জ্বীন জাতি হলো ইসলাম ধর্মের মূল গ্রন্থ কোরআনে বর্ণিত একটি জীব বা সৃষ্টি। প্রাক ইসলামী যুগেও জ্বীন জাতি সংক্রান্ত বিশ্বাস অন্যান্য আরব এবং এর কাছাকাছি এলাকায় বিদ্যমান ছিল। আরবি জ্বীন শব্দটির আক্ষরিক অর্থ গুপ্ত, অদৃশ্য, অন্তরালে বসবাসকারী বা অনেক দূরবর্তী। কুরআনে জ্বীন এবং ইনসান অর্থাৎ মানুষ এই দুই জাতির অস্তিত্বের কথা বলা হয়েছে। বৈজ্ঞানিকেরা এখনও জ্বীনের অস্তিত্বের প্রমাণ আবিষ্কারে সফল হতে পারেনননি। তবে বিভিন্ন মুসলমান সমাজে কিছু কিছু মানুষ কর্তৃক জ্বীন বশীভূত করা বা জ্বীনের সঙ্গে যোগাযোগের বিষয়টি প্রচলিত আছে।
ইসলাম ধর্ম আবির্ভাবের অন্তত কয়েক শত বছর পূর্বে প্রাচীন আরবে জ্বীনের কিংবা সেরূপ কোন চরিত্রের আরাধনা প্রচলিত ছিল বলে নৃতত্ত্ববিদেরা প্রমাণ পেয়েছেন। পালমাইরার নিকট বেথ ফাসি এল থেকে প্রাপ্ত আরামিক লিপিতে জিনায়ে কে ভাল এবং ফলপ্রসূ ঈশ্বর হিসেবে সম্মান জানানো হয়েছে।এই ব্যাপারে তর্ক আছে যে, জিনায়ে শব্দটির থেকে আরবি জ্বীন শব্দের উৎপত্তি।কোরান এবং ইসলাম ও প্রাক-ইসলাম যুগের সাহিত্যে অনেক সংখ্যকবার জ্বীনের উল্লেখ ইঙ্গিত দেয় যে জ্বীনের অস্তিত্বে বিশ্বাস প্রাক-ইসলামিক বেদুইন ধর্মে বেশ প্রভাবশালী ছিল। যাইহোক জ্বীন শব্দটি যে আরামিক থেকে আগত তা খৃষ্টানরা প্যাগান ঈশ্বরদের ডেমন আখ্যা দেওয়ার মাধ্যমে সে ব্যাপারে প্রমান পাওয়া গিয়েছে। যা পরবর্তীতে আরবীয় লোকগাঁথায় প্রাক-ইসলামিক যুগে প্রবেশ করে।জুলিয়াস ওয়েলহসেন পর্যবেক্ষণ করেন যে এই ধরণের আত্মারা জনশূন্য অন্ধকার এবং নোংরা পরিবেশে বিরাজ করে যেখানে সচরাচর এদের ভয় পাওয়া হয়।প্রচলিত মতে মানুষকে এদের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করে চলতে হয় যদিও এদের বাস্তব অস্তিত্ব প্রশ্নস্বাপেক্ষ।কুরআন অনুসারে জ্বীন জাতি মানুষের ন্যায় আল্লাহ সৃষ্ট অপর আরেকটি জাতি যারা পৃথিবীতে মানব আগমনের পূর্ব থেকেই ছিল এবং এখনো তাদের অস্তিত্ব রয়েছে তবে মানুষের চোখে তারা দৃষ্টিগ্রাহ্য নয়। কিন্তু জ্বীনরা মানুষদেরকে দেখতে পায়। তারা বিশেষ কিছু শক্তির অধিকারী। তাদের মধ্যেও মুসলিম এবং কাফির ভেদ রয়েছে। তারা মসজিদে নামাজ পড়তে আসে। তাদেরও সমাজ রয়েছে। তাদের আয়ু মানুষের চেয়ে অনেক বেশি।উদাহরণস্বরূপ তারা ৩০০ বছর বয়সে প্রাপ্তবয়স্ক হয়। ঈমাম ইবনে তাইমিয়ার মতে জ্বিন জাতি তাদের অবয়ব পরিবর্তন করতে পারে।
ইসলামের মতে জ্বীন জাতি এক বিশেষ সৃষ্টি। কুরআনের ৭২তম সুরা আল জ্বিন এ শুধু জ্বীনদের নিয়ে কথা বলা হয়েছে। এছাড়া সূরা আন নাস এর শেষ অংশে জ্বীন জাতির উল্লেখ আছে।কুরআনে আরো বলা আছে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) কে জ্বীন এবং মানবজাতির নবী হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে। হযরত সুলায়মান (আঃ) এর সেনাদলে জিনদের অংশগ্রহণ ছিল বলে কুরআনে উল্লেখ আছে। ইসলামে আরো বলা আছে ইবলিশ তথা শয়তান প্রকৃতপক্ষে জ্বীন জাতির একজন ছিল। ইসলামের মতে শয়তান হচ্ছে দুষ্ট জ্বীন নেতা। ইবলিশ বা শয়তান ছিল প্রথম জ্বীন যে আল্লাহর বিরুদ্ধাচরণ করেছিল।কুরআনে উল্লেখ আছে যে ইবলিশ এক সময় আল্লাহর একনিষ্ঠ বান্দা ছিল । কিন্তু আল্লাহ যখন হযরত আদম (আঃ) কে সৃষ্টি করলেন তখন হিংসা ও অহংকারের বশবর্তী হয়ে ইবলিশ আল্লাহর হুকুম অমান্য করে। এ কারণে ইবলিশ কে বেহেশত থেকে বিতাড়িত করা হয় এবং এরপর থেকে তার নামকরণ হয় শয়তান। ইসলাম পূর্ব আরব উপকথা গুলোতে জ্বীন সদৃশ সত্ত্বার উল্লেখ আছে। প্রাচীন সেমাইট জাতির জনগণ জ্বীন নামক সত্ত্বায় বিশ্বাস করতো। তাদের মতানুসারে নানাপ্রকারের জ্বীন পরিলক্ষিত হয়। যেমন ঘুল দুষ্ট প্রকৃতির জ্বীন যারা মূলত কবরস্থানের সাথে সম্পর্কিত এবং এরা যেকোন আকৃতি ধারণ করতে পারে), সিলা (যারা আকৃতি পরিবর্তন করতে পারতো এবং ইফরিত এরা খারাপ আত্মা। এছাড়া মারিদ নামক এক প্রকার জ্বীন আছে যারা জ্বীন দের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী। প্রাচীন আরবদের মতে জ্বীন রা আগুনের তৈরি।
উল্লেখ্য যে আরব্য রজনীর কাহিনীর মতো সবসময় জ্বীন অসাধ্য সাধন করতে পারে না। কেননা ঝড় বাদলের দিনে জ্বীনরা চলতে পারে না। কারণ তারা আগুনের তৈরি বিধায় বৃষ্টির সময় আয়োনাজাইশেন ও বজ্রপাতের তীব্র আলোক ছটায় তাদের ক্ষতি হয়ে থাকে এবং কোন ঘরে যদি নির্দিষ্ট কিছু দোয়া কালাম ও কাঁচা লেবু থাকে, তাহলে ঐ ঘরে জিন প্রবেশ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। আর একটি কথা মানুষ মাটি দিয়ে সৃষ্টি হলেও শেষ পর্যন্ত এর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। কারণ মানুষ মূলত মাটি, পানি, বায়ু ও অগ্নির সংমিশ্রণ। আর তাই জিন আগুনের শিখা দিয়ে পয়দা হলেও তাদের দেহে জলীয় পদার্থের সমাবেশ লক্ষণীয়। এর স্বপক্ষে যুক্তি হলো,, রসুল (সঃ) একদা উল্লেখ করেছিলেন যে, শয়তান বলে একটি জিন একদা নামাজের সময় তার সাথে মোকাবিলা করতে এলে তিনি ওই জিনকে গলা টিপে ধরলে সেইক্ষণে জ্বিনের থুথুতে শীতলতা অনুভব করেছিলেন।সুরা সাদ ৩৮:৩৫ এতে প্রতীয়মান হয় যে জিন যদি পুরোপুরি দাহ্য হতো তাহলে ঠাণ্ডা থুথুর থাকার কথা নয়। অন্যদিকে জিন তিন প্রকারের আওতায় বিদ্যমান প্রথমত, জমিনের সাপ, বিচ্ছু, পোকা-মাকড়, ইত্যাদি; দ্বিতীয়ত. শূন্যে অবস্থান করে এবং শেষত সেই প্রকারের জিন, যাদের রয়েছে পরকালে হিসাব। পূর্বেই বলেছি এরা সূক্ষ্ম, তাই স্থূল মানুষ বা পশু-পাখি জিনদের দেখতে পারে না। তবে কুকুর এবং উট এদের হুবহু দেখতে পারে। এ প্রেক্ষাপটে উল্লেখ্য যে, রাতে কোন অপরিচিত বস্তু বা জীব চোখে না দেখা গেলেও কুকুর কি যেন দেখে ছুটাছুটি ও ঘেউ ঘেউ করলে তাতে জ্বিনের আবির্ভাব হয়েছে বলে বুঝতে হবে। জিন বহুরূপী। এরা মানুষ, পশু-পাখি, ইত্যাদি যে কোন রূপ ধরতে পারে। সেই ক্ষণে উক্ত জীবের বৈশিষ্ট্যের আদলে তার ঘনত্ব কম বেশি হয়ে থাকে এবং মানুষের দৃষ্টির মধ্যে আসে।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে নভেম্বর, ২০১৭ রাত ১১:৫৫