যুদ্ধসাহিত্য ও 'আর কত দিন' : বিপন্ন মানবতার বৈশ্বিক চিত্ররূপ ।। রেজওয়ান তানিম
আধুনিকায়নের সূচনা পর্ব হিসেবে উনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দী বিশ্বসাহিত্য ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ সময়। এ সময় সাহিত্যে আধুনিকতার প্রবেশ ঘটেছে শুধু এমন নয়, বরং বিশ্ব মানচিত্রে পালাবদলের হাওয়া এ সময়েই লাগে। গোটা পৃথিবীর ভূভাগকে নিজেদের খেয়ালখুশি মত কয়েকভাগে ভাগ করে শাসন ও শোষণে মগ্ন থাকা সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে দেশে দেশে মানুষের মুক্তচেতনা ও স্বাধীনতাকামী ধারনার বিকাশ লাভে। ফলশ্রুতিতে বিগত দুশ বছরে বিশেষ করে গত শতকে অধিকাংশ দেশে স্বাধীনতা লাভ, রাজনৈতিক পট পরিবর্তন অনিবার্য সত্য হিসেবে দেখা দেয়, সমাজে চর্চিত হয় সামাজিক মূল্যবোধের নতুন প্রকরণ। আপামর জনসাধারণ শিক্ষা ও সংস্কৃতির মুক্ত প্রকাশের প্রভাবে সমাজের এসব পরিবর্তনের সাথে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে থাকে-হোকে সে ধনাত্মক অথবা ঋণাত্মক। প্রগতি বা ইতিবাচকতার এই চর্চার পাশাপাশি বিগত শতাব্দীতে শান্তিকামী মানবতার পরাজয় ঘটেছে বারবার।
বিংশ শতাব্দীর শুরুর ভাগেই বিশ্বের কোটি কোটি শান্তিকামী মানুষের হৃদয় বিদীর্ণ করে নেমে আসে যুদ্ধের খড়গ। ফলশ্রুতিতে সমাজ ও রাজনীতি সচেতন সংবেদনশীল লেখকেরা যুদ্ধ বিষয়টিকে অস্বীকার করে থাকতে সমর্থ হলেন না। তাদের লেখায় পড়ল যুদ্ধের ছাপ, এ যুদ্ধ এক নবতর প্রকরণের নাম, যুদ্ধকে নতুন চোখে দেখার একটা আনকোরা প্রচেষ্টা। যুদ্ধ প্রসঙ্গ, যুদ্ধের বিপুল ধ্বংসলীলা এবং মানবতার অবক্ষয়ের চিত্রটি ফুটে উঠেছে তাদের লেখায়। বিষয় ভাবনায়, প্রকরণে, চরিত্র চিত্রণে, ধ্বংসলীলার দৃশ্যপট অঙ্কনে এবং যুদ্ধের সাথে জনমানুষের সম্পর্কের নবতর ব্যাখ্যা মেলে এসব সাহিত্যকর্মে।
উনবিংশ শতকের যুদ্ধভিত্তিক লেখাগুলোর সাথে এ সময়ের সাহিত্যরীতির পার্থক্য নানাবিধ। এর কারণ খুঁজতে গেলে নজর দিতে হবে যুদ্ধের গতি প্রকৃতি ও বিস্তারিত যুদ্ধকৌশলের দিকে। খুব বেশিদিন আগের কথা নয় যখন যুদ্ধ ছিল সাধারণত দুটো যুধ্যমান বাহিনীর রক্তখরচের বিষয়। যুদ্ধে বেসামরিক লোকের অংশগ্রহণ খুব একটা তখন থাকত না, কিংবা থাকলেও তা খুবই নগণ্য। যুদ্ধপরবর্তী সময়ে যদিও বেসামরিক নাগরিকেরা এর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ফলাফল ভোগ করেছে প্রায়শই, বিজয়ী শক্তি শত্রুবিনাশ নীতিতে বিশ্বাসী হয়ে অত্যাচার, নির্যাতন, লুণ্ঠন, অগ্নিযোগ ইত্যাদি নানা প্রকার তাণ্ডবলীলা চালিয়ে ছারখার করেছে বিজিত শহর; তথাপি যুদ্ধকালীন সময়ে সামরিক বাহিনীর পাশাপাশি আপামর জনসাধারণ ও স্থাপনার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির তথা বিশ্বসভ্যতার যুদ্ধের সাথে যে বেদনাবিধূর সম্পর্ক, তা নতুন করে প্রথম ভাবতে শেখায় প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। বেসামরিক লোকেরা আপাত নিরাপদ স্থানেও নির্বিচারে ক্ষয়ক্ষতির স্বীকার হতে পারে এ ভাবনাটি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। পরবর্তীতে সারা বিশ্বের মানুষ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব ও ধ্বংসলীলাকে মনে রেখেছে মানবাত্মার বিপন্নতার চূড়ান্ত সাক্ষর হিসেবে। দুটো বিশ্বযুদ্ধেই ভারতীয় উপমহাদেশের সে অর্থে সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল না। তবে যুদ্ধের গতি প্রকৃতির নির্মাণে ভারতীয় উপমহাদেশের কোন ভূমিকা না থাকলেও ইংরেজ উপনিবেশ হিসেবে যুদ্ধের তাপ এখানে এসে লাগে। তবে তা খুবই সামান্য এবং জনজীবনে ব্যাপক সারা ফেলবার মত কখনোই জোরালো ছিল না, বিশেষ করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে দুর্ভিক্ষ এবং জাপানীদের বার্মা দখল এ অঞ্চলে মোটামুটি একটা ছাপ ফেলেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ভারতবর্ষে চলছিল স্বাধীনতা আন্দোলন। তাই এ সময়ে বাংলা সাহিত্য যুদ্ধ কিংবা যুদ্ধ বাস্তবতার উপন্যাস সময়ের দাবি হলেও সে অর্থে আমরা পাইনি যুদ্ধভিত্তিক সাহিত্য কর্ম। দুর্ভিক্ষের এ বিষয়টি কেন্দ্র করে বিভূতিভূষণ অশনি সংকেত নামে একটি উপন্যাস রচনা করেন। তথাপি একথা জোর কণ্ঠেই বলা চলে বিশ্বসাহিত্যের অন্যান্য তীর্থকেন্দ্রে যখন যুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস সাহিত্যের জোয়ার চলছিল যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে, ভারতীয় উপমহাদেশের বাংলা ভাষার সাহিত্যিকেরা সেদিক থেকে অনেকটাই দূরে সরে ছিলেন। এ কারণেই বৈশ্বিক যুদ্ধ ও বিপন্ন মানবতার অসহায়ত্বের উপর ভিত্তি করে যুদ্ধ ভিত্তিক কথা সাহিত্যে এ অঞ্চল হাতে তেমন কোন নিদর্শন পাওয়া যায় নি বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের পূর্ববর্তী সময়ে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বিশেষ করে ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে উপন্যাসের ক্ষেত্রে মূল ধারাই হয়ে ওঠে যুদ্ধের অনিবার্য সংঘাতময়তায় জীবন ও সম্পদের ক্ষয়ের ফলে সৃষ্ট ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের বয়ান। এ ধারার উপন্যাস গুলোর মধ্যে এরিখ মারিয়া রেমার্ক এর অল কোয়ায়েট অন দ্যা ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট, দ্যা ব্লাক ওবেলিস্ক, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে’র এ ফেয়ারওয়েল টু আর্মস, রিচার্ড এ্যাডলিংটন এর ডেথ অফ এ হিরো, আর্নল্ড জিগ এর Der Streit un den Sergeanten Grischa (The Case of Sergeant Grischa), and চার্লস ইয়েল হ্যারিসনের জেনারেলস ডাই ইন বেড, এগুলো উল্লেখযোগ্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে আবারো যুদ্ধ সাহিত্যের পালে নতুন হাওয়া লাগে এবং এ সময়ে আমেরিকান কথাসাহিত্যিকেরা কালজয়ী উপন্যাসের জন্ম দিয়েছেন। তন্মধ্যে হেরম্যান ওউক এর দি কেইন মিউটিনি, জেমস জোনস এর ফ্রম হেয়ার টু এটারনিটি, হেমিংওয়ের ফ্রম হুম দ্যা বেল টোলস প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। আটলান্টিকের ওপারের আমেরিকানরা মূলত যুদ্ধ করেছে জলে ও অন্তরীক্ষে এবং তাদের যুদ্ধ ছিল এশিয়ার দেশগুলোর সাথে। তাদের যুদ্ধকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিও ছিল ভিন্ন। একটি বিষয় লক্ষণীয় বিশ্ব ক্ষমতার পালা বদলে ইউরোপ থেকে আমেরিকার কালক্রমে সুপার পাওয়ারে পরিণত হবার সাথে সাথে সাহিত্যেরও কর্তৃত্ব আমেরিকায় চলে গেল কিনা এ এক প্রশ্ন।
