বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক একটি ঐতিহাসিক সম্পর্ক, মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে , মুক্তিযুদ্ধের সময় এবং পরবর্তীতে বৃহৎ প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত, বাংলাদেশের সাথে কূটনৈতিকভাবে সম্পর্ক বজায় রেখেছে এবং প্রভাবান্বিত করেছে। আর তাই বাংলাদেশ ভারত সম্পর্ক আলোচনার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সংবেদনশীল বিষয়। এ নিয়ে ধারাবাহিক পর্যালোচনার প্রথম পর্ব প্রকাশ করছি, লেখাটা নিয়েছি Akm Wahiduzzaman স্যারের এই নোট থেকে ।
---------------------------------------------------------------------------------------------------------------
বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বিদ্যুতের চাহিদা। এক সময় এই চাহিদা মিটাতে সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ব্যবহৃত হলেও এখন আমাদের সমহারে বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। এই বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো কোনোটি যেমন সরকারি উৎপাদন কেন্দ্রের চেয়েও পরিবেশবান্ধব ও সাশ্রয়ী, আবার কোনো কোনোটি পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ ও অনেক বেশি ব্যয়বহুল। সুন্দরবনের পরিবেশগত বিপদসীমার মধ্যে প্রস্তাবিত রামপাল কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র তেমনই একটি সম্ভাব্য স্থাপনা।
সুন্দরবন ও প্রস্তাবিত রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র
২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছিল সেখানে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার ভিত্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং সঞ্চালনের একটি প্রস্তাব ছিল। এই প্রস্তাবের ভিত্তিতে ২০১২ সালে সুন্দরবনের নিকটবর্তী রামপালে দুটি ৬৬০ ইউনিট মিলে মোট ১৩২০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লাভিত্তিক তাপ-বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার জন্য ভারতের ন্যাশনাল থারমাল পাওয়ার করপোরেশনের (এনটিপিসি) সঙ্গে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি স্বাক্ষরের আগেই ২০১০ সালের ২৭ ডিসেম্বর কোনোরূপ পরিবেশগত প্রভাব নিরূপণ না করেই প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণের আদেশ জারি করা হয় এবং অবকাঠামো উন্নয়নের রূপরেখা চূড়ান্ত করা হয়।
সুন্দরবনের সঙ্কট দূরত্বের মধ্যে এই কয়লাভিত্তিক তাপ-বিদ্যুৎ প্রকল্পের পরিবেশ ঝুঁকি বিবেচনা করে বাংলাদেশের পরিবেশবিদরা প্রতিবাদ করেন এবং এক পর্যায়ে পরিবেশগত প্রভাব নিরূপণ সার্টিফিকেট না নিয়ে এই প্রকল্প চালুর বিষয়ে হাইকোর্ট রুল জারি করে। এমতাবস্থায় তড়িঘড়ি করে পরিবেশ অধিদপ্তরের ইনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট (ইআইএ) রিপোর্টে এই প্রকল্পকে পরিবেশবান্ধব বলে সার্টিফিকেট দেয়া হয় এবং সেই প্রতিবেদন অনলাইনে আপলোড করে জনগণের মতামত চাওয়া হয়। অথচ নিয়ম হচ্ছে প্রকল্প শুরুর আগেই ইআইএ প্রতিবেদন তৈরির পর সেটার ভিত্তিতে প্রকল্প অনুমোদন বা বাতিল করা। অবশেষে সেই ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেয়া বিতর্কিত ইআইএ প্রতিবেদনকে সঠিক ধরে নিয়েই গত ২০ এপ্রিল ঢাকায় ভারতের সঙ্গে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য চূড়ান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। স্বাক্ষরিত তিনটি চুক্তির মধ্যে রয়েছে- যৌথ উদ্যোগ চুক্তি, বাস্তবায়ন চুক্তি ও বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি।
প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ করা যায়, ভারতের এনটিপিসি কোম্পানি সেই দেশের ছত্তিশগড়ে একই প্রকল্প অর্থাৎ একটি ১৩২০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লাভিত্তিক তাপ-বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দিয়েছিল। সেই দেশের পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের গ্রিন প্যানেলের ইআইএ রিপোর্ট প্রকল্পটিকে পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি বলে প্রতিবেদন দাখিল করায় ভারত সরকার সেই প্রকল্পটি বাতিল করেছে । স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, যে প্রকল্পটি তার জন্মভূমি ভারতে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্র পেতে ব্যর্থ হলো সেটি আমাদের দেশে পরিবেশগত ছাড়পত্র পেল কীভাবে?
