চাইনা সাউদার্ন এয়ারলাইনসে যারা দক্ষিণ কোরিয়ার যাত্রী তাদেরকে ‘ট্রানজিট/ট্রান্সফার ভিজায়’ এক রাত গুয়াংজুতে থাকতে হবে। পরদিন সকাল সাড়ে ন’টায় ইনছনের (দ. কোরিয়া) ফ্লাইট। ব্যাপারটা হলো এরকম যে, চীনের কোন এয়ারলাইনসে আপনি যেখানেই যান, তাদের কোন শহরের ওপর দিয়ে যেতে হবে। সেটি গুয়াংজু হতে পারে, অথবা কুনমিংও হতে পারে। অথবা হংকং। যেমন এমিরেটস এয়ারলাইনসে আপনি আফ্রিকা, আমেরিকা বা ইউরোপের যে দেশেই যান, দুবেইয়ে একবার পা রাখতে হবে। ২০০৭ সালে এমিরেটস এয়ারলাইনসে কাজাখস্তানে যাবার পথে দুবেই শহরে ট্রানজিট নিতে হয়েছিলো! নিজ দেশ থেকে এতটুকু সুবিধা তো তারা নিতেই পারে। আমাদের ‘বিমান’ এক্ষেত্রে কতটুকু সুবিধা নিচ্ছে বা নিতে পারছে জানি না; তবে তারা যে কোনদিন লাভের মুখ দেখতে পাবে না, সেটি খুব ভাল জানি। যাত্রীসেবা আর পেশাদারিত্বের কথা বাদ দিলেও, অন্তত লাভ-লোকসানের হিসাবটা যদি ‘বিমানের’ বিমলা দিদিরা করতে পারতেন, তবু একদিন তারা যাত্রীসেবার মূল্য বুঝতে পারতেন। যাক যে কথা!
বিমানবন্দরে প্রথম ধাক্কা খেলাম বোর্ডিং পাস নেবার সময়। এক হাজার টাকা ‘অপ্রত্যাশিত’ ট্যাক্স দিতে হবে! কেন? সরকারের নতুন রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রার কারণে জুলাই থেকে এটি কার্যকর হয়েছে। ভালো কথা, তো সেটি আমাকে আগে জানানো হলো না কেন? আমার তো লোকাল কারেন্সি নেই? উত্তর, লোকাল কারেন্সি না দিলেও চলবে, ১০০ আরএনবি (চাইনিজ) দিলেও হবে। বলে কী? আরএনবি ১০০ মানে তো কমপক্ষে ১৩০০ টাকা? উত্তর, তাহলে ১০০০ টাকা দিন। (বুঝুন ‘মিজাজটা’ কেমন লাগে!) এসব বিষয়ে যাত্রীদেরকে আগেই জানাবার প্রয়োজন মনে করেন নি আপনারা? উত্তর, জানিয়েছি তো! কই, আমি তো জানলাম না?
আর কত বাদানুবাদ করা যায়? পেছনের যাত্রীরা সকলেই ১০০০ টাকা হাতে নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। অতএব ১০০ আরএনবি (অভিশম্পাৎ সমেত) পরিশোধ করে শুধুমাত্র ‘ঢাকা-টু-গুয়াংজু’ রুটের একটি বোর্ডিং পাস হাতে করে মনে অনেক অনিশ্চয়তা নিয়ে ইমিগ্রেশনের দিকে পা বাড়ালাম। অনিশ্চয়তার কারণটি হলো, দক্ষিণ কোরিয়া পর্যন্ত বোর্ডিং পাস না থাকলে, চীনারা আমাকে একদিনের ট্রানজিট ভিজা দেবে কি না সেটি নিয়ে। ‘টিকেট দেখালেই হবে। তাছাড়া, গুয়াংজু বিমানবন্দরে নামার পর আমাদের লোকেরাই আপনাদেরকে রিসিভ করে সবকিছু করিয়ে দেবে।’ কাউন্টারে দেশি ভাইদের এতটুকু ভরসায় ভরসা পাচ্ছি না।
