টিভিতে এনিমেল প্ল্যানেট চ্যানেলে জেরেমী ওয়েডের রিভার মনষ্টার পর্বগুলো আমি বারবার দেখি। ছোটবেলায় বড়শিতে মাছ ধরার নেশা ছিল বলেই হয়তো এই এক্সট্রিম এংলারের দৃশ্যগুলো এত ভালোলাগে।কিন্ত তার চেয়েও বড় কথা এই রিভার মনষ্টার পর্বগুলো আমাকে বহু বছর আগের এক রাতের স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। আজ যদি সে সময় থাকতো তাহলে জেরেমীকে বাংলাদেশের হাওড়ে মনষ্টার খুজতে অনুরোধ করতাম।
অফিসের কাজে হাওড় এলাকায় আমাদের কয়েকটি শাখা অফিসে প্রশিক্ষন দিতে গিয়েছিলাম। মার্কুলি, আনন্দপুর, দাউদপুর, দিরাই, ইত্যাদি গ্রামে ছিল আমাদের শাখা বা ক্যাম্পগুলোর অবস্থান। ঢাকা থেকে ভৈরব তারপর লঞ্চে মার্কুলি। সেখান থেকে যেতে হবে সবগুলো শাখায় কিন্ত পাড়ি দিতে হবে সমুদ্রের মত সেই হাওড় তাও কিনা ছোট ছৈইয়া নৌকায়। সে সময় ইঞ্জিনের নৌকার প্রচলন হয়নি। পুরো একদিন লাগতো এক ক্যাম্প থেকে আরেক ক্যাম্পে যেতে। যা হোক এসব বৃত্তান্ত লেখা আমার উদ্দেশ্য নয়।
কাজের এক পর্যায়ে পৌছালাম আনন্দপুর। ছোট্ট গ্রাম চারিদিকে তার অথৈ পানি। ঢেউ আছড়ে পড়ছে দ্বীপের মত সেই গ্রামের চারিদিকে । গ্রামের ঠিক মাঝখানে একটি টিনের ঘরে অফিস, সামনে বারান্দা। সন্ধ্যায় বাবুর্চি একটা হ্যাজাক জালিয়ে দিয়ে গেল উঠানে।
গ্রামের পুরুষদের নিয়ে ছিল আমাদের সমিতি যার বেশিরভাগই ছিল মৎসজীবি। একটু পর একজন দুজন করে বেশ কয়েকজন সমিতির সদস্য হাজির হলো সেখানে। আমিও গিয়ে বসলাম তাদের সাথে। অন্ধকার নেমে এসেছে ততক্ষনে, সাগরসম হাওড় আর দেখা যাছিলনা তবে ঢেউএর ছলাৎ ছলাৎ শব্দ কানে ভেসে আসছিল অবিরত।
শুরু হলো আলাপ। মাছের কথা উঠতেই বৃদ্ধ বয়সের একজন বলে উঠলো এখন আর হাওড়ে আগের মতন মাছ নেই। বুঝলাম মাছ ধরা তার পেশা ছিল। কিন্ত জেলে বলে সম্বোধন করায় বয়োজেষ্ঠ কয়েকজন একসাথে প্রতিবাদ করে উঠলো। তারা তাদের জেলে বলে মানতে নারাজ। বল্লো তারা জেলে নয়, মাছ শিকারী। বুঝতে পারছিলামনা কেন তারা এই পার্থক্য করতে চাইছে। এটা বুঝতে গিয়ে তাদের মুখ থেকে যে কয়টি কাহিনী শুনেছিলাম তার তুলনা শুধু এনিমেল প্ল্যানেটের রিভার মনষ্টারের পর্বগুলোর সাথেই মিলে। আর তাই তারা যে যথার্থই মাছ শিকারী আমি তা মানতে বাধ্য হয়েছিলাম।
আনন্দপুর গ্রামের এমনি এক কাহিনী। এক বর্ষায় খবর এলো গ্রামের হাঁসগুলো পানিতে নামলে আর ফিরছে না।পাশের গ্রামের এক ছোট শিশুও নিখোজ । খবর গেল মাছ শিকারীদের কাছে। তারা লম্বা জেলে নৌকা নিয়ে হাজির হলো। সামনের গলুইতে হ্যাজাক বাতি জ্বালানো, পেছনে হারপুন হাতে শিকারীর তীক্ষ দৃষ্টি। হাওড়ে বড় মাছ ধরার এটাই পদ্ধতি। হ্যাজাকের আলোতে সন্মোহিত হয়ে মাছ ভেসে উঠে জলের উপর আর সেই সুযোগে হারপুন ছুড়ে মারে শিকারী। বক্তা নিজেই ছিল সেই শিকারী।
