'কৌন্ হো তুম-বাঙালি ইয়া মুসলমান'- আজকের দিনে এটা একটা বহুশ্রুত প্রশ্ন, বাংলাদেশের শত্রুকবলিত অঞ্চলগুলোতে এরকম প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় যে-কোনো বাঙালিকে। প্রশ্নকর্তা হানাদার পাকিস্তানি সৈন্য। এমনি প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছিলেন চট্টগ্রামের একটি মসজিদের ইমাম সাহেব, ৬০ বছর বয়সী শান্ত সৌম্য বৃদ্ধ হতভাগ্য ইমাম সাহেব, জোহরের জামাত শেষে জায়নামাযে বসে তসবিহ পাঠ করেন কিছুক্ষণ। ততোক্ষণে মুসল্লিরা যার যার ঘরে ফিরে যায়- জামে মসজিদের সিঁড়িতে ভীড় থাকেনা। তখনই নেমে আসছিলেন সিঁড়ি বেয়ে সড়কে। সামনে পড়লো একদল টহলদার পাকিস্তানি সৈন্য, ওদের একজন প্রশ্ন করলোঃ 'এই বুড্ঢা। তুম বাঙালি, ইয়া মুসলমান?' বলে কী! নিশ্চয় আমি বাঙালি, এই বাংলার চায়া-সুনিবিড় এক শান্তির নীড়ে আমি জন্মেছি, মায়ের আদরে বোনের সোহাগে বড়ো হয়েছি। মায়ের মুখের বুলি বাংলাভাষায় কথা বলতে শিখেছি এবং আমি যে আরবি-ফারসি ভাষা ধর্মপুস্তক পাঠ করেছি, তা-এ বাংলা ভাষার মাধ্যমেই। আমার দেশ বাংলাদেশ, দেশের মানুষের ভাষা বাংলা ভাষা। ঘরে-বাইরে যেখানেই যাই, বাংলা ভাষাতে হয় আমাদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা। আমার মা বাঙালি, বাপ বাঙালি, এই যে মসজিদে নমাজের জামাতে শামিল হয় অগণিত মুসল্লি, তাদের কেউ জুম্মার নামাজ- ঈদের নামাজের নিয়ত না জানলে বাংলাতেই তাদেরকে শিখিয়ে দিই নিয়ত পাঠ করার জন্য। এবং নিশ্চয় আমি মুসলমানও। বংশপরম্পরায় আমরা মুসলমান। আমার বাপ-দাদা ছিলেন মুসলমান। আমাকে তাঁরা দীন-ই-ইলম শিক্ষা দিয়েছেন। আমি আজ মুসলমানদের নমাজের জামাতে ইমাম পর্যন্ত হয়েছি। আমি রোজ রোজ মসজিদের মুসল্লীদের উদ্দেশ্যে নসিহত করে থাকি। নিশ্চয় আমি মুসলমান। জন্মগতভাবে। দেশ-পরিচয়ে আমি একজন অকৃত্রিম বাঙালি এবং আমার ধর্ম পরিচয় আমি মুসলমান। কিন্তু এটা কেমন প্রশ্নঃ বাঙালি না মুসলমান? আমাদের মহানবী(সাঃ) নিজকে জন্মভূমির পরিচয়ে 'আরবীয়' বলতে আনন্দ পেতেন, আমার 'বাঙালি' পরিচয়ও তাই আনন্দদায়ক। বিশেষ করে আজ আমাদের সন্তানেরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার লড়াইয়ে অকাতরে প্রাণপণ করেছে। বৃদ্ধ ইমাম সাহেব জবাব দিলেনঃ 'আমি তো, বাপু, একজন বাঙালি মুসলমান।' তিনি হয়তো আরো কিছু বলতেন। কিন্তু তার আগেই হানাদার দস্যুর বিষাক্ত বেয়নেট বিদ্ধ করে দিয়েছিলো ৬০ বছরের বৃদ্ধের বুক! বৃদ্ধ ইমামের মুখে অন্তিম কলেমা পাঠ শুনেও দুষ্কৃতকারী পাকিস্তানি সৈন্যদের বিচলিত হবার কোনো কারণ ছিলো না। আর এভাবেই তারা হত্যা করেছে বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষদের। বাংলাদেশের শত্রুকবলিত এলাকাগুলোকে বাঙালিশূন্য করাই তাদের উদ্দেশ্য। কিন্তু তাদের সে উদ্দেশ্য কোনো দিনই সফল হবে না, কেননা বাংলার আবালবৃদ্ধবিনতা আজ রক্তের বদলে রক্ত নেবার সঙ্কল্পে ঐক্যবদ্ধ। পাকিস্তানি পশুশক্তিকে তারা বাংলার সবুজ মাঠ থেকে উতখাত করবেই। সর্বশেষ রক্তবিন্দুর বিনিময়ে তারা এ সঙ্কল্প থেকি বিচ্যুত হবে না। বাঙালি মুসলমান বৃদ্ধ ইমাম সাহেবের উষ্ণ রক্তকে কিছুতেই তারা দেবে না বৃথা যেতে।
-
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ০২-০৫-১৯৭১-এ বেলাল মোহাম্মদ কর্তৃক রচিত ও প্রচারিত কথিকা।