আউটসোর্সিং আমাদেরকে অনেক কিছু দিয়েছে। নাই মামার চেয়ে কানা মামার সুবিধা দিয়েছে। কিছুই যেখানে করতে পারতাম না, সেখানে ঘরে বসে নিজের পরিবারের সাথে থেকে দু’টি পয়সা আয় করে চলতে পারছি। বিশাল বড় পাওয়া।
মা-বাবার লাখ লাখ টাকা খরচ করে এন্জিনিয়ার হয়েছি, কম্পিউটার এন্জিনিয়ার। সেই সনদ দিয়ে কোন প্রতিষ্ঠানের প্রধান হতে না পারলেও, সামাজিক কোন অবস্থান সৃষ্টি করতে না পারলেও, কোন প্রকার পদবী অর্জন করতে না পারলেও, টাকা তো আয় করতে পারছি! “তুই কী করস রে?” উত্তরে বলি, “আউটসোর্সিং”।
-আউটসোর্সিং? এইডা আবার কী চাকরি?
-চাকরি না। আত্মকর্মসংস্থান।
বুঝতে পারি, এই কথা বলার মধ্যে কতটুকু অহংকার কাজ করে একজন ফ্রিল্যান্সারের মনে। কিন্তু বন্ধুরা যখন সরকারের বিভিন্ন প্রশাসনে বিভিন্ন পদবী নিয়ে সমাজে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে, তখন একটু হলেও ভেতরের কোথাও বেদনার সৃষ্টি হয়। অথবা দেখা গেলো, কেউ কোন বড় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হয়ে বাড়ি গাড়ি নিয়ে ‘পুরোপুরি সেটলড লাইফ লিড’ করছে। তখন হঠাৎ করেই প্রশ্ন জাগে, শুধুই কি অর্থের জন্য পড়াশুনা করেছি, সমাজে কি পরিচয়ের একটুও দরকার ছিলো না?
আমি বলছি তাদের কথা, যারা আউটসোর্সিংয়ের দরজায় প্রবেশ না করলে নিজেদের একাডেমিক সনদ দিয়ে সরকারি/বেসরকারি/কর্পোরেট সেক্টরে ভালো একটি চাকরির সংস্থান করতে পারতো। দরজা খোলা, তাই প্রবেশ করেছে। বন্ধ থাকলে হয়তো সামনের দিকে এগিয়ে আরও উন্নতর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারতো। শুধুই তাদের কথা বলছি।
তাদের জন্য আমার ব্যথিত নই, যারা উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে অথবা না করে, শুধুমাত্র ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় বেইসিক কম্পিউটার অপারেটিং রপ্ত করেছে। তারপর নিজের প্রচেষ্টায় গ্রাফিক্স বা ওয়েবডিজাইনিং অথবা এসইও শিখে আউটসোর্সিংয়ের জগতে বিশাল বাজার তৈরি করেছে। শুধু নিজের জন্য নয়, সমগোত্রীয় অন্যদের জন্যও তারা সৃষ্টি করেছে নিশ্চিত কর্মসংস্থান। নিজের বাড়িতে আপনজনের সাথে থেকেই তারা সংসারের আর্থিক চাহিদা মেটাচ্ছে। এমনকি অতিরিক্ত সম্পদেরও মালিক হচ্ছে। তাদের জন্য আমার কোন আফসোস নেই, কারণ অন্যথায় তারা আরও নিম্নস্থরের কাজে নিযুক্ত হতে হতো। অথবা বেকারত্বের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে অপরাধ জগতে ঢুকে যেতো। তাই, তাদের এই উত্তরণে আমি বরং গর্বিত।
আমি তাদের জন্য, সেসব ছোট-ভাইবোনদের জন্য ব্যথিত হই, যারা অনেক অর্থ ও মেধা দিয়ে শিক্ষাজীবনের প্রায় সবগুলো স্তর অতিক্রম করেছে। আত্মসিদ্ধির মহাসড়কে আর ক’টা দিন হাঁটতে পারলেই তারা আরও সম্মানজনক একটি কর্মসংস্থান অথবা সামাজিক অবস্থান অর্জন করতে পারতো। কিন্তু আউটসোর্সিংয়ের ‘কুইক মানি’ তাদেরকে আত্মসিদ্ধির পথকে রুদ্ধ করে দিয়েছে। তাদেরকে থামিয়ে দিয়েছে গ্রাফিক্স আর ওয়েব ডিজাইনের মাঝে। অন্যথায়, তারা বৃহত্তর সমাজে নিজের অবস্থান তো নিশ্চিত করতে পারতোই, সে সাথে দেশ ও জাতির উন্নয়নের ডিজাইন করতে পারতো।
