জাহাজ যেদিন ভিয়েতনামের হেলং বে’তে এ্যংকর করলো সেদিনের ঘটনাটা বেশ মজার। আমি তখন ছিলাম ডিউটি অফিসার। মাত্র এ্যংকর শেষ করছি। একটা বোট এসে জাহাজের গায়ে লাগলো। শীপ চ্যান্ডেলারের বোট। শীপ চ্যান্ডেলার মানে বিভিন্ন দেশে জাহাজে যারা ষ্টোর সাপ্লাই দেয়। তাদের কাছে ভিয়তনামের সীম কার্ডও ছিল। ইমিগ্রেশন কাষ্টমস ক্লিয়ার হবার আগে জাহাজে কাউকে উঠতে দেবার জন্য ক্যাপ্টেনের পার্মিশন দরকার। যেহেতু শীপ চ্যান্ডেলারের কাছে সীম কার্ড ছিল এবং ক্যাপ্টেন আগেই বলে দিয়েছিল কেউ যদি সীম নিয়ে আসে তবে যেন তাকে তার কাছে পাঠিয়ে দিই তবু আমি ক্যাপ্টেনকে ওয়াকি-টকিতে জানালাম একজন লেডি শীপ চ্যান্ডেলার আসছে। ক্যাপ্টেন সাহেব সীমের কথা শুনে আগ্রহী হলেন কিন্তু বললেন জাহাজে কোন মেয়েমানুষ ওঠানো যাবে না। যদি কোন পুরুষ মানুষ থাকে তবে যেন সে উঠে আসে। আমি জানালাম কোন পুরুষ মানুষ নেই। যেহেতু আমাদের লোকাল সীম কার্ড দরকার তাই আমরা মেয়েটাকে গ্যাংওয়ে পর্যন্ত এলাউ করতে পারি। কিন্তু ক্যাপ্টেন সাহেব তার জায়গায় অনড়। জাহাজে কোন মেয়েমানুষ ওঠানো যাবে না। সীম কার্ডের কোন দরকার নেই। আমি ক্যাপ্টেনকে বোঝাতে ব্যর্থ হলাম, এই মেয়েটি একজন প্রফিশনাল বিজনেসম্যান। বাইরের বিভিন্ন দেশের সে কথিত মেয়েমানুষ নয়। ক্যাপ্টেন তো বুঝলেনই না উল্টা আমাকে অপমান করলেন। এই ঘটনার পরে উনার সম্পর্কে অন্যরকম ধারনা হয়েছিল যেটা আরো স্পষ্ট হল এবার বাইরে আসার পরে।
এটি পাহাড়ের খাঁচে অবস্থিত কাষ্টমস ও ইমিগ্রেশন হাউজ। জাহাজ থেকে নেমে বাইরে আসার সময় আমাদের বোট গিয়ে থামে ইমিগ্রেশনের জেটিতে। আমরা পাসপোর্ট দেখিয়ে সোর পাশ নিয়ে ঘুরতে বের হই নতুন প্রাকৃতিক সপ্তম আশ্চার্যের একটি।
হং গাই বোট স্টেশন। বোট স্টেশনের কাছাকাছি যে মার্কেটটাতে আমরা প্রথমে ঢুকি সেখানে এসি ছিল না। প্রচন্ড গরমে খুব কষ্ট হচ্ছিল আমাদের। ছোট ছোট দোকান গুলোতে কাষ্টমারদের ঠান্ডা জন্য পর্যাপ্ত ফ্যানের ব্যবস্থাও ছিল না। আমি হঠাৎ লক্ষ্য করলাম আমাদের ক্যাপ্টেন সাহেব দোকানের একদম ভেতরে ঢুকে সেলসগার্লদের কাছাকাছি হয়ে মাথার টুপি খুলে মাথায় বাতাস লাগাচ্ছেন। আমার মনে হল এখানকার সেলসগার্লগুলোকে তিনি মেয়েমানুষ বলে চিনতে পারেননি বোধ হয়। :!>