সাহিত্যের ভাষারীতি ও প্রকাশভঙ্গীর দিকটি নিয়ন্ত্রণে সমাজ ও রাজনীতি কত বড় নিয়ামক তা বোঝা যায় এই সময়ের বাংলা সাহিত্যের দিকে তাকালে। শক্তিমান সব কথাসাহিত্যিক সে সময়ে লেখালেখিতে সক্রিয়, অথচ তাদের লেখায় যুদ্ধ বাস্তবতায় উপনিবেশ শাসিত ভারতবর্ষের নব্য গড়ে ওঠা নগরকেন্দ্রিক মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বাস্তবতা উঠে আসেনি। তাদের লেখায় তারা এ প্রেক্ষাপটটিকে রীতিমত অস্বীকার করে গেছেন এর পিছনে কারণ হিসেবে ভেবে নেয়া যেতে পারে লেখক সমাজের দীর্ঘদিনের ঔপনিবেশিকতার চর্চা এবং সমাজের চালিকা শক্তি সম্পন্ন সামাজিক শ্রেণী হিসেবে গ্রাম ও গ্রামীণ জনপদকে তুলে ধরার প্রচেষ্টার কারণেই অনুপস্থিত এই যুদ্ধ ও যুদ্ধপরবর্তী বাস্তবতা। মূলত বাংলা সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী সময়ে পশ্চিম বঙ্গের বাম ধারার লেখকেরা কিংবা মুসলিম জাতিসত্তার ধারনায় উদ্বুদ্ধ পশ্চিম পাকিস্তানের লেখকেরা কেউই এ সময়ে সারাবিশ্বে ঘটে যাওয়া সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিকাশ ও আগ্রাসনের দিকটিকে তাদের সাহিত্য কর্মে তুলে আনেননি। মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী বাংলা তথা বাংলাদেশী সাহিত্যে (তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান)সমাজ চেতনার প্রবল প্রকাশ ঘটে ষাটের দশকের শেষ দিকে বিক্ষুব্ধ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে। এ সময়ে কয়েকজন সমাজ ও বিশ্বরাজনীতি সচেতন লেখক তাদের লেখনীতে সমকালীন সমাজ ও বিশ্ব রাজনীতিকে ধারণ করার চেষ্টা করেন। এ বিষয়টিকে যথাযথভাবে তুলে ধরেছেন জীবনঘনিষ্ঠ কথা সাহিত্যিক জহির রায়হান।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা পূর্ব সময়ে সবচেয়ে সফল ও জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক জহির রায়হান। বিশ্বজনীন যুদ্ধ বাস্তবতা ও সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রেক্ষাপটে তার লিখিত ‘আর কত দিন’ উপন্যাসটি বিশ্ব সাহিত্যে, বিশেষ করে বাংলা সাহিত্যে একটি অনন্য সংযোজন। উপন্যাসটির গুরুত্ব মূলত এ কারণেই যে, এটির জন্ম বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন মুক্তিযুদ্ধের আগেই।১ মুক্তিযুদ্ধ আমাদের দেশের আপাত সহিষ্ণু এবং শান্তিপ্রিয় জনগণের চিন্তাধারা ও পরিবেশের সাথে প্রতিক্রিয়া দেখাবার দিকটিকে অনেকটাই বদলে দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ এদেশের কবি, লেখক, চিত্রকর, চলচ্চিত্রকার, ভাস্কর্য শিল্পী সবাইকে ছুঁয়ে বলে গেছে সে এক স্বতন্ত্র অধ্যায়, ‘অসমাপ্ত ইতিহাস’ হয়ে। মুক্তিযুদ্ধের আবেগ ও বাস্তবতা ধারণে কবি, লেখক ও বুদ্ধিজীবীরা নিরন্তর লিখে গেছেন এবং লিখছেন সাম্প্রতিক সময়ে অব্ধি। মুক্তিযুদ্ধকে উপজীব্য করে বেশ কিছু সাহিত্যকর্ম রচিত হয়েছে যা বিশ্বমানের কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের আগে তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানে বাংলা সাহিত্যে সমাজ সচেতনতা এবং রাজনৈতিক টানাপোড়ন, নব উত্থিত নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অস্থির রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের সাথে টানাপোড়ন এর বিষয়গুলো হাতে গোনা দু চার জন লেখক ছাড়া আর কারো লেখায় তেমন আসেনি। এ কারণেই জহির রায়হানের এ উপন্যাসটির পুন:পাঠ আবারো জরুরী হয়ে পড়েছে। উপন্যাসটির আমাদের চমক জাগায় এই জন্যে যে উপন্যাসটির বাস্তবতা ও প্রেক্ষাপট আমাদের মনে করিয়ে দেয় উপন্যাসটি লিখিত হবার বছরাধিক কালের মধ্যেই সংঘটিত মহান মুক্তিযুদ্ধের রক্তস্নাত ও টানটান উত্তেজনার ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের নয় মাসের কথা।
উপন্যাস হিসেবে ‘আর কত দিন’ এর ব্যাপ্তি তেমন বিস্তৃত নয়। ছোট এ রচনাকর্মে একক কোন চরিত্র গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেনি বরং সমান্তরাল কয়েকটি চিত্রকল্প সমান তালে এগিয়েছে শুরু হতে। এসব চিত্রকল্প বর্ণনার মাধ্যমে লেখকের প্রতিবাদী বক্তব্যটিকে পাঠকের কাছে পৌঁছানোই ছিল লেখকের প্রধান লক্ষ্য, যা চরিত্রগুলোর বিকাশের চাইতে মানবিক অনুভূতি ও আবেগের দিকে নজর দিয়েছে বেশি। প্রকৃত অর্থে সব চরিত্রই স্থান কালের বাধ্যবাধকতাকে অতিক্রম করে গেছে সার্থক ভাবে এবং নির্দিষ্ট একটি বক্তব্য ধারণ করে এগিয়েছে। এই বক্তব্যটি হল বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে মানবতার বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের নানা-মাত্রিক প্রকরণের বিরুদ্ধ এক ধরনের নিরব প্রতিবাদ। ঔপন্যাসিকের কুশলী উপস্থাপন গুনে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটে চলা হাজারো মানুষ আমাদের মনে করিয়ে দেয় একাত্তরে ভয়াবহ গণহত্যার শিকার বাংলার লাখো কোটি মানুষের শরণার্থী হিসেবে পালিয়ে বাচার চেষ্টার কথা। অবক্ষয়ের শিকার এ মানবাত্মার প্রতি লেখকের সহানুভূতি উঠে এসেছে নাতিদীর্ঘ বর্ণনায়, অল্প কটি দৃশ্য ও প্রতীককে আশ্রয় করে। আকৃতি ও চরিত্র চিত্রণের প্রকৃতি বিবেচনায় ক্ষুদ্রকায় এ সাহিত্য প্রয়াসকে উপন্যাস বলার চাইতে দীর্ঘ গল্প কিংবা ক্ষুদ্র উপন্যাসিকা বলা শ্রেয়। যদিও তাতে কোন অংশেই এই রচনাটির গুরুত্ব ক্ষুণ্ণ হবার নয়, কেননা এ গল্পের মূলে আছে মানবতার পরাজয়ের বিষণ্ণ ধ্বনি যা আমাদেরকে ব্যথিত করে আসছে হাজার বছর ব্যাপী এবং সাম্প্রতিক সময়ে যার প্রাসঙ্গিকতা চার দশক আগে উপন্যাসটির লেখার সময়কালের চেয়ে কোন অংশে কম নয়।
উপন্যাস কিংবা দীর্ঘ গল্প যাই বলা হোক না কেন ‘আর কত দিন’ শুরু হয়েছে হতাশার পিঠে আশার কথা শোনাবার আকুতি থেকে। উপন্যাসে শব্দের ব্যবহারের কুশলতা লক্ষণীয়। লেখক খুব সতর্কভাবে শব্দ ব্যবহার করেছেন এই উপন্যাসে এবং পুরো উপন্যাসটি যেহেতু রূপকধর্মীতাকে আশ্রয় করে গড়ে উঠেছে তাই শব্দ ব্যবহারে বাহুল্য বর্জন একে দিয়েছে এক কাব্যিক রূপ। মানবতার বিরুদ্ধে যে অপরাধ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিনিয়ত ঘটে চলছে তার প্রকাশে লেখক বেশ কিছু জায়গায় জীবনের বিপর্যয়ের কথা উল্লেখ করেছেন কাব্যিক দৃশ্যরূপে। তেমনি একটু অংশ তুলে ধরা যাক,
“দীর্ঘ প্রশস্ত পথগুলোতে কবরের শূণ্যতা।
ভাঙা কাচের টুকরো। ইটের টুকরো। আর মৃতদেহ।
কুকুরের।
বিড়ালের।
শূকরছানার।
পাখির।
আর মানুষের।...