পরিবেশগত ছাড়পত্র দেয়ার জন্য যে ইআইএ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছিল, তার মধ্যে বেশ কিছু মোটা দাগের অসঙ্গতি রয়েছে। ছত্তিশগড়ে বাতিল হয়ে যাওয়া একই প্রকল্পের জন্য ভারতীয় ইআইএ প্রতিবেদনের সঙ্গে বাংলাদেশের ইআইএ প্রতিবেদনের তুলনা করলে বিষয়টি পরিষ্কার বোঝা যায়। এই অসঙ্গতিগুলো হচ্ছে-
সুন্দরবন হতে স্বল্প সঙ্কট দূরত্ব: ইআইএ প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রস্তাবিত রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পটি সুন্দরবন থেকে মাত্র ১৪ কিমি দূরে এবং সরকার নির্ধারিত সুন্দরবনের চারপাশের ১০ কিলোমিটার ইনভায়রনমেন্টালি ক্রিটিক্যাল এরিয়া (ইসিএ) থেকে ৪ কিমি বাইরে বলে নিরাপদ হিসেবে দাবি করা হয়েছে। কিন্তু জিআইএস সফটওয়্যার দিয়ে মেপে দেখা যায়, এই দূরত্ব সর্বনিম্ন ৯ কিলোমিটার হতে সর্বোচ্চ ১৩ কিলোমিটার।
রামপাল তাপ-বিদ্যুৎকেন্দ্রের অবস্থানিক মানচিত্রে সুন্দরবন হতে দূরত্ব
এনটিপিসি নামে যে ভারতীয় কোম্পানিটি সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের পাশে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে যাচ্ছে সেই ভারতেরই ‘ওয়াইল্ড লাইফ প্রটেকশন অ্যাক্ট ১৯৭২’ অনুযায়ী, বিদ্যুৎকেন্দ্রের ১৫ কিমি ব্যাসার্ধের মধ্যে কোনো বাঘ বা হাতি সংরক্ষণ অঞ্চল, জীববৈচিত্র্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বনাঞ্চল, জাতীয় উদ্যান, বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য কিংবা অন্য কোনো সংরক্ষিত বনাঞ্চল থাকা চলবে না। অর্থাৎ ভারতীয় কোম্পানি এনটিপিসিকে বাংলাদেশে সুন্দরবনের যত কাছে পরিবেশ ধ্বংসকারী কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে দেয়া হচ্ছে, নিজ দেশ ভারতে হলে সেটা তারা করতে পারত না। শুধু তা-ই নয়, আন্তর্জাতিক কোনো মানদণ্ডেই সংরক্ষিত বনাঞ্চলের এত স্বল্প সঙ্কট দূরত্বে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। আমাদের দেশে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে কোনো আইন না থাকায় এনটিপিসি ও পিডিবি এই ১০ কিলোমিটারের সুযোগটা নিয়েছে।
প্রকল্প এলাকা ও ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় জনবসতি, ফসল ও মৎস্য সম্পদের ক্ষতি : রামপালে প্রতিষ্ঠিতব্য এই ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ভারতে প্রতিষ্ঠার জন্য ৭৯২ একর একফসলি কিংবা অনুর্বর পতিত জমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল অথচ বাংলাদেশে সেই একই প্রকল্পের জন্য ১৮৩৪ একর কৃষি, মৎস্য চাষ ও আবাসিক এলাকার জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে, যার ৯৫ শতাংশই তিনফসলি কৃষি জমি, যেখানে বছরে ১২৮৫ টন ধান ও ৫৬৯ দশমিক ৪১ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদিত হয়। এই ধান-মাছ উৎপাদন বন্ধের সঙ্গে সঙ্গে এখন প্রায় ৮ হাজার পরিবার উচ্ছেদ হবে, যার মধ্যে উদ্বাস্তু এবং কর্মহীন হয়ে যাবে প্রায় ৭ হাজার ৫০০ পরিবার।
বাংলাদেশের ইআইএ প্রতিবেদন অনুসারেই প্রস্তাবিত প্রকল্প এলাকার ১০ কিমি ব্যাসার্ধের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় রয়েছে ৭৫ শতাংশ কৃষি জমি, যেখানে বছরে ৬২ হাজার ৩৫৩ টন ধান এবং ১ লাখ ৪০ হাজার ৪৬১ টন অন্যান্য শস্য উৎপাদিত হয়। গরান (ম্যানগ্রোভ) বনের সঙ্গে এই এলাকার নদী ও খালের সংযোগ থাকায় এখানে বছরে ৫,২১৮ দশমিক ৬৬ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদিত হয়। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাস্তবায়ন করতে গেলে প্রকল্প এলাকার ফসল ও মৎস্য সম্পদ উৎপাদন বন্ধ হওয়ার পাশাপাশি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
