বিষয়টি দুঃখজনক না সুখকর ঠিক বলতে পারছি না। তা হল ইদানীং সকলেই ইসলাম ও তার সংস্কৃতি নিয়ে মতামত প্রকাশ করতে শুরূ করেছেন। একজন অমুসলিম বলে দেন এটা ইসলাম সাপোর্ট করে, এটা করে না। একজন নাস্তিক, তিনিও বলেন, এটা ইসলামে নিষিদ্ধ নয়। একজন নৃত্যশিল্পী, তিনিও বলেন, এ কাজটি ইসলাম সম্মত। একজন কণ্ঠ শিল্পী, তিনিও মতামত দেন, এ কাজটা ইসলামে জায়েয আছে। একজন কথা শিল্পী, যার কথার শিল্প ছাড়া অন্য কোন গতি নেই, তিনিও বলেন, এটা ইসলামে নিষিদ্ধ নয়। আবার প্রমাণও উপস্থাপন করেন।
এ অবস্থাটা যদি ইতিবাচক দিক থেকে নেয়া হয়, তাহলে বলা যায়, সকলের মধ্যে ইসলামী চেতনা কাজ করছে। সকলেই ইসলামকে গুরুত্ব দিতে শুরু করেছে। ইসলাম সম্পর্কে পড়াশুনা ও গবেষণা করতে চাচ্ছে। তাই সকলে ইসলাম সম্পর্কে মতামত দিতে চায়।
আর যদি বিষয়টি নৈতিবাচক দিক দিয়ে নেয়া হয়, তাহলে বলতে হয়, বিষয়টি খুবই বিপদ-জনক। যাদের ইসলাম সম্পর্কে ভাল জ্ঞান নেই, তারা যদি ইসলাম সম্পর্কে ফতোয়া দিতে শুরু করে, তাহলে ইসলাম অবিকৃত থাকার বিষয়ে হুমকি সৃষ্টি হয়। যেমনটি হয়েছে খৃস্ট ধর্মের ব্যাপারে। যে দৃষ্টিতেই বিষয়টি দেখা হোক না কেন, পরিণতির বিচারে আসলে এটা খুব বিপদ-জনক। বিশেষ করে মুসলিম উম্মাহর জন্য। এটা তাদের পথ-বিচ্যুত হওয়ার একটি স্পষ্ট আলামত। যে বিপদ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সা. সতর্ক করেছেন একাধিকবার।
যুক্তি ও বাস্তব দাবী ছিল, এ সকল বিষয়ে ইসলামী স্কলার বা শরীয়তবিদগন মতামত দেবেন। কিন্তু দেখা যায় তাদের মতামত চাওয়া হয় না, বা মতামত দিলে গ্রহণ করা হয় না। বা তাদের মতামত সঠিক মনে করা হয় না।
একটি বিতর্ক ঃ ভাস্কর্য না মূর্তি
বিমানবন্দর গোল চক্করে লালনের ভাস্কর্য নির্মাণ করা হচ্ছিল। মুসলমানদের বাধার মুখে কর্তৃপক্ষ তা গত ১৫ই অক্টোবর -২০০৮ তারিখে তা সরিয়ে নেয়। এরপর এ নিয়ে দেখা যায় তুমুল বিতর্ক। কিছু লোক এটি পুনস্থাপনের পক্ষে আন্দোলন শুরূ করে। আবার অনেকে এখানে হজ মিনার নির্মাণের পক্ষে আন্দোলন আরম্ভ করে। এটিকে কেন্দ্র করে বুদ্ধিজীবিদের মধ্যে দেখা যায় বিতর্ক। চলছে প্রিন্ট মিডিয়ায় লেখালেখি। রেডিও টিভিতে টক শো, বিভিন্ন রকম অভিনব পদ্ধতির প্রতিবাদ ইত্যাদি।
ঘটনার বিবরণ দেয়া আমার উদ্দেশ্য নয়। এখানে আমার আলোচ্য বিষয় হল, কিছু সংখ্যক বুদ্ধিজীবি বলেছেন, ‘বিমান বন্দর গোল চক্করে যা নির্মাণ করা হচ্ছিল ওটা মূর্তি নয়, ভাস্কর্য।’ তারা ‘মূর্তি’ ও ‘ভাস্কর্য’কে আলাদাভাবে সজ্ঞায়িত করতে চান। বুঝাতে চান দুটো এক বিষয় নয়। তাদের কথা হল, মূর্তি ইসলামে নিষিদ্ধ হলেও ভাস্কর্য নিষিদ্ধ নয়।
এ বিষয়টি আলোচনা করতে কয়েকটি বিষয় বিবেচনা করা হবে ঃ
আভিধানিক অর্থে ভাস্কর্য ঃ
ভাস্কর্য অর্থ ঃ Sculpture (স্কালপচার)। যে আকৃতি বা ছবি খোদাই করে তৈরী করা হয়, তাকে ভাস্কর্য বলা হয়। যেমন বলা হয় ‘ভাস্কর্য বিদ্যা’ এর অর্থ হল ঃ The art of carving বা খোদাই বিদ্যা। যিনি এ বিদ্যা অর্জন করেছেন তাকে বলা হয় ভাস্কর (Sculptor) অর্থাৎ যিনি খোদাই করে আকৃতি বা ছবি নির্মাণ করেন। যেমন আছে অক্সফোর্ড অভিধানে ঃ One who carves images or figures. অর্থ্যাৎ যে ছবি অথবা আকৃতি খোদাই করে তৈরী করে।
মূর্তি অর্থ হল ছায়া। অর্থ্যাৎ এমন আকৃতি বা শরীর, যার ছায়া আছে।
ভাস্কর্য ও মূর্তির আভিধানিক অর্থে স্পষ্ট পার্থক্য দেখা গেল। ফলাফল দাড়াল, যে সকল আকৃতি খোদাই করে তৈরী করা হয়, তা হল ভাস্কর্য। রৌদ্র বা আলোর বিপরীতে এর ছায়া পড়ে না।
আর যে সকল আকৃতি এমনভাবে নির্মাণ করা হয়, রৌদ্রে বা আলোর বিপরীতে যার ছায়া প্রকাশ পায়, তা হল মূর্তি। বিভিন্ন অভিধানে এভাবেই বলা হয়েছে।
এখন প্রশ্ন হল, যে আকৃতিটা বিমান বন্দর গোল চক্করে নির্মাণ করা হচ্ছিল, এ সজ্ঞার বিচারে তা কি ভাস্কর্য -যেমনটি বলেছেন এর পক্ষের পণ্ডিত বুদ্ধিজীবিগণ- না মূর্তি -যেমনটি মনে করেছে মাদ্রাসার মূর্খ অবুঝ ছাত্ররা?