জীবনের স্পন্দনহীন নগরী শুধু এক শব্দের তাণ্ডবের হাতে বন্দি। যেন অসংখ্য হিংস্র জানোয়ার
বন্য ক্ষুধার তাড়নায় চিৎকার করছে।
যেন অনেক গুলো পাগলা কুকুর।
কিংবা রক্ত পিপাসু সিংহ। বাঘ।
অথবা একদল মারমুখো শূকর-শূকরী।”
অল্পকটি কথায় লেখক মানবতার শত্রু এসব পশুদের অনাচারকে তুলে ধরেছেন। উপন্যাসের শুরুর বাক্যেই তিনি বলেছেন, ‘মানুষের এই দীনতার শেষ নেই’। হত্যা ও ধ্বংসের প্রতি তীব্র ধিক্কার দিয়ে শুরু করা লেখাটিতে শোনা যায় মানবের অন্তিম আকাঙ্ক্ষার কথা, “মানুষ মরতে চায়না, ওরা বাচতে চায়”। উপন্যাসে কয়েকটি দৃশ্যপট রচিত হয়েছে, যা সমান্তরালে আগাতে থাকে। যুদ্ধোবিরোধিতা এবং যুদ্ধকালীন অবক্ষয়ের চিত্র তুলে ধরে পাশবিক ভয়াবহতা ও ভীতির আবেশকে মূল বক্তব্য ধরে চলে উপন্যাসের গতিধারা। প্রারম্ভিক ভূমিকার পরে দেখতে পাই, মানুষের বন্যতার ভয়ে ভীত একদল মানুষের কথা দিয়ে শুরু হয়েছে স্নায়ু উত্তেজক যাত্রার। নোংরা অন্ধকার একটি ঘরে, গর্ত স্থিত ইঁদুরের মত জড়সড় হয়ে বসে আছে একদল মানুষ। উনিশজন মানুষ। যার মাঝে আছে ছেলে, বুড়ো, মেয়ে। কিশোরী যুবতী আর একজন সন্তান সম্ভবা মহিলা। হটাত পদশব্দ, হৃদয় কাপিয়ে কড়া নাড়ে কেউ একজন। ফ্যাঁকাসে মুখগুলোর শ্বাস বুজে আসে। ওই বুঝি মৃত্যু।
কিন্তু না, মৃত্যু ও ধ্বংসের মাঝেও অবশিষ্ট থাকে কিছু প্রাণ। আর তাই অসহায় মানুষগুলোর সাহাযার্থে এগিয়ে আসেন এক বুড়িমা। প্রবল দ্বিধা দ্বন্দ্ব স্বত্বেও উনিশজন মানুষের দলটি দরজা খুলে দেয় এবং তার পরামর্শ মোতাবেক এগিয়ে চলে নিরাপদ আশ্রয়ের খোজে। নিজের বাড়িতে নিয়ে একটি কাঠের তৈরি বাক্সঘরে ওদের উঠিয়ে তালাবন্ধ করে রাখেন বুড়িমা। এ সিদ্ধান্তে তীব্র আপত্তি তোলে তার তিন ছেলে, কিন্তু মা তাদের বোঝান নিরপরাধ লোক গুলোর সাথে ওদের ভাই নিখোঁজ ভাই তপুর কোন পার্থক্য নেই, দুপক্ষই অসহায়। এভাবে এক স্থানের বাস্তবতা বা দৃশ্যপটের অবসান।
উপন্যাসটির একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য, এখানে কোন স্থানের নাম উল্লেখিত হয়নি যেখানে ঘটনাগুলো সংঘটিত হচ্ছে। তবে বুঝে নিতে কষ্ট হয় না এ অনুল্লেখিত এসব স্থান দিয়ে লেখক সারা বিশ্বেরই প্রতিকৃতি তুলে ধরতে চেয়েছেন যেখানে যেখানে নিয়ত ধর্ষিত হচ্ছে মানবতা এবং মানুষ হচ্ছে নতুন করে আকা মানচিত্রের বলি। দ্বিতীয় আরেকটি বাস্তবতা যা তুলে ধরতে চেয়েছেন জহির রায়হান সেখানে দেখি একই পরিস্থিতির বয়ান,
“এখানেও জীবনের কোন অস্তিত্ব নেই।
প্রশস্ত পথ জুড়ে ভাঙা কাচের টুকরো। ইটের টুকরো। আর মৃতদেহ।”
এখানকার প্রতিবেশের বর্ণনা শুরু তপুর মাধ্যমে। তপু নামটির প্রতি লেখকের বিশেষ দুর্বলতা লক্ষণীয়। এই নামটি দ্বারা প্রধান চরিত্র হিসেবে দাড় করিয়ে তিনি ভাষা আন্দোলনের উপর ‘একুশের গল্প’ নামে একটি গল্প লিখেছিলেন যেখানে তপু ছিল একজন ছাত্রনেতা। সেখানকার মত তপু এখানেও সচেতন সমাজের প্রতিভূ ও মুক্তিকামী মানুষের প্রতীক। তপু ছুটছে, ছুটতে ছুটতেই সামনে খোলা একটি দরজা থেকে ঢুকে গেল এক ঘরে। সেখানে ঢুকে দেখতে পেল ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে বিছানা, আসবাব, বই, কাপড় আর কাচ। বাথরুমে জলের শব্দ, বাথটাবে কয়েকটা মৃতদেহ। মৃতদেহ গুলো চেনাজানা লোকের- ইভার মা, বাবা ভাইয়ের। ইভা তার প্রাণের মানুষ যাকে নিয়ে সে স্বপ্ন দেখে সুন্দর আগামীর। ইভা নিখোঁজ। পশুদের হুংকার শুনে ভয়ে লুকোতে গিয়ে হঠাত দেখা মেলে ইভার। অচেতন দেহ, গড়িয়ে পড়ে মেঝেতে। ইভাকে অভয় দেয় তপু, কেঁদে ওঠে ইভা। এভাবেই শেষ হয় দৃশ্যপটের এবং আরেকটি দৃশ্যপটে আসে নতুন এক বাস্তবতা নিয়ে। এ দৃশ্যে আছে আকাশের অবিরাম কান্নাধারা উপেক্ষা করে একহাঁটু পানি, কাদা ভেঙে এগিয়ে চলা জরাগ্রস্ত একদল মানুষের নিরন্তর হেটে চলার কথা, যারা একটু নিরাপদ আশ্রয়, বুকের খাঁচায় পোষা প্রাণটিকে টিকিয়ে রাখতে হিমালয় পদানত করবার ধীশক্তি নিয়ে উদ্ধত। এরা বাচতে চায় আর দশটা মানুষের মতই, তাই খোজে একটি নিরাপদ আশ্রয়, ঠিক যেমন একাত্তরে খুঁজেছিল লাখো শরণার্থী।
খুব সংগত কারণেই এই প্রশ্নটি উত্থাপিত হয় নিপীড়িত এইসব মানুষ কোথাকার। এই মানুষেরা কি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরাজিত জার্মানেরা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পারমানবিক নির্মমতার স্বীকার জাপানিরা; এই মানুষেরা কি ভিয়েতনাম কিংবা প্যালেস্টাইনের নিপীড়িত মানুষ- যারা তথাকথিত সন্ত্রাস নিধনকারীদের দ্বারা নিয়ত সন্ত্রাসের স্বীকার, নাকি এই মানুষেরা জহির রায়হানের লেখক স্বত্বার এক সুনিপুণ ভবিষ্যতবাণী, যা বাস্তব হয়ে দেখা দিয়েছে বাংলা ও বাঙালীর কাছে; যারা বিশ্বময় এসব গণহত্যা ও মানবিক বিপর্যয়ের মতই সমান ভয়াবহ গণহত্যার স্বীকার হয়েছিল একাত্তরে? বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া, জমিদখল, রক্ত ও লাল জলে ধ্বংস ও আগুনের কাব্যকথার মাঝে নিপীড়িত একদল মানুষকে আশ্রয় দেয়া সেই বুড়িমা খুঁজে বেড়ান তপুকে। নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে পালাতে থাকা মানুষগুলোকে থামিয়ে খোঁজেন সন্তানকে। তাকে কাঁদতে দেখে সান্ত্বনা দিয়ে এসে যখন কেউ বলে কেঁদে কি হবে, আমরা উপলব্ধি করি যুদ্ধের সেই নির্মমতার ইতিকথা। উপন্যাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এখানে তুলে ধরা প্রয়োজন-
"নিজের সন্তানের নির্মম মৃত্যুর কথা ভেবে অবিরাম বৃষ্টিধারার মাঝখানে নীরবে দাড়িয়ে রইলেন তিনি।
দুচোখ থেকে ঝড়ে পড়া অশ্রু, বৃষ্টির পানির সঙ্গে মিশে, দু গণ্ড বেয়ে গড়িয়ে পড়লো নীচে।
তুমি কাঁদছ কেন গো। কেঁদে কি হবে। আমার দিকে চেয়ে দেখ আমি তো কাঁদি না। অফুরন্ত মিছিলের একজন বললো। ওরা আমার ছেলেটাকে মেরে ফেলেছে হিরোশিমায়। আমার মাকে খুন করেছে জেরুজালেমের রাস্তায়। আমার বোনটা এক সাদা কুত্তার বাড়িতে বাঁদি ছিলো।
তার প্রভু তাকে ধর্ষণ করে মেরেছে আফ্রিকাতে। আমার বাবাকে হত্যা করেছে ভিয়েতনামে। আর আমার ভাই, তাকে ফাঁসে ঝুলিয়ে মেরে ওরা। কারণ সে মানুষকে ভীষণ ভালোবাসতো।
কিন্তু আমি তো কাঁদি না। তুমি কাঁদছ কেন।
বিষণ্ণ বুড়িমা স্তব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন সেই লোকটার দিকে। লোকটা থামলো না। একহাঁটু পানি আর কাদা ডিঙিয়ে সে এগিয়ে গেলো। সামনে। সহস্র শরণার্থীর অবিরাম মিছিলে। "
উপন্যাসের এই অংশটুকু খুবই গুরুত্বপূর্ণ মানবতার অবক্ষয়ের আর্ন্তজাতিকতা প্রকাশে লেখকের সাবলীলতা তুলে ধরতে। সামান্য কটি কথা দিয়েই তিনি তুলে ধরেছেন নিপীড়নের বৈশ্বিক রূপচিত্র। হিরোশিমায় আমেরিকার অমানবিক ও বিলাস প্রসূত পারমানবিক পরীক্ষা, জেরুজালেমে ইউরোপের বহিরাগত ইহুদিদের দ্বারা নিপীড়িত ফিলিস্তিনীদের কথা, কিংবা আফ্রিকা সহ সারাবিশ্বে দাসদের প্রতি তাদের সাদা প্রভুদের অত্যাচার, ভিয়েতনামে মার্কিন আগ্রাসনের প্রতীকী চিত্র চলে এসেছে একটি মাত্র প্যারায়। অসামান্য দৃঢ়তায় তিনি বিশ্বের সমকালীনতাকে স্পর্শ করে গেছেন, যা সমগ্র বাংলা ভাষার উপন্যাস সাহিত্যের ক্ষেত্রে অনেকাংশেই দুর্লভ। আজকের দিনেও উপন্যাসটি সমান প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে আমাদের মাঝে হাজির হয় যখন বিদ্বেষ, বিভেদ, হানাহানি জাতিতে জাতিতে যুদ্ধ চলে নিয়ত। মৃত্যুর পরে মৃত্যু, ‘মৃত্যু’ শব্দটাকেই করে তোলে মূল্যহীন। আর তাইত রেমার্ক বলেছিলেন, “একজন মানুষের মৃত্যু বিয়োগান্তক কিছু, কিন্তু লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু পরিসংখ্যান মাত্র”।২
