অনেকদিন পর- না, অনেক বছর পর আজ সকালে বক্সে মোবাইল চার্জার খুঁজতে গিয়ে পুরনো কয়েকটি ডায়েরী চোখে পড়ে। পরনো বলতে ১৮ থেকে ১৯ বছর আগের। আমার ডায়েরী লেখার সখ বা অভ্যাস কোনটাই কোনদিন ছিল বলে মনে নেই। তবে মন চাইলে অনেক কথাই লিখতাম। সেটা পড়া লেখার খাতাতেই চলে যেতো। মনে আছে, ১৯৯৭ইং সালে এসএসসি পাশ করে কলেজে ভর্তি হওয়ার পর একটা ডায়েরী কিনেছিলাম। তাও কলেজে সবার দেখাদেখি বললেই চলে। এখন আর সেই ডায়েরীটা খুঁজে পাই না। তবে, এইচ এস সি পাশ করার পর ১৯৯৯ইং আমার বড় ভাই আব্দুল লতিফ নূর আমাকে খুশি হয়ে একটা ডায়েরী উপহার দিয়েছিল। সেই ডায়েরীটা উপহার পাওয়ার পরে বিভিন্ন খাতায় লিখা অনেক কথাই তুলে রেখেছিলাম। তাছাড়া দৈনিন্দন কোন ঘটনা তেমন সেখানে লেখা নেই বললেই চলে। যা কয়েকটা দৈনিক বর্ণনা তা সংখ্যায় খুব কম। সেই ডায়েরীটা আজ সকালে বক্সের রাখা ডায়েরী গুলোর নিচ থেকে বেরকরে কিছুক্ষণ পড়লাম। অনেক লেখা কেমন যেন অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বুঝতে সমস্যা না হলেও হয়তো কোনদিন নাও বুঝা যেতে পারে। তাই ভাবলাম লেখাগুলো শেয়ার করবো অনলাইনে।
একটা বিষয় আমাকে অবাক করেছে আজ, তা হলো পরোটা ডায়েরী পাতা উল্টিয়ে মোটামুটিরকম পড়ে কোথাও কোন সুখের অস্তিত্ব পাইলাম না। যেখানে যা লেখা তা কেবল বিষাদিত সব কথা। সেই সময় বা তার অনেক আগে থেকেই গান আমার খুব প্রিয় একটা বিষয় ছিল। নিজের একটা টেপরেকর্ডার ছিল। ক্যাসেট কতগুলো ছিল হিসেব রাখিনি। তো গান শুনতাম খুব বেশি। শুনতে শুনতে অনেক গান মুখস্থ হয়ে যেতো। সেই গান গুলোর অনেক গান আমার ডায়েরীতে জায়গা পেয়েছিল। তবে সেই গান গুলোও বিরহবেদনা ভরা। গানের নিচে একদু লাইন মন্তব্য লেখা সবগুলোর মধ্যে। নিজেরও অনেক লেখা আছে দেখলাম। বেশিরভাগ লেখাই গানের মতো করে নয়তো কবিতার মতো করে। কিছু গদ্যের মতোও লেখা আছে। কিন্তু সবই আমার তখনকার বিরহ বেদনাময় বিষাদিত কথা। ডায়েরীর কোথাও সুখের অস্তিত্ব চোখে পড়লো না। এটা সত্যিই আমাকে অবাক করেছে আজ। কত মানসিক কষ্টের সময় পার করেছি আমি। কতটা যন্ত্রণা ছিল আমার মনে তা ডায়রী দেখে কিছুটা পরিমাপ করা সম্ভব মাত্র। কারণ, অনেক কথাই লিখে রাখিনি সেখানে। কেন লিখতে পারিনি বা লেখিনি সে বিষয়টা আমার মনে পড়ে গেছে ডায়েরী দেখেই।