যারা সেটি প্রত্যক্ষ করেছেন নিজ চোখে কিংবা ছবিতে, তারা সকলেই দেখেছেন যে, ওটা এমন আকৃতি যার ছায়া আছে। এবং সেটি কোন কিছুর উপর খোদাই করে নির্মাণ করা হয়নি। কাজেই প্রমাণিত হল আভিধানিক অর্থে সেটি মূর্তি ছিল, ভাস্কর্য নয়।
এখন বড় একটা সমস্যা এসে যায়, তা হল, যে সকল বুদ্ধিজীবি, পণ্ডিত বলেছেন ওটা মূর্তি নয়, ভাস্কর্য, তারা কী ভুল করেছেন? কীভাবে ভুল করবেন? তারা বিমান বন্দরের আশে পাশে অবস্থিত মাদ্রাসার ছাত্রদের থেকে অভিধানের ক্ষেত্রে অনেক বেশী পণ্ডিত। বরং তারা অভিধান লিখেছেন ও শিখাচ্ছেন।
আমি এর উত্তর খুঁজতে চেয়ে যা বুঝেছি তা হল ঃ
এক. সম্ভবত বুদ্ধিজীবিরা ওখানে নির্মিতব্য লালনের আকৃতিটা দেখেননি। তারা মতলববাজ মিডিয়ায় প্রচারিত ‘ভাস্কর্য’ শব্দটি শুনে মনে করেছেন সত্যিই ওটা ভাস্কর্য, যা কোন দেয়ালে বা স্থাপনায় খোদাই করে নির্মাণ করা হচ্ছিল।
দুই. তারা মনে করেছেন, যদিও ওটা আভিধানিক অর্থে মূর্তি, ভাস্কর্য নয়। কিন্তু পারিভাষিক অর্থে ভাস্কর্য। তারা মনে করেছেন, যে সকল আকৃতি পূজা আরাধনার উদ্দেশ্যে নির্মাণ করা হয় সেগুলোকে মূর্তি বলে। আর যা পূজার জন্য নয়, তা হল ভাস্কর্য।
তিন. তারা খুব ভাল করেই জানেন যে, ভাস্কর্য ও মূর্তির মধ্যে আভিধানিক পার্থক্য কি? কিন্তু তারা ওটা নির্মাণের পক্ষে। আর মাদ্রাসার ছাত্ররা যেহেতু এর মধ্যকার পার্থক্যগুলো বুঝে না, তাই তাদেরকে ভুল বুঝানো যে, ওটি মূর্তি নয়। কাজেই তোমরা থেমে যাও। যা করেছ তা ভুল ছিল। তোমরা বোকা।
এক b¤^i উত্তরের জবাবে বলা যায়, যদি তারা নির্মিতব্য লালন আকৃতিটি না দেখে থাকেন, তাহলে তাদের এ বিষয়ে ফতোয়া দেয়া মোটেই উচিত হয়নি। কোন বিষয় মতামত দিতে হলে ভালভাবে বুঝে শুনে দিতে হয়। এ কথায় তারা ভিন্নমত পোষন করবেন বলে মনে করি না।
দুই b¤^i উত্তরের উত্তরে বলতে চাই, আপনার যেমন মনে করেছেন যে, পারিভাষিক অথের্, যে আকৃতির পূজা করা হয় সেটি মূর্তি। আর যার পূজা করা হয় না, সেটি ভাস্কর্য। আপনাদের এ ব্যাখ্যা কোথাও প্রচলিত নয়। যা প্রচলিত নয়, তা কখনো পারিভাষিক অর্থে ব্যবহার বলে মেনে নেয়া যায় না। বরং ছায়া দেয় এমন সকল আকৃতিকে মূর্তি বলে মানুষ জানে ও জানায়। যেমন, আমরা দেখেছি যখন লেলিনের দেহটি টেনে নামানো হল, তখন সকলে বলেছে ‘লেলিনের মূর্তি ..” এমনিভাবে যখন সাদ্দামের আকৃতি টেনে নামানো হল, তখন সকলে বলল, “সাদ্দামের মূর্তি নামিয়ে ফেলা হয়েছে।” তখন কেহ ভাস্কর্য বলেছে বলে শুনিনি। এমনিভাবে লোকে বলে ফেরআউনের মূর্তি, আব্রাহাম লিঙ্কনের মূর্তি ইত্যাদি। এ দুটো উদাহরণে প্রমাণ পাওয়া গেল যে, ওই আকৃতিগুলোর ছায়া ছিল ও খোদাই করে নির্মিত নয় বলে ওগুলো মূর্তি। আর ওগুলো পুজার জন্য স্থাপন করা হয়নি, তবু তা মূর্তি। অতএব দেখা গেল, ভাস্কর্য ও মূর্তির আভিধানিক অর্থই পারিভাষিক অর্থ হিসাবে প্রচলিত। সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য। পূজার জন্য হলেও মূর্তি, পূজার জন্য না হলেও মূর্তি। এখানে আমাদের বুদ্ধিজীবি ও পণ্ডিতদের জ্ঞানের দৈন্যতার আরেকটি প্রকাশ। তাদের প্রতি করুণা হয়।
তিনি b¤^i উত্তরের জবাবে বলব, অন্যকে বোকা বানিয়ে নিজেদের ¯^v_© চরিতার্থ করার প্রচেষ্টা কোন নৈতিকতার মধ্যে পড়ে না। যারা মানুষকে জ্ঞান দিতে চান তাদের থেকে এ ধরনের আচরণ জাতির জন্য খুবই দূর্ভাগ্যজনক।
কাজেই বিভিন্ন প্রকাশ্য স্থানে যে সকল মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে তাকে ভাস্কর্য বলে চালিয়ে দেয়া একটি মুর্খতা, একটি কাপুরুষতা, একটি কপটতা। উদ্দেশ্য হল, ভাস্কর্য শিল্পের নামে ইসলামী সংস্কৃতির বিরোধিতা করা এবং অন্ধকার যুগের পৌত্তলিক সংস্কৃতি-কে বাংলাদেশি জাতির সংস্কৃতি বলে প্রতিষ্ঠিত করা।
এক বুদ্ধিজীবির ফতোয়া ঃ
