somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অলিম্পিকের গল্পঃ অলিম্পিকের মিথ

১৫ ই জুলাই, ২০১২ ভোর ৫:৪০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সিপাইলাস (Sipylus)- মিথোলজী অনুযায়ী মানুষ নির্মিত প্রথম নগররাষ্ট্র। ট্যান্টালাস ছিলেন এই নগররাষ্ট্রের রাজা। ট্যান্টালাসের আরো একটি পরিচয় আছে- তিনি দেবতা জিউসের ছেলে এবং একই সাথে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। জিউস প্রায়শই ট্যান্টালাসকে অলিম্পিয়া পর্বতে ডেকে নিতেন, একসাথে ভোজ করতেন, এমনকি জিউস তার অনেক গোপন কথাও ট্যান্টালাসকে বলেছেন। অথচ ট্যান্টালাস ছিলেন অকৃতজ্ঞ, অহংকারী। তিনি জিউসের গোপন কথা সবাইকে বলে বেড়াতেন, স্বর্গ থেকে অমৃত আর এম্ব্রোসিয়া চুরি করে এনে পৃথিবীবাসী বন্ধুদের খাওয়াতেন, শুধু তাই নয়, দেবতাদের জব্দ করার জন্য একবার এক জঘন্য কাজ করলেন।

তিনি সব দেবতাদের নিজ রাজ্যে দাওয়াত দিলেন। সবার সামনে সবচেয়ে সুস্বাদু মাংস দিলেন। দেবী দিমিতার, মেয়ে পার্সিফনের বিরহে কিছুটা অন্যমনস্ক ছিলেন, তাই কিছু বুঝে উঠার আগেই এক টুকরো মাংস খেয়ে ফেলেন। কিন্তু জিউসসহ বাকী সব দেবতারা মাংস স্পর্শ করলেন না, তারা বুঝতে পারলেন, এই মাংস ট্যান্টালাসের ছেলে পেলোপসের। ট্যান্টালাস দেবতাদের জব্দ করার জন্য নিজ পুত্র সন্তান পেলোপসকে নিজ হাতে হত্যা করে মাংস রান্না করেন, পেলোপসের মা ডিওনে এর কিছুই জানতেন না। দেবতারা রুষ্ট হলেন। ট্যান্টালাসের রাজ্য ধ্বংস হলো। দেবতারা ট্যান্টালাসকে চরম শাস্তি দিলেন। তাকে বন্দী করা হলো পাতালের সবচেয়ে ভয়ংকর জায়গা টারটারাসে। তাকে রাখা হলো আকণ্ঠ পানিতে ডুবিয়ে, কিন্তু যখনই পানি খেতে যেতেন, পানি সরে যেতো। জলাশয়ে ডুবে থেকেও ট্যান্টালাস থেকে যান চির তৃষ্ণার্ত।


পেলোপস

দেবতারা এরপর ট্যান্টালাসের সন্তান পেলোপসকে নতুন জীবন দান করেন। দেবী দিমিতার পেলোপেসের এক কাঁধের কিছু অংশ খেয়েছিলেন, তিনি সেটা হাতির দাঁত দিয়ে তৈরী করে দিলেন। পেলোপস দেখতে হলেন অসম্ভব সুন্দর। সাগরের দেবতা পসাইডন পেলোপেসের প্রেমে পড়ে গেলেন। পেলোপসকে চুরি করে অলিম্পাস পর্বতে নিয়ে গেলেন। পৃথিবীর ইতিহাসে সেটাই ছিলো প্রথম সমকামিতা। পসাইডন পেলোপসকে চ্যারিয়ট (এক ধরনের ঘোড়া দৌড়) খেলা শেখালেন। কিন্তু ট্যান্টালাসের প্রতি রাগবশত জিউস পেলোপসকে অলিম্পাস পর্বত থেকে পৃথিবীতে ফেরত পাঠিয়ে দেন।


