আমি চারুকলা থেকে বের হয়ে ১১ তারিখ একটু অন্যমনস্কভাবে ফুটপাথের বইগুলা দেখতে দেখতে নাটমন্ডলের দিকে যাচ্ছিলাম,হঠাতই এক মুশকো জওয়ানের ধাক্কা খেয়ে তাল সাম্লাতে গিয়ে দেয়ালে চোখ পড়লো,দেখি ১২ তারিখ(মানে গতকাল)জনসংস্কৃতি মঞ্চে বক্তব্য রাখবেন আনু মুহম্মদ,সলিমুল্লা খান এবং ফারুক ওয়াসিফ।প্রসংগ আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের রচনাবলী।
দেখে ঠিক করলাম এখানে যাওয়া উচিত।যেই ভাবা সেই কাজ।
পরদিন ঢাঃবিঃর লেকচার থিয়েটারের আর,সি মজুমদার অডিটোরিয়ামে বিকেল চারটায় গেলাম।শুরু হলো আরো কিছু পরে।
প্রথমে আলচনা কোরলেন ঢাঃবিঃ বাংলার শিক্ষক মোহাম্মদ আযম।তার আলোচনায় বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে ইলিয়াসের বিশ্লেষন পেলাম।তিনি ইলিয়াসের ছোটগল্প,উপন্যাস দু'খনা,এবং প্রবন্ধের ভুয়সী প্রসংসা করলেন।
এরপর ফারুক ওয়াসিফ আলচনায় আস্লেন।তার দীর্ঘ আলোচনায় তিনি পোর্ট উইলিয়ামস কলেজের নিন্দা করেন।কেননা উপনিবেশিক আমলে তারা ভাষাকে কেটে ছেটে ভদ্র করার রীতি চালু করে,এবং এর প্রভাবে প্রভাবিত হয়েছিল বাংলার ততকালীন সমাজ।
ফারুক ওয়াসিফ মনে করেন বাংলার এই সুশীল ভাষাচ্ররচার একপর্যায়ে বাংলা উপন্যাসের সৃস্টি।বংকিমের রচনায় সে সময়ের উপনিবেশিক প্রভাব নিয়েও কিছু কথা বলেন।তার ভাষার ততকালীন সুশিলতা যাকে লেজুরবৃত্তি বলেন তিনি।
ওয়াসিফ বিস্ময় প্রকাশ করেন যে এসব নেতিবাচক প্রভাবের মাত্র ৫০-৬০ বছর পর ইলিয়াসের রচনার ভাষা অনেক কার্যকরী ও প্রান্তিকদের কথা বলে,সে বিষয়ে।তিনি মনে করেন চিলেকোঠার সেপাই'ইয়ের হাড্ডি খিজির একজন প্রান্তিকদের প্রতিনিধি।
তার দীর্ঘ আলোচনা এখানে সংক্ষেপ করলাম।
এরপর আসেন পিয়াস করিম যিনি সম্প্রতি বিদেশ থেকে এসেছেন এবং জনসংস্কৃতি মঞ্চের সক্রিয় সদস্য বলে ঘোষক পরিচয় দেন।
পিয়াস করিম মনে করেন ইলিয়াসের রচনায় একটি পোস্ট রিয়ালিস্টিক বিষয় আছে।কেননা ইলিয়াস তার সব রচনাতেই এক্তা অমিমাংসিত ভাব রেখে দেন।
পিয়াস করিম মনে করেন যে ইলিয়াসের প্রান্তিক চরিত্ররা যখন আন্দোলনে পাগল হয়ে যা-তখন মনে হয় যেন তারা যে জেনেশুনে করছে তা নয়,বরং একটা সিজফ্রেনিক রোগীর মতো ঘোর নিয়ে এ সব করে।ঊদাহ্ররণ হিসেবে তিনি খোয়াবনামার তমিজের বাপ ও চিলেকোঠার সেপাই'ইয়ের রঞ্জু ও হাড্ডি খিজিরের কথা বলেন।
এরপর তিনি একটি ব্যাক্তিগত অভিমত দেন যে তার নাকি ইলিয়াসে গল্প,ঊপন্যাস ভাল লাগে কিন্তু ইলিয়াসের প্রবন্ধ ভাল লাগেনা।কারণ সে গুলোতে যেন একটু বেশী বেশীই মার্ক্সিস্ট গন্ধ তিনি পান যা তার মনে হয় এত বেশী না বললেও হতো।
এরপর ঘোষক সলিমুল্লা খান-কে আসতে বলেন,যাকে তিনি স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির শিক্ষক ও চিন্তাবিদ বলে পরিচয় দেন।
প্রথমেই সলিমুল্লা খান বিরক্তি প্রকাশ করেন যে ফারুক ওয়াসিফ তার বক্তব্য অনেক দীর্ঘ করে ফেলেছেন তার উচিত ছিলো অন্যদেরো কথা বলার সুযোগ দেয়া।তিনি একারণে খুব বেশী কিছু বলবেন না বললেন।ফলে যথারিতি গুঞ্জন শুরু হয়ে গেলো হলে।
এরপর তিনি সবাইকে আশবস্ত করার মত একটা ভংগি করে তার আলোচনা আরম্ভ করলেন।