প্রস্তাবিত রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা
পরিবহন করার ফলে বাড়তি নৌযান চলাচল, ক্ষতিকর রাসায়নিক ও তেলসহ কঠিন ও তরল বর্জ্য নিঃসরণ, শব্দদূষণ, আলো দূষণ ইত্যাদি। পরিবেশ আইন অনুসারে এসব নিয়ন্ত্রণের কোনো নজির বাংলাদেশে নেই বলেই আমরা বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা নদীর দিকে তাকালে প্রমাণ পাই। সুতরাং এই অতিরিক্ত নৌযান চলাচলের ফলে সুন্দরবনের বাস্তুব্যবস্থা (ইকোসিস্টেম) বিশেষ করে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হরিণ, ডলফিন, গরান বন ইত্যাদির ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে।
এছাড়াও প্রকল্প নির্মাণ পর্যায়ে পশুর নদীতে ড্রেজিং করার কারণে নদীর পানি ঘোলা হয়ে নদীর বাস্তুব্যবস্থা বিপন্ন হবে এবং জেটি ও নদীতীর সংরক্ষণের জন্য অবকাঠামো নির্মাণের সময় গরান বনভূমির অনেক গাছ ও ঝোপঝাড় কেটে পরিষ্কার করতে হবে। বিভিন্ন পাখি, বিশেষ করে সারস ও বক জাতীয় পাখির বসতি নষ্ট হবে।
কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প চলাকালীন সমস্যাবলি: ইআইএ প্রতিবেদন অনুযায়ী ১৩২০ মেগাওয়াটের এই প্রকল্পের জন্য বছরে ৪৭ লাখ ২০ হাজার টন কয়লা পোড়ানো হবে। আমরা জানি অ্যাভোগ্রেডোর প্রকল্প অনুযায়ী ১ টন কয়লা পুড়লে ২ দশমিক ৮৬ টন কার্বন ডাই-অক্সাইড উৎপন্ন হয়। সেই হিসাবে এই প্রকল্প ৮০ শতাংশ লোড ফ্যাক্টরে উৎপাদন করলেও বছরে ১ কোটি ৮ লাখ টন কার্বন ডাই-অক্সাইড উৎপন্ন হওয়ার হথা। যদিও প্রতিবেদনে সুপার ক্রিটিক্যাল পদ্ধতি ব্যবহার করায় উদ্যোক্তাদের হিসাব মতেই ৭৯ লাখ টন কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস উৎপন্ন করে বাকি কার্বন ফ্লাই অ্যাশে যোগ হবে বলে ধারণা দেয়া হয়েছে। যদি উদ্যোক্তাদের হিসাবই সঠিক বলে ধরে নেয়া হয়, তারপরও প্রশ্ন হচ্ছে, ৭৯ লাখ টন কার্বন ডাই-অক্সাইড কী কম ক্ষতিকর! যত উঁচু চিমনিই ব্যবহার করা হোক না কেন বাতাসের চেয়ে ভারী এই গ্যাস তো এই দেশেই ফিরে আসবে, ফিরে আসবে সুন্দরবনের বুকে।
এছাড়াও বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে প্রতিদিন প্রায় ১৪২ টন বিষাক্ত সালফার ডাই-অক্সাইড (বছরে ৫১ হাজার ৮৩০ টন) ও ৮৫ টন বিষাক্ত নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড (বছরে ৩১ হাজার ২৫ টন) নির্গত হবে। বিপুল পরিমাণ বিষাক্ত গ্যাস সুন্দরবনের বাতাসে সালফার ডাই-অক্সাইড ও নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইডের ঘনত্ব বর্তমান ঘনত্বের তুলনায় কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়ে গোটা সুন্দরবন ধ্বংস করবে। অথচ ইআইএ প্রতিবেদনে এই মাত্রা ‘পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৭’-এর নির্ধারিত সীমার মধ্যে দেখানোর জন্য জালিয়াতির আশ্রয় নেয়া হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী সুন্দরবনের জন্য পরিবেশগত ‘স্পর্শকাতর’ এলাকার মানদণ্ড ব্যবহার করার কথা থাকলেও প্রতিবেদনে সুন্দরবনের জন্য ‘আবাসিক ও গ্রাম’ এলাকার মানদণ্ড দেখানো হয়েছে!