প্রায় কাছাকাছি ঘরানার দুটি যুদ্ধকেন্দ্রিক বাস্তবতা ও ভিন্ন পরিবেশকে কেন্দ্র করে এগিয়ে চলে উপন্যাস। এক অংশ এগিয়েছে কাঠের বাক্স বন্দী একদল নিপীড়িত মানুষকে ঘিরে। আর অংশে আছে মুক্তিকামী, চোখের স্বপ্ন ম্লান হতে না দেয়া ইভা ও তপুর সংগ্রামের বয়ান। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে রচিত এ উপন্যাস খুব অল্প কথায় ছুঁয়ে গেছে মানবজাতির রক্তে প্রোথিত আদিতম পাপ বর্ণবাদ ও আন্ত:ধর্মীয় সংঘাতের চিত্রকে। শাদা কালো বিভেদের কারণে গির্জায় আশ্রয় নেয়া তপু আর ইভাকে যখন একদল লোক বের করে দিতে উদ্ধত হয় অন্ধকারের খা খা সীমান্তে তখন মানবতার কান্নার ধ্বনি উচ্চকিত হয়ে ওঠে। তবে এতসব অন্ধকার, এত এত হতাশার মাঝেও আশার আলো একেবারে ফুরিয়ে যায় না, তা প্রমাণ করতেই যেন গির্জার পাদ্রি উদ্ধত ও হিংস্র জনতাকে ফিরিয়ে দেন। দেখা দেন যীশু প্রদর্শিত চিরন্তন মহানুভবতাকে সঙ্গী করে। লেখক একইভাবে ধর্মগত বিভেদকে ছুঁয়েছেন এসব প্রতীকী দৃশ্যায়নের মাধ্যমে। এসব দৃশ্য চিত্র রচনায় তিনি বিভেদের মূলকে চিহ্নিত করেছেন। গুজব এবং মানুষের পবিত্রতা ও ভালবাসাময় অনুভূতিকে অপব্যাখ্যা দিয়েই চলে বিশ্বজুড়ে ধর্মীয় হানাহানির এই নারকীয় রূপ। আর তাই উপন্যাসে যখন আশ্রয়দাত্রীর সন্তানেরা শুনতে পায় ভাই তপুকে খুন করে ফেলার মিথ্যা সংবাদ বা গুজব, বুড়িমার ঘরে আশ্রয় নেয়া অসহায় মানুষের দলটার প্রতি তাদের ক্ষোভ জাগে, প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে ওঠে ছেলেগুলো। বাক্সবন্দী অসহায় মানুষগুলোকে হত্যা করতে উদ্ধত ওরা যখন ছোট্ট শিশুর হাসি শুনে নামিয়ে আনে হাতে নেয়া অস্ত্র তখন আমাদের মনে পড়ে যায়, আসলে পৃথিবীতে এখনো মানবতা বলে কিছু আছে। সব শেষ হয়ে যায় নি। এখনো শিশুরা হাসে, কারণ এখনো ফুল ফোটে, পৃথিবীতে লেখা হয় নতুন কোন প্রেমিক যুগলের জন্য আনকোরা প্রেমের গান।
তারা এখন কাঠের বাক্সঘরে। বন্দী, তালাবন্ধ। ওদিকে ঘরের দরজায় হিংস্র পশুদের পদধ্বনি। আবারো উৎকণ্ঠা। একদল হায়েনার প্রবেশ। ওরা রক্ত চায়, উনিশজন মানুষের দীর্ঘদিনের হতাশায় মিইয়ে যাওয়া রক্তে ওদের স্নায়ুকে উত্তেজিত করতে চায়। পুরো বাড়ি জুড়ে আতঙ্ক, বুড়িমার সন্তানেরা ভীত সন্ত্রস্ত, উপরের লোকগুলো উৎকণ্ঠিত। যেন মৃত্যুময় নিস্তব্ধতা এসে গেছে আসে পাশে। এমন সময়ে অন্তঃসত্ত্বা মহিলাটির প্রসব বেদনা, উনিশজন মানুষের অভিশাপ কুড়িয়ে জন্ম নিল বিষাক্ত পৃথিবীতে নিষ্পাপ এক ফুল। সে বাচতে পারেনি, তার কান্না চেপে ধরে থামিয়ে দেয়া হয়েছে; কান্নার সাথে সাথে থেমে গেছে তার জীবন প্রদীপ। তার কান্না থামাতে বাধ্য হয়েছে এইসব মানুষেরা, কেননা তার কান্না থামানোতে মৃত্যু ঘটেছে একটি শিশুর আর কান্না চললে মৃত্যু ঘটত সাথের উনিশটি প্রাণের। এভাবেই সংখ্যাতত্বের পাল্লায় শিশুটি হয়ে পড়েছে তার বাবা মায়ের কাছেও নগণ্য তাই তাকে বাঁচানোর কোন চেষ্টাই করেনি বাবা মা। যুদ্ধ বা গৃহযুদ্ধ, অথবা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা অথবা যে কোন ধরনের সংঘর্ষের এই ভয়াল বাস্তবতা আমাদের আবারো মনে করিয়ে দেয় মুক্তিযুদ্ধ সহ বিশ্বের নানা দেশে সংঘটিত যুদ্ধের কথা, যেখানে মানবতা আসলে কতগুলো শব্দগত উপহাসের নাম। মুক্তিযুদ্ধের সময়েও এইভাবেই ভূলুণ্ঠিত হয়েছিল মানবতা। যে শিশুর কান্না হবার কথা ছিল পৃথিবীর অপার সৌন্দর্য উপভোগে তার প্রচেষ্টার ক্ষুদ্র একটা বিজ্ঞাপন, তা কতবার থেমে গেছে পাক হানাদার বাহিনীর বুটের তলায় কিংবা নিজের মা বাবার পালিয়ে বাচার চেষ্টায় মুখ চেপে ধরায়, তার কোন হিসেব জানা নেই বাংলার মানুষের।
বিশ্বের সর্বত্র যেখানেই যুদ্ধ ও দারিদ্র তার করাল গ্রাসে আটকে ফেলেছে মানবাত্মার সুকুমার বৃত্তিগুলোকে, যেখানেই দেখা দিয়েছে মানবিক বিপর্যয়। আর তাই প্রথম কিংবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ভিয়েতনাম আমেরিকা যুদ্ধ কিংবা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ সর্বত্রই একই চিত্র, বিপুল ক্ষয় ও ধ্বংস রক্ত ও প্রাণের, সম্পদ ও ভালবাসার। আর তাই জহির রায়হানের এই উপন্যাসটিও পেয়েছে আলাদা মাত্রা বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে। ঔপন্যাসিক শাহরিয়ার কবির এই উপন্যাসের মূল ধারনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তাই রচনা করেন একাত্তরের যীশু। এইটিই প্রমাণ করে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় যুদ্ধের গতি প্রকৃত, ক্ষয় ক্ষতির প্রকরণ ভিন্নধর্মী হতে পারে, তবে তার মূল গন্তব্য মানবিক বিপর্যয়কে তরান্বিত করা এবং সামাজ্রবাদীতার কালো থাবাকে আরো প্রসারিত করার মাঝেই সীমাবদ্ধ।
চিরাচরিত নিয়ম মেনে উপন্যাসটি একসময়ে শেষ হয়। শেষ হয় একদল মানুষের নিরন্তর ছুটে চলার বর্ণনা দিয়ে। তারা এগিয়ে চলেন একটা নিরাপদ সময়ের জন্যে, একটা নিরাপদ দেশ কিংবা জনপদের জন্যে। যেখানে ছেলেকে হারাতে হবে না হিরোশিমায় নিহত লাখো মানুষের মত। মাকে হারাতে হবে না জেরুজালেমে জাতিগত অন্যায়ের শিকার হয়ে, বাবাকে মরতে হবে বুখেনওয়ার্ল্ডে গণহত্যার পাশবিক নির্মমতার শিকার হয়ে। বিশ্বব্যাপী বিপন্ন মানবতার অন্তিম আশাবাদ একটি স্বপ্নময় জনপদ গঠনের অনিশ্চিত ধারনাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে শেষ হয় নাতিদীর্ঘ বয়ানের উপন্যাসটি। একটি সাহিত্যকর্ম, যা সময়, দেশ কাল এবং বিশ্বজনীন চেতনাকে ধারণ করে নিজ মহিমায় সমুজ্জ্বল তা কি কখনো শেষ হয় প্রকৃতপক্ষে? আমার মনে হয় না তা শেষ হয়, লেখক তার বক্তব্যকে শেষ করে যান, কিন্তু পাঠক তার নতুন অর্থ খুঁজে নেয় নতুন নতুন পাঠের দ্বারা। পাঠকের ভাবনার অফুরন্ত স্বাধীনতা থেকেই এখানে উপন্যাসটিকে দেখার চেষ্টা করা হয়েছে আন্তর্জাতিক যুদ্ধবাস্তবতার প্রেক্ষাপট থেকে। বিষয়বস্তু ও অনুপম প্রকাশ বৈচিত্র্যের জন্যে উপন্যাসটিকে বিশ্বজনীন বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। উপন্যাসটিকে বিশ্বের নানা প্রান্তের শান্তিকামী মানুষের কাছে ছড়িয়ে দেবার জন্যে যথাযথ অনুবাদ কর্মের দিকেও দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন বলেই মনে হয়। কেননা, উপন্যাসটি এখনও সমকালীন এবং মানব সভ্যতার ইতিহাসে বিষফোড়া স্বরূপ এসব যুদ্ধ যতদিন থাকবে ততদিন উপন্যাসটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেবে মানবতার বিরুদ্ধে বৈশ্বিক এ অন্যায় আর কত দিন?
