যাবতীয় তথ্য-উপাত্ত সম্পর্কে ধারণা রাখেন। অনেক সময় তথ্য এতটাই জরুরি হয়ে ওঠে যে এর জোগান ছাড়া সফলতার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে আসে। এ ছাড়া পরিকল্পনা করা কিংবা এর বাস্তবায়নেও দরকার তথ্য। তথ্যের বিশ্লেষণ ছাড়া এগোতে গেলেই বিপদ।
৫. কেন্দ্রবিন্দুতে মনোযোগ
নতুন উদ্যোক্তাদের সফল হওয়ার প্রধান শর্ত মনোযোগী থাকা। এ কাজটাকেই সফলতার চাবিকাঠি বলে গণ্য করেন আদর্শ ব্যবসায়ীরা। যে পথে এগোচ্ছেন তাতে এমন একটি বিষয় আছে, যা আপনাকে অবশ্যই বোঝাপড়ার মধ্যে আনতে হবে।
৬. দক্ষ লোকের সন্ধান
উদ্যোক্তারা নতুন প্রতিষ্ঠানের জন্য এমন কর্মী নিয়োগ দেন, যাঁরা দায়িত্ব সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা রাখেন। নতুন ব্যবসায় উত্থান-পতন থাকবেই। আর এ অবস্থার সঙ্গে নতুন কর্মীদের মানিয়ে চলার সক্ষমতা থাকতে হবে। আর এমন কর্মী খুঁজে বের করেন সফল উদ্যোক্তারা।
মাত্র ১৬ টাকা পুঁজি নিয়ে ১৩ বছর বয়সে গলায় ঝুড়ি ঝুলিয়ে কমলালেবুর ফেরিওয়ালা হিসেবে ব্যবসা শুরু। এরপর ১৯৫২ সালে বিড়ির ব্যবসার মধ্য দিয়ে ব্যবসার গতি-প্রকৃতি একেবারে জাদুর মতো বদলে যেতে থাকে। পরবর্তী সময়ে যে ব্যবসায় হাত দিয়েছেন, সেখানেই সাফল্য পেয়েছেন তিনি। একে একে তিনি দেশের উল্লেখযোগ্য ২৩টি শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠা করে ব্যবসার জাদুকরে পরিণত হন।
এতক্ষণ বলছিলাম আকিজ গ্রুপ ও আদ্-দ্বীনের প্রতিষ্ঠাতা শেখ আকিজ উদ্দীনের জীবনের গল্প।
খুলনার ফুলতলা থানার মধ্যডাঙ্গা গ্রামে ১৯২৯ সালে জন্ম নেন শেখ আকিজ উদ্দীন। শৈশব কেটেছে কঠিন দারিদ্র্যের মধ্যে। স্বপ্ন দেখতেন দারিদ্র্য জয় করে একদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াবেন। কিন্তু জীবনসংগ্রামের শুরুতে পদে পদে বাধার মুখে পড়েন। সেই বাধা পেরোতে শেখ আকিজ উদ্দীনের সম্বল ছিল সাহস, সততা আর কঠোর পরিশ্রম। এই তিনটি জিনিসকে পুঁজি করেই শুরু হয় উদ্যোক্তা আকিজ উদ্দীনের উত্থান পর্ব।
তিনি দেশের উন্নয়ন ও অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে লাখো মানুষের নিয়োগকর্তা হিসেবে ইতিহাসে নাম লেখান। কিভাবে শুরু হলো তার উত্থান।
ব্যবসা শুরুর পদে পদে বাধা : আকিজ উদ্দীনের বাবা শেখ মফিজ উদ্দিন ছিলেন ক্ষুদ্র ব্যবসয়ী। তিনি খুলনার ফুলতলা থানার মধ্যডাঙ্গা গ্রামে ফল ও ফসলের মৌসুমি ব্যবসা করতেন। আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে মা-বাবার একমাত্র সন্তান হয়েও আকিজ লেখাপড়া করার সুযোগ পাননি। তিনি খুব কাছ থেকে দারিদ্র্য দেখেছেন। আর গভীরভাবে বাবার ব্যবসা পর্যবেক্ষণ করেছেন। স্বপ্ন দেখেছেন। কিন্তু স্বপ্নের কোনো কিনারা করতে না পেরে ১৯৪২ সালে মাত্র ১৬ টাকা হাতে নিয়ে জীবিকার সন্ধানে কিশোর শেখ আকিজ উদ্দিন খুলনার মধ্যডাঙ্গা গ্রাম থেকে বের হন।