প্রশ্ন হচ্ছে, সুন্দরবন কি আবাসিক বা গ্রাম এলাকা, নাকি পরিবেশগতভাবে স্পর্শকাতর একটি সংরক্ষিত বন? তাহলে সুন্দরবনের মতো পরিবেশগত স্পর্শকাতর একটি এলাকার জন্য মানদণ্ড হিসেবে আবাসিক ও গ্রাম এলাকার জন্য নির্ধারত মানদণ্ড বেছে নেয়া হলো কেন? এর কারণ ‘পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৭’ অনুযায়ী পরিবেশগত স্পর্শকাতর এলাকার বাতাসে সালফার ডাই-অক্সাইড ও নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইডের ঘনত্ব প্রতি ঘনমিটারে ৩০ মাইক্রোগ্রামের বেশি হতে পারবে না। অথচ ইআইএ প্রতিবেদন অনুযায়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে নির্গত সালফার ডাই-অক্সাইড ও নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইডের ঘনত্ব নভেম্বর-ফেব্রুয়ারি সময়ে ৫৪ মাইক্রোগ্রাম হবে। এই অগ্রহণযোগ্য মাত্রাকে বৈধতা দেয়ার জন্যই ইআইএ প্রতিবেদনে সুন্দরবনকে ‘আবাসিক ও গ্রাম’ এলাকা দেখিয়ে তার জন্য নির্ধারিত মাত্রা ৮০ মাইক্রোগ্রামের চেয়ে কম ঘনত্ব দেখানো হয়েছে।
ইআইএ প্রতিবেদন অনুযায়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রে বাষ্প দিয়ে টারবাইন ঘোরানো ও শীতলীকরণসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহারের জন্য পশুর নদী থেকে ঘণ্টায় ৯১৫০ ঘনমিটার করে পানি প্রত্যাহার করা হবে এবং ব্যবহারের পর অবশিষ্ট পানি পরিশোধন করে ঘণ্টায় ৫১৫০ ঘনমিটার হারে আবার নদীতে ফেরত দেয়া হবে। ফলে নদী থেকে প্রতি ঘণ্টায় কার্যকর পানি প্রত্যাহারের পরিমাণ হবে ৪০০০ ঘনমিটার। এই পানি প্রত্যাহারের কারণে নদীর নিম্নপ্রবাহে সুন্দরবন এলাকায় পানির লবণাক্ততা, নদীর পলি প্রবাহ, প্লাবন, জোয়ার-ভাটা, মাছসহ নদীর উদ্ভিদ ও প্রাণী জগৎ ও বাস্তুব্যবস্থার ওপর কেমন প্রভাব পড়বে তার কোনো বিশ্লেষণ করা হয়নি। এর পেছনে তাদের যুক্তি হচ্ছে, ৪০০০ ঘনমিটার পানি পশুর নদীর শুকনো মওসুমের মোট পানি প্রবাহের ১ শতাংশেরও কম। এখানে যে ফাঁকিটা দেয়া হয়েছে সেটি হচ্ছে, পানি প্রবাহের ডাটা ২০০৫ সালের। এর মধ্যে উজানে ভারতীয় এলাকায় বাঁধের কারণে পশুর নদীর উৎস নদীতে যেমন পানির সরবরাহ কমেছে, তেমনি বেড়েছে শিল্প ও গৃহস্থালি কাজে পানির ব্যবহার। প্রকল্প চলাকালীন পরবর্তী ২৫-৩০ বছরে যে এই চাহিদা আরো বাড়বে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, ইআইএ প্রতিবেদনে পানি পরিশোধনের কথা বলা হলেও ‘শূন্য নির্গমন’-এর (জিরো ডিসচার্জ) বিষয়টি উল্লেখ করা হয়নি। এটা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত যে, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে পানি নির্গমন হলে তাতে বিভিন্ন মাত্রায় দূষণকারী উপাদান থাকে। যে কারণে পৃথিবীর সব দেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রে ‘শূন্য নির্গমন’ নীতি অবলম্বন করা হয়। এমনকি এনটিপিসি রামপালে ‘শূন্য নির্গমন’ নীতি অনুসরণ না করে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে যাচ্ছে, সেই এনটিপিসিই যখন ভারতের ছত্তিশগড়ে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করার প্রস্তাব দিয়েছিল, তখন ‘শূন্য নির্গমন’ নীতি অনুসরণ করার বাধ্যবাধকতার বিষয়টি ভারতের ইআইএ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল। সর্বোপরি এই বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে নির্গত ঘণ্টায় ৫১৫০ ঘনমিটার পানি পশুর নদীর জলজ পরিবেশের তাপমাত্রা, পানি নির্গমনের গতি, পানিতে দ্রবীভূত নানান উপাদান বিভিন্ন মাত্রায় পরিবর্তন করবে, যা সংশ্লিষ্ট পুরো সুন্দরবন এলাকার পরিবেশের জন্য ধ্বংসকারী প্রভাব সৃষ্টি করবে।
বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধির বিষয়টিও ইআইএ প্রতিবেদনে উপেক্ষা করা হয়েছে। ২৭৫ মিটার উঁচু চিমনি থেকে নির্গত গ্যাসীয় বর্জ্যরে তাপমাত্রা ১২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলেও শুধু পরিবেশ সংরক্ষণ নীতিমালা মেনে চিমনি তৈরি করার কারণে এই উচ্চতাপ স্থানীয় এলাকার তাপমাত্রা বৃদ্ধি করবে না বলে ইআইএ রিপোর্টে আশা প্রকাশ করা হয়েছে। সচেতন মানুষমাত্রেই জানেন, এর ফলে মাইক্রোক্লাইমেটিক পরিবেশে পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী।
রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের সবচেয়ে ক্ষতিকর বর্জ্য হবে এর দুই ধরনের কয়লাপোড়া ছাই। এখানে বছরে ৪৭ লাখ ২০ হাজার টন কয়লা পোড়ানোর ফলে ৭ লাখ ৫০ হাজার টন ফ্লাই অ্যাশ ও ২ লাখ টন বটম অ্যাশের বর্জ্য তৈরি হবে। এই ফ্লাই অ্যাশ, বটম অ্যাশ, তরল ঘনীভূত ছাই বা স্লারি বিপজ্জনক মাত্রায় পরিবেশদূষণ করে। কারণ এতে আর্সেনিক, পারদ, সিসা, নিকেল, ভ্যানাডিয়াম, বেরিলিয়াম, ব্যারিয়াম, ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম, সেলেনিয়াম, রেডিয়ামের মতো বিভিন্ন ক্ষতিকর ও তেজস্ক্রিয় ভারী ধাতু মিশে থাকে। ইআইএ প্রতিবেদনে উৎপাদিত ছাই যেন পরিবেশদূষণ না করে সেজন্য ফ্লাই অ্যাশ চিমনি দিয়ে নির্গত হওয়ার আগেই ইএসপি সিস্টেমের মাধ্যমে ধরে রাখার কথা বলা হলেও এটা স্বীকার করা হয়েছে, ‘কিছু উড়ন্ত ছাই’ বাতাসে মিশবে। এই কিছুর পরিমাণ কত? এটা ন্যূনতম ১ শতাংশ ধরে নেয়া হলেও বছরে ৭ হাজার ৫০০ টন ফ্লাই অ্যাশ আশপাশের এলাকাসহ সুন্দরবন পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে তেজস্ক্রিয় দূষণ ঘটাবে এবং আশপাশে নিউমোনিয়াসহ ফুসফুসের রোগ সৃষ্টি করবে।