১) জহির রায়হানের 'আর কত দিন' উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৭০ সালে। আন্তর্জাতিকতাবাদ ও বিশ্ব মানবতার প্রতি নিপীড়নের বাস্তবতায় লিখিত এ উপন্যাসটি প্রকাশের এক বছরের মাথাতেই শুরু হয় বাঙালি জাতির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন মুক্তিযুদ্ধ।
২) জার্মানির বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক এরিখ মারিয়া রেমার্ক এর ’দ্যা ব্লাক ওবেলিস্ক’ উপন্যাসের একটি স্মরণীয় উক্তি এটি।
ফুটনোট: সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সংগীত পরিচালক ও চলচিত্রকার জহির রায়হানের বহুমাত্রিক সৃষ্টিকর্মের কথা আমরা সকলেই অবগত। তার সৃষ্টিকর্মের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ এ ক্ষুদ্রাকায় উপন্যাসটি যে কোন কারণেই হোক, কম আলোচিত। সে কারণেই এই উপন্যাসটি পাঠের পরে আমার মনে হল এটি নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন আছে। আর তাই এই লেখাটির অবতারনা। আজ মৃত্যুঞ্জয়ী এই লেখকের জন্মদিন। তার স্মৃতির উদ্দেশ্যে আমার এ লেখাটি নিবেদন করছি।ু 'আর কত দিন' : বিপন্ন মানবতার বৈশ্বিক চিত্ররূপ
আধুনিকায়নের সূচনা পর্ব হিসেবে উনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দী বিশ্বসাহিত্য ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ সময়। এ সময় সাহিত্যে আধুনিকতার প্রবেশ ঘটেছে শুধু এমন নয়, বরং বিশ্ব মানচিত্রে পালাবদলের হাওয়া এ সময়েই লাগে। গোটা পৃথিবীর ভূভাগকে নিজেদের খেয়ালখুশি মত কয়েকভাগে ভাগ করে শাসন ও শোষণে মগ্ন থাকা সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে দেশে দেশে মানুষের মুক্তচেতনা ও স্বাধীনতাকামী ধারনার বিকাশ লাভে। ফলশ্রুতিতে বিগত দুশ বছরে বিশেষ করে গত শতকে অধিকাংশ দেশে স্বাধীনতা লাভ, রাজনৈতিক পট পরিবর্তন অনিবার্য সত্য হিসেবে দেখা দেয়, সমাজে চর্চিত হয় সামাজিক মূল্যবোধের নতুন প্রকরণ। আপামর জনসাধারণ শিক্ষা ও সংস্কৃতির মুক্ত প্রকাশের প্রভাবে সমাজের এসব পরিবর্তনের সাথে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে থাকে-হোকে সে ধনাত্মক অথবা ঋণাত্মক। প্রগতি বা ইতিবাচকতার এই চর্চার পাশাপাশি বিগত শতাব্দীতে শান্তিকামী মানবতার পরাজয় ঘটেছে বারবার।
বিংশ শতাব্দীর শুরুর ভাগেই বিশ্বের কোটি কোটি শান্তিকামী মানুষের হৃদয় বিদীর্ণ করে নেমে আসে যুদ্ধের খড়গ। ফলশ্রুতিতে সমাজ ও রাজনীতি সচেতন সংবেদনশীল লেখকেরা যুদ্ধ বিষয়টিকে অস্বীকার করে থাকতে সমর্থ হলেন না। তাদের লেখায় পড়ল যুদ্ধের ছাপ, এ যুদ্ধ এক নবতর প্রকরণের নাম, যুদ্ধকে নতুন চোখে দেখার একটা আনকোরা প্রচেষ্টা। যুদ্ধ প্রসঙ্গ, যুদ্ধের বিপুল ধ্বংসলীলা এবং মানবতার অবক্ষয়ের চিত্রটি ফুটে উঠেছে তাদের লেখায়। বিষয় ভাবনায়, প্রকরণে, চরিত্র চিত্রণে, ধ্বংসলীলার দৃশ্যপট অঙ্কনে এবং যুদ্ধের সাথে জনমানুষের সম্পর্কের নবতর ব্যাখ্যা মেলে এসব সাহিত্যকর্মে।
উনবিংশ শতকের যুদ্ধভিত্তিক লেখাগুলোর সাথে এ সময়ের সাহিত্যরীতির পার্থক্য নানাবিধ। এর কারণ খুঁজতে গেলে নজর দিতে হবে যুদ্ধের গতি প্রকৃতি ও বিস্তারিত যুদ্ধকৌশলের দিকে। খুব বেশিদিন আগের কথা নয় যখন যুদ্ধ ছিল সাধারণত দুটো যুধ্যমান বাহিনীর রক্তখরচের বিষয়। যুদ্ধে বেসামরিক লোকের অংশগ্রহণ খুব একটা তখন থাকত না, কিংবা থাকলেও তা খুবই নগণ্য। যুদ্ধপরবর্তী সময়ে যদিও বেসামরিক নাগরিকেরা এর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ফলাফল ভোগ করেছে প্রায়শই, বিজয়ী শক্তি শত্রুবিনাশ নীতিতে বিশ্বাসী হয়ে অত্যাচার, নির্যাতন, লুণ্ঠন, অগ্নিযোগ ইত্যাদি নানা প্রকার তাণ্ডবলীলা চালিয়ে ছারখার করেছে বিজিত শহর; তথাপি যুদ্ধকালীন সময়ে সামরিক বাহিনীর পাশাপাশি আপামর জনসাধারণ ও স্থাপনার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির তথা বিশ্বসভ্যতার যুদ্ধের সাথে যে বেদনাবিধূর সম্পর্ক, তা নতুন করে প্রথম ভাবতে শেখায় প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। বেসামরিক লোকেরা আপাত নিরাপদ স্থানেও নির্বিচারে ক্ষয়ক্ষতির স্বীকার হতে পারে এ ভাবনাটি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। পরবর্তীতে সারা বিশ্বের মানুষ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব ও ধ্বংসলীলাকে মনে রেখেছে মানবাত্মার বিপন্নতার চূড়ান্ত সাক্ষর হিসেবে। দুটো বিশ্বযুদ্ধেই ভারতীয় উপমহাদেশের সে অর্থে সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল না। তবে যুদ্ধের গতি প্রকৃতির নির্মাণে ভারতীয় উপমহাদেশের কোন ভূমিকা না থাকলেও ইংরেজ উপনিবেশ হিসেবে যুদ্ধের তাপ এখানে এসে লাগে। তবে তা খুবই সামান্য এবং জনজীবনে ব্যাপক সারা ফেলবার মত কখনোই জোরালো ছিল না, বিশেষ করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে দুর্ভিক্ষ এবং জাপানীদের বার্মা দখল এ অঞ্চলে মোটামুটি একটা ছাপ ফেলেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ভারতবর্ষে চলছিল স্বাধীনতা আন্দোলন। তাই এ সময়ে বাংলা সাহিত্য যুদ্ধ কিংবা যুদ্ধ বাস্তবতার উপন্যাস সময়ের দাবি হলেও সে অর্থে আমরা পাইনি যুদ্ধভিত্তিক সাহিত্য কর্ম। দুর্ভিক্ষের এ বিষয়টি কেন্দ্র করে বিভূতিভূষণ অশনি সংকেত নামে একটি উপন্যাস রচনা করেন। তথাপি একথা জোর কণ্ঠেই বলা চলে বিশ্বসাহিত্যের অন্যান্য তীর্থকেন্দ্রে যখন যুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস সাহিত্যের জোয়ার চলছিল যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে, ভারতীয় উপমহাদেশের বাংলা ভাষার সাহিত্যিকেরা সেদিক থেকে অনেকটাই দূরে সরে ছিলেন। এ কারণেই বৈশ্বিক যুদ্ধ ও বিপন্ন মানবতার অসহায়ত্বের উপর ভিত্তি করে যুদ্ধ ভিত্তিক কথা সাহিত্যে এ অঞ্চল হাতে তেমন কোন নিদর্শন পাওয়া যায় নি বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের পূর্ববর্তী সময়ে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বিশেষ করে ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে উপন্যাসের ক্ষেত্রে মূল ধারাই হয়ে ওঠে যুদ্ধের অনিবার্য সংঘাতময়তায় জীবন ও সম্পদের ক্ষয়ের ফলে সৃষ্ট ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের বয়ান। এ ধারার উপন্যাস গুলোর মধ্যে এরিখ মারিয়া রেমার্ক এর অল কোয়ায়েট অন দ্যা ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট, দ্যা ব্লাক ওবেলিস্ক, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে’র এ ফেয়ারওয়েল টু আর্মস, রিচার্ড এ্যাডলিংটন এর ডেথ অফ এ হিরো, আর্নল্ড জিগ এর Der Streit un den Sergeanten Grischa (The Case of Sergeant Grischa), and চার্লস ইয়েল হ্যারিসনের জেনারেলস ডাই ইন বেড, এগুলো উল্লেখযোগ্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে আবারো যুদ্ধ সাহিত্যের পালে নতুন হাওয়া লাগে এবং এ সময়ে আমেরিকান কথাসাহিত্যিকেরা কালজয়ী উপন্যাসের জন্ম দিয়েছেন। তন্মধ্যে হেরম্যান ওউক এর দি কেইন মিউটিনি, জেমস জোনস এর ফ্রম হেয়ার টু এটারনিটি, হেমিংওয়ের ফ্রম হুম দ্যা বেল টোলস প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। আটলান্টিকের ওপারের আমেরিকানরা মূলত যুদ্ধ করেছে জলে ও অন্তরীক্ষে এবং তাদের যুদ্ধ ছিল এশিয়ার দেশগুলোর সাথে। তাদের যুদ্ধকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিও ছিল ভিন্ন। একটি বিষয় লক্ষণীয় বিশ্ব ক্ষমতার পালা বদলে ইউরোপ থেকে আমেরিকার কালক্রমে সুপার পাওয়ারে পরিণত হবার সাথে সাথে সাহিত্যেরও কর্তৃত্ব আমেরিকায় চলে গেল কিনা এ এক প্রশ্ন।
