শৈশবের দিনগুলি কতই না মজার ছিল! সারাদিন হৈহুল্লোড়, ছুটাছুটি, মাতিয়ে বেড়াতাম আমাদের গ্রাম। আমি ছিলাম টো টো কোম্পানীর ম্যানেজার
![;)](https://s3.amazonaws.com/somewherein/assets/css/images/emot-slices_09.gif)
![B-)](https://s3.amazonaws.com/somewherein/assets/css/images/emot-slices_07.gif)
আমার প্রিয় কিছু খেলা ছিল সেসময়। সেগুলোর সাথেই পরিচিত করে দেব সবাইকে। অবশ্য এখানে কিছু খেলার আঞ্চলিক নাম ব্যবহার করা হয়েছে। এসব খেলাগুলো বিলুপ্তপ্রায় । তবুও স্মৃতি থেকে লিখতে ইচ্ছে হল___
ডাংগুলি খেলাঃ
এইটা ছিল আমার সবচেয়ে প্রিয় খেলা। ডাংগুলি খেলার সর্দার ছিলাম আমি। আমি যে দলে থাকতাম, সেই দল প্রতিপক্ষকে কয়েকটা শাল দিতই। ২০ গজে ১ শাল। আর ১গজে গণনা করা হতো যথাক্রমে বাড়ী, দুড়ী, থেড়ী, চাকল, চরব, ঝেক, মেক। এইগুলো সবই আঞ্চলিক কথা। এর অর্থ আমি নিজেও জানি না।
![:-B](https://s3.amazonaws.com/somewherein/assets/css/images/emot-slices_53.gif)
গোসলে হৈ-হুল্লোড়ঃ
দুপুর হলেই আমার সাঙ্গ-পাঙ্গ নিয়ে দৌড় দিতাম সমাবেত গোসলের জন্য। আমাদের বাড়ির পাশের খালের উপর পুল/ব্রিজ থেকে একটার পর একটা লাফ দিতাম। যতক্ষন না পর্যন্ত চোখ লাল হচ্ছে, ততক্ষন আমাদের গোসল চলতে থাকতো। মাঝে মাঝে মা এসে বকাবকি করে গোসল ভঙ্গ করে দিতো।
ঘুড়ি উড়ানোঃ
বিকেল হলেই আমাকে আর আটকায় কে! ঘুড়ি আর নাটাই হাতে ছুটতাম মাঠের দিকে। আমার দলবলও হাজির হয়ে যেত ঠিক সময়। কার ঘুড়ি বেশি উপরে উঠে, এই নিইয়ে চলতো প্রতিযোগীতা। একেক জন একেক রকম ঘুড়ি তৈরি করতাম। এইগুলোর আঞ্চলিক নাম ছিল__ চিলি ঘুড়ি, কোয়াড়ী ঘুড়ি, ঢাউস ঘুড়ি। এদের নিয়ে একটা ছড়াও ছিলঃ
“চিলি করে ঝিলিমিলি
কোয়াড়ী করে টান,
ঢাউস শালা উইঠ্যা বলে
আরো সুতো আন।”
সবচেয়ে বেশি উপড়ে উড়তো ঢাউস ঘুড়ি এবং বেশি টান অনুভব হত কোয়াড়ী ঘুড়ি। আর লেজওয়ালা চিলি ঘুড়ি ঝিলিমিলি করে ঢেউ খেলে উড়তো।
দাড়িয়াবান্ধা/গাদিঃ
দাড়িয়াবন্ধা খেলাটিকে আমাদের এলাকায় গাদি খেলা বলে। বেশ মজা পেতাম এই খেলাটায়।
ডাকটিকেটে গাদি খেলার নমুনা
গাদি খেলার কোট
খেলার নিয়মঃ মোটামুটি ৫টি ঘর কেটে খেলা হতো দাড়িয়াবান্ধা। পাঁচ ঘরে খেলোয়াড় সংখ্যা ৬ জন। অর্থাৎ দুই দল মিলিয়ে মোট ১২ জনের খেলা। কিন্তু আমরা অত নিয়ম কানুনের ধার ধারব কেন? ৫ জনের জায়গায় ৮ জনের খেলাতেও আমাদের তেমন আপত্তি ছিল না, আবার তিনজন খেলোয়াড় নিয়েও অনায়াসে চালিয়ে নিতাম।