প্রিন্ট মিডিয়াতে এ বিষয়ে অনেক বুদ্ধিজীবির ফতোয়া প্রকাশিত হয়েছে। আমি এর মধ্য থেকে বহুল প্রচারিত একটি প্রবন্ধ নিম্নে তুলে ধরছি।
তিনি ‘এখন কোথায় যাব কার কাছে যাব’ শিরোনামে লিখেছেন ঃ
আমাদের মহানবী (সা.) কাবা শরিফের ৩৬০টি মূর্তি অপসারণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। দেয়ালের সব ফ্রেসকো নষ্ট করার কথাও তিনি বললেন। হঠাত তাঁর দৃষ্টি পড়ল কাবার মাঝখানের একটি স্তম্ভে। যেখানে বাইজেন্টাইন যুগের মাদার মেরির একটি অপূর্ব ছবি আঁকা। নবীজী (সা.) সেখানে হাত রাখলেন এবং বললেন, ‘এই ছবিটা তোমরা নষ্ট কোরো না।’ কাজটি তিনি করলেন সৌন্দর্যের প্রতি তাঁর অসীম মমতা থেকে। মহানবীর (সা.) ইন্তেকালের পরেও ৬৮৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ধর্মপ্রাণ খলিফাদের যুগে কাবা শরিফের মতো পবিত্র স্থানে এই ছবি ছিল, এতে কাবা শরিফের পবিত্রতা ও শালীনতা ক্ষুণ্ন হয়নি।
মহানবীর (সা.) প্রথম জীবনীকার ইবনে ইসহাকের (আরব ইতিহাসবিদ, জন্ন: ৭০৪ খৃষ্টাব্দ মদিনা, মৃত্যু: ৭৬৭ খৃষ্টাব্দ বাগদাদ) লেখা দি লাইফ অব মোহাম্মদ গ্রন্থ থেকে ঘটনাটি বললাম। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত বইটি অনুবাদ করেছেন আলফ্রেড গিয়োম (প্রকাশকাল ২০০৬, পৃষ্ঠাসংখ্যা ৫৫২)।
আমরা সবাই জানি, হজরত আয়েশা (রা.) নয় বছর বয়সে নবীজীর (সা.) সহধর্মিণী হন। তিনি পুতুল নিয়ে খেলতেন। নবীজীর তাতে কোনো আপত্তি ছিল না, বরং তিনিও মজা পেতেন এবং কৌতুহল প্রদর্শন করতেন। (মুহাম্মদ আলী আল-সাবুনী, রাওযাইউল বয়ন, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা ৪১৩)
৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দে হজরত ওমর (রা.) জেরুজালেম জয় করেন। প্রাণীর ছবিসহ একটি ধুপদানি তাঁর হাতে আসে। তিনি সেটি মসজিদ-ই-নব্বীতে ব্যবহারের জন্য আদেশ দেন। (আব্দুল বাছির, ‘ইসলাম ও ভাস্কর্য শিল্প: বিরোধ ও সমন্বয়’, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলা অনুষদ পত্রিকা, জুলাই ২০০৫ জুন ২০০৬)
পারস্যের কবি শেখ সাদীকে কি পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছু আছে? উনি হচ্ছেন সেই মানুষ যার ‘নাত’ এ দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা মিলাদে সব সময় পাঠ করে থাকেন।
মাদ্রাসার উত্তেজিত বালকেরা শুনলে হয়তো মন খারাপ করবে যে, শেখ সাদীর মাজারের সামনেই তার একটি মর্মর পাথরের ভাস্কর্য আছে। সেখানকার মাদ্রাসার ছাত্ররা তা ভাঙেনি।
ইসলামের দুজন মহান সুফিসাধক, যাঁদের বাস ছিল পারস্যে (বর্তমান ইরান) এঁদের একজনের নাম জালালুদ্দীন রুমি। অন্যজন ফরিদউদ্দীন আত্তার (নিশাপুর)। তাঁর মাজারের সামনেও তাঁর আবক্ষমূর্তি আছে। (বরফ ও বিপ্লবের দেশে, ড. আবদুস সবুর খান, সহকারী অধ্যাপক, ফার্সি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।)
কঠিন ইসলামিক দেশের একটির নাম লিবিয়া। লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপলিতে বিশাল একটা মসজিদ আছে। মসজিদের সামনেই গ্রিকদের তৈরি একটি মূর্তি স্বমহিমায় শোভা পাচ্ছে। সেখানকার মাদ্রাসার ছাত্ররা মূর্তিটা ভেঙে ফেলেনি।
বিগত ২৭ অক্টোবর কয়েকটি মিডিয়ায় প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছে। একজন বিখ্যাত লেখক, কথা শিল্পী এটি লিখেছেন। এখানে লেখাটির একটি অংশ তুলে ধরা হল। সম্পূর্ণটা নয়।
এ লেখা থেকে আমরা কায়েকটি বিষয় জানতে পারি, আর কয়েকটি প্রশ্ন করতে পারি ঃ
১- যদি ইবনে ইসহাকের বর্ণিত তথ্য সত্য হয়ে থাকে তাহলে জানার ইচ্ছা জাগে, যে ছবিটি রাসূলুল্লাহ সা. রেখে দিলেন সেটি কোথায় গেল? কোন মাদ্রাসার ছাত্র সেটা নষ্ট করে দিল? মুসলমানগণ ইবনে ইসহাকের তথ্য গ্রহণ করবেন, না আল্লাহর রাসূল সা. এর নির্দেশ মেনে চলবেন?
