আগের পর্বগুলোর এখানে পাবেনঃ
ইসলামে নারী নেতৃত্ব (পর্ব-০১)
ইসলামে নারী নেতৃত্ব (পর্ব-০২)
ইসলামে নারী নেতৃত্ব (পর্ব-০৩)
প্রথমে ২ পর্ব, পরে ৩ পর্বে শেষ করবো ভাবলেও কলেবর বৃদ্ধির কারণে তা করতে অপারগ হওয়ায় তা সকলেই ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবনে বলে আশা করি।
এই পর্বে নিখাদ আলোচনা করতে চাই এখন পর্যন্ত যা লিখেছি তার সাপেক্ষে।
একেবারে প্রথম পর্বেই বলেছি যে লোকমুখে একটা কথা রটা “ইসলামে নারী নেতৃত্ব হারাম।” অথচ এ ধরনের কোন সরাসরি উদ্ধৃত নেই। সুতরাং এই কথা থেকে আমরা দায়মুক্ত হতে পারি।
এবার প্রসংগ, তাহলে যে দুটো হাদীসের রেফারেন্স দিলাম সেগুলো?
এখানে যথেষ্ট মতভেদ আছে।
রাসূল (সাঃ) যখন জানতে পারলেন যে ইরান (তৎকালীন পারস্য) এর রাষ্ট্রপ্রধানের কন্যাকে পারস্যবাসী নিজেদের বাদশাহ বানিয়েছে তখন এ খবর শুনে রাসূল (সাঃ) এরশাদ করলেন-
“যে জাতি নিজেদের জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় ব্যাপারের দায়িত্বসমূহ কোন নারীর ওপর সোপর্দ করে সে জাতি কখনোই প্রকৃত কল্যাণ এবং সার্থকতা লাভ করতে পারে না।” .................................(বুখারী,তিরমিযী,নাসাঈ)
এই হাদীসের বর্ণনাকারী নিয়েই মতভেদ এবং এই হাদিস কতটুকু সহিহ তা শুরু।
১, এছাড়াও, তাকে হযরত উমর(রাঃ) এর খেলাফতের সময় মিথ্যা বলার কারণে শাস্তি দেয়া হয়েছিল।
২, অনেকেই বলেন যে, এই হাদিসের শব্দমালা রাসূল(সাঃ) পারস্যের ক্ষমতার পট পরিবর্তনের সাথে সংযুক্ত করে বলেছেন (পারস্য তখন বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র ছিল না)
৩, এই হাদীস বর্ণনা করেছেন আবু বকর নামে একজন সাহাবী ( ইসলামের প্রথম খলিফা আবু বকর(রাঃ) কোন ক্রমেই নন) যিনি এই হাদীস উদ্ধৃত করেছেন রাসূল(সাঃ) এর অন্তর্ধানের ২৫ বছর পর উটের যুদ্ধের পরে; যখন যুদ্ধে হযরত আয়েশা(রাঃ) পরাজিত হয়েছেন হযরত আলী(রাঃ) এর কাছে এবং আবুবকর এ যুদ্ধে আয়েশা(রাঃ) এর হয়ে অংশ নিয়েছিলেন।
৪, ফাতিমা মার্নিসি (মরোক্কের একজন মুসলিম নারীবিদ) আরেকটি কারণ দেখান যে, আবু বকর সুযোগসন্ধানী হিসেবে এই হাদীস উদ্ধৃত করেন যাতে তার যুদ্ধকালীন প্রতিপক্ষ আলী(রাঃ) এর সহানুভূতি অর্জন করা যায়। (এটা একান্তই তার ব্যক্তিগত অভিমত, তাই এটা নিয়ে কথা বাড়াচ্ছিনা)
** যদি ১ নং ঘটনা সত্য হয় তাহলে ইমাম মালিক(রহঃ) এর মতে এই হাদিসটি গ্রহনযোগ্য নয় (এমন কি আবু বকর আর যেসব হাদীস বর্ণনা করেছেন সেগুলো ও)
যদি ২ নং সত্য বলে প্রতিভাত হয় , তাহলে হাদিসটি একটা নির্দিষ্ট স্থান এবং ঘটনার প্রসংগ, সার্বিক নয়।
