ভুলতে বসা সোনালী অতীত, বাংলাদেশের জাহাজ
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
আমাদের দেশের ভৌগোলিক অবস্থান ছোট হলেও আমরা জাতি হিসেবে ছিলাম অনেক বড়। কিন্তু হীনতা, দীনতা, হতাশার করাল গ্রাস আমাদের মাথাকে নুয়ে দিয়েছে। আমরা আবার বড় হতে চাই। তাই আমাদের গৌরবময় অতীত জানা দরকার। জানানো দরকার সবাইকে।
আমাদের নৌশিল্পের গৌরবোজ্জ্বল অতীত কাহিনী অনেকেরই অজানা। এর কিছুটা ধারণা পাওয়া যায় আমাদের প্রাচীন সাহিত্য থেকে। আমাদের লোকগীতি, পালা গান, মঙ্গল কাব্যে আছে আমাদের নৌকা ও জাহাজের কথা।
পূর্ববঙ্গ গীতিকার এক সাহসী চরিত্র নছর মালুম। নছর মালুম সাগর পাড়ি দেয়া জাহাজের নাবিক।
বাহির দরিয়ায় যখন
আসিল দুলুপ।
ঝাপটাইন্যা বয়ারে পড়ি
রইল ডুপ ডুপ।।
নছর মালুম যাইয়া
ধরিল ছুয়ান।
সাইগরে উঠিছে ঢেউ
মুড়ার সমান।।
মধ্য যুগের কবি বিজয় গুপ্তের মনসা মঙ্গল কাব্য। তাতে আছে চাঁদ সদাগরের কাহিনী। আছে সপ্তডিঙ্গা মধুকরের কাহিনী। চাঁদ সদাগরের বাণিজ্য বহরে ছিল বিশাল বিশাল সব জাহাজ। প্রতিটা জাহাজ যেন একটা ভাসমান শহর। তেমনি এক জাহাজের নাম গুয়ারেখী। তার মাস্তুল যেন পর্বত সমান। মাস্তুলে চরে রাবণের লঙ্কা দেখা যায়।
তার পাছে বাওয়াইল ডিঙ্গা
নামে গুয়ারেখী,
যার উপরে চরিয়া
রাবণের লঙ্কা দেখি।
বাংলা লোকসাহিত্যের আরেকটি জনপ্রিয় চরিত্র সয়ফুল মুলুক। সে ছিল মস্ত বড় সওদাগর। তার ছিল হাজার মাল্লার নাও। সে নাও নিয়ে সাত সাগর পাড়ি দিয়ে সয়ফুল মুলুক যায় কোয়েকাফের জঙ্গলে। মুক্ত করে বন্দি থাকা রাজকন্যাকে।
পুরনো সাহিত্যের ধূসর পাতা থেকে জানা যায় আমাদের জাহাজের নামগুলো। মধুকর, ময়ূরপঙ্খী, রাজহংস, রত্নপতি, শঙ্খচূড়, সমুদ্রফেন, উদয়তারা, কাজলরেখা, গুয়ারেখী, টিয়াঠুটি, বিজুসিজু ভাড়ার পটুয়া ইত্যাদি। এদের মধ্যে গুয়ারেখী, টিয়াঠুটি, বিজুসিজু, ভাড়ার পটুয়া নামগুলো প্রাকৃত শব্দ। আমাদের নৌশিল্পের আরো প্রাচীন যুগের সাক্ষী এসব শব্দ।
লোকসাহিত্যের তথ্য নিয়ে অনেকেরই সন্দেহ থাকতে পারে। কিন্তু ইতিহাসের বইয়ের ও তাম্রলিপির তথ্য তাদের সন্দেহ মুছে দেবে।
বৌদ্ধদের প্রাচীনতম বই ‘মিলিন্দ পান হো’। প্রথম খ্রিস্টাব্দে লেখা বইটিতে নৌ চলাচলের জন্য প্রসিদ্ধ কয়েকটি দেশের নাম আছে। সে তালিকায় আছে বাংলাদেশের নাম আর বাংলাদেশের জাহাজের কথা।
‘পেরিপ্লাস অব দি ইরিথ্রিয়ান সী’। প্রায় দুই হাজার বছর আগে ষাট খ্রিস্টাব্দে লেখা একটি বই। বইটিতে আছে আমাদের জাহাজের কথা। আমদের প্রাচীন ‘গাঙ্গে’ বন্দর থেকে ‘কোলান্দিয়া’ জাহাজ যেতো আরব, চীন, জাপান, জাভা, সুমাত্রা আর শ্রীলংকার বন্দরে।