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে উৎপাদিত ফ্লাই অ্যাশকে সিমেন্ট কারখানা ও ইট তৈরিসহ বিভিন্ন শিল্পে ব্যবহারের সম্ভাবনার কথা ইআইএ প্রতিবেদনে লেখা থাকলেও বাস্তবে কোন কারখানায় কীভাবে এর ব্যবহার হবে সে বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট বক্তব্য নেই। তুলনা করার জন্য বড়পুকুরিয়ার ২৫০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কথা বলা যেতে পারে। এখানে প্রতিদিন উৎপাদিত ৩০০ মেট্রিক টন ফ্লাই অ্যাশ কোনো সিমেন্ট বা ইট কারখানায় ব্যবহৃত হচ্ছে না। ফলে এগুলো গর্ত করে জমিয়ে রেখে পরিবেশের ক্ষতি করা হচ্ছে। এই ছাই বাতাসে উড়ে আশপাশে ছড়িয়ে পড়ছে এবং পানির সঙ্গে চুইয়ে মাটির নিচে ও আশপাশের জলাভূমিতে বিষাক্ত ভারী ধাতুর মারাত্মক দূষণ ঘটাচ্ছে। সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা না থাকায় রামপালের ক্ষেত্রেও এমনটা ঘটার আশঙ্কাই বেশি। সবচেয়ে আশঙ্কাজনক বিষয় হচ্ছে, ইআইএ প্রতিবেদনে বর্জ্যকে দূষিত ও ক্ষতিকর বলে উল্লেখ করার পরও এই প্রকল্পের উৎপাদিত কঠিন বর্জ্যের একটি অংশ দিয়ে সংশ্লিষ্ট এলাকার ১৪১৪ একর নিচু জমি ভরাট করার পরিকল্পনা করা হয়েছে! যা কোনো পরিবেশবিদের সমর্থন করার কথা নয়।
কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে টারবাইন, জেনারেটর, কম্প্রেসার, পাম্প, কুলিং টাওয়ার, কয়লা পরিবহন, ওঠানো-নামানো ইত্যাদির কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ও যানবাহন থেকে প্রকট শব্দদূষণ হয়। ইআইএ প্রতিবেদনে এই প্রকল্প পরিচালনার সময় সংশ্লিষ্ট এলাকায় পরিবেশ অধিদপ্তরের বেঁধে দেয়া দিনে ৫০ ডেসিবল এবং রাতে ৪০ ডেসিবলের চেয়ে বেশি শব্দ তৈরি হবে বলে স্বীকার করা হলেও আশা প্রকাশ করা হয়েছে, সবুজ বেষ্টনী তৈরির ফলে প্রকল্প এলাকার বাইরে উচ্চশব্দ যাবে না। শুধু সবুজ বেষ্টনী দিয়ে যেমন এই প্রকট শব্দ রোধ করা সম্ভব নয়, তেমনি সবুজ বেষ্টনী তো আর একদিনে তৈরি হবে না। কাজেই শব্দ দূষণের ঝুঁকিটা থেকেই যাচ্ছে।
কয়লা পরিবহনজনিত পরিবেশদূষণ: পরিবেশের জন্য আরেকটি হুমকি হচ্ছে, রামপাল কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য আমদানিকৃত কয়লা সুন্দরবনের ভেতর দিয়েই পরিবহন করা হবে। সমুদ্রপথে বছরে ৪৭ লাখ ২০ হাজার টন আমদানি করা কয়লা প্রথমে বড় জাহাজে করে সুন্দরবনের ভেতরে আকরাম পয়েন্ট পর্যন্ত আনতে হবে, তারপর আকরাম পয়েন্ট থেকে ছোট ছোট লাইটারেজ জাহাজে করে কয়লা পরিবহন করে প্রকল্প এলাকায় প্রতিষ্ঠিতব্য কয়লা বন্দরে নিয়ে যাওয়া হবে। এতে করে সুন্দরবনের ভেতরে হিরণ পয়েন্ট থেকে আকরাম পয়েন্ট পর্যন্ত ৩০ কিলোমিটার নদীপথে বড় জাহাজে বছরে ৫৯ দিন এবং আকরাম পয়েন্ট থেকে রামপাল পর্যন্ত প্রায় ৬৭ কিমি পথ ছোট লাইটারেজ জাহাজে করে বছরে ২৩৬ দিন পরিবহন করতে হবে!