২- আয়েশা রা. যখন পুতুল নিয়ে খেলতেন তখন তিনি বয়সে ছোট ছিলেন বলে ইসলামী অনুশাসন তার উপর বর্তায়নি। বিধায় রাসূল সা. তাকে পুতুল খেলতে নিষেধ করেননি। কিন্তু যখন বয়স্ক হলেন, তখন সামান্য ক্ষুদ্র ছবিও তাকে রাখতে নিষেধ করেছেন। আয়েশা রা. এর মুখেই শোনা যাক। তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সা. একদিন সফর থেকে ফিরে আসলেন। আমি একটি পর্দা টানিয়েছিলাম। যাতে ক্ষুদ্র প্রাণীর ছবি ছিল। রাসূলুল্লাহ সা. যখন এটা দেখলেন, ক্রোধে তার মুখমণ্ডল বিবর্ণ হয়ে গেল। তিনি বললেন, হে আয়েশা! কেয়ামতের দিন সবচেয়ে কঠিন শাস্তি তার হবে, যে আল্লাহর সৃষ্টির সাদৃশ্য নির্মাণ করে।’ অতপর আমি সেটাকে টুকরো করে একটি বা দুটি বালিশ বানালাম।
৩- উমার রা. ধুপদানিটি মসজিদে ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছেন প্রাণীর ছবিটি প্রদর্শনের জন্য নয়। ধুপদানিটি ধুপ দানের কাজে ব্যবহারের জন্য। প্রাণীর ছবি অস্পষ্ট থাকলে এ ধরনের সামগ্রী ব্যবহার করতে সমস্যা নেই।
৪- শেখ সাদী, রূমী, আত্তারের কবরে যে সকল মূর্তি আছে সেগুলো তারা নিজেরা স্থাপন করেননি। করার জন্য কাউকে নির্দেশও দিয়ে যাননি।
৫- রুমি ও আত্তারের কবরে স্থাপিত আকৃিত-কে লেখক ‘মূর্তি ’ বলে উল্লেখ করেছেন। লিবিয়াতে স্থাপিত আকৃতিকে মূর্তি বলে উল্লেখ করেছেন। ভাস্কর্য বলেননি। এতে প্রমাণিত হল, যা পূজা করা হয় না, এমন নির্মিত সকল আকৃতিকেও মূর্তি বলা হয়। শুধু সাধারণ মানুষেরা নয়, লেখকের মত বড় বড় পণ্ডিত ও ভাষাবিদরাও বলেন।
৬- বিভিন্ন মুসলিম দেশে যে সকল মূর্তি স্থাপিত আছে, সেগুলো তাদের সমস্যা। দায় তাদের। এর সাথে ইসলামের কী সম্পর্ক? ইসলামের সম্পর্ক হল, আল্লাহর বাণী ও রাসূলের আদর্শের সাথে। কুরআন ও সুন্নাহতে যা পাওয়া যাবে সেটা ইসলাম বলে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। কোন মুসলমানের আচার-আচারণ, কাজ-কর্ম ইসলাম নয়। যদি তা কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা অনুমোদিত হয়, তবে ভিন্ন কথা।
৭- কোথাও কোন বিষয় দেখলেই সেটা অনুসরণযোগ্য মনে করাটা ইসলাম ধর্মের বিরোধী। অনুসরণ করতে হলে দেখতে হবে এটা ইসলামে অনুমোদিত কিনা। ইসলামে যদি অনুমোদিত না হয়, তবে মক্কা শরীফের ইমাম সাহেব করলেও গ্রহণযোগ্য হবে না, অনুসরণ করা যাবে না। মক্কার বড় ইমাম সাহেব কাবা ঘরে ভাস্কর্য নির্মাণ করলেও তা মিটিয়ে দিতে হবে।
৮-শ্রদ্ধেয় লেখক প্রবন্ধটি লিখতে যে গবেষণাটি করেছেন তার জন্য ধন্যবাদ দিতে হয়। সাথে সাথে তাকে বলতে মনে চায়, এ সকল বিষয়ে আমেরকিান বই পত্র পড়ার সাথে সাথে কোন ইসলামিক স্কলারের স্মরণাপন্ন হওয়া উচিত ছিল। আল-কুরআন ও হাদীস অধ্যায়ন করা উচিত ছিল। আর যদি মনে করেন, এ বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত দেয়ার মত ইসলামিক স্কলার দেশে নেই, তাহলে তার উচিত হবে, নিজে কুরআন ও হাদীস শিখে নিয়ে সেই দায়িত্বটা পালন করা।
ভাস্কর্য সম্পর্কে ইসলামী দৃষ্টিভংগি কী?