বাঙালি নিজ দেশেই বৈষম্যের শিকার। বোর্ডিং-এর সময় একটি চরম বৈষম্য দেখলাম বিমানের কর্মকর্তাদের আচরণে। স্থানীয় যাত্রীদেরকে আবারও চেকিং! সাদা চামড়ার যাত্রীদেরকে হাসিমুখে ব্যাগ ওঠিয়ে নিয়ে চলে যেতে দিচ্ছে। অন্যদিকে স্থানীয়দের ব্যাগ মানি ব্যাগ জুতা মোজা সবকিছু চেক করছে। একটা বিষয় চোখে পড়লো: স্থানীয়দেরকেও কাউকে কাউকে তারা বাদ দিচ্ছে। কম বয়সী এবং কর্মপ্রত্যাশী যুবকদেরকে তারা বেশি অনুসন্ধান করছে। লক্ষণ ভালো ঠেকছে না! মতলব খারাপ, উদ্দেশ্য আরও খারাপ! এনডোর্সমেন্ট ছাড়া বেশ কিছু বিদেশি ডলার পাওয়া গেলো এক যুবকের মানিব্যাগে।
পেছনের লাইন থেকে এসব দেখছি আর নিজের করণীয় নিয়ে ভাবছি। ভাবলাম, এখানে নমনীয়তা আর ভদ্রতার মানে হবে দুর্বলতা। অবশেষে আমার টার্ন আসলো। আমি সোজা বলে দিই যে, আমি দু’সপ্তাহের পারিবারিক ভিজিটে বাইরে যাচ্ছি আমার সবকিছু ঠিক আছে। তারা ‘আপনি ব্যাগ নিয়ে চলে যান।’ বলে আমাকে ওয়েটিং লাউন্জে ঢুকতে দেওয়া হলো। আমি তাতে খুশি না হয়ে বরং রেগে আছি, কারণ তারা বিদেশীদের সামনে নিজ দেশের যাত্রীদেরকে ছোট করতেছে। সন্দেহ থাকলে তা অন্যভাবে সমাধা করতে পারতো।
বাংলাদেশ সময় দুপুর ১২টায় ছেড়ে স্থানীয় সময় বিকাল সাড়ে পাঁচটায় চীনের গুয়াংজু’র রানওয়েতে আমাদের বিমান এসে ধাক্কা খেলো। এই অল্প সময়ের মধ্যে যতটুকু পারি চীন দেখবো, এই পূর্বসিদ্ধান্তে অটল থাকলাম। কিন্তু সকল সিদ্ধান্ত মাটি করে দিলো গুয়াংজু বিমান বন্দরের বেরসিক কর্মকর্তারা। আমাদেরকে (ট্রান্সফার প্যাসেন্জার) কেউ অভ্যর্থনা জানাতে আসলো না। (হয়তো, এসেছিলো টের পাই নি! কারণ দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ফেরার পথে তাদেরকে খুঁজে পেয়েছি। কিন্তু অভ্যর্থনা জাতীয় কিছু পাই নি! আমরাই তক্কে তক্কে থেকে তাদেরকে চিহ্নিত করেছি।) ফলে সাধারণ যাত্রীর মতো আমরা ইমিগ্রেশনের মুখোমুখী হলাম এবং যা আশঙ্কা করেছিলাম, তা-ই হলো। আমাদেরকে সন্দেহ করা হলো। আমার মতো আরও কয়েকজন ট্রানজিট প্যাসেন্জারকে আমি চিহ্নিত করলাম। তাদের যা হবে, আমারও তা-ই হবে! একজন বয়স্ক ভদ্রলোক কানাডার যাত্রী। লাইনে তিনি আমার অগ্রবর্তী। তাকে বলা হলো ‘উনিশ নম্বর’ কাউন্টারে যেতে। আমি চুপচাপ লাইন বদল কলে উনিশ নম্বরে দাঁড়ালাম। সবুজ রঙের সাইনর্বোডে ‘স্পেশাল লেইন’ লেখা। অন্যগুলো নীল রঙের। ভালো। সবুজ দেখে অবুঝ মন শান্তি পেলো। এবার একটা সমাধান হবে। ইমিগ্রেশন পুলিশ আমাদের বোর্ডিং পাস চাইলেন, যা আমরা দিতে পারলাম না। আমার ক্ষেত্রে আমি বলতে চেষ্টা করলাম যে, টিকেটে সবকিছু লেখা আছে এবং আমাদেরকে কেবল গুয়াংজু পর্যন্ত বোর্ডিং পাস দেওয়া হয়েছে। চীনা পুলিস ইংরেজি বলতে না পারার কারণে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ক্ষুব্ধ। এবার তার অনুসন্ধান চালালেন আমার পাসপোর্টের ওপর। প্রসঙ্গত, আমার পাসপোর্টের ছবিটিতে চশমা নেই! কিন্তু পুলিসের আচরণ অস্বস্তিকরভাবে সন্দেহপ্রবণ। তার হাবভাব দেখে এবং নিজের মানইজ্জতের কথা ভেবে নিজেই চশমা খুলে তার দিকে তাকালাম। অগ্রিম বুঝতে পারার পুরস্কার হিসেবে পুলিস ‘ভিজা স্ট্যাম্প’ দেবার জন্য আমার পাসপোর্টটি পাশের কাউন্টারে পাঠিয়ে দিলেন। আমি নিষ্কৃতি পেলাম। সঙ্গে দু’জন বাঙালি যাত্রী।