সাহিত্যের ভাষারীতি ও প্রকাশভঙ্গীর দিকটি নিয়ন্ত্রণে সমাজ ও রাজনীতি কত বড় নিয়ামক তা বোঝা যায় এই সময়ের বাংলা সাহিত্যের দিকে তাকালে। শক্তিমান সব কথাসাহিত্যিক সে সময়ে লেখালেখিতে সক্রিয়, অথচ তাদের লেখায় যুদ্ধ বাস্তবতায় উপনিবেশ শাসিত ভারতবর্ষের নব্য গড়ে ওঠা নগরকেন্দ্রিক মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বাস্তবতা উঠে আসেনি। তাদের লেখায় তারা এ প্রেক্ষাপটটিকে রীতিমত অস্বীকার করে গেছেন এর পিছনে কারণ হিসেবে ভেবে নেয়া যেতে পারে লেখক সমাজের দীর্ঘদিনের ঔপনিবেশিকতার চর্চা এবং সমাজের চালিকা শক্তি সম্পন্ন সামাজিক শ্রেণী হিসেবে গ্রাম ও গ্রামীণ জনপদকে তুলে ধরার প্রচেষ্টার কারণেই অনুপস্থিত এই যুদ্ধ ও যুদ্ধপরবর্তী বাস্তবতা। মূলত বাংলা সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী সময়ে পশ্চিম বঙ্গের বাম ধারার লেখকেরা কিংবা মুসলিম জাতিসত্তার ধারনায় উদ্বুদ্ধ পশ্চিম পাকিস্তানের লেখকেরা কেউই এ সময়ে সারাবিশ্বে ঘটে যাওয়া সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিকাশ ও আগ্রাসনের দিকটিকে তাদের সাহিত্য কর্মে তুলে আনেননি। মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী বাংলা তথা বাংলাদেশী সাহিত্যে (তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান)সমাজ চেতনার প্রবল প্রকাশ ঘটে ষাটের দশকের শেষ দিকে বিক্ষুব্ধ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে। এ সময়ে কয়েকজন সমাজ ও বিশ্বরাজনীতি সচেতন লেখক তাদের লেখনীতে সমকালীন সমাজ ও বিশ্ব রাজনীতিকে ধারণ করার চেষ্টা করেন। এ বিষয়টিকে যথাযথভাবে তুলে ধরেছেন জীবনঘনিষ্ঠ কথা সাহিত্যিক জহির রায়হান।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা পূর্ব সময়ে সবচেয়ে সফল ও জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক জহির রায়হান। বিশ্বজনীন যুদ্ধ বাস্তবতা ও সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রেক্ষাপটে তার লিখিত ‘আর কত দিন’ উপন্যাসটি বিশ্ব সাহিত্যে, বিশেষ করে বাংলা সাহিত্যে একটি অনন্য সংযোজন। উপন্যাসটির গুরুত্ব মূলত এ কারণেই যে, এটির জন্ম বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন মুক্তিযুদ্ধের আগেই।১ মুক্তিযুদ্ধ আমাদের দেশের আপাত সহিষ্ণু এবং শান্তিপ্রিয় জনগণের চিন্তাধারা ও পরিবেশের সাথে প্রতিক্রিয়া দেখাবার দিকটিকে অনেকটাই বদলে দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ এদেশের কবি, লেখক, চিত্রকর, চলচ্চিত্রকার, ভাস্কর্য শিল্পী সবাইকে ছুঁয়ে বলে গেছে সে এক স্বতন্ত্র অধ্যায়, ‘অসমাপ্ত ইতিহাস’ হয়ে। মুক্তিযুদ্ধের আবেগ ও বাস্তবতা ধারণে কবি, লেখক ও বুদ্ধিজীবীরা নিরন্তর লিখে গেছেন এবং লিখছেন সাম্প্রতিক সময়ে অব্ধি। মুক্তিযুদ্ধকে উপজীব্য করে বেশ কিছু সাহিত্যকর্ম রচিত হয়েছে যা বিশ্বমানের কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের আগে তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানে বাংলা সাহিত্যে সমাজ সচেতনতা এবং রাজনৈতিক টানাপোড়ন, নব উত্থিত নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অস্থির রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের সাথে টানাপোড়ন এর বিষয়গুলো হাতে গোনা দু চার জন লেখক ছাড়া আর কারো লেখায় তেমন আসেনি। এ কারণেই জহির রায়হানের এ উপন্যাসটির পুন:পাঠ আবারো জরুরী হয়ে পড়েছে। উপন্যাসটির আমাদের চমক জাগায় এই জন্যে যে উপন্যাসটির বাস্তবতা ও প্রেক্ষাপট আমাদের মনে করিয়ে দেয় উপন্যাসটি লিখিত হবার বছরাধিক কালের মধ্যেই সংঘটিত মহান মুক্তিযুদ্ধের রক্তস্নাত ও টানটান উত্তেজনার ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের নয় মাসের কথা।
উপন্যাস হিসেবে ‘আর কত দিন’ এর ব্যাপ্তি তেমন বিস্তৃত নয়। ছোট এ রচনাকর্মে একক কোন চরিত্র গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেনি বরং সমান্তরাল কয়েকটি চিত্রকল্প সমান তালে এগিয়েছে শুরু হতে। এসব চিত্রকল্প বর্ণনার মাধ্যমে লেখকের প্রতিবাদী বক্তব্যটিকে পাঠকের কাছে পৌঁছানোই ছিল লেখকের প্রধান লক্ষ্য, যা চরিত্রগুলোর বিকাশের চাইতে মানবিক অনুভূতি ও আবেগের দিকে নজর দিয়েছে বেশি। প্রকৃত অর্থে সব চরিত্রই স্থান কালের বাধ্যবাধকতাকে অতিক্রম করে গেছে সার্থক ভাবে এবং নির্দিষ্ট একটি বক্তব্য ধারণ করে এগিয়েছে। এই বক্তব্যটি হল বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে মানবতার বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের নানা-মাত্রিক প্রকরণের বিরুদ্ধ এক ধরনের নিরব প্রতিবাদ। ঔপন্যাসিকের কুশলী উপস্থাপন গুনে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটে চলা হাজারো মানুষ আমাদের মনে করিয়ে দেয় একাত্তরে ভয়াবহ গণহত্যার শিকার বাংলার লাখো কোটি মানুষের শরণার্থী হিসেবে পালিয়ে বাচার চেষ্টার কথা। অবক্ষয়ের শিকার এ মানবাত্মার প্রতি লেখকের সহানুভূতি উঠে এসেছে নাতিদীর্ঘ বর্ণনায়, অল্প কটি দৃশ্য ও প্রতীককে আশ্রয় করে। আকৃতি ও চরিত্র চিত্রণের প্রকৃতি বিবেচনায় ক্ষুদ্রকায় এ সাহিত্য প্রয়াসকে উপন্যাস বলার চাইতে দীর্ঘ গল্প কিংবা ক্ষুদ্র উপন্যাসিকা বলা শ্রেয়। যদিও তাতে কোন অংশেই এই রচনাটির গুরুত্ব ক্ষুণ্ণ হবার নয়, কেননা এ গল্পের মূলে আছে মানবতার পরাজয়ের বিষণ্ণ ধ্বনি যা আমাদেরকে ব্যথিত করে আসছে হাজার বছর ব্যাপী এবং সাম্প্রতিক সময়ে যার প্রাসঙ্গিকতা চার দশক আগে উপন্যাসটির লেখার সময়কালের চেয়ে কোন অংশে কম নয়।
উপন্যাস কিংবা দীর্ঘ গল্প যাই বলা হোক না কেন ‘আর কত দিন’ শুরু হয়েছে হতাশার পিঠে আশার কথা শোনাবার আকুতি থেকে। উপন্যাসে শব্দের ব্যবহারের কুশলতা লক্ষণীয়। লেখক খুব সতর্কভাবে শব্দ ব্যবহার করেছেন এই উপন্যাসে এবং পুরো উপন্যাসটি যেহেতু রূপকধর্মীতাকে আশ্রয় করে গড়ে উঠেছে তাই শব্দ ব্যবহারে বাহুল্য বর্জন একে দিয়েছে এক কাব্যিক রূপ। মানবতার বিরুদ্ধে যে অপরাধ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিনিয়ত ঘটে চলছে তার প্রকাশে লেখক বেশ কিছু জায়গায় জীবনের বিপর্যয়ের কথা উল্লেখ করেছেন কাব্যিক দৃশ্যরূপে। তেমনি একটু অংশ তুলে ধরা যাক,
“দীর্ঘ প্রশস্ত পথগুলোতে কবরের শূণ্যতা।
ভাঙা কাচের টুকরো। ইটের টুকরো। আর মৃতদেহ।
কুকুরের।
বিড়ালের।
শূকরছানার।
পাখির।
আর মানুষের।...