ওপরের চিত্র-৫-এ ১নং ঘরটি মূল বা গাদি ঘর, ২নং টি নুন ঘর। প্রথমে দুই দলের মধ্যে টস হতো। টসজয়ী দলটা ঢুকত ১ নম্বর ঘরের ভেতর। অন্য দল তাদের রাখত কড়া পাহারায়। টসে হারা দলটির একজন দাঁড়াত ১ ও ২ নং ঘরের মাঝখানের দাগে, আরেকজন দাঁড়াতো ১ ও ৩ নং ঘরের মাঝখানে দাগের ওপর। খেলা শুরু হলে টসজয়ী দলটার প্রথম উদ্দেশ্যই প্রতিপক্ষের পাহারাকে ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে পড়া। তারপর সব দাগের সব প্রতিপক্ষকে টপকে সব ঘর স্পর্শ করে আবার প্রথম ঘরে ঢুকে পড়া।
সবাইকে ১ নং ঘরে ঢুকতেই হবে তার কোনো মানে নেই যেকোনো একজন ঢুকলেই চলবে। সেটা করতে পারলেই তারা পেয়ে যাবে এক গাদি বা এক পয়েন্ট। এক গাদি অর্জন করতে অবশ্যই সেই খেলোয়াড়কে নুনঘর ঘুরে আসতে হবে। প্রতিপক্ষকে ফাঁকি দিয়ে ১নং ঘরে ঢোকার মুহূর্ত পর্যন্ত যদি প্রতিপক্ষের কোনো খেলোয়াড় তাদের যে কোনো একজনকে নিজের দাগের ওপর দাঁড়িয়ে ছুঁয়ে দিতে পারে তবে সেই দান বাতিল। তখন টসজয়ী দলকে দাগে দাঁড়াতে হবে আর প্রতিপক্ষ ১ নং ঘরে ঢুকে নতুন দান শুরু করবে।
গাদি বা দাড়িয়াবান্ধা মূলত বারমাসি খেলা তবে বর্ষাকালেই খেলটা জমত বেশি।
গোল্লাছুটঃ
এই খেলাটাকে আমাদের এলাকায় ঘোপু খেলা বলে। বেশ মজা করে খেলতাম। খুব মিস করি এই গোল্লাছুট খেলাকে।
খেলার নিয়মঃ প্রথমে দুই দলে ভাগ হতে হয়। এই খেলার জন্য প্রয়োজন বড় প্রশস্ত জায়গা। প্রথমে গোল্লা নির্ধারণ করতে হয় এরপর গোল্লা থেকে ৬০/৭০ গজ দূরে নির্ধারণ করা হয় 'সীমানা'। গোল্লা থেকে সীমানা স্পর্শ করা হচ্ছে এই খেলার উদ্দেশ্য। যে গোল্লা রক্ষক সে যদি সীমানা স্পর্শ করতে পারে তাহলে এই খেলায় বিজয়ী হয়েছে বলে ধরা হয়।
গোল্লাতে পা রেখে খেলোয়াড়রা শেকল তৈরি করে প্রতিপক্ষদের স্পর্শ করার জন্য। যদি প্রতিপক্ষ কাউকে স্পর্শ করতে পারে তাহলে সে বাদ হয়ে যায়।
কেউ যদি সীমানা স্পর্শ করতে পারে তাহলে বিজয়ের জন্য একধাপ এগিয়ে যাওয়া হয়। কারণ তখন গোল্লা থেকে জোড়া লাফ দিয়ে সীমানার কাছে এগিয়ে যাওয়া হয়। ফলে সীমানা কাছে চলে আসে। অন্যদিকে প্রতিপক্ষ যদি কোন খেলোয়াড়কেই সীমানা ছুঁতে না দেয় তাহলে তারা দান পায়। পরে প্রতিপক্ষ দলনেতা গোল্লাকে ছুঁয়ে দাঁড়ায় আর অন্য সদস্যরা তাকে ছুঁয়ে আগের মতো ঘুরতে থাকে এবং চেষ্টায় থাকে কখন ছুটে গিয়ে সীমানা ছুবে। এভাবেই ঘুরে ফিরে খেলা চলতে থাকে।
মার্বেল বা কড়ি খেলাঃ