রামপাল প্রকল্পে প্রস্তাবিত কয়লা পরিবহন ব্যবস্থা
এভাবে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে কয়লা পরিবহনকারী জাহাজ চলাচল করার ফলে সরকারি ইআইএ প্রতিবেদন অনুসারেই প্রথমত কয়লা পরিবহনকারী জাহাজ থেকে কয়লার গুঁড়ো, ভাঙা বা টুকরো কয়লা, তেল, ময়লা-আবর্জনা, জাহাজের দূষিত পানিসহ বিপুল পরিমাণ বর্জ্য নিঃসৃত হয়ে নদী-খাল-মাটিসহ গোটা সুন্দরবন দূষিত করবে; দ্বিতীয়ত, সুন্দরবনের ভেতরে আকরাম পয়েন্টে বড় জাহাজ থেকে ছোট জাহাজে কয়লা স্থানান্তর করার সময় কয়লার গুঁড়ো, ভাঙা কয়লা পানিতে বা মাটিতে পড়ে কিংবা বাতাসে মিশে গিয়ে পরিবেশ দূষণ ঘটাবে; তৃতীয়ত, কয়লা পরিবাহী জাহাজের ঢেউ পশুর নদীর দুই তীরের ভূমি ক্ষয় করবে, কয়লা স্থানান্তরের যন্ত্রপাতি শব্দদূষণ ঘটাবে এবং রাতের বেলায় জাহাজের সার্চলাইটের আলো নিশাচর প্রাণীসহ সংরক্ষিত বনাঞ্চল সুন্দরবনের পশু-পাখির জীবনচক্রের ওপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে।
আর্থিকভাবে অলাভজনক: প্রস্তাবিত রামপাল কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের আরেকটি অগ্রহণযোগ্য দিক হচ্ছে, এটি বাংলাদেশের জনগণের জন্য আর্থিকভাবে অলাভজনক। এই প্রকল্পের ১৫ শতাংশ অর্থ জোগান দেবে পিডিবি, ১৫ শতাংশ ভারতীয় কোম্পানি এনটিপিসি এবং বাকি ৭০ শতাংশ ব্যাংক ঋণ নেয়া হবে। উৎপাদিত বিদ্যুৎ পিডিবি কিনবে আর যে নিট লাভ হবে সেটা ৫০ শতাংশ হারে পিডিবি ও এনটিপিসির মধ্যে ভাগ হবে। কয়লার ক্রয়মূল্যকে বিদ্যুতের দাম নির্ধারণের ভিত্তি হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। সে হিসাব অনুযায়ী ইতিমধ্যেই রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য সরকারি পর্যায়ে ১৪৫ ডলার মূল্যে কয়লা আমদানির সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়ে যাওয়ায় পিডিবি তথা সরকারকে দেশের জনগণের জন্য ৮ দশমিক ৮৫ টাকা মূল্যে বিদ্যুৎ কিনতে হবে। অথচ পিডিবির সঙ্গে দেশীয় ওরিয়ন গ্রুপের যে ক্রয় চুক্তি হয়েছে তাতে এই কোম্পানির মাওয়ায় প্রতিষ্ঠিতব্য কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে প্রতি ইউনিট ৪ টাকা মূল্যে এবং খুলনার লবণচরা ও চট্টগ্রামের আনোয়ারায় প্রতিষ্ঠিতব্য কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে প্রতি ইউনিট ৩ দশমিক ৮০ টাকা মূল্যে বিদ্যুৎ কেনা হবে।
এ অবস্থায় রামপাল থেকে দ্বিগুণেরও বেশি মূল্যে বিদ্যুৎ কিনে পিডিবিকে অবশ্যই ভর্তুকি দিয়ে জনগণের কাছে বিক্রয় করতে হবে। ফলে এই প্রকল্প থেকে পিডিবির প্রাপ্ত লভ্যাংশটি আখেরে ভর্তুকির মাধ্যমে লোকসানে পরিণত হবে; লাভ হবে কেবল ভারতীয় কোম্পানি এনটিপিসির। পরিবেশকে বিবেচনায় না নিলেও জেনেশুনে এই ধরনের লোকসানি প্রকল্প হাতে নেয়া কতটা যুক্তিসঙ্গত, তা আরো ভেবে দেখা দরকার ছিল।
বিকল্প বিদ্যুতের সন্ধানে: দ্রুত শিল্পায়ন ও অগ্রগতির এই যুগে বিদ্যুতের ক্রমবর্ধমান চাহিদাকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। কিন্তু সে কারণে পরিবেশ ধ্বংস করে উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের চেয়ে যদি বিকল্প কোনো উপায় থাকে, তাহলে আমাদের সেটাই প্রথমে চেষ্টা করা উচিত। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে আমাদের সরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলো প্রায় সবই তাপ-বিদ্যুৎকেন্দ্র। অর্থাৎ সেখানে মূল্যবান গ্যাস পুড়িয়ে পানিকে বাষ্পে রূপান্তর করে সেই বাষ্প দিয়ে টারবাইন ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। এসব কেন্দ্রে উৎপাদিত বিদ্যুতের ইউনিট প্রতি গ্যাস খরচ ১ দশমিক ৭০ টাকা থেকে ৩ দশমিক ২৮ টাকা পর্যন্ত; সার্বিক উৎপাদন খরচ আরো বেশি। ফলে এই কেন্দ্রগুলো লোকসান দিয়ে বিদ্যুৎ বিক্রি করে। অন্যদিকে বেসরকারি পর্যায়ে ৪ মেগাওয়াটের জেনারেটর বিশিষ্ট ছোট ছোট গ্যাস জেনারেটর বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ইউনিট প্রতি গ্যাস খরচ মাত্র শূন্য দশমিক ৭ টাকা এবং সার্বিক উৎপাদন খরচ প্রায় ১ দশমিক ৭৫ টাকা। এরা পিডিবির কাছে ৩ দশমিক ২৬ টাকা প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ বিক্রি করেও মুনাফা করছে।