ছবি,ভাস্কর্য, মূর্তি ইত্যাদিকে ইসলাম দুভাগে ভাগ করে। এক. প্রাণীর ছবি। দুই. প্রাণহীন বস্তুর ছবি। প্রাণীর ছবি, ভাস্কর্য, মূর্তি একান্ত প্রয়োজন ব্যতীত তৈরী করা যাবে না। প্রদর্শন করা যাবে না। স্থাপন করা যাবে না। হাদীসে এসেছে
আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. একদিন সফর থেকে ফিরে আসলেন। আমি একটি পর্দা টানিয়েছিলাম। যাতে প্রাণীর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছবি ছিল। রাসূলুল্লাহ সা. যখন এটা দেখলেন, ক্রোধে তার মুখমণ্ডল বিবর্ণ হয়ে গেল। তিনি বললেন, হে আয়েশা! কেয়ামতের দিন সবচেয়ে কঠিন শাস্তি তার হবে, যে আল্লাহর সৃষ্টির সাদৃশ্য নির্মাণ করে।’ অতপর আমি সেটাকে টুকরো করে একটি বা দুটি বালিশ বানালাম।
আলী রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. আমাকে নির্দেশ দিয়ে পাঠালেন যে, ‘কোন প্রতিকৃতি রাখবে না। সবগুলো ভেঙ্গে দেবে। আর কোন উচু কবর রাখবে না। সবগুলো সমতল করে দেবে।’
আবু তালহা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘যে ঘরে কুকুর ও প্রতিকৃতি আছে সেখানে ফেরেশ্তা প্রবেশ করে না।’
প্রাণী ব্যতীত যে কোন বস্তুই হোক তার ছবি, ভাস্কর্য, মূর্তি ইত্যাদি অংকন, নির্মাণ, স্থাপন ও প্রদর্শন করা যাবে। কারণ, হাদীসে যে সকল নিষেধাজ্ঞার কথা এসেছে তার সবই ছিল প্রাণীর ছবি বিষয়ে।
কেহ যদি কোন ফুল, ফল, গাছ, নদী, পাহাড়, চন্দ্র, সুর্য, ঝর্ণা, জাহাজ, বিমান, গাড়ী, যুদ্ধাস্ত্র, ব্যবহারিক আসবাব-পত্র, কলম, বই ইত্যাদির ভাস্কর্য তৈরী করে সেটা ইসলামে অনুমোদিত।
ভাস্কর্য-মূর্তি সম্পর্কে ইসলাম কঠোর কেন?
যতগুলো পৌত্তলিকতা বিরোধী ধর্ম আছে তার মধ্যে ইসলাম সর্বশ্রেষ্ঠ ও পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে সবচে সোচ্চার। পৌত্তলিকতা মানে এক কথায় বলা যায়, মহান সৃষ্টিকর্তার প্রতি মারাত্নক অবিচার। ক্ষমার অযোগ্য অন্যায়। তার প্রভুত্বকে A¯^xKvi করে তা অন্যকে প্রদান। তার প্রাপ্য উপাসনা-কে অন্যকে নিবেদন করা। অবশ্য যারা ভোগবাদী দর্শনে বিশ্বাসী, সৃষ্টিকর্তা ও পরকাল যাদের কাছে গুরুত্বহীন, তাদের কাছে পৌত্তলিকতা আর একত্ববাদ কোন বিষয় নয়। এটা কোন আলোচ্য বিষয় হওয়ার যোগ্যতাই রাখে না। তারা আমার এ কথাগুলো থেকে কোন কিছু বুঝতে পারবেন না।
ছবি, প্রতিকৃতি, ভাস্কর্য আর মূর্তি-কে ইসলাম পৌত্তলিকতার প্রধান উপকরণ মনে করে। শুধু মনে করা নয়, তার ইতিহাস, অভিজ্ঞতা স্পষ্ট। শুধু ইসলাম ধর্ম যে পৌত্তলিকতাকে ঘৃণার চোখে দেখে তা নয়। বরং আরো দুটি একেশ্বরবাদী ধর্ম ইহুদী ও খৃস্টানদের কাছেও তা ঘৃণিত। আর এ পৌত্তলিকাতর সূচনা হয়েছিল ছবি বা প্রতিকৃতির মাধ্যমে। ইতিহাসটা এ রকম, আদম আ. এর চলে যাওয়ার অনেক পরের ঘটনা। তখন সকল মানুষ ছিল একেশ্বরবাদী। এক আল্লাহর প্রভুত্ব ও উপাসনায় বিশ্বাসী। সে সমাজের পাঁচ জন অত্যন্ত জনপ্রিয় সৎ মানুষ মারা গেল। সমাজের লোকেরা শোকে একেবারে ভেঙ্গে পড়ল। সর্বদা তাদের আলোচনা ও তাদের জন্য শোক প্রকাশ করতে থাকল। শয়তান এ পরিস্থিতির সুযোগ নিল। সে একজন বৃদ্ধ মানুষের আকৃতিতে তাদের কাছে এসে বলল, যারা চলে গেছেন তারা খুব ভাল মানুষ ছিলেন। তোমরা কয়েকদিন পরে তাদেরকে ভুলে যাবে। একটা কাজ করা যায়, আমি তাদের ছবি একে দেই। তারা যেখানে বসবাস করত তোমরা ছবিগুলো সেখানে টানিয়ে রাখবে। তাহলে তোমরা ও তোমাদের পরবর্তিরা তাদের ভুলে যাবে না। সমাজের লোকেরা তাতে সম্মত হল। তারা বলল, খারাপ কি! প্রস্তাবটা ভাল। আমাদের পূর্বপুরুষদের আমরা স্মরণে রাখব এ ছবির মাধ্যমে। শয়তান পাঁচ জনের ছবি অংকন করে দিল। তারা তাদের বসবাসের স্থানে টানাল। এ প্রজন্ম চলে গেলে পরবর্তী প্রজন্ম আসল। তারা ছবিগুলোকে উন্নত ও অধিকতর স্থায়ী করার লক্ষ্যে সেগুলোকে মূর্তিতে রূপান্তর করল। কিন্তু তারা এগুলোর পূজা বা উপাসনা করত না। এ প্রজন্ম চলে গেল। আসল পরবর্তী প্রজন্ম। তারা এসে এ মূর্তিগুলোর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে থাকল। এরপর অন্য প্রজন্ম এসে সরাসরি এগুলোর উপাসনা শুরু করে দিল। এ হল মানব সমাজে মূর্তি পুজা, পৌত্তলিকতা ও শিরক প্রবর্তন করার ইতিহাস।
এটা হল আল-কুরআনের তাফসীর ও হাদীসে বর্ণিত ইতিহাস। কারো কাছে কুরআন ও হাদীস ভাল না লাগলে তিনি ইহুদী ও খৃস্টানদের ধর্মীয় গ্রন্থ পাঠ করে এ ঘটানার সত্যাসত্য জেনে নিতে পারেন। আমরা আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি!