আরও কিছু আনুষ্ঠানিকতা সেরে ‘হোটেল একোমোডেশন ভাউচার’ নিয়ে ‘ড্রাগন লেইক প্রিন্সেস হোটেলের’ বাসে যখন ওঠতে পারলাম, তখন স্থানীয় সময় সাতটা অতিক্রম করেছে। সন্ধার রঙ দেখছি চীনের আকাশে। গন্তব্যে পৌঁছতে তিরিশ মিনিট লাগবে, জানালেন হোটেল কর্মী। বসতিহীন বিস্তির্ণ এলাকাটি ছেড়ে ছোট্ট বাসটি এগিয়ে চলেছে। বাঁ দিকে উচু দালান, ডান দিকে একতলা দু’তলা বসতবাড়ি। অনেকটা জনমানবহীন। হয়তো মানুষ আছে, তবে আমার চোখে তেমন পড়লো না। হাইওয়ে ছেড়েছি কিছুক্ষণ হলো। সেটিও ডানে রেখে ‘ড্রাগন লেইক কমিউনিটি’ নামের একটি বড় গেইট অতিক্রম করে আরেকটি ছোট রাস্তায় ঢুকলাম। এবারের দালানগুলো ক্যাসলের মতো দেখাচ্ছে। সমস্ত কৌতূহল নিয়ে দেখছি সন্ধার গুয়াংজুকে। হোটেলে আমরা চেক-ইন পেলাম। সকাল ৬টায় ওয়েইক-আপ কলের অনুরোধ রেখে এলিভেটরের দিকে পা বাড়ালাম।
হোটেল কক্ষ পেতে কমপক্ষে পাঁচ মিনিট হাঁটতে হলো অভ্যন্তরের গলিতে। শোবার, বসার, পড়ার, জামা পরিধানের, মুখ ধোবার, গোসল করার এবং পয়কর্ম সম্পন্ন করার আলাদা আলাদা ব্যবস্থা। গোসলের জন্য আছে বাঙালি এবং পশ্চিমা ব্যবস্থা: বাতটাব তো আছেই আবার আলাদা কক্ষে শাওয়ারও আছে। আছে গোসল, শেভিং, ব্রাশিং ও ড্রেসিং-এর জন্য উপযুক্ত প্রসাধনী। পানীয় জল এবং কফি বা চা খাবার ব্যবস্থা তো আছেই। বড় স্ক্রিনের এলইডি টেলিভিশন। পাঁচতারা হোটেলের স্যালুন-সদৃশ স্যুটটিতে প্রবিষ্ট হয়ে বিমানবন্দরের বিমাতাসুলভ আচরণ ভুলতে চেষ্টা করলাম। ফেরার পথে টের পেলাম বাধ্য হয়েই এতো দামি হোটেলে আমাদেরকে রাখা হয়েছিলো। যাত্রী বেশি থাকায় অন্য হোটেলগুলো আগেই অকুপাইড হয়ে গিয়েছিলো। আসার পথে তিনতারা হোটেলে ছিলাম।
এমনিতেই সময় দু’ঘণ্টা এগিয়ে, তারপর হোটেলে বিভিন্ন সুবিধাদি চেক করতে করতে রাত প্রায় শেষ হবার পথে। ওয়েইক আপ কলের অনেক আগেই আমি জেগে স্যুটেড-বুটেড হয়ে বসে আছি। ঘুম না হলেও পরদেশ দেখার কৌতূহলে ক্লান্তি সব মুছে গেলো। প্রভাতের আলো আসার সাথে সাথে বারান্দায় বের হয়ে দেখতে লাগলাম একটুকরো চীনকে।
লেখাটি দীর্ঘ হয়ে গেলো। ফেরার পথে গুয়াংজু’র অভিজ্ঞতা দ্বিতীয় পর্বে শেষ করে দেবো।
--------------------
*ছবিগুলো মোবাইলে তোলা। কেউ যেন শিল্প না খুঁজেন
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই আগস্ট, ২০১৪ দুপুর ২:৫৯