১৯৯৪ই সালের শেষের দিকে সম্ভবত মিনতির সাথে আমার প্রেম শুরু। শুরু বলতে তার সাথে কথা বা চিঠিপত্র আদান প্রদান শুরু হয়েছিল। আমার এসএসসি পাশ করার পর থেকে মিনতি আর আমার মধ্যে বিরহের শুরু। ঠিকমতো দেখা হতো না, কথা হতো না। যখন না সে কোন খবর পাঠিয়ে ডেকে নিয়ে যেতো। যদিও সংবাদ ছাড়া দেখাও হতো দুজনার তা খুবই কাকতালীয়। তখন মোবাইল ছিল না। দুজনার গ্রাম ছিল দুটা। আমার গ্রাম থেকে একগ্রাম পর ছিল তার গ্রাম। তাই খুঁজ খবর নিতে মাধ্যমই বেশি লাগতো। অনেক সময় মাধ্যমও পাওয়া যেতো না। তখন খুব সমস্যা হতো দুজনার। মাঝেমধ্যে আমিও যেতাম তাদের বাড়ির দিকে ঘুরতে। তা তো আর প্রতিদিন যাওয়া হতো না। মাঝেমধ্যে যাওয়া হতো তার গ্রামের দিকে। বেশিরভাগ দিনই তার সাথে দেখা হতো না। অনেকদিন তার ঘরের পাশে দাঁড়িয়ে তার মুখের দুটো কথা শুনে আসতাম হাসি মুখে। যেদিন তার সেই অদেখা কণ্ঠও ভাগ্যে জুটতো না, সেদিন থেকে প্রতিক্ষণ কেমন চলতো আমার তা বোঝাবো কেমনে। যাক, এভাবেই চলতে হতো আমাদের ১৯৯৭ইং সালের প্রথম থেকে ২০০০ই সালের তৃতীয় মাস পর্যন্ত।
যে বিষয়ে লিখতে বসেছি এখানে তাই বলি। তার আমার প্রেম নিয়ে একটা লেখা আছে আমার। 'বড় ভুল করেছিলাম তোমায় ভালোবেসে' গল্প আকারে লেখা সেখানে তার আমার বিস্তারিত থাকবে। এখানে পুরনো ডায়েরী গুলির লেখাই প্রকাশ করার ইচ্ছে নিয়ে আমার এ লেখা। কিভাবে শুরু করবো সেটাই ভেবে পাচ্ছি না....।
যাক, শুরু তো করতেই হবে, লিখবো যখন ভেবেছি। পুরনো একটা মোটা খাতা পেয়েছি। সম্ভবত লেখার জন্যই কিনেছিলাম। কিন্তু সেখানে বেশি লেখা নেই। মাত্র কয়েকটি লেখাই সেখানে। সেটা থেকেই শুরু করি। এই পোষ্টে সমস্ত লেখাই ১৯৯৫ইং থেকে ২০০৩ইং পর্যন্ত থাকবে আমার বিভিন্ন ডায়েরী বা খাতা থেকে সংগৃহীত।
কবিতার মতো করে লেখা, কোন তারিখ উল্লেখ নেই। এটা সম্ভবত ২০০০ অথবা ০২ সালের মধ্যে লেখা হবে।
তুমি ছাড়া
পাষাণ পৃথিবী আমায় কি দিলে
ভাবো একবার, বিরহ ছাড়া।
ঝলমলে মনটা পুড়িয়ে গেলে,
হৃদয়টাকে করে গেলে কয়লা।
সুখ কি লিখে'নাই প্রভু এই ভাগ্যে
দিয়ে গেলে কেবল বিরহ যন্ত্রণা।
আকাশের তারা গুনে কেটে যায় রাত আমার,
ভালোবাসার বিনিময় কষ্ট পেলাম এমনি বরাত।
ভাগ্যের ফে'রে পড়ে আমার এই জীবন,
চলে যাবে হায় শুধু কি একা!
ঘুমহীন চোখে স্বপ্ন গুলো আমাকে কাঁদায়,
সুন্দর পৃথিবী মেঘলা হলো সুখেরি নেশায়।
সুখ তো এখনো অনেক দূর বহুদূরে,
পাবো কিনা কভু আর তাও অজানা।
মিনতিকে হারানোর পর আমার দিনগুলো কতটা হতাশা ঘেরা ছিল তা আজ ডায়েরী পড়তে গিয়ে বুঝতে পারি। সুখের নেশায় ভালোবেসে ছিলাম মিনতিকে। তখন, একটা ভালোবাসার মানুষ পাওয়াই কাম্য ছিল। পেয়েও ছিলাম মিনতিকে। তাকে পেয়ে ভেবেছিলাম আমার জীবনটা তাকে নিয়েই সুখী করে তুলবো। নতুন জীবনের উম্মাদনাকে লুকিয়ে শুধু স্বপ্ন দেখতাম কবে পাবো তাকে আপন করে। কিন্তু সে স্বপ্ন আমার স্বপ্নই থেকে গেছে, তাকে আর পাওয়া হয়নি আপন করে। তাকে হারানোর ব্যথা কতটা পুড়িয়েছে তা বোঝানো সম্ভব হবে না। সবাই বলবে বোকারাম, একটা মেয়েকে হারিয়ে কেন এত আহাজারী, কেন এত নিঃস্বতা? আসলে যাকে সাপে দংশে'নি কখনো সে কি করে বুঝবে বিষের যন্ত্রণা! আরেকটা পাতায় লিখেছিলাম-
সুখ কোথায়...।
জীবনের ধারাবাহিতায় যাচ্ছে সময় চলে,
কেবল এই সুন্দর ভুবনে আমার কষ্টগুলো
এখনো রয়ে গেছে হৃদয় জুড়ে।
নয়ন যদি আবার আসতে পারতো পৃথিবীতে,
তাহলে তার জীবনে আর দুঃখকষ্ট থাকতো না।
নয়ন যদি সামান্য সুখের আশায়
বিশ্বাসের মালা গাঁথে, আর যদি সেই মালার
পাপড়ি গুলো ঝড়ে ঝড়ে পড়ে যায়,
তাহলে অবশিষ্ট আর কি রইল পাওয়ার...!
আসলে নয়নের জন্মটাই বৃথা যাবে হয়'তো...
এই জীবনে সুখের দেখা পাবো কি কখনো...!
এই পৃথিবীতে কি একটিও মানুষ নেই....
আমাকে দিতে পারে সামান্য শান্তনা,
দিতে পারে সামান্য সুখের ঠিকানা।
হবে কি কোনদিন কাঙ্ক্ষিত সেই সুখের দেখা...!
হে আল্লাহ্! আমি ভালোবাসতে চেয়েছিলাম,
তোমার সৃষ্টির এক অনন্য সুন্দরী নারীকে।
তার ভালোবাসার রঙেই রাঙাতে চেয়েছি
আমার জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত, পারিনি...।
মনে হয় আর সুখ পাওয়া হবে না আমার জীবনে...!
সুখী আমি হতে পারবোনা কোনদিন...।
ভালোবাসা যদি হয় প্রতারিত, মিথ্যে...
প্রেম যদি হয় শুধু কলঙ্কের উৎস
তবে আর সুখ থাকে কোথায়....!