ট্রেনে চেপে তিনি কলকাতায় যান। কলকাতার শিয়ালদহ রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে তিনি রাত কাটাতেন। ওখানেই পাইকারি বাজার থেকে কমলালেবু কিনে ফেরি করে বিক্রি করেছেন। কিছু দিন কমলালেবুর ব্যবসা করার পর তিনি একটি ভ্রাম্যমাণ দোকান দেন। কিন্তু একদিন পুলিশ অবৈধভাবে দোকান দেওয়ার অভিযোগে তাঁকে ধরে নিয়ে যায়। কয়েক দিন জেল খেটে মুক্ত হয়ে আকিজ উদ্দিন উদ্ভ্রান্তের মতো কলকাতা শহর ঘুরেছেন। কলকাতায় তাঁর সঙ্গে পাকিস্তানের পেশোয়ারের এক ফল ব্যবসায়ীর পরিচয় হয়। আকিজ ওই ব্যবসায়ীর সঙ্গে পেশোয়ারে গিয়ে ফলের ব্যবসা শুরু করেন। দুই বছর ব্যবসা করে তাঁর পুঁজি দাঁড়ায় ১০ হাজার টাকা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আকিজ বাড়ি ফিরে আসেন।
উত্থানের গল্প : ১৯৫২ সালের দিকে বন্ধুর বাবা বিড়ি ব্যবসায়ী বিধু ভূষণের সহযোগিতায় আকিজ উদ্দিন বিড়ির ব্যবসা শুরু করেন। পাশাপাশি তিনি গ্রামগঞ্জ ঘুরে ধান, পাট, নারকিল ও সুপারি কিনে আড়তে আড়তে বিক্রি করেছেন। সামান্য কিছু টাকা জমিয়ে বাড়ির পাশে বেজেরডাঙ্গা রেলস্টেশনের কাছে একটি দোকান দেন। কিন্তু দোকানটি আগুনে পুড়ে যায়। আকিজ সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে তিনি এলাকাবাসীর সহায়তায় ফের দোকান দেন। পাশাপাশি শুরু করেন ধান, পাট, চাল ও ডালের ব্যবসা। এরপর তিনি সুপারির ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হন। রাত জেগে সেই সুপারি ছিলে দিতেন তাঁর সহধর্মিণী। এই সুপারি তিনি কলকাতায় পাঠাতেন। সুপারির ব্যবসায় তাঁর বেশ লাভ হয়। এরপর তিনি বিধু বিড়ির মালিক বিধু ভূষণের পরামর্শে বিড়ির ব্যবসায় যুক্ত হন। নাভারণের নামকরা ব্যবসায়ী মুজাহার বিশ্বাসের সহায়তায় তিনি ছোট্ট একটি বিড়ি তৈরির কারখানা গড়ে তোলেন। শুরু হয় আকিজের উত্থান পর্ব।
বিড়ি ফ্যাক্টরির পর ১৯৬০ সালে অভয়নগরে অত্যাধুনিক চামড়ার কারখানা এসএএফ ইন্ডাস্ট্রিজ, ১৯৬৬ সালে ঢাকা টোব্যাকো, ১৯৭৪ সালে আকিজ প্রিন্টিং, ১৯৮০ সালে আকিজ ট্রান্সপোর্ট, নাভারণ প্রিন্টিং, ১৯৮৬ সালে জেস ফার্মাসিউটিক্যাল, ১৯৯২ সালে আকিজ ম্যাচ, ১৯৯৪ সালে আকিজ জুট মিল, ১৯৯৫ সালে আকিজ সিমেন্ট, আকিজ টেক্সটাইল, ১৯৯৬ সালে আকিজ পার্টিকেল, ১৯৯৭ সালে আকিজ হাউজিং, ১৯৯৮ সালে সাভার ইন্ডাস্ট্রিজ, ২০০০ সালে আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ, একই বছর আকিজ অনলাইন, নেবুলা ইন্ক, ২০০১ সালে আকিজ করপোরেশন, আকিজ কম্পিউটার, আকিজ ইনস্টিটিউট অ্যান্ড টেকনোলজি, ২০০৪ সালে আফিল এগ্রো, ২০০৫ সালে আফিল পেপার মিলস প্রতিষ্ঠা করেন। ২০০৬ সালের ১০ অক্টোবর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত শেখ আকিজ উদ্দিন অসংখ্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এ ছাড়া তিনি আদ্-দ্বীন ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা করে স্বাস্থ্যসেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তাঁর মৃত্যুর পর সন্তানরা আরো অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।