আমরা হেলং বে’র সীবীচে ঘুরতে আসছিলাম। বাইরে আসার পরে ক্যাপ্টেন সাহেব সীবীচে আসতে চাননি। সম্প্রতি তিনি হজ্জ করিয়া আসছেন। এবং হজ্জে যাবার আগে তিন চিল্লা দিয়া ইমানের খুটি শক্ত করিয়া নিয়েছিলেন। সীবীচে গেলে ঈমান হালকা হয়ে যেতে পারে এই ভয়ে তিনি বোট স্টেশন সংলগ্ন একটা মার্কেটে ঢুকে নামাজের স্থান খুঁজতে লাগলেন। জাহাজ থেকে ব্যাগে করে কম্পাস লাগানো জায়নামাজ সঙ্গে এনেছেন তিনি।
আমরা তিনজন তিনটা মোটর সাইকেলের সাওয়ারি হয়ে শহর টা চক্কর দিয়ে সী বীচে আসলাম। তখনও আমরা বীচে ঢুকি নাই। একটা বাদ্যযন্ত্রের দোকানে বেহালা পিয়ানো গিটার নেড়ে চেড়ে দেখছিলাম। হঠাৎ দেখি একটা বাইক থেকে ক্যাপ্টেন সাহেব নামলেন। আমরা হাসি মুখে তাকে অভিবাদন জানালাম। তিনিও মুখে বললেন, ‘মানুষ খারাপ হইতে পারে জায়গা তো আর খারাপ না’। বুঝলাম তার ঈমানের খুটি কত্তো মজবুত।
আমার হেলং বে ভ্রমনের মজার স্মৃতির কথা মনে হলেই এই কথাগুলো মনে পড়ে, তাই ব্যাপার টা শেয়ার করলাম। কেউ আবার ভাইবেন না জাহাজের ক্যাপ্টেনরা ভন্ড হয়। এই ধরনের ভন্ড হুজুরের অভাব নেই আমাদের দেশে।
হং গাই শহরে ঘণ্টায় দুই ডলার চুক্তিতে ঘোরার জন্য খুব সুন্দর ব্যবস্থা। আমরা তিনজন তিনটা বাইকে উঠে শহরে ঘুরছিলাম। হঠাৎ আমি আবিষ্কার করলাম আমি দল ছুট হয়ে গেছি। আমার সঙ্গের দুইজনের বাইক আমি দেখতে পাচ্ছিলাম না। বাইকওয়ালার ইংরেজি জ্ঞান জিরো। জিজ্ঞাসা করতে ইশারা ইঙ্গিতে যা বোঝলো সে সর্টকার্ট যাচ্ছে। কিন্তু সে আমরা যেখানে যাবো সেখানে না নিয়ে গিয়ে একটা স্কুলের সামনে এসে দাড় করালো। তারপর কাকে যেন ফোন করলো। আমার বেশ নার্ভাস লাগছিল। অচেনা শহর। পকেটে কিছু ডলার আছে। আছে একটা দামি মোবাইল। আফ্রিকাতো বটেই চায়নাতেও এধরনের ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে।
কিন্তু কিছুক্ষন পরে কয়েকটা মেয়ে বেরিয়ে এল স্কুল থেকে। আমি বুঝতে পারছিলাম না ব্যপারটা কি?