ছোটবেলায় মার্বেল খেলার ভক্ত ছিলাম খুব। কাচের জগের এক জগ মার্বেল ছিল আমার । তখন মার্বেল জেতা একটা নেশার মধ্যে ছিল। যত বেশি মার্বেল জিততাম, ততবেশি আনন্দ লাগত।
ফুলটোকা খেলাঃ
মাঝে মধ্যে খেলতাম ফুলটোকা খেলা। কোথাও কোথাও এটি বউরানী খেলা নামেও পরিচিত।
খেলার নিয়মঃ দুইজন রাজার অধীনে সমান সংখ্যক খেলোয়াড় থাকে। মাঝখানে অনেক ফাঁকা জায়গা রেখে দুইপাশে দুইটি রেখা টেনে দিতে হয়। দুইপক্ষ রেখা বরাবর বসে পড়ে। খেলার শুরুতে রাজা ফুল-ফলের নামে নিজ দলের সদস্যদের নাম ঠিক করে দেয়। তারপর সে বিপক্ষ দলের যেকোন একজনের চোখ হাত দিয়ে বন্ধ করে, ‘আয়রে আমার গোলাপ ফুল, বা আয়রে আমার টগর ফুল’ ইত্যাদি নামে ডাক দেয়। সে তখন চুপিসারে এসে চোখবন্ধ যার তার কপালে মৃদু টোকা দিয়ে নিজ অবস্থানে ফিরে যায় এবং সবাই একসাথে জোরে বল,
'ক খ গ
মাথায় হেড'
এরপর চোখ খুলে দিলে ওই খেলোয়াড় যে টোকা দিয়ে গেল তাকে সনাক্ত করার চেষ্টা করে।
সফল হলে সে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। এবার বিপক্ষের রাজা একই নিয়ম অনুসরণ করে। এভাবে লাফ দিয়ে মধ্যবর্তী সীমা অতিক্রম করে প্রতিপক্ষের জমি দখল না করা পর্যন্ত খেলা চলতে থাকে।
এই খেলা হচ্ছে বুদ্ধিমত্তার খেলা। এই খেলায় আমরা অনেক চালাকি করতাম। যেমন ইশারা ভাষা ব্যবহার করতাম। মাথায় হাত দিলে বা কান চুলকালে অমুকজন টোকা দিয়েছে তা সহজে বোঝার জন্য।
![;)](https://s3.amazonaws.com/somewherein/assets/css/images/emot-slices_09.gif)
![:||](https://s3.amazonaws.com/somewherein/assets/css/images/emot-slices_42.gif)
ওপেন টু বায়োস্কোপঃ
দু জন চৌকশ খেলোয়াড় হয় রাজা। মানে অধিনায়ক আরকি। দুই রাজা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দুই হাত উঁচু করে তোরণ তৈরি করে। বাকি খেলোয়াড়রা পরস্পরের কাঁধে হাত রেখে রেলগাড়ির মতো সেই তোরণের ভেতর দিয়ে পার হয়। চিত্রের দিকে তাকালেই বুঝতে পারবে। তোরণের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় ছেলেমেয়ে এক যোগে একটা ছড়া কাটে। অত্যন্ত্য জনপ্রিয় ছড়াঃ
“ওপেন টু বায়োস্কোপ
নাইন টেন তেইশ কোপ
সুলতানা বিবিয়ানা
সাহেব-বাবুর বৈঠকখানা
সাহেব বলেছে যেতে
পানের খিলে খেতে
পানে তে মৌরি বাটা
স্প্রিংয়ের চাবি আঁটা
যার নাম মণিমালা
তারে দেবো মুক্তার মালা”
ওপেন টু বায়োস্কোপ পদ্ধতিঃ