এ ইতিহাসে আমরা দেখতে পেলাম মূর্তিগুলো যারা নির্মাণ করেছিল তারা কিন্তু উপাসনার উদ্দেশ্যে করেনি। এমনিভাবে যারা ছবি অংকন ও টানিয়ে রাখার অনুমোদন দিয়েছিল, তারাও পূজা করার নিয়্যত করেনি। কিন্তু শয়তান তাদের এ কাজটিকে তাদের কাছে সুশোভিত করেছে।
ছবি ও ভাস্কর্যের পথ ধরেই যুগে যুগে পৌত্তলিকতার আগমন ঘটেছে। আর এ পৌত্তলিকতার অন্ধকার থেকে তাওহীদের আলোতে নিয়ে আসার জন্য আল্লাহ যুগে যুগে নবী ও রাসূলদের পাঠিয়েছেন। আজীবন তারা এ পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম করেছেন। অনেকে জীবন দিয়েছেন। অনেকে দেশ থেকে বিতারিত হয়েছেন। এ জন্যই ইসলাম ও অন্যান্য একেশ্বরবাদী ধর্মগুলো মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে সোচ্চার। এবং এ মূর্তিপুজা ও পৌত্তলিক সংস্কৃতির বিরোধিতা করা তাদের ধর্মের একটি বড় পরিচয়।
যদি পূজা উপাসনার জন্য মূর্তি নির্মিত না হয় তবুও?
অনেকেই মতামত দিয়ে দেন। বলেন, এ ছবি, এ প্রতিকৃতি, এ ভাস্কর্যতো পূজা করার জন্য নয়। এতে দোষের কী?
দোষের কিছু আছে কিনা তা জানতে প্রশ্ন করা দরকার, আপনি ছবিটা কেন টানাবেন, অর্থ, শ্রম, সময় ও মেধা খরচ করে ভাস্কর্যটা কেন নির্মাণ করবেন? কেন তা উম্মুক্ত স্থানে স্থাপন করবেন? মূর্তিটা কেন বানাবেন?
এর উত্তর হতে পারে একাধিক। যেমন
(ক) মূর্তিটি যার বা প্রতিকৃতিটি যার, তাকে স্মরণীয় করে রাখতে এ কাজটি আমরা করে থাকি।
ভাল কথা, সে ভাল মানুষ, তাকে স্মরণীয় করে রাখা হোক এটা ইসলাম অনুসারীরাও চায়। কিন্তু তাকে স্মরণীয় করে রাখতে এ পদ্ধতি ব্যতীত অন্য কোন পদ্ধতি আছে কিনা? যদি বিকল্প থাকে, তাহলে যা ইসলাম পছন্দ করে না এমন পদ্ধতিটা Aej¤^b করতে আমরা বাধ্য কেন? কে আমাদের বাধ্য করে? কে আমাদের প্ররোচিত করে?
এ পদ্ধতিতে তাকে স্মরণীয় করে রাখতে অন্য মানুষের কোন কল্যাণ আছে কি না? যদি না থাকে তাহলে আমরা এমন অনর্থক কাজ কেন করব যা মৃত মানুষকে কোন কল্যাণ দেয় না। যা জীবিত মানুষের কোন উপকারে আসে না? তার নামে একটি হাসপাতাল, একটি ইয়াতীম খানা, একটি নলকূপ, একটি রাস্তা, একটি স্কুল নির্মাণ ইত্যাতি জনহিতকর কাজ করেও তাকে স্মরণীয় করে রাখা যায়। এতে তারও কল্যাণ, আর অন্যান্য মানুষেরও কল্যাণ। এ ভাল পদ্ধতি বাদ দিয়ে আামরা খারাপ পদ্ধতি গ্রহণ করব কার নির্দেশে?