প্রথম রাতে শিকারীরা গ্রামের চারিদিকে নৌকা বেয়ে কিছুই দেখতে পেলো না। দ্বিতীয় রাতে আবার অভিযান শুরু করলো। সেই রাতে দেখা মিললো সেই হাঁস খাদকের। বিস্মিত হয়ে তারা দেখলো তাদের নৌকার সমান সাইজের প্রকান্ড এক বোয়াল ভেসে উঠেছে পানির উপর। শিকারী তড়িত সিদ্ধান্ত নিল হারপুন ছুড়ে না মারার। কারন হারপুন বিদ্ধ হলে সে যে দৌড় দিত তার বেগ সামলানো তাদের পক্ষে সম্ভব হতো না। মৃত্যু ছিল নিশ্চিত। দৈত্যাকার মাছটি তারা ধরতে পারেনাই বটে তবে হাঁস আর শিশু হারানোর রহস্য উদ্ধাঘাটন ঠিকই করতে পেরেছিল ।
এই সিদ্ধান্তের যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা সে দিয়েছিল আরেকটি কাহিনী বলে আর সেটা ছিল আইড় মাছের। এমনি ভাবে তার দল প্রকান্ড এক আইড় মাছকে হারপুন দিয়ে গেথেছিল। কিন্ত মাছটি দমার পাত্র ছিলনা। হারপুন গাথা অবস্থায় দিয়েছিল দৌড়। দুর্ভাগ্যবশত একজন শিকারীর পায়ে দড়িটি আটকে ছিল। ফলে টানের চোটে নৌকা থেকে সে ছিটকে পড়লো পানিতে। তাকে আর জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়নাই। এই অভিজ্ঞতাই বোয়ালটিকে হারপুন ছুড়ে না মারার জন্য তাদের বিরত রেখেছিল।
মাছের হাতে মানুষের মৃত্যুর আরেকটি কাহিনী তারা আমাকে বলেছিল। তখন হাওড়ে অনেক বড় বড় পাঙ্গাস মাছ পাওয়া যেত। জেলেরা পাঙ্গাসের ঝাঁককে জাল দিয়ে বেড় দিয়ে রাখতো। এরপর প্রতিদিন কিছু কিছু মাছ ধরে বাজারজাত করতো। এমনি একটি ঘেরে জেলেরা লক্ষ্য করলো মাছ যা থাকার কথা তা থেকে যেন কমে যাচ্ছে। সিদ্ধান্ত নিল ব্যাপারটি পরীক্ষা করার। নামালো ডুবুরীকে। কিন্ত সে আর ভেসে উঠছে না। পরে সবাই বুঝতে পেরেছিল যে জালের এক জায়গা ছিদ্র করে পাঙ্গাসগুলো বেড়িয়ে যাচ্ছিল। ডুবুরী দেখতে পেয়ে তা বন্ধ করার চেষ্টা নিয়েছিল কিন্ত সেই দৈত্যাকার পাঙ্গাসের ঝাঁক তাকে এমনভাবে চেপে ধরেছিল যে তাদের হাত থেকে সে আর মুক্তি পায়নি।
সত্যি ভয়ংকর তাদের সেই অভিজ্ঞতার কাহিনী শুনতে শুনতে রাত দুটো বেজে গিয়েছিল। হাওড়ের সেই ভয়ংকর মনষ্টারদের গল্পগুলো আজও আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল। এনিমেল প্ল্যানেটের রিভার মনষ্টারের কাহিনীগুলোর সাথে আমি তার সাদৃশ্য খুজে পাই।
বাংলাদেশে সেই সব রিভার বা হাওড় মনষ্টারদের কাহিনী এখন আর হয়তো শোনা যাবে না। আর সে সব শিকারীরাও হয়তো আর বেঁচে নেই।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা আগস্ট, ২০১৫ দুপুর ১২:২৫