মুক্তার মালা বলার সাথে সাথে ছড়া শেষ হয়ে যায়। ছড়া শেষের মুহূর্তে যে খেলোয়াড় তোরণের ভেতর আটকা পড়ে তাকে দুই রাজা গলায় মালা দেয়ার মতো করে বন্দি করে। আগেই ঠিক করা থাকে যে খেলোয়াড় পড়বে সে কোন রাজার দলে খেলবে।এভাবে প্রথম খেলোয়াড়ের দল নির্বচন হয়ে গেলে তাকে বাদ দিয়ে আবার শুরু হয় রেলগাড়ি চলা। সাথে ছড়াতো আছেই। দ্বিতীয়বারে যে ধরা পড়ে সে দ্বিতীয় রাজার দলে খেলে। এভাবে একজন করে ধরে দলে ভেড়ায় রাজারা।
ষোল গুটি খেলাঃ
দাবা খেলার গ্রাম্য সংস্করণ ষোল গুটি খেলা। অলস দুপুরে সময় কাটানোর জন্য ষোল গুটি খেলতাম। বুদ্ধি, ধৈর্য, কৌশল ও সতর্কতার সাথে খেলাটি খেলতে হয় বলে বয়স্ক লোকসহ সব বয়েসের লোকেরা এই খেলা খেলতো। এই খেলার উপকরণ একদম সহজলভ্য।
ষোলগুটির ছকের নমুনা
খেলার নিয়মঃ দুজন প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে এই খেলা হয়ে থাকে। উভয় খেলোয়াড় ১৬ টি করে মোট ৩২ টি গুটি দিয়ে এই খেলা খেলে থাকে। খেলার সুবিধার্থে উভয়পক্ষের গুটির বর্ণ আলাদা হয়। সাধারণত মাটিতে দাগ কেটে ষোল গুটির ঘর বানানো হয়। শুধু ঘরের মাঝখানের দাগটি দান চালার জন্য খালি থাকে। কোনাকুনি দাগের গুটিগুলো সারা ঘর জুড়ে এক ঘর করে কোনাকুনি খেতে পারে। উলম্ব দাগ কাটা ঘরের গুটিগুলো লম্বভাবে এক ঘর করে খেতে পারে। অপর পক্ষের গুটিকে ডিঙ্গাতে পারলেই সে গুটি কাটা পড়ে। এই ভাবে প্রতিপক্ষের গুটির সংখ্যা কমিয়ে শূন্য করে ফেলতে পারলেই খেলা শেষ হয়ে যায়।
সবচেয়ে মজার খেলাটাই তো বাদ পড়েছে__ লাট্টু ঘোরানো! খুব দ্রুত লাটিম ঘোরাতে পারতাম। আবার ঘুরন্ত লাটিম হাতে তালুতে নিয়ে অনেক মজা করতাম।
আরো একটা খেলা প্রিয় ছিল__ লোহার রিং/বালা চালানো। রাস্তায় লোহার রিং/বালা চালাতে বেশ ভালো লাগতো।
শৈশবে আরোও কিছু মজার মজার খেলা করতাম। তার মধ্যে, বৌ-তোলা, লুকোচুরি, সাতগুটি, চোর-পুলিশ, ইত্যাদি আরো নাম না জানা অনেক খেলা।
বর্তমানে এইসব খেলাগুলো বিলুপ্তপ্রায়। আধুনিক সভ্যতা গ্রাস করেছে এইসব গ্রাম্য খেলাগুলো। আজ গ্রামের প্রতিটা মানুষের হাতে মোবাইল, ঘরে ঘরে টিভি, ডিশ লাইন, কম্পিউটার। সভ্যতা আমাদের অনেক কিছু দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু কেড়ে নিয়েছে আমাদের ক্ষুদ্র ভালোলাগা গুলো।
উৎসর্গঃ ঘুড্ডির পাইলট কে (যদিও রাফাত ভাই ঘুড্ডির পাইলট, তবুও আমার মনে হয় উনি আমার থেকে বেশি ঘুড্ডি উড়ায়নি)।
![;)](https://s3.amazonaws.com/somewherein/assets/css/images/emot-slices_09.gif)
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জুলাই, ২০১৩ বিকাল ৩:৩৬