(খ) মূর্তিটি যার, তাকে সম্মান ও ভালবাসা জানাতে তার ভাস্কর্য নির্মাণ করে থাকি।
ভাল কথা তার প্রতি সম্মান জানাতে ইসলাম অনুসারীরাও চায়। কিন্তু এ সম্মানের প্রদ্ধতিটা ইসলাম বিরোধি হতে হবে কেন? সম্মান প্রদর্শনের ব্যবস্থা এমন পদ্ধতিতে হওয়া দরকার যাতে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলে এতে অংশ নিতে পারে।
আর মূর্তির প্রতি সম্মান প্রদর্শনই হল মূর্তি পূজা। যারা মূর্তিকে পূজা করে, তারাও তো এ সাকার মূর্তির মাধ্যমে অনুপস্থিত সত্তার প্রতি সম্মান করে। মূর্তির প্রতি সম্মান প্রদর্শনতো একটি বিশেষ ধর্মের ধর্মীয় রীতি।
যদি বলা হয়, আসলে মূর্তির প্রতি আমাদের সম্মান নয়। শ্রদ্ধা প্রদর্শন নয়। তার প্রতি আমাদের ভালবাসা নেই। বরং এটা হল যার মূর্তি তারই জন্য।
তা হলে আমি বলব, যে মূর্তির প্রতি আপনাদের কোন শ্রদ্ধা নেই, ভালবাসা নেই, কেহ সে মূর্তিটা ভাঙ্গতে চাইলে আপনাদের ব্যাথা লাগে কেন? এ ব্যাথা লাগার অনুভূতিই প্রমাণ করে আসলে আপনাদের ভালবাসা ও সম্মান মূর্তির জন্য নিবেদিত। এটাই তো স্পষ্ট মূর্তিপূজা। ভাবতে আশ্চর্য লাগে, কত বড় মূর্খতা ও জাহেলিয়াত। একটি মূর্তি যা মানুষের কোন কল্যাণে আসে না বরং পরোক্ষভাবে অকল্যাণই করে, তার প্রতি সম্মান ও ভালবাসা দেখাতে যেয়ে জীবিত, সমাজে সম্মানিত মানুষগুলোকে অপমান করা হয়, তাদের অমানুষ ভাবা হয়। তাদের নির্মূল করার ও উচ্ছেদ করার হুমকি ধমকি দেয়া হয়। তাদের প্রতিরোধ করতে প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়। এর চেয়ে মূর্তি পূজার বড় দৃষ্টান্ত আর কী হতে পারে? কোন্ আদর্শ মূর্তির প্রতি আপনাদের এ সীমাহীন ভালবাসা সৃষ্টি করেছে? একটু ভেবে দেখবেন কী? এটা তো অন্ধকার যুগের সংস্কৃতি। ইবরাহীম আ. তার পিতা ও সমপ্রদায়কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমরা এ মূর্তিগুলোর সামনে অবস্থান কর কেন?’ তারা বলল, ‘আমাদের পূর্ব-পুরুষদের এ রকম করতে দেখেছি।’ ইবরাহীম বলল, ‘যদি তোমরা ও তোমাদের বাপ-দাদারা স্পষ্ট ভ্রান্তিতে থাকে তবুও তাদের অনুসরণ করবে?’
যারা এখনও এগুলো করে তাদের কাছে এ কাজের সমর্থনে এর চেয়ে ভাল কোন জওয়াব নেই।
(গ) বলা হতে পারে মূর্তির প্রতি সম্মান বা ভালবাসা প্রদর্শন উদ্দেশ্য নয়। উদ্দেশ্য হল আমাদের জাতীয় পরিচয়, দেশজ সংস্কৃতি তুলে ধরা।
ভাল কথা, জাতীয় পরিচয়, দেশজ সংস্কৃতি তুলে ধরতে সকল জাতির ও সব দেশের লোকেরাই চায়। এটা দেশ প্রেম- সন্দেহ নেই। কিন্তু আমাদের বাংলাদেশীদের সংস্কৃতি মূর্তির মাধ্যমে তুলে ধরতে হবে এটা কোন সংস্কৃতির প্রকাশ। আমাদের সংস্কৃতিতে মূর্তি গড়ার সংস্কৃতি কোথায়? এটা ভারতের সংস্কৃতি হতে পারে বাংলাদেশের নয়। কাজেই যা আমাদের নয়, তা আমাদের বলে চালিয়ে দেয়া তো অন্যায় কাজ। আলোচিত লালন মূর্তির নির্মাতা মৃণাল হককে বিবিসি থেকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ওটা নির্মাণ করতে বিমান বন্দর চত্বর কেন বেছে নিলেন? তিনি উত্তরে বললেন, ‘বাহির থেকে মানুষ বাংলাদেশে প্রবেশ করেই যেন আমাদের সংস্কৃতি সম্পর্কে একটা ধারনা পেয়ে যায়। এ জন্য ঐ স্থানটিকে বেছে নেয়া।’
কত চমৎকার জওয়াব! বাহির থেকে মানুষ এসেই যেন ধারনা করে বাংলাদেশী সমাজ ও সংস্কৃতি হল একটি পৌত্তলিক সংস্কৃতি। এরা শুধু একতারা দোতারা সেতারা নিয়েই ব্যস্ত থাকে। মৃণালের কথায় প্রমাণ, এটা ছিল বাংলাদেশী জাতির উপর চাপিয়ে দেয়া একটি সাংস্কৃতিক আগ্রাসন।
কিন্তু তারা এতটুকু ভাবল না, এ দেশে সংখ্যাগরিষ্ট ধর্মপ্রাণ মানুষেরা যতবার এটা দেখবে ততবার অভিশাপ দেবে। এ স্থান থেকে হাজার হাজার হজ যাত্রী পৌত্তলিকতা ও মূর্তি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে শ্লোগান দিতে দিতে মূর্তিমুক্ত পবিত্র মক্কার উদ্দেশ্যে হজ করতে যায়, উমরা করতে যায়। আবার এ পথেই ফিরে আসে। এটি তাদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করবে মারাত্নকভাবে।
একটি ভাস্কর্য যতই সুন্দর হোক, তা যদি ইসলামী সংস্কৃতির কোন পরিচয় বহন করে তাহলে তা ভারত বা আমেরিকা তাদের দেশের উম্মুক্ত স্থানে স্থাপন করতে দেবে না। তারা বলবে, ‘এটি সংখ্যাগরিষ্ট জনগনের সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।’ বাংলাদেশে কেন এমন ভাস্কর্য স্থাপিত হবে, যা এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ট মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানে? যা একশ ভাগই একটি পৌত্তলিক গোষ্ঠির সংস্কৃতির অংশ।
যে সকল মুসলিম পরিচয় দানকারী ব্যক্তিরা এ মূর্তির পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন তাদের উদ্দেশ্যে বলছি, কোন বিষয়টি ইসলামের প্রতি আপনাদের এত বিদ্বেষী করে তুলল? কেন ইসলামী সংস্কৃতির প্রতি আপনারা এত শত্রুতা পোষন করেন?