ওনোমাউসের মূর্তি

ওনোমাউস- গ্রীসের নগররাষ্ট্র পিসার রাজা এবং যুদ্ধদেবতা এরেসের সন্তান। ভবিষ্যত গননা করে তিনি জানতে পারলেন, তার মেয়ে-জামাইয়ের হাতেই তার মৃত্যু হবে। তাই তার অনিন্দ্যসুন্দর মেয়ে হিপ্পোডামিয়ার বিয়ের জন্য এক অভিনব পন্থা অবলম্বন করলেন। ঘোষণা দিলেন, যে তার মেয়ে হিপ্পোডামিয়াকে বিয়ে করতে চাইবে, তাকে তার সাথে চ্যারিয়ট প্রতিযোগিতা করতে হবে। যদি হিপ্পোডামিয়ার পাণিপ্রার্থী খেলায় জিতে তাহলে সে হিপ্পোডামিয়াকে বিয়ে করতে পারবে, আর হেরে গেলে প্রাণ দিতে হবে। খেলায় ওনোমাউস পরাজয়ের কোনো চিন্তাই করলেন না, কারণ তার ঘোড়াগুলো ছিলো গ্রীসের সেরা ঘোড়া, আসলে এগুলো ছিলো স্বর্গীয় ঘোড়া, যা তার বাবা যুদ্ধের দেবতা এরেসের কাছ হতে পেয়েছেন। আর তার চ্যারিয়ট যিনি চালাতেন, তিনি হচ্ছেন মিরটিলাস, দেবতা হেরমেসের সন্তান এবং চ্যারিয়ট চালনায় ছিলেন অতুলনীয়। ফলাফল যা হবার তাই হলো। বারোজন অসম সাহসী যুবক হিপ্পোডামিয়াকে বিয়ে করতে এসে চ্যারিয়ট খেলায় হেরে গিয়ে তাদের প্রাণ বিসর্জন দিলেন। এরপরে এলেন পেলোপস, যে হিপ্পোডামিয়াকে প্রথম দেখাতেই ভালোবেসে ফেলেন।

পেলোপস বুঝতে পেরেছিলেন, ওনোমাউসের কাছে তিনি চ্যারিয়ট খেলায় হেরে যাবেন। তাই তিনি দেবতা পসাইডনের কাছে তাদের পূর্ববর্তী ভালোবাসার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে সাহায্য চাইলেন। পসাইডন পেলোপসকে একটি স্বর্গীয় চ্যারিয়ট দিলেন। এতেও জয় সম্পর্কে নিঃসন্দেহ না হয়ে পেলোপস ওনোমাউসের চ্যারিয়ট চালক মিরটিলাসের কাছে গেলেন। মিরটিলাসকে বললেন, যদি খেলায় সে হেরে যায়, তাহলে হিপ্পোডামিয়ার সাথে প্রথম রাতে মিরটিলাস সহবাস করবে। হিপ্পোডামিয়ার প্রতি গোপন প্রেমে মত্ত মিরটিলাস এতে রাজী হলেন।


হিপ্পোডামিয়ার মূর্তি

চ্যারিয়ট খেলার সময় পসাইডনের চ্যারিয়টের সাহায্যে পেলোপস প্রথমেই অনেক দূর এগিয়ে যান। কিন্তু শেষের দিকে যখন ওনোমাউস পেলোপসকে অতিক্রম করতে যাবেন, ঠিক তখনই মিরটিলাস চ্যারিয়টের চাকার একটি লিঞ্চপিন ওনোমাউসের অজান্তে খুলে ফেলেন। ওনোমাউসের চ্যারিয়ট উল্টে যায়, ওনোমাউস ছিটকে বাইরে পড়ে যান। কিন্তু ঘোড়ার লাগামের সাথে ওনোমাউসের শরীর আটকে যায়, ফলে ঘোড়াগুলো দৌড়াতে থাকলে এক পর্যায়ে ওনোমাউস মারা যান, কিন্তু মারা যাবার পূর্বে মিরটিলাসকে অভিশাপ দেন।


চ্যারিয়ট প্রতিযোগিতা

চ্যারিয়ট খেলায় জিতে পেলোপস হিপ্পোডামিয়াকে বিয়ে করেন এবং একই সাথে পিসার রাজা হোন। মিরটিলাসকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে পাহাড় চূড়া থেকে নিচে নিক্ষেপ করে তাকে হত্যা করেন। মৃত্যুর পূর্বে মিরটিলাস পেলোপসকে অভিশাপ দিয়ে যান- শুরু হয় পেলোপসের পরিবারের একের পর এক করুণ কাহিনী। সেটা অন্য কাহিনী, আরেকদিন বলা যাবে। আজ আমরা সীমাবদ্ধ থাকবো অলিম্পিকের জন্ম কথায়।