লেখাটা সম্ভবত ২০০১ইং সাল অথবা '০২ইং সালের মধ্যেই লিখেছিলাম। আমি লেখা বিশ্লেষণ করার মতো জ্ঞান কখনওই অর্জন করতে পারিনি। তাই বোঝাতে পারবো না তখনকার এই লেখা গুলোতে কি প্রকাশ করেছিলাম। তবে এইটুকু বোঝতে পারছি, তাকে হারানো ছিল একেবারেই অনাকাঙ্ক্ষিত। তাই হয় তো বেশিই কষ্ট পেতাম সবসময়। কয়েক বছর কতটা বিষণ্ণতা আমাকে পুড়েছিল তা এখন বোঝানো আমার পক্ষে সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।
সেই সময় গুলোর আরেকটা পাতায় লেখা-
যে নয়ন ছিল এক রোখা, জেদি, সাহসী, গম্ভীর...আবার হাস্যময় চঞ্চল কিশোর - কেউ জানেনা সেই নয়ন আজ কিরকম জীবন পার করছে.... কি ভাবে একা মনে সারাক্ষণ। কেনই'বা তার মনের আকাশ জুড়ে লেগেই থাকে কালো মেঘ... কিসের এতো কষ্ট তার... কিসের কষ্টে তার চোখদুটো সবসময় বেদনায় ভরে থাকে......
তখনকার সময়টা কেমন কাটিয়েছি তার কিছুটা বুঝা যায় আমার প্রাণের বন্ধু মিন্টুকে লেখা একটা অসমাপ্ত চিঠি দেখে। চিঠিটা সম্ভবত ২০০১ইং সালেই হবে। যখন আমি চাকরিতে যোগ দিয়েছিলাম, আর বাড়ি যেতে পারছিলাম না। তখন মোবাইল ছিল না, তাই চিঠি লিখেই খুঁজ খবর বা নিজের পরিস্থিতি জানাতে হতো। নিচে বন্ধু মিন্টুকে লেখা সেই অসমাপ্ত চিঠি দিয়ে আজকের মতো বিদায় নিবো। দেখা হবে নতুন আরেক পোষ্টে 'পুরনো ডায়েরী থেকে' নেয়া কথা নিয়ে....
মিন্টু-
আমার শুভেচ্ছা নিস। আশা করি ভালোই আছিস। আমি দোআ করি তোরা সুখী হ। আল-আমিন কেমন আছে। তোর কাছে চিঠি দিয়েছিলাম। জানিনা তোরা আমার চিঠি পাস কিনা। নাকি পেয়ে আমার প্রতি ঘৃণায় অভিমান জড়িয়ে থাকিস।
মিন্টু- কি লিখবো তোদের কাছে। তোদের একটু সংবাদ পাইলে নিজেকে সুখী লাগে। মনে হয় আমার দেহে এখনো প্রাণ আছে। মিন্টু- তোদেরকে নেশা করতে মানা করেছিলাম। আমিও বাদ দিয়েছি। আমার মনের ভিতর তুষের আগুনে পুড়ে ছাই হওয়া অন্তর, মাঝে মাঝে সূর্যের খড়াতাপে তপ্ত হয়ে দেহের ভিতর আঘাত করে। তখন নিজেকে মনে হয় অনেক রোগা। মনে হয় আমিই পৃথিবীর অবহেলিত মানুষ, যে কিনা সারাটা জীবন প্রতারিত হলো আর লাঞ্চনা পেলো প্রিয়জনদের কাছ থেকে। মিন্টু- নিজেকে প্রকৃতির অবস্থান থেকে আলাদা করে নিজের মনের কাছে ফেরারি হয়ে বেঁচে ছিলাম - তাই হয়তো ভালো ছিল । আসলে এই পৃথিবী আমাকে চায় না। আমি বোকার মতো পৃথিবীর বুঝা হয়ে বেঁচে আছি।
মিন্টু- আমার চাওয়ায় আল্লায়ে ভুল ডুকিয়ে দেয়। - এই জগতে মনের মূল্য পেলাম না.......
আজকের মতো এ পর্যন্তই। আবার দেখা হবে 'পুরনো ডায়েরী থেকে- নয়ন' দ্বিতীয় পর্বে।
সাথে থাকার জন্য কৃতজ্ঞতা জানবেন।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে এপ্রিল, ২০১৭ রাত ৯:৪৫