প্রথমেই তিনি বললেন যে পিয়াস করিমের সাথে একমত নন এবং তার আসলে ইলিয়াসের প্রবন্ধই ভাল লাগে,বরং উপন্যাস ভাল লাগেনা ও তিনি সেটা পড়তে পারেন না।এর কারণ হিসেবে সলিমুল্লা খান মনে করেন চিলেকোঠার সেপাই বা খোয়াবনামায় ইলিয়াস ভাষার নিরিক্ষন চালিয়েছেন যার কারণে তার মতো এই মুর্খ ব্যক্তি সে ভাষা বুঝতে পারেন না।একারণে ইলিয়াসের উপন্যাস তার ভাল লাগেনি এবং তিনি তা পড়েননাই।
এরপর সলিমুল্লা খান বলেন যে যখন চিলেকোঠার সেপাই সে সময়ের দৈনিকে ধারাবাহিক ভাবে ছাপা হচ্ছিল তখন কিছু সংখ্যা পড়ার পর তার আর কোনো আগ্রহ জাগেনি।
সলিমুল্লা খান এবার ইলিয়াসের সংস্কৃতির ভাংগা সেতু থেকে কিছু উদ্ধৃতি পড়ে শোনান জনসংস্কৃতি শব্দটির অরথ নির্ণয়ের জন্য।সেখানে দেখআন যে ইলিয়াস তিন প্রকার সংস্ক্বরতির কথা বলেছেন।
তিনি বলেন ইলিয়াসের কথা অনুযায়ী এই মঞ্চ জনসংস্কৃতি বলতে প্রান্তিক বা শ্রমিকদের সংস্কৃতির কথা বোঝাচ্ছে।তিনি ইলিয়াসের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন যে মধ্যবিত্ত অপসংস্কৃতি দারা আক্রান্ত।
ইলিয়াসে আরেক উদ্ধৃতির কথা তিনি বলেছেন যেখানে ইলিয়াস তথাকথিত বাম সংগথনের সমালচনা করেছেন এবং বাম কর্মীরা কখনো শ্রমিকদের সাথে একাত্ন হতে পারে না ,কারণ তারা শ্রমিকদের সাথে মিশবার জন্য যে গভীর মর্যাদাবোধ দরকার তাদের তা নেই।একারণে বাম আন্দোলনগুলো বা সংগঠনগুল লিটল থিয়েটার হিসেবে রয়ে যায়,কখনো কাজে আসে না।
এ প্রসংগে তিনি বলেন এরুপ মঞ্চগুলো থেকে মধ্যবিত্তের অপসংস্কৃতিকে অনেক গালিগালাজ করা হয়।বর্তমানে এ গালিগালাজের হার মোটামুটি কমেছে বলে আনু মুহম্মদকে উদ্দেশ্য করে সন্তুস্টি প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন অনেকক্ষেত্রে ইলিয়াস সংস্কৃতি বলতে ইন্সট্রুমেন্টাল এলিমেন্টস যেমন নাটক,গান,কবিতা ইত্যাদি ব্যভার করেছেন বলে তার মনে হয়েছে।
তার এ মতের বিরোধিতা করেছেন ফারুক ওয়াসিফ মাথা নেড়ে।
এর কিছুক্ষণ পর তিনি তার আলোচনা শেষ করেন।
এরপর বক্তা হলেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ভাই ওয়াহেদুজ্জামান ইলিয়াস।তিনি কিছুক্ষেত্রে সলিমুল্লা খানের সাথে এক্মত নন বলে অল্পকথায় শেষ করেন।
সবশেষে আনু মুহম্মদ বলেন কারো আলোচনাই আসলে তেমন দীর্ঘ হয়নি।তিনি মনে করেন সমালচনা হতেই পারে তবে সেটা পাঠ করে সমালচনা করলে ভাল হয়-বলা বাহুল্য এই কথা আসলে সলিমুল্লা খান-কে উদ্দেশ্য করে বলেছেন।
আনু মুহম্মদ স্মৃতিচারন করে বলেন ইলিয়াসের সাথে একসাথে কাজ করার কথা।ইলিয়াস কে তিনি জাতিয় লেখক শিবিরে যোগ দেবার জন্য যখন আহবান করতে যান ইলিয়াস জিজ্ঞাসা করেন যে সাথে ফরম আছে কি-না।তিনি সাথে সাথেই যোগ দেন।আনু মুহম্মদ বলেন ইলিয়াস আসলে একটি সাংগথনিক ব্যানারে যোগ দেবার জন্য মুখিয়ে ছিলেন,কেননা তিনি সশরীরে কাজ করতে চাচ্ছিলেন।
এর কিছুক্ষন পর তিনি তার আলচনা শেষ করে অনুস্ঠান শেষ করেন।
আমি এ কথা ভাবতে ভাবতে ফেরত এলাম যে আমাদের আলোচনাগুলোর নিস্পত্তি ও চুড়ান্ত সমাধান কবে হবে?
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০০৮ রাত ১:৪২