আমি খুব চাচ্ছিলাম কেউ আমাদের চোখগুলো খুলে দিক। আমরা যে আউটসোর্সিংয়ের নামে নতুন নীলকুটির শোষণে পড়েছি, তা কেউ আমাদেরকে বলে দিক। আমি যুক্তি খুঁজতেছিলাম, কীভাবে এমন একটি জনপ্রিয় বিষয়ের বিপরীতে কথা বলা যায়। বস্তুত, আমি এর বিপক্ষে নই, চাই শুধু দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। চাই আরও নেগোশিয়েশন হোক, বাঙালির ক্ষমতা বাড়ুক শ্রমের দামটি আরেকটু বেশি হাঁকার। আর চাই, সম্ভাবনাময় ও প্রতিশ্রুতিশীল নতুন প্রজন্ম ওখান থেকে সোজা বের হয়ে আসুক। এসে জাতি ও দেশ গঠনের অন্যান্য কাজে হাত দিক।
আমার মনের কথাগুলো যেন অবিকল পেয়ে গেলাম একটি ব্লগপোস্টে। লিখেছেন সাবেক মন্ত্রী ও রাজনীতিবিদ আবু সাঈদ :
“ইদানীং নতুন প্রজন্মকে স্বপ্ন দেখানো হচ্ছে, লাখো বেকারের কাজের সংস্থান হবে। কীভাবে হবে? বিশ্বায়নের প্রভাব এখানেও হাত দিয়েছে এবং এর দূতিয়ালি করার মহাজনদের দেখা যাচ্ছে। প্রযুক্তির পরিভাষায় এর নাম 'আউটসোর্সিং'। করপোরেট বিজনেস হাউস, বড় বড় কোম্পানি তাদের গোটা কাজের কিছু অংশ বাইরে থেকে করিয়ে নিতে চায়। কারণ সস্তা মজুরি। আমেরিকায় যে কাজে শ্রমিকের পাওনা ঘণ্টায় ২৫ ডলার, মেক্সিকােতে তা ১ ডলার, চীনে ৫০ সেন্ট, ভিয়েতনামে ৩০-৩৫ সেন্ট, বাংলাদেশে ১২ সেন্ট। এই 'আউটসোর্সিং'-এর মাধ্যমে নতুন প্রজন্ম ঝুঁকে পড়ছে। রাত জেগে দীর্ঘ সময় ব্যয় করে তারা যা শ্রম-মজুরি পাচ্ছে তাকে তারা লাভ মনে করে। আসলে তারা যে শোষিত হচ্ছে এ কথা বুঝলেও তাদের করার কিছুই নেই।”
মায়ের কানের গয়না বিক্রি করে যারা পরীক্ষার ফিস দিয়েছে, বাবার একমাত্র ধানী জমিটি বিক্রি করে যারা সেশন চার্জ দিয়েছে, সেসব মেধাবী তরুনদের মাথায় ‘নব’ লাগিয়ে শোষণ করে নিচ্ছে তাদের জীবনী শক্তি। আউটসোর্সিংয়ের মায়ায় আটকে গিয়ে তারা আর উন্নততর বা সৃষ্টিশীল কিছু চোখে দেখছে না। তারা আর বের হতে চায় না, ঘরেই বসে থাকতে চায়। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, শোষিত হচ্ছে সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় এবং মহানন্দে!
এমন কি কোন আঁকিয়ে আছেন? কোন কার্টুনিস্ট? যিনি যথাযথভাবে এবং কোন ভুলবুঝাবুঝির সৃষ্টি না করে উপরের চিত্রটি ছবিতে রূপান্তর করতে পারেন?
[প্রবাসী পাঠক এবং কাল্পনিক ভালোবাসার বিফলে-মূল্য-ফেরত পরামর্শে আজকের পোস্টটিকে প্রথম পৃষ্ঠায় আনা গেলো। তাদেরকে ধন্যবাদ! ভাবতেছি, এতো রহস্য তারা জানে কেমনে!!]
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই আগস্ট, ২০১৪ ভোর ৬:১৫