জাভাতে বরোবুদুর নামে একটি প্রাচীন মন্দির আছে। সেই মন্দিরের গায়ে আঁকা আছে আমাদের জাহাজের ছবি।
আমাদের জাহাজ যে প্রাচীন কালে সাগর পাড়ি দিত এই ছবি তার প্রমাণ।
আগের দিনে বড় বড় ঘটনা লিখে রাখা হতো তামার লিপিতে। ফরিদপুরে পাওয়া একটি তাম্রলিপিতে আছে আমদের ‘নবাত ক্ষেণী’ বা জাহাজ নির্মাণকেন্দ্রের কথা।
পাল ও সেন যুগের তাম্রলিপিতে বাংলার শক্তিশালী নৌবাহিনী ও রণতরীর কথা লেখা আছে।
ভাটেরার তাম্রলিপিতে আছে সিলেটের ঈশাণদেবের যুদ্ধ জাহাজের কথা। মোঘল আমলে দিল্লির সম্রাটরা সিলেটের রাজাদের কাছ থেকে কর হিসেবে টাকা পয়সা নিতেন না। কর হিসেবে নিতেন যুদ্ধ জাহাজ। সিলেটের জাহাজ ছিল মোঘলদের প্রিয়।
মধ্যযুগের ভারতবর্ষের ইতিহাসের জন্য নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ আবুল ফজলের ‘আইন-ই-আকবরী’। তাতে লেখা আছে নৌযান নির্মাণে বাংলাদেশ ছিল সবার সেরা।
ফারসী ভাষার ইতিহাসবিদ শাহাবুদ্দিন তালিশ। তার বর্ণনায় উঠে এসেছে মোঘল সুবাদার ইসলাম খাঁ, মীর জুমলা, শায়েস্তা খাঁর আমলের নৌ বহরের কথা। সে সময় ঢাকার নৌবহরে তিন হাজার জাহাজ ছিল। সবচেয়ে বড় জাহাজের নাম ছিল সলব। তারপর ঘ্রাব, জলবা, কোশ, খালু, ধুম। এসব রণতরী জলদস্যু দমনে ব্যবহৃত হতো।
‘রিয়াজুস সালাতিন’ এক বিখ্যাত ইতিহাস গ্রন্থ। ১৭৮৮ সালে গোলাম হোসেন সলিমের লেখা এই বইয়ে আছে উঁচু গলইয়ের এক প্রকার রণতরীর কথা। এর গলুই দুর্গের প্রাচীর থেকেও উঁচু ছিল। ফলে যুদ্ধের সময় প্রাচীর ভেদ করা সহজ হতো।
বাংলাদেশের নৌশিল্প সম্পর্কে চমৎকার বিবরণ পাওয়া যায় বিদেশি পর্যটকদের কাছ থেকে। তেরো শতকে বাংলাদেশে আসেন মার্কোপোলো। তার বর্ণনায় উঠে এসেছে আমদের সাগরগামী জাহাজের কথা।
আমদের সাগরগামী জাহাজগুলো তৈরি হতো দুই প্রস্থ তক্তা দিয়ে। তার উপর আরেক প্রস্থ কাঠের আচ্ছাদন। ব্যবহার করা হতো ফার জাতের কাঠ। জাহাজের ডেকের নিচে থাকতো সারিসারি কেবিন। জাহাজের আয়তন অনুযায়ী কেবিনের সংখ্যা কমবেশি হতো। মার্কোপোলো একটি জাহাজে ষাটটি কেবিন দেখেছেন।
প্রতিটি জাহাজে থাকতো কয়েকটি অংশ। অনেকটা ট্রেনের বগির মতো। একটি অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও জাহাজের বাকি অংশ রক্ষা পেত। মার্কোপোলো কোন কোন জাহাজে তেরোটি অংশ দেখেছেন। এসব জাহাজ প্রায় পনের হাজার মণ পর্যন্ত মাল বহন করতে পারতো। প্রতিটি জাহাজের সাথে থাকতো কয়েকটি ছোট নৌকা। জাহাজের নোঙর ফেলাসহ আরো অনেক কাজ করতো এসব ছোট নৌকা।