যদি ৩ নং প্রমাণিত হয়, এটা হাদিসকে দুর্বল করে ফেলে।
প্রসঙ্গক্রমে আরও যোগ করতে চাই যে, একই হাদীসের একাধিক বর্ণনাকারী পাওয়া গেলে সেই হাদিসের শুদ্ধতা নিয়ে তত প্রশ্ন জাগেনা। কিন্তু আলোচ্য হাদীসের একজন বর্ণনাকারী ই পাওয়া যায়, অন্য কেউ এইরকম হাদীস বর্ণনা করেন নি।
((উল্লেখযোগ্য যে, Mohammad Hashim Kamali এর Hadith Studies বইয়ের তথ্য অনুযায়ী, যখন ইমাম বুখারী(রহঃ) সংগ্রহের কাজ শেষ করেন তিনি সেটা সেই সময়ের ইসলামী পণ্ডিতদের ( আহমদ ইবনে হান্বাল সহ প্রমুখ) যারা চারটি হাদিসকে দুর্বল বলে চিহ্নিত করেন, কিন্তু বুখারী(রহঃ) সেগুলো রেখে দেন যেহেতু তিনি এ ব্যাপারে যথেষ্ট বিশ্বাসী ছিলেন। তারপরও বুখারী(রহঃ) তাঁর সংকলনের ভূমিকা পত্রে লিখেছেন যে মানুষ হিসেবে ভুল হতেই পারে তাঁর। এছাড়াও হাদীস বিশেষজ্ঞরা বুখারী শরীফের ৪৩০ জন বর্ণনাকারীর মধ্যে ৮০ জনের বর্ণনাকৃত হাদীস নিয়ে প্রশ্ন রেখেছেন কিংবা দুর্বল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, আর ৮৯টি হাদিসকে চিহ্নিত করা হয়েছে “কিছু ত্রুটি আছে” এই বিবেচনায়। এটা কিন্তু কোনভাবেই বুখারী শরীফের সম্মানকে প্রশ্নবিদ্ধ করা নয় বরং প্রগাঢ় সত্য অনুধাবনে এই গবেষণার কাজে জড়িতদের মতামত সম্পর্কে অবগত থাকা।))
এবার একটু কিয়াস আর ইজতিহাদী মাসআলা নিয়ে আলোচনা করছি। কিয়াস হচ্ছে ইসলামী ফিকহ এর ৪র্থ উৎস, কোন বিষয় নিয়ে যখন কোরআনে সুস্পষ্ট নির্দেশনা পাওয়া যাবেনা, এরপরে হাদীসেও পাওয়া যাবেনা এমন কি ইজমাহ তেও না; তার সমাধান এর জন্য কিয়াস আরোপিত হয় হক্কানী পন্ডিতগণের সিদ্ধান্তে ; তবে অবশ্যই কোরআন এবং সুন্নাহ্র ভিত্তিতে।
আর ইজতিহাদী মাসআলা (কিয়াসের একটা অংশ) হচ্ছে এমন বিষয়াদি যেগুলোতে সরাসরি কোন সর্বাঙ্গীন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়না। উদাহরণ দিয়ে স্পষ্ট করি; ইংরেজ শাসনামলে খন্ড ভারত আর অখন্ড ভারত সমর্থনের বিষয়টি ছিল ইজতিহাদী মাসআলা। উভয় পক্ষেই হক্কানী এবং যুগের শ্রেষ্ঠ আলেমগণ ছিলেন। দেওবন্দ আলেমরা এই বিষয় নিয়ে স্পষ্টত দু ভাগ হয়ে পড়েন। দারুল উলুম দেওবন্দের সদ্রুল মুদার্রিস শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাব্বির আহ্মদ ওসমানী(রহঃ) এর নেতৃত্বাধীন আলেমগণ খন্ড ভারত (অর্থাৎ পাকিস্তান সৃষ্টি) আর শায়খুল ইসলাম আল্লামা সাইয়্যেদ হোসাইন আহ্মদ মাদানী(রহঃ) এর নেতৃত্বে আলেমগণ অখণ্ড ভারত এর পক্ষে আন্দোলন চালিয়ে যান।