আকিজ উদ্দিনের ১৫টি সন্তান। ১০ ছেলে পাঁচ মেয়ে। বড় ছেলে ডাক্তার শেখ মহিউদ্দিন আদ্-দ্বীনের নির্বাহী পরিচালক ও আকিজ বিড়ির চেয়ারম্যান, অন্য সন্তানদের মধ্যে শেখ মোমিন উদ্দিন এসএএফ চামড়া ফ্যাক্টরির এমডি, শেখ আফিল উদ্দিন সংসদ সদস্য ও আফিল গ্রুপের এমডি, শেখ বশির উদ্দিন আকিজ গ্রুপের এমডি। এ ছাড়া শেখ নাসির উদ্দিন, শেখ আমিন উদ্দিন, জামিন উদ্দিন, শেখ আজিজ উদ্দিন, শেখ জামিল উদ্দিন সবাই আকিজ গ্রুপের সঙ্গে জড়িত।
বাবার স্মৃতিচারণা করে ডাক্তার শেখ মহিউদ্দিন বলেন, ‘আমার বাবা আমাদের বলতেন, আগুন হয়তো মনের শক্তি দিয়ে হাতে চেপে রাখা যায়। কিন্তু ক্ষমতা ও সম্পদ ধরে রাখা তার চেয়ে আরো অনেক কঠিন। বাবার এই বাণী ধারণ করে তাঁর আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি সমাজসেবার হাল ধরে রেখেছি।’
শেখ বশির উদ্দিন বলেন, ‘বাবার নামাজ-কালামের পরই ছিল ফিন্যানশিয়াল ডিসিপ্লিনের স্থান। এ ছাড়া তাঁর সময়জ্ঞান ছিল উল্লেখ করার মতো। তিনি কোনো মিটিংয়ে এক মিনিট পরে আসেননি। আমি তাঁর এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় দুটি অনুসরণ করে লাভবান হয়েছি।’
শেখ আফিল উদ্দিন বলেন, ‘বাবার মধ্যে কোনো আত্ম-অহমিকাবোধ ছিল না। তিনি সব কিছু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। তাঁর দূরদর্শিতার কারণেই আকিজ গ্রুপ সমপ্রসারিত হয়েছে।’
শেখ মোমিন উদ্দিন বললেন, ‘বাবার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিল না। কিন্তু তাঁর শিক্ষার প্রতি প্রেম ছিল। তিনি আমাদের উচ্চশিক্ষা দিয়ে ব্যবসার পাসপোর্ট দিতেন। তাঁর সততা, ধৈর্যশীলতা, মেধা, সহনশীলতার কারণেই আকিজ গ্রুপ সাফল্যের শিখরে উঠেছে।’
মধ্যডাঙ্গা গ্রামের শেখ আকিজ উদ্দিনের নিকটতম প্রতিবেশী আলী আকবর বলেন, ‘আকিজ উদ্দিনের সংসারে সব সময় অভাব লেগেই থাকত। আকিজ বাড়িতে থাকতেন না, মাঝেমধ্যে গ্রামে আসতেন। তিনি এসে স্ত্রী সকিনা খাতুনকে সংসার চালানোর জন্য কিছু টাকা দিতেন। কিন্তু তাতে সংসার ১৫ দিনও চলত না। আকিজ উদ্দিন বাড়িতে এলে তাঁর কাছ থেকে টাকা নিয়ে ধার শোধ করতেন।’
তিনি বলেন, ‘আকিজ উদ্দিন আমাদের বলতেন, কারো কোনো দেনা রাখব না। আমি রাতদিন ব্যবসার পেছনে ছুটছি। আল্লাহ আমাকে লাভ দেবেন। সেই লাভের টাকা দিয়ে তোমাদের দেনা শোধ করে দেব।’
আকিজ উদ্দিন ২০০৬ সালে মারা যান। তার রেখে যাওয়া ব্যবসা ও আদর্শ এখনো তার স্ত্রী-সন্তানেরা ধরে রেখেছেন
সফল উদ্যোক্তা হওয়ার ১০ পরামর্শ
উদ্যোক্তার ভালো দিক
উদ্যোক্তা সৃষ্টি
একজন সফল উদ্যোক্তা
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা অক্টোবর, ২০১৭ রাত ১০:২৬