মরক্কোর ইবনে বতুতা। চৌদ্দ শতকের পর্যটক। বাংলার প্রথম স্বাধীন সুলতান ফখরুদ্দীন মোবারক শাহের আমলে তিনি বাংলায় আসেন। তখন সোনারগাঁ একটি সমৃদ্ধ বন্দর। ইবনে বতুতা এখানে দেখেছেন চ্যাপ্টাতলা পাল তোলা জাহাজ। মজার ব্যাপার হলো তিনি আমাদের জাহাজে করেই জাভা ও চীন সফর করেন।
আরেক জগতখ্যাত পর্যটক মাহুয়ানও দেখেছেন সোনারগাঁ থেকে জাভা ও চীন পর্যন্ত নিয়মিত জাহাজ চলাচল।
পনের শতকের আরেক পর্যটক নিকোলকন্টি। বাংলাদেশে তখন মুসলিম শাসনের স্বর্ণযুগ। সে সময় নিকোলকন্টি বাংলায় এসে দেখেছেন বড় বড় জাহাজ। এসব জাহাজের কোন কোনটি বিশ থেকে পঁচিশ হাজার মণ মাল বয়ে নিত। তিনি ইউরোপে এত বড় জাহাজ কখনো দেখেননি।
ষোল শতকের আরেক বিখ্যাত পর্যটক সিজার দি ফ্রেডারিক। তার মতে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ জাহাজ নির্মাণ কেন্দ্র ছিল আমদের সন্দ্বীপ। সারা দুনিয়ায় ছিল সন্দ্বীপের জাহাজের নাম ডাক।
তুরস্কের সুলতান তখন দুনিয়ার নেতা। তিনিও জেনেছিলেন সন্দ্বীপের জাহাজের খ্যাতি। সন্দীপ থেকে অনেক জাহাজ তৈরি করে নেন সুলতান। এর আগে তুর্কীরা জাহাজ সংগ্রহ করতো মিসরের আলেকজান্দ্রিয়া থেকে। সেখানকার জাহাজ সুলতানকে সন্তুষ্ট করতে না পারলেও বাংলাদেশের সন্দ্বীপের জাহাজ সুলাতানকে মুগ্ধ করে।
সতেরো শতকের পর্যটক টেভারনিয়ার শায়েস্তা খানের আমলে ঢাকায় বিশাল বিশাল জাহাজ তৈরি হতে দেখেছেন। তার বিবরণ থেকে জানা যায় সে যুগের জাহাজ শিল্পের চরম উৎকর্ষতার কথা।
একই সময় ঢাকা সফর করেন টমাস বাউরি নামের আরেক ইংরেজ পর্যটক। তিনি লিখেছেন ‘পাতেলা’ নামের চ্যাপ্টা তলার জাহাজের কথা। তিনি নদীপথেরও কিছু জাহজের নাম বলেন। ওলোয়াকো, বাজারো, পারগু, ভূরা, মাসুল, কাঁটামারণ ইত্যাদি।
ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, সন্দ্বীপ ছাড়াও নৌ শিল্পের জন্য বিখ্যাত ছিল বরিশাল, যশোর, শ্রীপুর বন্দর।
তারপর ধীরে ধীরে আমরা হারিয়ে ফেললাম আমাদের এই গৌরব। উত্তাল সাগরের নাবিক নছর মালুম সাগর ভুলে কুয়ার ব্যাঙে পরিণত হলো। মসলিন, রেশম, লবণ, লবঙ্গ, এলাচের সওদা ফেলে চাঁদ সদাগর হলেন আদার ব্যাপারী। একদল বণিকরূপী হার্মাদ আমদের সোনার ছেলেদের বুক থেকে কেড়ে নিল সাগরের নেশা। বড়ই করুণ সে কাহিনী।
১৭৮৯ সাল। ১৪ই জানুয়ারি। ইংরেজ সরকার জারি করলো এক ফরমান। আইন করা হলো, বড় নৌকা তৈরি করা চলবে না। চাঁদপুরের দশ দাঁড় বিশিষ্ট ‘পঞ্চ ওয়েস’ নৌকা, চল্লিশ-পঞ্চাশ হাত লম্বা ‘লুখা’ নৌকা, তিরিশ-সত্তর হাত লম্বা ‘জেলিয়া’ নৌকা সবার জন্য একই আইন।