এখন, প্রশ্ন হচ্ছে যে “নারী নেতৃত্ব” নিয়ে কোরআন কিংবা হাদিসে সুস্পষ্ট নির্দেশনা (হ্যাঁ/না সূচক) আছে? উত্তর হচ্ছে, নেই। যেভাবে উদ্ধৃত আছে (হাদিস সহিহ কিংবা নয়; যেটাই হোক) সেখান থেকে দৃশ্যমান হয় যে নারী নেতৃত্বকে বলা হচ্ছে “এটি মাত্র অনুত্তম।” সরাসরি নিষেধ কিংবা হারাম কোথাউ বলা নেই।
আলোচনা এখানে শেষ করলে অপূর্ণ থেকে যায় বিধায় ২য় পর্বে হুদায়বিয়ার সন্ধি প্রসংগ উত্থাপন। ভাল করে যদি আপনারা ঘটনা প্রবাহ খেয়াল করেন (হুদায়বিয়ার সন্ধি) তাহলে স্পষ্ট দেখবেন যে ইসলামের চরম অপমান করা হয়েছে সন্ধিতে (আপাত দৃষ্টিতে); আল্লাহকে অস্বীকার করা; রাসূল (সাঃ) যে আল্লাহ্র রাসূল সেটায় অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করা কাফেরদের সেই পত্রে রাসূল(সাঃ) সম্মত হয়েছেন। আপনার চিন্তার ডাল পালা এখান থেকেই মেলে ধরুন কিছু প্রশ্নের আলোকে---
=> আল্লাহকে অস্বীকার করা এই সন্ধিতে কেন রাসূল(সাঃ) চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন?
=> আল্লাহ্র রাসূল(সাঃ) কে অস্বীকার করা এই সন্ধিতে কেন রাসূল(সাঃ) চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন?
=> মুসলমানদের উপর একরোখা এই সন্ধিতে কেন রাসূল(সাঃ) চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন?
=> উমর(রাঃ) এর বক্তব্যের প্রেক্ষিতে রাসূল(সাঃ) কেন ওরকম বলেছিলেন?
উত্তরটা জানতে হলে কোরআনের আয়াত খুঁজে নিতে হবে, সূরা আল-ফাতহের ১-২ নং আয়াতে আল্লাহ্ বলেন,
“হে নবী, আমি তোমাদের জন্য সুস্পষ্ট বিজয়ের উদ্বোধন করেছি যেন আল্লাহ্ তোমার আগের ও পেছনের সকল গুনাহ মাফ করে দেন, তোমার উপর তাঁর নিয়ামত পূর্ণ করেন এবং তোমাকে নির্ভুল পথে পরিচালিত করেন।”
একই সূরার ২৭ নং আয়াতে আল্লাহ্ বলেন,
“আল্লাহ্ তাঁর রাসূলের স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করেছেন। তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন যে তিনি শীগ্রই নিরাপদে ও নির্ভয়ে মক্কায় প্রবেশ করবেন। আল্লাহ্র ইচ্ছায় তোমরা অবশ্যই মসজিদুল হারামে নিরাপদে মাথার চুল মুন্ডিয়ে ও ছেটে নির্ভীকচিত্তে প্রবেশ করবে। সে (আল্লাহ্র রাসূল) সেই জিনিস অবগত হয়েছে যা তোমরা অবগত হওনি। ঐ ঘটনার (হুদায়বিয়া সন্ধি) পরেই নির্ধারিত রেখেছেন আসন্ন বিজয়।”