আমাদের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশে বড় বড় বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পের অভিজ্ঞতা হচ্ছে, এগুলো চালু থাকলে যত লোকসান হয়, বন্ধ থাকলে তার চেয়ে কম লোকসান হয়। এ অবস্থায় গ্যাসে পরিচালিত বড় বড় তাপ-বিদ্যুৎকেন্দ্রের বদলে অনেক ছোট ছোট গ্যাস জেনারেটর বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করলে বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত গ্যাস দিয়েই দেশের চাহিদা মেটানোর মতো বিদ্যুৎ আরো কম খরচে ও বিনা লোকসানে দেয়া সম্ভব হবে। তাছাড়া এই ছোট ছোট (মাত্র ৪ মেগাওয়াট) জেনারেটরগুলোর একটি ইউনিট নষ্ট হলেও তার রক্ষণাবেক্ষণ যেমন সহজ, তেমনি এর ফলে পুরো বিদ্যুৎ ব্যবস্থায় প্রভাব হয় খুবই নগণ্য।
আন্তর্জাতিক সমুদ্র চার্ট অনুযায়ী সন্দ্বীপ চ্যানেলে জোয়ার-ভাটা স্রোতের বেগ
বিদ্যুৎ উৎপাদনের আরেকটি সহজ পথ হতে পারে উপকূলীয় অঞ্চলে জোয়ার-ভাটা স্রোত ব্যবহার করে টাইডাল বিদ্যুৎকেন্দ্র। মাত্র ২ নটিক্যাল মাইল বেগের জোয়ার-ভাটা স্রোত থেকে অস্ট্রেলিয়ায় টাইডাল বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। সেই তুলনায় আমাদের বিশাল উপকূলীয় অঞ্চলের সব স্থানেই জোয়ার-ভাটা সমুদ্র স্রোতের বেগ ২ নটিক্যাল মাইলের চেয়ে বেশি। এমনকি আন্তর্জাতিক সমুদ্র চার্ট অনুযায়ী সন্দ্বীপ চ্যানেলে জোয়ার-ভাটার বেগ ৫ দশমিক ৫ নটিক্যাল মাইল (চিত্র-৫)। শুধু এই চ্যানেলে ধারাবাহিক ভাসমান বা সাবমার্জিবল টারবাইন বসিয়ে ২০০-৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। এছাড়াও চট্টগ্রাম উপকূলের অন্যান্য স্থান, মেঘনা নদীর মোহনা ও সমগ্র দক্ষিণ উপকূলজুড়ে আরো প্রায় ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব, যা দিয়ে পুরো উপকূলীয় উপজেলাগুলোর বিদ্যুৎ চাহিদা মিটিয়েও জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা সম্ভব।
আমাদের দেশের জন্য অবশ্যই বিদ্যুৎ প্রয়োজন। তবে সেই বিদ্যুৎ উৎপাদন করার আরো পরিবেশবান্ধব ও সাশ্রয়ী উপায় থাকতে সুন্দরবনের মতো প্রাকৃতিক বর্ম নষ্ট করে রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। তাও আবার এমন একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে, যে প্রতিষ্ঠানটি তার নিজের দেশেই এই বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য পরিবেশগত ছাড়পত্র পায়নি। বিদ্যুৎ সঙ্কট মেটাতে যদি আমাদের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করতেই হয়, তবে সেটা অন্য কোনো জায়গায় করা যেতে পারে যেমন- শরীয়তপুর, মাদারী-পুর, বরিশাল, পটুয়াখালী, মুন্সীগঞ্জ ইত্যাদি; কিন্তু অবশ্যই সুন্দরবনের আশপাশে নয়। সুন্দরবন ও এর বাস্তুব্যবস্থা এবং জীববৈচিত্র্যকে বাঁচাতে চাইলে অবশ্যই রামপালে প্রতিষ্ঠিতব্য কয়লাভিত্তিক তাপ-বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পটি বাতিল করতে হবে।
[কৃতজ্ঞতা স্বীকার: মোহাম্মদ তৌসিফ সালাম, কল্লোল মোস্তফা, পিনাকী ভট্টাচার্য, মইনুল আহসান সাবের ও হাসান মাহিন]
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে আগস্ট, ২০১৩ রাত ১১:১১