একাকী দূরের যাত্রায় আমি সব সময়ই টেনশনে থাকি যে আমার পাশের সহযাত্রী কেমন হবে সেটি নিয়ে।আর মনে মনে প্রার্থনা করি এই দূরের যাত্রায় যেন আমার পাশের সিটে কোন নারী যাত্রী না বসে।কারন মেয়েরা বাস যাত্রায় বমি করে বেশি।অন্য কারও বমি করা দেখলে আমারও গা গুলায়।
অফিসের কাজে ঢাকা এসেছিলাম।কাজ শেষে গাবতলী বাস টার্মিনালে এসে দিগন্ত পরিবহনের টিকিট কাটলাম।বাস ছাড়তে আরও বেশ কিছু সময় দেরি।
তাই আশেপাশেই ঘুরছিলাম।যখন বাসে উঠলাম আমার পাশের সিটটা তখনও খালি।বাস ছাড়ার পাঁচ-ছয় মিনিট আগে আমার কাছে একটা মেয়ে এসে জানতে চাইল ভাইয়া,এইটা কি এত নং সিট?আমি দেখে নিয়ে বললাম হ্যা এইটাই মনে হয় আপনার সিট।
মনে মনে বললাম, যা চাইনি সেটাই হল,অবশেষে এই দূর যাত্রায় একজন নারীই আমার সহযাত্রী হল।
বাস ছাড়লে আমি সিটে হেলান দিয়ে একটু ঘুমাতে চেষ্টা করলাম।কিন্তু ঘুম আসল না।বাসে আমার ঘুম হয়না বললেই চলে।আর অনেক দিন পর বাসে উঠলে মাথাটি কেমন ঝিম ধরে থাকে।বাস অনেক দূরে চলে আসলেও আমার সাথে মেয়েটির কোন কথা হয়নি।আমার কথা বলার কোন ইচ্ছেই ছিল না।
তবে এটা ঠিক সহযাত্রীর সাথে খোলা মনে কথা বললে যাত্রার পথটা হয়তো তেমন দূরের মনে হয়না।
তখনও আরিচা ঘাটে পৌছায়নি।জ্যামে পড়ে ও বাস কিছু জায়গাতে থামার কারনে বেশ দেরি হল ঘাটে পৌছাতে।বাস যখন ফেরির জন্য দাড়িয়ে থাকে সেই সময়টাই আমার কাছে সবচেয়ে বিরক্তিকর।
আরিচা ঘাটে যাওয়ার কিছু আগে পাশে বসা মেয়েছি হঠাৎ আমাকে বললেন,ভাইয়া একটু হেল্প করবেন?আমার পানির বোতলের মুখটা একটু খুলে দিবেন?
আসি পানির বোতলের মুখ খুলে দিলাম।মেয়েটি তার মত ব্যাগ থেকে এটা ওটা বের করে খাচ্ছে।আমি বাসে উঠলে তেমন কিছু খাইনা।
তবে ফেরিতে উঠলে ডিম খাই।ফেরিতে উঠার আগে দেখি এক ফেরিওয়ালা ভ্যানে করে ছোট ছোট আনারস বিক্রি করছে।আমি চারটি কিনলাম।একটু পরে মেয়েটি খাওয়ার জন্য পিস করে কাটা আনারস কিনল।আমার দিকে তাকিয়ে বলল,ভাইয়া কিছু মনে না করলে আপনি এক পিস নিতে পারেন আমি এত খেতে পারব না।
মেয়েটির বলার মাঝে কেমন জানি সরলতা ছিল তাই আর না বললাম না।আনারস খুবই মিষ্টি ছিল।ছোটছোট আনারস গুলো এত মিষ্ট হবে আমি তা ভাবিনি।
তারপর আস্তে আস্তে মেয়েটি ও আমার মধ্যো জানা পরিচায় হল।আমি যাব কোটালীপাড়া উনিও।উনার নানা বাড়ি কোটালীপাড়াতে।আর নিজ বাড়ি খুলনাতে।
ঢাকায় থাকেন উত্তরা।পড়ছেন উকালতি।
ফেরি পার হওয়ার পরে মেয়েটি বমি করা শুরু করল।কি আশ্চর্য কারও বমি দেখলেই যেখানে আমার যা গুলায় সেখানে আজ আমার একটুও খারাপ লাগছে না বরং কেমন একটা সহনুভুতি হতে লাগল মেয়টির উপরে।
এক সময় মেয়েটির বমি করা কমল।আমরা টুকটাক কথা বলছি।অনেক কথায় বলেছিলাম সেদিন আমার এই সহযাত্রীর সাথে।
উকালতি পড়া নিয়েও কথা বললাম।বললাম আজকাল উকিলরা তো টাকা ছাড়া কাজ করে না।শুধু টাকা ইনকাম করার ধান্দায় থাকেন সবাই।
মেয়েটি বললেন,এত টাকা খরচ করে পড়ছি টাকা ছাড়া কাজ করব কেন?আমি বললাম এত টাকা দিয়ে আপনি কি করবেন?
মেয়েটি উত্তরে যা বললেন তা আমি কখনই ভাবিনি।
মেয়েটি বললেন,আমার অনেক টাকার দরকার,আমার খুব শখ আমি একটি বিদ্ধাশ্রম বানাব।
মূহুর্তেই মেয়েটির প্রতি আমার শ্রদ্ধায় মাথা অবনত হয়ে এল।কি বলব কিছু ভেবে পাচ্ছিলাম না।মানুষ প্রচুর টাকা ইনকাম করে শুধু নিজের ব্যাংক ব্যালান্স বাড়াতে চাই।অনেকে ইনকাম করে দেশের টাকা বিদেশে পাচার করে দেয়।আর এই মেয়ে কিনা স্বপ্ন দেখে টাকা ইনকাম করে একটা বিদ্ধাশ্রম বানাবে!
আমাদের দেশে এই মেয়েটির মত আরও অনেক ছেলে-মেয়ে সুন্দর কিছু স্বপ্ন দেখে বলেই হয়তো দেশটা এখনও সব নষ্টদের দখলে চলে যায়নি।
আমি শেষে বললাম,আপনি যখন বিদ্ধাশ্রম করবেন তখন সেখানে আমার জন্য একটা চাকরি দিয়েন।মেয়েটি হাসি মুখে বলল,আচ্ছা ঠিক আছে।
সেই বিশাল মনের মেয়েটির নাম মুন্নি।তার ফোন নাম্বার আমাকে দিলেও আমি তাকে কোনদিন ফোন করিনি।
বিশাল মনের মানুষের সাথে কথা বলতে গেলে নিজের মনটাকেও কি বিশাল করা লাগেনা?