জীবনের স্পন্দনহীন নগরী শুধু এক শব্দের তাণ্ডবের হাতে বন্দি। যেন অসংখ্য হিংস্র জানোয়ার
বন্য ক্ষুধার তাড়নায় চিৎকার করছে।
যেন অনেক গুলো পাগলা কুকুর।
কিংবা রক্ত পিপাসু সিংহ। বাঘ।
অথবা একদল মারমুখো শূকর-শূকরী।”
অল্পকটি কথায় লেখক মানবতার শত্রু এসব পশুদের অনাচারকে তুলে ধরেছেন। উপন্যাসের শুরুর বাক্যেই তিনি বলেছেন, ‘মানুষের এই দীনতার শেষ নেই’। হত্যা ও ধ্বংসের প্রতি তীব্র ধিক্কার দিয়ে শুরু করা লেখাটিতে শোনা যায় মানবের অন্তিম আকাঙ্ক্ষার কথা, “মানুষ মরতে চায়না, ওরা বাচতে চায়”। উপন্যাসে কয়েকটি দৃশ্যপট রচিত হয়েছে, যা সমান্তরালে আগাতে থাকে। যুদ্ধোবিরোধিতা এবং যুদ্ধকালীন অবক্ষয়ের চিত্র তুলে ধরে পাশবিক ভয়াবহতা ও ভীতির আবেশকে মূল বক্তব্য ধরে চলে উপন্যাসের গতিধারা। প্রারম্ভিক ভূমিকার পরে দেখতে পাই, মানুষের বন্যতার ভয়ে ভীত একদল মানুষের কথা দিয়ে শুরু হয়েছে স্নায়ু উত্তেজক যাত্রার। নোংরা অন্ধকার একটি ঘরে, গর্ত স্থিত ইঁদুরের মত জড়সড় হয়ে বসে আছে একদল মানুষ। উনিশজন মানুষ। যার মাঝে আছে ছেলে, বুড়ো, মেয়ে। কিশোরী যুবতী আর একজন সন্তান সম্ভবা মহিলা। হটাত পদশব্দ, হৃদয় কাপিয়ে কড়া নাড়ে কেউ একজন। ফ্যাঁকাসে মুখগুলোর শ্বাস বুজে আসে। ওই বুঝি মৃত্যু।
কিন্তু না, মৃত্যু ও ধ্বংসের মাঝেও অবশিষ্ট থাকে কিছু প্রাণ। আর তাই অসহায় মানুষগুলোর সাহাযার্থে এগিয়ে আসেন এক বুড়িমা। প্রবল দ্বিধা দ্বন্দ্ব স্বত্বেও উনিশজন মানুষের দলটি দরজা খুলে দেয় এবং তার পরামর্শ মোতাবেক এগিয়ে চলে নিরাপদ আশ্রয়ের খোজে। নিজের বাড়িতে নিয়ে একটি কাঠের তৈরি বাক্সঘরে ওদের উঠিয়ে তালাবন্ধ করে রাখেন বুড়িমা। এ সিদ্ধান্তে তীব্র আপত্তি তোলে তার তিন ছেলে, কিন্তু মা তাদের বোঝান নিরপরাধ লোক গুলোর সাথে ওদের ভাই নিখোঁজ ভাই তপুর কোন পার্থক্য নেই, দুপক্ষই অসহায়। এভাবে এক স্থানের বাস্তবতা বা দৃশ্যপটের অবসান।
উপন্যাসটির একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য, এখানে কোন স্থানের নাম উল্লেখিত হয়নি যেখানে ঘটনাগুলো সংঘটিত হচ্ছে। তবে বুঝে নিতে কষ্ট হয় না এ অনুল্লেখিত এসব স্থান দিয়ে লেখক সারা বিশ্বেরই প্রতিকৃতি তুলে ধরতে চেয়েছেন যেখানে যেখানে নিয়ত ধর্ষিত হচ্ছে মানবতা এবং মানুষ হচ্ছে নতুন করে আকা মানচিত্রের বলি। দ্বিতীয় আরেকটি বাস্তবতা যা তুলে ধরতে চেয়েছেন জহির রায়হান সেখানে দেখি একই পরিস্থিতির বয়ান,
“এখানেও জীবনের কোন অস্তিত্ব নেই।
প্রশস্ত পথ জুড়ে ভাঙা কাচের টুকরো। ইটের টুকরো। আর মৃতদেহ।”
এখানকার প্রতিবেশের বর্ণনা শুরু তপুর মাধ্যমে। তপু নামটির প্রতি লেখকের বিশেষ দুর্বলতা লক্ষণীয়। এই নামটি দ্বারা প্রধান চরিত্র হিসেবে দাড় করিয়ে তিনি ভাষা আন্দোলনের উপর ‘একুশের গল্প’ নামে একটি গল্প লিখেছিলেন যেখানে তপু ছিল একজন ছাত্রনেতা। সেখানকার মত তপু এখানেও সচেতন সমাজের প্রতিভূ ও মুক্তিকামী মানুষের প্রতীক। তপু ছুটছে, ছুটতে ছুটতেই সামনে খোলা একটি দরজা থেকে ঢুকে গেল এক ঘরে। সেখানে ঢুকে দেখতে পেল ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে বিছানা, আসবাব, বই, কাপড় আর কাচ। বাথরুমে জলের শব্দ, বাথটাবে কয়েকটা মৃতদেহ। মৃতদেহ গুলো চেনাজানা লোকের- ইভার মা, বাবা ভাইয়ের। ইভা তার প্রাণের মানুষ যাকে নিয়ে সে স্বপ্ন দেখে সুন্দর আগামীর। ইভা নিখোঁজ। পশুদের হুংকার শুনে ভয়ে লুকোতে গিয়ে হঠাত দেখা মেলে ইভার। অচেতন দেহ, গড়িয়ে পড়ে মেঝেতে। ইভাকে অভয় দেয় তপু, কেঁদে ওঠে ইভা। এভাবেই শেষ হয় দৃশ্যপটের এবং আরেকটি দৃশ্যপটে আসে নতুন এক বাস্তবতা নিয়ে। এ দৃশ্যে আছে আকাশের অবিরাম কান্নাধারা উপেক্ষা করে একহাঁটু পানি, কাদা ভেঙে এগিয়ে চলা জরাগ্রস্ত একদল মানুষের নিরন্তর হেটে চলার কথা, যারা একটু নিরাপদ আশ্রয়, বুকের খাঁচায় পোষা প্রাণটিকে টিকিয়ে রাখতে হিমালয় পদানত করবার ধীশক্তি নিয়ে উদ্ধত। এরা বাচতে চায় আর দশটা মানুষের মতই, তাই খোজে একটি নিরাপদ আশ্রয়, ঠিক যেমন একাত্তরে খুঁজেছিল লাখো শরণার্থী।
খুব সংগত কারণেই এই প্রশ্নটি উত্থাপিত হয় নিপীড়িত এইসব মানুষ কোথাকার। এই মানুষেরা কি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরাজিত জার্মানেরা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পারমানবিক নির্মমতার স্বীকার জাপানিরা; এই মানুষেরা কি ভিয়েতনাম কিংবা প্যালেস্টাইনের নিপীড়িত মানুষ- যারা তথাকথিত সন্ত্রাস নিধনকারীদের দ্বারা নিয়ত সন্ত্রাসের স্বীকার, নাকি এই মানুষেরা জহির রায়হানের লেখক স্বত্বার এক সুনিপুণ ভবিষ্যতবাণী, যা বাস্তব হয়ে দেখা দিয়েছে বাংলা ও বাঙালীর কাছে; যারা বিশ্বময় এসব গণহত্যা ও মানবিক বিপর্যয়ের মতই সমান ভয়াবহ গণহত্যার স্বীকার হয়েছিল একাত্তরে? বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া, জমিদখল, রক্ত ও লাল জলে ধ্বংস ও আগুনের কাব্যকথার মাঝে নিপীড়িত একদল মানুষকে আশ্রয় দেয়া সেই বুড়িমা খুঁজে বেড়ান তপুকে। নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে পালাতে থাকা মানুষগুলোকে থামিয়ে খোঁজেন সন্তানকে। তাকে কাঁদতে দেখে সান্ত্বনা দিয়ে এসে যখন কেউ বলে কেঁদে কি হবে, আমরা উপলব্ধি করি যুদ্ধের সেই নির্মমতার ইতিকথা। উপন্যাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এখানে তুলে ধরা প্রয়োজন-
"নিজের সন্তানের নির্মম মৃত্যুর কথা ভেবে অবিরাম বৃষ্টিধারার মাঝখানে নীরবে দাড়িয়ে রইলেন তিনি।
দুচোখ থেকে ঝড়ে পড়া অশ্রু, বৃষ্টির পানির সঙ্গে মিশে, দু গণ্ড বেয়ে গড়িয়ে পড়লো নীচে।
তুমি কাঁদছ কেন গো। কেঁদে কি হবে। আমার দিকে চেয়ে দেখ আমি তো কাঁদি না। অফুরন্ত মিছিলের একজন বললো। ওরা আমার ছেলেটাকে মেরে ফেলেছে হিরোশিমায়। আমার মাকে খুন করেছে জেরুজালেমের রাস্তায়। আমার বোনটা এক সাদা কুত্তার বাড়িতে বাঁদি ছিলো।
তার প্রভু তাকে ধর্ষণ করে মেরেছে আফ্রিকাতে। আমার বাবাকে হত্যা করেছে ভিয়েতনামে। আর আমার ভাই, তাকে ফাঁসে ঝুলিয়ে মেরে ওরা। কারণ সে মানুষকে ভীষণ ভালোবাসতো।
কিন্তু আমি তো কাঁদি না। তুমি কাঁদছ কেন।
বিষণ্ণ বুড়িমা স্তব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন সেই লোকটার দিকে। লোকটা থামলো না। একহাঁটু পানি আর কাদা ডিঙিয়ে সে এগিয়ে গেলো। সামনে। সহস্র শরণার্থীর অবিরাম মিছিলে। "
উপন্যাসের এই অংশটুকু খুবই গুরুত্বপূর্ণ মানবতার অবক্ষয়ের আর্ন্তজাতিকতা প্রকাশে লেখকের সাবলীলতা তুলে ধরতে। সামান্য কটি কথা দিয়েই তিনি তুলে ধরেছেন নিপীড়নের বৈশ্বিক রূপচিত্র। হিরোশিমায় আমেরিকার অমানবিক ও বিলাস প্রসূত পারমানবিক পরীক্ষা, জেরুজালেমে ইউরোপের বহিরাগত ইহুদিদের দ্বারা নিপীড়িত ফিলিস্তিনীদের কথা, কিংবা আফ্রিকা সহ সারাবিশ্বে দাসদের প্রতি তাদের সাদা প্রভুদের অত্যাচার, ভিয়েতনামে মার্কিন আগ্রাসনের প্রতীকী চিত্র চলে এসেছে একটি মাত্র প্যারায়। অসামান্য দৃঢ়তায় তিনি বিশ্বের সমকালীনতাকে স্পর্শ করে গেছেন, যা সমগ্র বাংলা ভাষার উপন্যাস সাহিত্যের ক্ষেত্রে অনেকাংশেই দুর্লভ। আজকের দিনেও উপন্যাসটি সমান প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে আমাদের মাঝে হাজির হয় যখন বিদ্বেষ, বিভেদ, হানাহানি জাতিতে জাতিতে যুদ্ধ চলে নিয়ত। মৃত্যুর পরে মৃত্যু, ‘মৃত্যু’ শব্দটাকেই করে তোলে মূল্যহীন। আর তাইত রেমার্ক বলেছিলেন, “একজন মানুষের মৃত্যু বিয়োগান্তক কিছু, কিন্তু লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু পরিসংখ্যান মাত্র”।২