আপনার যদি মনে করেন এ দেশের ইসলামের ধারক বাহক ও প্রচারকরা ইসলাম বুঝে না তাহলে আপনারা কেন ইসলাম নিয়ে পড়াশুনা করেন না। কেন কুরআন ও হাদীস নিয়ে গবেষণা করেন না। আপনারা কত কিছুই তো পারেন। এ কাজটি কেন করতে পারেন না?
আপনারা অনেকে বলেছেন, ইরানে মূর্তি আছে, ইরাকে আছে, লিবিয়াতে মূর্তি আছে, ইন্দোনেশিয়াতে মূর্তি আছে। আরো অনেক মুসলিম দেশে আছে। তাহলে আমাদের দেশে থাকলে ক্ষতি কী?
ভাল কথা। মুসলিম দেশে কোন খারাপ বস্তু থাকলে সেটা গ্রহণ করা যায়, কিন্তু কোন ভাল বিষয় থাকলে তা গ্রহণ করা যায় না। সেটা যতই জনকল্যাণ মূলক হোক। এটাই মনে হয় আপনাদের মূলনীতি। অনেক মুসলিম দেশে শরীয়াহ আইন চালু আছে। অনেক মুসলিম দেশে ইসলামি পারিবারিক আদালত আছে। অনেক মুসলিম দেশে সূদী কারবার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অনেক মুসলিম দেশে সেকুলার শিক্ষা ব্যবস্থা নেই। অনেক মুসলিম দেশ বৃটিশ প্রবর্তিত আইনে চলে না। এগুলো গ্রহণ করা যায় না। গ্রহণ করার কথা বলাও অপরাধ। আর মুসলিম দেশে যদি ইসলাম পরিপন্থী কিছু থাকে তাহলে সেটা আমাদের অনুসরণ করতে হবে। আপনাদের ব্যাপারে কী তাহলে আল্লাহর সে বাণীই প্রযোজ্য, যেখানে তিনি বলেছেন ঃ
وَإِنْ يَرَوْا سَبِيلَ الرُّشْدِ لَا يَتَّخِذُوهُ سَبِيلًا وَإِنْ يَرَوْا سَبِيلَ الْغَيِّ يَتَّخِذُوهُ سَبِيلًا ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ كَذَّبُوا بِآَيَاتِنَا وَكَانُوا عَنْهَا غَافِلِينَ
“তারা সঠিক পথ দেখলেও তাকে পথ হিসাবে গ্রহণ করবে না। আর ভ্রান্ত পথ দেখলে পথ হিসাবে গ্রহণ করবে। এটা এ জন্য যে, তারা আমার আয়াতসমূহ A¯^xKvi করেছে এবং সে সম্পর্কে তারা ছিল অমনোযোগী।”
এটা কোন ধরনের মানসিকতা? নিজেকে প্রশ্ন করুন! আল-কুরআনের ভাষায় ‘তারা নিজেদের প্রবৃত্তিকে প্রভূ বানিয়ে নিয়েছে।’ আপনি তাদের মধ্যে পড়ে যাচ্ছেন কি না, একটু ভাবুন! দুনিয়ার সকল ইসলামি ধর্মীয় নেতারা যে বিষয়ে ঐক্যতম পোষণ করেছেন, তার বিরোধিতা করলে মুসলিম থাকে কিনা সেটাও ভাবার বিষয়। আমরা ইসলামকে যথাযথভাবে মানতে পারি না। জানতে চাই না। সেটা আমাদের সীমাবদ্ধতা, আমাদের দুর্বলতা। আল্লাহ এ অপরাধ হয়তো ক্ষমা করে দিতে পারেন। কিন্তু ইসলামের বিরোধিতা করতে হবে কেন? ইসলামী অনুশাসনের সাথে বৈরীতা পোষণ করতে হবে কেন? তা হলে আল্লাহর কাছে আমরা কী অজুহাত পেশ করব? এ প্রশ্ন করে আপনাদের বিবেকের দরজায় নাড়া দিতে চেষ্টা করলাম।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,
وَمَنْ يُشَاقِقِ الرَّسُولَ مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ الْهُدَى وَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيلِ الْمُؤْمِنِينَ نُوَلِّهِ مَا تَوَلَّى وَنُصْلِهِ جَهَنَّمَ وَسَاءَتْ مَصِيرًا
“আর নিজের কাছে সত্য পথের দিশা প্রকাশ হওয়ার পরও রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে এবং মুমিনদের পথের বিপরীত পথ অনুসরণ করে, আমি তাকে ফিরিয়ে দেব যে দিকে সে যেতে চায় এবং প্রবেশ করাব জাহান্নামে। আর আবাস হিসাবে তা খুবই মন্দ।”
সমাপ্ত
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই নভেম্বর, ২০০৮ বিকাল ৩:০৭