পেলোপস ছিলেন একজন অসাধারণ রাজা। তার নামানুসারেই গ্রিসের দক্ষিন অংশকে আজো আমরা বলি পেলোপেনেসে (Peloponnese), যার অর্থ পেলোপসের দ্বীপ। রাজা ওনোমাউসের মৃত্যুর পর পেলোপস অনুতপ্ত হয়ে ওনোমাউসের সম্মানে এবং একই সাথে দেবতা জিউসকে খুশি করার জন্য চার বছর অন্তর অন্তর অলিম্পিয়া নামক জায়গায় এক ক্রীড়া উৎসবের আয়োজন করেন। আর এভাবেই ৭৭৬ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দে শুরু হয় প্রাচীন অলিম্পিক গেমসের এবং পেলোপস পরিণত হোন এক মিথোলজীক্যাল চরিত্রে। গ্রীক যুদ্ধের নায়ক রাজা আগামেমনন এবং হেলেনের স্বামী মেনেলাউস ছিলেন রাজা পেলোপসেরই বংশধর।


মানচিত্রে অলিম্পয়ার অবস্থান

প্রাচীন অলিম্পিকের শুরু হওয়া নিয়ে আরো একটি মিথ রয়েছে।

গ্রীসের সর্বকালের সেরা বীর হারকিউলিস আরগসের রাজা ইউরিসথেউসের দাসত্ব থেকে নিজেকে মুক্ত করার জন্য ১২টি কাজ সম্পন্ন করেন। তার মধ্যে একটি কাজ ছিলো এলিসের রাজা অউজিয়াসের আস্তাবল পরিষ্কার করা। কথিত ছিলো, রাজা অউজিয়াসের আস্তাবলে এতো পরিমাণ প্রাণী ছিলো যে, তাদের মলের জন্য দেশের অধিকাংশ জায়গা চাষ করা যেতো না! দেবী এথেনার সাহায্যে আলফেউস (Alpheios) নদীর গতিপথ পরিবর্তন করে দিয়ে হারকিউলিস আস্তাবল পরিষ্কার করেন।


রোমানদের দৃষ্টিতে হারকিউলিস


সাফল্যজনক ভাবে কাজটি সমাপ্ত করতে পারায় হারকিউলিস এক উৎসবের আয়োজন করেন। তিনি পেলোপসের কবরের পাশে তরুকুঞ্জ পরিষ্কার করে জিউসের সম্মানে এক দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু করেন। দূরত্ব মাপা হয় হারকিউলিসের পা দিয়ে, ৬০০ পা দূরত্ব! হারকিউলিস আরেকটি কাজ করেন, কবরের পাশে পবিত্র অলিভ গাছের চারা রোপণ করেন, পরবর্তীতে যা পরিণত হয়েছিলো অলিম্পিক বিজয়ীদের পুরষ্কারের উৎসে।

যে ভাবেই প্রাচীন অলিম্পিকের সূচনা হোক, এক সময় এই খেলা বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে হারকিউলিসের বংশধর এলিসের রাজা ইপহিটোস পুনরায় এই খেলা চালু করেন। তার সময়ে গ্রীসে প্লেগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়, একই সাথে চলতে থাকে যুদ্ধ বিগ্রহ। কিংবদন্তী আছে, রাজা ইপহিটোস ডেলফির মন্দিরে যান প্লেগ এবং যুদ্ধ থেকে মুক্তি পেতে হলে কি করতে হবে তা জানার জন্য। সেই মোতাবেক তিনি আবার অলিম্পিক খেলা শুরু করেন এবং এই খেলার সময় শান্তি চুক্তির প্রচলন করেন। এভাবেই গ্রীস থেকে প্লেগ কমে যায় এবং যুদ্ধ থেমে যায়।

রাজা ইপহিটোসই প্রথম ব্যক্তি, যিনি বিজয়ীদের পুরষ্কার হিসেবে হারকিউলিসের রোপণ করা অলিভ গাছের পাতা দিতেন। কিন্তু ৩৯৩ খ্রিষ্টাব্দের দিকে রোমান রাজা থিওডেসিয়াস প্রথম (ততদিনে গ্রিস রোমের দখলে চলে যায়) খ্রিষ্টান ধর্ম রক্ষার জন্য, অলিম্পিক খেলাকে পৌত্তলিকদের খেলা ঘোষণা করে এই খেলা একেবারে বন্ধ করে দেন। এভাবেই সমাপ্তি হয় একটি অসাধারণ অধ্যায়ের, প্রাচীন অলিম্পিকের অধ্যায়।

(ঘুরে আসুন আমার সুড়ঙ্গ থেকে, দেখে আসুন অনেক কিছু)
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হালহকিকত

লিখেছেন স্প্যানকড, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:১২

ছবি নেট ।

মগজে বাস করে অস্পষ্ট কিছু শব্দ
কুয়াসায় ঢাকা ভোর
মাফলারে চায়ের সদ্য লেগে থাকা লালচে দাগ
দু:খ একদম কাছের
অনেকটা রক্তের সম্পর্কের আত্মীয় ।

প্রেম... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×