যেখানেই এসব নৌকা দেখা যেত ইংরেজ সরকার সেগুলো দখল করে নিতো। এমনকি ইংরেজ সরকারের লিখিত আদেশ ছাড়া কোন জমিদার তার এলাকায় কোন নৌযান মেরামতও করতে পারবে না।
সমুদ্রগামী জাহাজের বদলে এরপর শুধুই তৈরি হতে লাগলো ছোট ছোট নাও। এক মাল্লা, কোষা বা ডিঙ্গি যার নাম।
তিনশ’ মাল্লার বিরাট পাল তোলা জাহাজে হাল ধরতো যে দুরন্ত নাবিক- সে এখন পিঠ বাঁকা করে গুণ টনতে শুরু করলো কাশবনের ধার ঘেষে।
আমদের সাহিত্যে গুয়ারেখী, সপ্তডিঙ্গা মধুকর আর থাকলো না। নছর মালুম, সয়ফুল মুলুক, চাঁদ সদাগর হলেন ডিঙ্গি নৌকার মাঝি।
ছিপ খান তিন দাঁড়
তিনজন মাল্লা,
চৌপর দিন ভর
দেয় দূর পাল্লা।
তথ্যসূত্রঃ ১. সেনার দেশ বাংলাদেশ – মোহাম্মদ আবদুল মান্নান
২. উইকিপিডিয়া
৩. ছবি – নেট থেকে সংগৃহীত
১৫টি মন্তব্য ১৪টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
চাই সরাসরি দুইস্তর বিশিস্ট প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন: নতুন বাংলাদেশের অঙ্গীকার
ভূমিকাঃ
ছাত্র-জনতার সফল জুলাই বিপ্লবের পর আজ বাংলাদেশ গণতন্ত্র, মৌলিক মানবাধিকার, আইনের শাসন ও প্রকৃত উন্নয়নের এক নতুন পথে যাত্র শুরু করেছে। নোবেল লরিয়েট ড। ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তবর্তীকালীন সরকার... ...বাকিটুকু পড়ুন
=শোকর গুজার প্রভুর তরে=
প্রভু তোমার দয়ার কথা, বলে হয় না শেষ তো
কত রিযিক আহার দিয়ে, রাখছো মোদের বেশ তো!
তোমার সৃষ্টির কেরামতি, নেই কো বুঝার সাধ্য
তোমার বান্দা তোমার গোলাম, শুধু তোমার বাধ্য!
গাছে... ...বাকিটুকু পড়ুন
সুপার সানডে : সংঘর্ষ ও নৈরাজ্যের পথে বাংলাদেশ!
আজকের দিনটি বাংলাদেশের সচেতন মানুষের দীর্ঘদিন মনে থাকবে। এত সংঘর্ষ ও মারামারি অনেকদিন পর ঢাকাবাসী প্রত্যক্ষ করলো। দেশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে মানুষ আগে থেকেই উদ্বিগ্ন তার উপর বিভিন্ন অবরোধ... ...বাকিটুকু পড়ুন
ভয়েস অব আমেরিকার জরিপে সংস্কার শেষে ভোটের পক্ষে রায় দিয়েছে ৬৫.৯ % মানুষ
পাগল ও নিজের ভালো বুঝে ,কখনো শুনেছেন পাগল পানিতে ডুবে মারা গেছে কিংবা আগুনে পুড়ে মারা গেছে ? মানসিক ভারসাম্য না থাকলেও মানুষের অবচেতন মন ঠিকই বুঝে আগুন ও পানি... ...বাকিটুকু পড়ুন
ইউনূস সরকার নিজেই নিজের চাপ তৈরি করছে
ইউনূস সরকার সব সংস্কার কিংবা কাজ করতে পারবে না ,সেটা নিয়মিতর নিয়ম মেনে নিতে হবে । রাজনৈতিক দলগুলো , যে কালচার তৈরি করে গেছে সেটা এই সরকার আমূলে বদলে দিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন