২০০৫সাল।
তারিখটা সম্ভবত ২৫শে জানুয়ারী।
সবে মেডিকেল এ ঢুকেছি। ছুটি চলছে। সারাদিন ঘুমাই। সকাল ১১টার দিকে হঠাৎ একটা ফোন। অপরিচিত নম্বর হতে অপরিচিত কন্ঠস্বর। "১১টাতেও কেউ ঘুমায়? উঠেন এখনি।" আমি অবাক। ঝাড়ি দিয়ে ফোন রেখে দিতে না দিতেই মিসকল। শুরু হলো মিসকল যন্ত্রনা। ফলাফল পরবর্তী ১ঘন্টায় প্রায় ১০০টা মিসকল। সমাধান দরকার। ফোন দিয়ে আবার ঝাড়ি দিতে যেয়ে উল্টা থ্রেট খেলাম।"আমার ইচ্ছা আমি মিসকল দেব, আপনি পারলে ঠেকান"। বলেই খটাস। আমি হতভম্ব হয়ে কিছু বুঝে উঠার আগেই শুরু হলো আবারো মিসকল পানিশমেন্ট।
কি ভাবছেন? খুব কমন একটা ঘটনা, না? মাফ করবেন শুরুটা এর চাইতে নাটকীয় করতে পারলাম না বলে। শুরুটা যে নাটকীয় ছিল না ভাই। তাই শুরুটা এমনই। খুব কমন। পরিনতিটাও খুব কমন ছিল। টেনশনের কারন নেই।
পাঠকদের ধৈর্য্য বিবেচনা করে মধ্যবর্তী গল্প বলা থেকে বিরতই থাকি। এটাও কমন ব্যাপার। বাংলা ফিল্মে যা হয় আর কি। পরিচয় পেলাম। আমার খালুর আপন বোনের মেয়ে ইনি। আমি সেভাবে না চিনলেও গল্পবাজ বাঙালীর অতিরন্জিত গল্পের পরিনতিতে তিনি আমাকে চেনেন ভালো করেই। শুরু হলো একটা স্বাভাবিক আটপৌড়ে প্রেমের গল্প।
আমি ছিলাম খুব অহংকারী একটা ছেলে। যে পরিবেশ পেয়েছিলাম তাতে এমন হওয়া ছাড়া উপায় ছিল না হয়তো। সবার মনোযোগ পেয়ে নিজেকে খুব বড় ভাবতাম। হয়তো ছিল রক্তের দোষ ও। ফলাফল নিজের এমন একটা গুন হারালাম যার রেশ টানতে হচ্ছে এখনও। সেক্রিফাইজ করা। হুমমম। আমি সেক্রিফাইজ করা জানতাম না। যেখানে যাবো মূল্যায়ন পাবো। আমার জন্য সবাই সেক্রিফাইজ করবে। আমি কেন সেক্রিফাইজ করব?
কি ঘৃণা করছেন? করেন। প্লিজ। আমার প্রাপ্য এটা।
সম্ভবত তাকে যতটা না ভালবাসতাম, তার চাইতে অনেক বেশী চাইতাম অধিকারবোধ। ফলাফলঃ অযথা হম্বিতম্বি। এটা করবা না। ওটা করবা না। ছেলেদের সাথে মিসবানা। ইত্যাদি। ইত্যাদি।
ও খুব ভালো মেয়ে ছিল ভাই। আমার কথার বাইরে একটা কাজও করতো না। ভুল করলে মেনে নিত দোষ। ২য় বার আবারো কোন দোষ করেছে এমন কোন কাহিনী আপনাদের বলতে পারেলে খুব হালকা লাগতো হয়তো। বাট পারলাম না।
২/১টা সুখের স্মৃতি বলি? এগুলোও অবশ্য আর দশটা স্বাভাবিক বাঙালীর বাদামভাজা খাওয়া টাইপ এর কমন গল্প।
একবার কোন কারনে দেখা করার পর, কোন একটা ব্যাপারে রাগ করে আমি বলেছি যে আমি আর দেখা করতে আসবো না। ওর কি কান্না!! আমার শার্টের হাত ধরে কানছে। টপটপ করে চোখের পানি পড়ছে আমার শার্টের হাতায়। আর আমার ফ্রেন্ডকে বলছে, "না! ও আর আসবেনা আমাকে দেখতে। আমি জানিই এটাই শেষ দেখা"।
আর তার সেই ভালোবাসা ভরা কান্নার আমি কি প্রতিদান দিয়েছিলাম জানেন? "এইভাবে কাঁদার কি আছে? লোকজন কি ভাববে? চোখ মোছ।" বকা খেয়ে না, আমি জানি ভালোবেসেই আমার কথা রেখেছিল সে। চোখ মুছেছিল। রিকসার বাকি পথ টুকুতে আর কাঁদেনি।
কি ভাই? আমাকে ঘৃনা করছেন তো? প্লিজ করেন। আমার ব্যাপারে আপনার ধারনা যা ছিল ভেঙে যাচ্ছে তো? ভাংতে দিন। আরো অনেক অনেক ঘৃনা আমার প্রাপ্তি।
আমি আজ দোষ স্বীকার করতে এসেছি। আমি আমার শাস্তি চাই।
ও করেনি আমার জন্য এমন কোন কাজ নেই। সামান্য বান্ধবীর বাসায় বেড়াতে যাওয়ার আগে আমার পারমিশন নিয়েই গিয়েছে। বাবা-মার সাথে আমার সম্পর্ক খারাপ করেছে। ভাই এর সাথে কথা বলেনি অনেকদিন। আর আমি কি করেছি জানেন?
কোন একদিন তার কোন একটা কাজে বরাবর এর মত নিজের সমস্ত পৌরষত্ব দিয়ে থ্রেট দিলাম যে, আমি আর রিলেশন রাখবো না। সে কানছে। আর তাতে আমার পৌরষত্ব বেড়ে গেল। মোবাইল বন্ধ করে দিলাম। টানা ১টা মাস মোবাইল খুলিনি। রিলেশনটা সেই থেকে ব্রেক আপ। ওটা ২০০৭ এর মার্চের কথা। তারিখটা মনে নেই।
দুঃখিত। গল্পের প্রথম অংশের এখানেই সমাপ্তি। চিরাচরিত বাঙালীপ্রেমের গল্পের একটা ধিকৃত সমাপ্তি টানলাম আমার সমস্ত পৌরষত্ব দিয়ে। এখানে অনেক বিবেকবান মানুষ আছেন আপনারা। মেয়েটার জন্য টেনশন করবেন না। ২বছরের প্রেম এ এমন কিছুই করিনি কখনো যাতে সে কোন সমস্যায় পড়ে কখনো। ভালো ছেলে বলে এটা করেছি তা কিন্তু না। সম্ভবত সুযোগের অভাব ছিল।
সমস্যাটার শুরু তার পর থেকে।
১মাস পরে তাকে ফোন দিলাম। সে ফোন রিসিভ করতেই আমি এমনভাবে কথা বলা শুরু করলাম যেন কিছুই হয়নি। হঠাৎ সে খুব রাগী স্বরে বলল,"নাহিদ! আমি চাই না তুমি আমার সাথে আর যোগাযোগ কর"। সেই দিন হঠাৎ করে কি যে হল। হু হু করে উঠলো পুরোটা বুক। মাফ চাইলাম। সে মাফ করেনি। না। ওকে খারাপ ভাববেন না। আমাকে মাফ করার কোন কারন যে ছিল না ভাই। যে পরিমান মানসিক প্রেসার এ তাকে রাখতাম তাতে অতিষ্ট হওয়াটা খুব স্বাভাবিক। তার ডিসিশনটাই সঠিক ছিল। বাট প্রব্লেম টা অন্য জায়গায় ভাই।
সেই দিনের পর থেকে তার সাথে কথা হয়েছে হাতেগোনা ৩/৪বার। কিছু বিশেষ প্রেক্ষাপটে। আমি তাকে ফেরত আসতে অনুরোধ জানিয়েছি কিনা ভাবছেন?
বলেছিলাম। প্রথম ২বার কথা বলার সময়। কিন্তু তার স্বরের কঠোরতায় বুঝেছি সে আর আসবে না। আমার কি? আমিও বা কম কিসে? যোগ্যতা কি কম আছে আমার? আমি তাকে আর ফেরার কথা বলিনি। নিজের উপর আস্থা ছিল। প্রেম করা কোন ফ্যাক্টর হলো?
"হারামজাদা" গালিটা কারা কারা দিলেন মনে মনে? ধন্যবাদ ভাই। অনেক ধন্যবাদ।
ভাই একটা সত্য কথা বলি?