প্রায় কাছাকাছি ঘরানার দুটি যুদ্ধকেন্দ্রিক বাস্তবতা ও ভিন্ন পরিবেশকে কেন্দ্র করে এগিয়ে চলে উপন্যাস। এক অংশ এগিয়েছে কাঠের বাক্স বন্দী একদল নিপীড়িত মানুষকে ঘিরে। আর অংশে আছে মুক্তিকামী, চোখের স্বপ্ন ম্লান হতে না দেয়া ইভা ও তপুর সংগ্রামের বয়ান। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে রচিত এ উপন্যাস খুব অল্প কথায় ছুঁয়ে গেছে মানবজাতির রক্তে প্রোথিত আদিতম পাপ বর্ণবাদ ও আন্ত:ধর্মীয় সংঘাতের চিত্রকে। শাদা কালো বিভেদের কারণে গির্জায় আশ্রয় নেয়া তপু আর ইভাকে যখন একদল লোক বের করে দিতে উদ্ধত হয় অন্ধকারের খা খা সীমান্তে তখন মানবতার কান্নার ধ্বনি উচ্চকিত হয়ে ওঠে। তবে এতসব অন্ধকার, এত এত হতাশার মাঝেও আশার আলো একেবারে ফুরিয়ে যায় না, তা প্রমাণ করতেই যেন গির্জার পাদ্রি উদ্ধত ও হিংস্র জনতাকে ফিরিয়ে দেন। দেখা দেন যীশু প্রদর্শিত চিরন্তন মহানুভবতাকে সঙ্গী করে। লেখক একইভাবে ধর্মগত বিভেদকে ছুঁয়েছেন এসব প্রতীকী দৃশ্যায়নের মাধ্যমে। এসব দৃশ্য চিত্র রচনায় তিনি বিভেদের মূলকে চিহ্নিত করেছেন। গুজব এবং মানুষের পবিত্রতা ও ভালবাসাময় অনুভূতিকে অপব্যাখ্যা দিয়েই চলে বিশ্বজুড়ে ধর্মীয় হানাহানির এই নারকীয় রূপ। আর তাই উপন্যাসে যখন আশ্রয়দাত্রীর সন্তানেরা শুনতে পায় ভাই তপুকে খুন করে ফেলার মিথ্যা সংবাদ বা গুজব, বুড়িমার ঘরে আশ্রয় নেয়া অসহায় মানুষের দলটার প্রতি তাদের ক্ষোভ জাগে, প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে ওঠে ছেলেগুলো। বাক্সবন্দী অসহায় মানুষগুলোকে হত্যা করতে উদ্ধত ওরা যখন ছোট্ট শিশুর হাসি শুনে নামিয়ে আনে হাতে নেয়া অস্ত্র তখন আমাদের মনে পড়ে যায়, আসলে পৃথিবীতে এখনো মানবতা বলে কিছু আছে। সব শেষ হয়ে যায় নি। এখনো শিশুরা হাসে, কারণ এখনো ফুল ফোটে, পৃথিবীতে লেখা হয় নতুন কোন প্রেমিক যুগলের জন্য আনকোরা প্রেমের গান।
তারা এখন কাঠের বাক্সঘরে। বন্দী, তালাবন্ধ। ওদিকে ঘরের দরজায় হিংস্র পশুদের পদধ্বনি। আবারো উৎকণ্ঠা। একদল হায়েনার প্রবেশ। ওরা রক্ত চায়, উনিশজন মানুষের দীর্ঘদিনের হতাশায় মিইয়ে যাওয়া রক্তে ওদের স্নায়ুকে উত্তেজিত করতে চায়। পুরো বাড়ি জুড়ে আতঙ্ক, বুড়িমার সন্তানেরা ভীত সন্ত্রস্ত, উপরের লোকগুলো উৎকণ্ঠিত। যেন মৃত্যুময় নিস্তব্ধতা এসে গেছে আসে পাশে। এমন সময়ে অন্তঃসত্ত্বা মহিলাটির প্রসব বেদনা, উনিশজন মানুষের অভিশাপ কুড়িয়ে জন্ম নিল বিষাক্ত পৃথিবীতে নিষ্পাপ এক ফুল। সে বাচতে পারেনি, তার কান্না চেপে ধরে থামিয়ে দেয়া হয়েছে; কান্নার সাথে সাথে থেমে গেছে তার জীবন প্রদীপ। তার কান্না থামাতে বাধ্য হয়েছে এইসব মানুষেরা, কেননা তার কান্না থামানোতে মৃত্যু ঘটেছে একটি শিশুর আর কান্না চললে মৃত্যু ঘটত সাথের উনিশটি প্রাণের। এভাবেই সংখ্যাতত্বের পাল্লায় শিশুটি হয়ে পড়েছে তার বাবা মায়ের কাছেও নগণ্য তাই তাকে বাঁচানোর কোন চেষ্টাই করেনি বাবা মা। যুদ্ধ বা গৃহযুদ্ধ, অথবা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা অথবা যে কোন ধরনের সংঘর্ষের এই ভয়াল বাস্তবতা আমাদের আবারো মনে করিয়ে দেয় মুক্তিযুদ্ধ সহ বিশ্বের নানা দেশে সংঘটিত যুদ্ধের কথা, যেখানে মানবতা আসলে কতগুলো শব্দগত উপহাসের নাম। মুক্তিযুদ্ধের সময়েও এইভাবেই ভূলুণ্ঠিত হয়েছিল মানবতা। যে শিশুর কান্না হবার কথা ছিল পৃথিবীর অপার সৌন্দর্য উপভোগে তার প্রচেষ্টার ক্ষুদ্র একটা বিজ্ঞাপন, তা কতবার থেমে গেছে পাক হানাদার বাহিনীর বুটের তলায় কিংবা নিজের মা বাবার পালিয়ে বাচার চেষ্টায় মুখ চেপে ধরায়, তার কোন হিসেব জানা নেই বাংলার মানুষের।
বিশ্বের সর্বত্র যেখানেই যুদ্ধ ও দারিদ্র তার করাল গ্রাসে আটকে ফেলেছে মানবাত্মার সুকুমার বৃত্তিগুলোকে, যেখানেই দেখা দিয়েছে মানবিক বিপর্যয়। আর তাই প্রথম কিংবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ভিয়েতনাম আমেরিকা যুদ্ধ কিংবা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ সর্বত্রই একই চিত্র, বিপুল ক্ষয় ও ধ্বংস রক্ত ও প্রাণের, সম্পদ ও ভালবাসার। আর তাই জহির রায়হানের এই উপন্যাসটিও পেয়েছে আলাদা মাত্রা বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে। ঔপন্যাসিক শাহরিয়ার কবির এই উপন্যাসের মূল ধারনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তাই রচনা করেন একাত্তরের যীশু। এইটিই প্রমাণ করে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় যুদ্ধের গতি প্রকৃত, ক্ষয় ক্ষতির প্রকরণ ভিন্নধর্মী হতে পারে, তবে তার মূল গন্তব্য মানবিক বিপর্যয়কে তরান্বিত করা এবং সামাজ্রবাদীতার কালো থাবাকে আরো প্রসারিত করার মাঝেই সীমাবদ্ধ।
চিরাচরিত নিয়ম মেনে উপন্যাসটি একসময়ে শেষ হয়। শেষ হয় একদল মানুষের নিরন্তর ছুটে চলার বর্ণনা দিয়ে। তারা এগিয়ে চলেন একটা নিরাপদ সময়ের জন্যে, একটা নিরাপদ দেশ কিংবা জনপদের জন্যে। যেখানে ছেলেকে হারাতে হবে না হিরোশিমায় নিহত লাখো মানুষের মত। মাকে হারাতে হবে না জেরুজালেমে জাতিগত অন্যায়ের শিকার হয়ে, বাবাকে মরতে হবে বুখেনওয়ার্ল্ডে গণহত্যার পাশবিক নির্মমতার শিকার হয়ে। বিশ্বব্যাপী বিপন্ন মানবতার অন্তিম আশাবাদ একটি স্বপ্নময় জনপদ গঠনের অনিশ্চিত ধারনাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে শেষ হয় নাতিদীর্ঘ বয়ানের উপন্যাসটি। একটি সাহিত্যকর্ম, যা সময়, দেশ কাল এবং বিশ্বজনীন চেতনাকে ধারণ করে নিজ মহিমায় সমুজ্জ্বল তা কি কখনো শেষ হয় প্রকৃতপক্ষে? আমার মনে হয় না তা শেষ হয়, লেখক তার বক্তব্যকে শেষ করে যান, কিন্তু পাঠক তার নতুন অর্থ খুঁজে নেয় নতুন নতুন পাঠের দ্বারা। পাঠকের ভাবনার অফুরন্ত স্বাধীনতা থেকেই এখানে উপন্যাসটিকে দেখার চেষ্টা করা হয়েছে আন্তর্জাতিক যুদ্ধবাস্তবতার প্রেক্ষাপট থেকে। বিষয়বস্তু ও অনুপম প্রকাশ বৈচিত্র্যের জন্যে উপন্যাসটিকে বিশ্বজনীন বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। উপন্যাসটিকে বিশ্বের নানা প্রান্তের শান্তিকামী মানুষের কাছে ছড়িয়ে দেবার জন্যে যথাযথ অনুবাদ কর্মের দিকেও দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন বলেই মনে হয়। কেননা, উপন্যাসটি এখনও সমকালীন এবং মানব সভ্যতার ইতিহাসে বিষফোড়া স্বরূপ এসব যুদ্ধ যতদিন থাকবে ততদিন উপন্যাসটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেবে মানবতার বিরুদ্ধে বৈশ্বিক এ অন্যায় আর কত দিন?
১) জহির রায়হানের 'আর কত দিন' উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৭০ সালে। আন্তর্জাতিকতাবাদ ও বিশ্ব মানবতার প্রতি নিপীড়নের বাস্তবতায় লিখিত এ উপন্যাসটি প্রকাশের এক বছরের মাথাতেই শুরু হয় বাঙালি জাতির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন মুক্তিযুদ্ধ।
২) জার্মানির বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক এরিখ মারিয়া রেমার্ক এর ’দ্যা ব্লাক ওবেলিস্ক’ উপন্যাসের একটি স্মরণীয় উক্তি এটি।
ফুটনোট: সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সংগীত পরিচালক ও চলচিত্রকার জহির রায়হানের বহুমাত্রিক সৃষ্টিকর্মের কথা আমরা সকলেই অবগত। তার সৃষ্টিকর্মের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ এ ক্ষুদ্রাকায় উপন্যাসটি যে কোন কারণেই হোক, কম আলোচিত। সে কারণেই এই উপন্যাসটি পাঠের পরে আমার মনে হল এটি নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন আছে। আর তাই এই লেখাটির অবতারনা। আজ মৃত্যুঞ্জয়ী এই লেখকের জন্মদিন। তার স্মৃতির উদ্দেশ্যে আমার এ লেখাটি নিবেদন করছি।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে আগস্ট, ২০১৮ সকাল ৭:৪২