একটা মেয়ে পরিষ্কার ইংরেজিতে আমার সাথে পরিচিত হল। নামটা ঠিক মনে নেই। ট্যুরিজমের ওপর পড়ছে সে। এই বাইকের ড্রাইভারে প্রতিবেশী সে। বাইকওয়ালা আমাকে তার কাছে নিয়ে গেছে কিছু সময় তার সাথে ইংরেজিতে কথা বলার জন্য। মেয়েটার ইংরেজিতে কথা বলা প্রাক্টিস করতে চায়। আজিব। মোঘলরা শুনতাম এক সাথে খানা খাবার জন্য লোক উঠিয়ে নিয়ে যেত কিন্তু কেউ যে কাউকে ইংরেজিতে কথা বলার জন্য এইভাবে ধরে আনতে পার জানা ছিল না।
তবে হংগাই শহরে বিশেষ কিছু নেই ঘুরে দেখার। যা কিছু আছে সেটা এই হেলং বে।
এই পাহাড়গুলো দেখে আমার প্রথমে মনে হয়েছিল এ্যভাটার মুভির শুটিং বুঝি এখানেই হয়েছিল। তবে এ্যভাটারের অতিবাস্তব পাহাড়গুলো কম্পিউটার গ্রাফিক্সের কাজ হলেও জেমস বন্ডের ‘Tomorrow Never Dies’ এর কিছু শুটিং এখানে হয়েছিল এটা আমি জানি।
খাড়াখাড়া পাহাড়গুলো সাগরের গভীর থেকে আকাশে উঠে গেছে। অনেকগুলোর গোড়া একেবারে সরু। মনে হয় এখনি ভেঙ্গে পড়বে। কিন্তু বছরের পর বছর এগুলো এমনি দাড়িয়ে আছে। ইউনেস্কো কর্তৃক ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট ঘোষিত এই হেলং বে’কে বলা হয় ‘রক ওয়ান্ডার অফ দ্যা স্কাই’।
ফিশিং ভিলেজ। ভাসমান এই ঘরগুলোতে প্রায় ১৬০০ মানুষের বসবাস। যারা মাছ ধরেই জীবিকা নির্বাহ করে থাকে।
এটাকে বলা হয় ম্যান’স হেড আইল্যান্ড। এই পাহাড়টিকে দেখে মনে হয় কেউ একজন সমূদ্রের মাঝে দাড়িয়ে মেইনল্যান্ড ভিয়েতনামের দিকে তাকিয়ে আছে।
দ্যা কিসিং আইল্যান্ড। এরকম রোমান্টিক একজোড়া পাহাড় দেখে মন ভালো না হয়ে পারে না। লাইমস্টোন রকের তৈরি এ পাহাড় নামকরণ ও বেশ মজাদার। বিভিন্ন সাইজের ও শেপের এ পাহাড়্গুলোর মধ্যে ৯৮৯টি পাহাড়ের নামকরণ করা হয়েছে ইতিমধ্যে।
টুরিষ্টদের কাছে হ্যালোন বে’ ভ্রমনটা কে আরো উপভোগ্য করে তোলার জন্য এই পাহাড়টিকে ঘিরে বানানো হয়েছে ঘোরানো সিড়ি যেটা দিয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে হেটে বেড়ানো সম্ভব। আর এই সিড়ির সাথে পুরো পাহাড়টিকে লাইটিং করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। রাতের অন্ধকারে পাহাড়টি জ্বল জ্বল করে। এই পাহাড়ের এই মনোরম দৃশ্য দেখার জন্য মূল শহর থেকে ব্রীজ আকারে একটা রাস্তাও টেনে আনা হয়েছে।
প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চার্য নির্বাচন প্রতিযোগিতায় সুন্দরবনকে পিছে ফেলে নয়নাভিরাম দৃশ্যের এই হেলং বে নির্বাচিত হয়। আমার দেশের সুন্দরবনকেও আমি কাছ থেকে দেখেছি। অবশ্যই এটি নতুন প্রাকৃতিক সপ্তাচার্য হিসেবে নির্বাচিত হবার মতো ছিল কিন্তু আমাদের বাংলাদেশীদের অলসতায় পর্যাপ্ত ভোটের অভাবে সুন্দরবন পৃথিবীতে ইতিহাস হতে পারেনি। তবে হেলং বে'র কাছে সুন্দরবন হেরে যাওয়ায় আমার মনে যে ক্ষোভ ছিল হেলং বে দেখে সেটা চলে গেছিল। এটি আসলেই পৃথিবীর সুন্দরতম একটা স্থান এবং সপ্তাচার্য হিসেবে নির্বাচিত হবার যোগ্যতা রাখে।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে আগস্ট, ২০১৪ সকাল ১১:০১