যেহেতু পবিত্র কোরআন এবং হাদীসে নারী নেতৃত্ব এর ব্যাপারে সুস্পষ্ট নির্দেশনা নেই সেহেতু এই জায়গাতে অনেক ব্যাখ্যা থাকবেই। হুদায়বিয়া সন্ধিতে রাসূল(সাঃ) মুসলমানদের জন্য (আপাতদৃষ্টিতে) অপমানজনক চুক্তিতে সম্মত হয়েছিলেন শুধুমাত্র আল্লাহ্র নির্দেশে এক ঐতিহাসিক বিজয়ের জন্য, সেই বিজয় যা ইসলামের জয়ের ইতিহাসকে করেছে এর আগের কয়েক বছরের চেয়ে অনেক বেশি মাত্রায় উজ্জ্বল এবং স্মরণীয়। হাদীসের রেফারেন্স, সাবার রাণীর ঘটনা সহ অন্যান্য দিকের পরেও যে দিকটি আমরা ভুলে না যাই সেটি হল “পরিস্থিতি”। মনে রাখবেন,গুরুতর প্রয়োজনে ইসলাম “pork ” অর্থাৎ “Meat from a domestic hog or pig” খাওয়াকে মেনে নেয়; তাই “পরিস্থিতি” অনেক কিছুর নির্দেশক।
আগেই বলেছিলাম, “লেখাটির কোথাও আমি ব্যক্তিগতভাবে নিজস্ব কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হচ্ছিনা এবং কাউকে পরামর্শ দেবার ঔদ্ধত্ব্য ও দেখাচ্ছিনা। শুধু আলোচনা করতেই এই প্রয়াস। ইসলাম সর্বদা আলোচনাকে উৎসাহ প্রদান করে।”
বুখারী শরীফের হাদিস অনুযায়ী , এহেন আলোচনার মাধ্যমে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হলে তার জন্য যেমনি সওয়াব; ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত হলেও তার জন্য সওয়াব। আর ভুল ঠিকের নির্ধারক কিন্তু মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন।
শেষ করছি পবিত্র কোরআনের কয়েকটি আয়াত দিয়েঃ
১) এটি একটি গ্রন্থ, যা আপনার প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে, যাতে করে আপনি এর মাধ্যমে ভীতি-প্রদর্শন করেন। অতএব, এটি পৌছে দিতে আপনার মনে কোনরূপ সংকীর্ণতা থাকা উচিত নয়। আর এটিই বিশ্বাসীদের জন্যে উপদেশ।(সূরা আরাফ: আয়াত ২)
২) এটা মানুষের একটি সংবাদ-নামা এবং যাতে এতদ্বারা ভীত হয় এবং যাতে জেনে নেয় যে, উপাস্য তিনিই-একক; এবং যাতে বুদ্ধিমানরা চিন্তা-ভাবনা করে। (সূরা ইবরাহিম: আয়াত ৫২)
৩) আপনাকে ক্লেশ দেবার জন্য আমি আপনার প্রতি কোরআন অবতীর্ণ করিনি। কিন্তু তাদেরই উপদেশের জন্য যারা ভয় করে। (সূরা ত্বাহা: আয়াত ২-৩)
৪) আমি রসূলকে কবিতা শিক্ষা দেই নি এবং তা তার জন্যে শোভনীয়ও নয়। এটা তো এক উপদেশ ও প্রকাশ্য কোরআন। যাতে তিনি সতর্ক করেন জীবিতকে এবং যাতে কাফেরদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়। (সূরা ইয়াসীন: আয়াত ৬৯-৭০)
৫) আমি কোরআনকে সহজ করে দিয়েছি বোঝার জন্যে। অতএব, কোন চিন্তাশীল আছে কি? (সূরা কামার: আয়াত ১৭)
আল্লাহ্ আমাদের সহায় হোন। আমিন।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জুন, ২০১৩ রাত ১১:০৪