আমি ওকে ভালোবাসি। খুবই ভালোবাসি। আমি ওকে ভুলতে পারিনি। আমি পারিনি আর কোন মেয়েকে আমার জীবনে গ্রহন করতে। প্রেমের চেষ্টা করেছি। ভালোবাসার চেষ্টা করেছি অন্য কাউকে। কিন্তু পারিনি। ২ মাস যেতে না যেতেই বুঝেছি, হচ্ছে না। মনে ভালোবাসা তৈরী হচ্ছে না।
এখন ২০০৯ সাল এর অক্টোবর মাস। জানেন ভাই। আমি এখনো চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাই ওর সেই বাসায় ঢোকার আগে মুহুর্তে মাথাটা হালকা কাত করে "আসি?" বলার দৃশ্যটা। আমি এখনো অনুভব করি ওর সাথে রিকসায় ঘোরার সময় রিকসার প্রতিটা ঝাঁকি। ফার্মগেটে এখনো আমি "আনন্দ সিনেমা হল" এর সামনের টিকিট কাউন্টারগুলো থেকে টিকিট কাটতে পারিনা। আমার পা চলেনা ওদিকে। এখনো আমার হাত কাঁপে ওর কথা লিখতে বসলে। এখনো, স্টিল এখনো, রাতে চিৎকার করে কান্না আসে। আমি কোন মেয়েকেই গ্রহন করতে পারছি না। নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টাটা করে যাচ্ছি অন্য কাউকে ভালোবাসার জন্য। বাট ফেইলড ব্রাদার।
আমি চোখ বন্ধ করলে এখনো দেখতে পাই নীল রং এর জামা পরা ওকে।
সেই মীরপুর।
সেই শ্যাওড়াপাড়া।
সেই চিপসের দোকান।
ওই যে, রিকসায় ঘোরার সময় দেখলাম, নতুন একটা বিল্ডিং হচ্ছে।
ওই যে, মহাখালী ফ্লাইওভার।
ওই যে, রাম্তা পার হওয়ার সময় ওর হাসিটা।
ওই যে, ঝালমুড়ি খাওয়াটা।
আমি নামায পড়তে ঢুকলাম। আর ওর রিকসায় অপেক্ষা করা।
ভাই। আমি খুব কষ্টে আছি। আমি গত আড়াইটা বছর ধরে নিজেকে বোঝাচ্ছি, "নাহিদ, সব শেষ। ভোলার চেষ্টা কর। নিজের দোষে হারিয়েছো। আর ভালবেসো না। সব শেষ। কিন্তু পারিনি নিজেকে বোঝাতে।"
এখনো পারছি না, রিকসার সেই ঝাঁকি ভুলতে। সেই রোদেলা দুপুরটাকে ভুলতে। সেই ডাবওয়ালার দোকান বা রিকসায় করে ওর চলে যাওয়ার সময় ওর রিকসার পিছন হয়ে আমাকে দেখার চেষ্টার কথা ভুলতে।
আমি খুব কষ্টে আছি ভাই। আমি নিজেকে হারাচ্ছি। আমি জানিনা আমি কিভাবে নিজেকে ফেরত পাবো। কিন্তু খুব দরকার। নিজেকে ফিরে পাওয়া দরকার তাকে ভোলার জন্য। নিজেকে ফিরে পাওয়া দরকার তার ঘৃনাকে অগ্রাহ্য করার জন্য। তাকে ভোলার জন্য করিনি এমন কোন কাজ নেই। কিন্তু পারছি কই?
আর পারছি না আমি।
নিজেকে কেন যেন ইদানিং উন-মানুষ বলে মনে হয়। মনে হয় এটাই আমার প্রাপ্তি। এখন আমি আর মাথা উঁচু করে থাকিনা। মনে হয় মাথা নিচু করে থাকাটাতেই শান্তি। নিজেকে সম্পূর্ণ ব্যার্থ একজন মানুষ বলে মনে হয়, আর ভেবে খুব আত্নপ্রশান্তিও পাই। কেউ অবহেলা করলে গায়ে লাগে না। মনে হয় এটাই আমার প্রাপ্য। কেউ গালি দিলে হাসিমুখে শুনি। ভাবি আমারই দোষ। আমাকে গালি দেবেনাতো কাকে দেবে? কারো সাথে মিশতে মন চায় না। ফাঁকা সময়ে বিছানায় একা শুয়ে থাকি। আর তার কথা ভাবি। পুরাতন স্মৃতি খুব আনন্দ দেয়। সত্যি বলছি, খুব কষ্টে পড়লেই আমি তার কথা ভাবি। মন ভালো হয়ে যায়।
অপসসসসসসসস!!! মন ভালো হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে মনটা খারাপ থাকে এটাই হলো প্রবলেম। মাঝে মাঝে বেশ স্বস্তি লাগে এটা ভেবে যে আমি ওকে আসলেই ভালবাসতে পেরেছি।
আসলে ওই আমার সব। ও না আসুক জীবনে। আমি তো ওকে ভালবাসি। অনেক। এটা কখনোই ও জানবে না। না জানুক। আমি আমার সুখ-স্মৃতিগুলো নিয়েই বাঁচতে চাই।
উন-মানুষ হয়ে বাঁচার আনন্দ অনেক। আমি আজীবন উন-মানুষ হয়ে বাঁচতে চাই। মাথা নিচু করে বাঁচতে চাই। আল্লাহ আমাকে যেন আর কখনো মাথা উচুঁ করার সুযোগ না দেন।
প্লিজ। যাওয়ার সময় একটা থু দিয়ে যাবেন। খুব শান্তি পাবো।
nahid.djmc@gmail.com