এক) রাজা এগামেমননের সাথে মতের অমিল হওয়ায় গ্রিসের পক্ষে যুদ্ধক্ষেত্রে যাওয়া বন্ধ করে দিলেন মহাবীর একিলিস। এরপর থেকে একটির পর একটি মৃত্যু এবং পরাজয়ের খবর আসতে লাগলো। কিন্তু কিছুতেই আর একিলিসকে যুদ্ধে নিয়ে যেতে পারবে না। মেনেলাউসের স্ত্রী হেলেনকে উদ্ধারের জন্য সৃষ্ট বিরোধ এখন তার বড়ভাই এগামেমননের রাজ্য-জয়ের অভিলাষের সাথে যুক্ত হয়ে বিশাল যুদ্ধের কারণ হয়েছে। তাছাড়া, রাজা এগামেমননকে একিলিসের একেবারেই না-পছন্দ – লোভী এবং দুশ্চরিত্র। যুদ্ধবন্দী সুন্দরী ব্রাইসিসকে কেড়ে নেওয়া ছিল প্রতিহিংসার বড় কারণ। কেন শুধু একজনের রাজ্য বিস্তারের জন্য যুদ্ধ করা? ওদিকে এগামেমনন প্রবল অহংকারী এক রাজা। তার মতে, একিলিসের নিয়তিই হলো যুদ্ধ করা, সে যোদ্ধা আর এগামেমনন হলেন রাজা। তিনি তার রাজাসুলভ ব্যক্তিত্বকে নিচে নামিয়ে একিলিসকে ফের অনুরোধ করেন নি। উভয়ের বন্ধু ওডিসিউস মধ্যস্থতা করেও একিলিসকে রাজি করাতে পারলেন না।
অন্যদিকে গ্রিসের সকল অঙ্গরাজ্যের সকল সৈন্যরা একে ‘দেশের জন্য যুদ্ধ’ বলে মেনে নিয়েছে। মেনে নিয়েছে একিলিসের বিশ্বস্ত সহচর এবং অনুগত শিষ্য পেটরোক্লাসও। ট্রয়ের যোদ্ধারা এতো আগ্রাসী আর কখনও হয় নি। হাতে তৈরি গোলা গুলো মার্বেলের মতো গড়িয়ে এসে গ্রিকদের তাবুগুলো পুড়িয়ে দিতে লাগলো। তারা বুঝতে পেরেছে গ্রিকদের সাথে একিলিস নেই। কিন্তু একিলিসকে সে কোনভাবেই যুদ্ধে ফেরাতে পারছে না। অগত্যা তারই যু্দ্ধপোশাক বর্ম ঢাল মস্তকাবরণী পড়ে সে যুদ্ধে যোগ দেয়। এটিই তার জন্য মরণফাঁদ ডেকে এনেছে। হেকটরসহ ট্রয়ের সকলেই ধরে নিয়েছে যে, আজ একিলিস যুদ্ধে নেমেছে। একই বিশ্বাসে নিজ দেশের সৈন্যরাও আত্মবিশ্বাসী হয়েছিলো। এক পর্যায়ে হেকটর এসে তাকে চ্যালেন্জ করলে পেটরোক্লাস তা প্রত্যাখ্যান করা কাপুরুষোচিত মনে করলো। বেশ কিছু সময় প্রতিরোধ করার পর মহাবীর হেকটরের হাতে পেটরোক্লাস নিহত হয়। মরণ আঘাত দিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে যখন তার মস্তকাবরণ খুললেন, হেকটর কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন – এ তো একিলিসের পোশাকে এক বালক যোদ্ধা! খবর গেলো একিলিসের কাছে! নিহত হবার খবরে সহযোদ্ধাদের ওপর এতই ক্ষিপ্ত হলেন যে, গলায় পা দিয়ে তিনি ঘনিষ্ট এক সহচরকে প্রায় মেরেই ফেলেছিলেন। কেন মরতে হলো পেটরোক্লাসকে? রাজা এগামেমননের ওপর ক্ষিপ্ত একিলিস যেন হঠাৎ শান্ত হয়ে গেলেন। তিনি ফিরে গিয়ে দুঃখ প্রকাশ করলেন সেসব সহযোদ্ধাদের কাছে, যারা তার তাৎক্ষণিক ক্ষোভের শিকার হয়েছিলো। রাজা এগামেমনন ও সকল মন্ত্রী-সেনাপতিদের উপস্থিতিতে এক অবর্ণনীয় বিষাদময় সন্ধায় একিলিস পেটরোক্লাসের মুখাগ্নি করলেন। সকলেই তার শোকের অংশিদার হয়েছিলেন। হেলেনের স্বামী মেনেলাউসের নিহত হবার খবরও গ্রিকদেরকে এতো শোকাহত করে নি। একিলিস ছিলেন অস্বাভাবিক রকমের নিরব। এ নিরবতা যেন ঝড়ের পূর্বের নিরবতা। এগামেমনন বলেই বসলেন, ছোকরা মরে গিয়ে আমাদের জন্য যুদ্ধটাকে বাঁচিয়ে গেলো। তারপর একিলিসের যুদ্ধে ফেরার জন্য এখন কেবল সকাল হবার প্রয়োজন।
দি ইলিয়াড পড়েছিলাম কতটি বছর হয়ে গেলো! হেকটরের ওপর একিলিসের প্রতিশোধ নেয়ার বিষয়টি দি ইলিয়াড কাব্য-উপন্যাসের প্রধান ঘটনা। পেলিউসের সন্তান এবং দেবতা জিউসের দৌহিত্র ‘অর্ধ-দেবতা একিলিস’ দি ইলিয়াড-এর প্রধান চরিত্রও। মহাকবি হোমার এই পেটরোক্লাসের মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে বিষাদের সৃষ্টি করেছেন তার কালোত্তীর্ণ মহাকাব্যে, তা পর্যাপ্তভাবে বাংলায় প্রকাশ করতে পারি নি। মূলত মহাকাব্যটি লেখাই হয়েছে বিষাদের আবহ দিয়ে। দি ইলিয়াড-এর প্রধান আকর্ষণই ছিলো ঘটনার পরিণতিতে সৃষ্ট বিষাদ, যা পাঠকের হৃদয়ে অনুরণিত হয়েছে। পাঠকের হৃদয়কে দগ্ধ করেছে, মথিত করেছে তার অনুভবকে। তাতে পাঠক আরও আগ্রহী হয়ে মনোযোগী হয়েছে পরবর্তি অধ্যায়গুলোতে। একিলিস কীভাবে ‘নবিস যোদ্ধা’ পেট্রোক্লাসের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেন, এটি দেখা তখন পাঠকের একমাত্র উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায়। আদর্শ স্বামী, আদর্শ বড়ভাই, আদর্শ পিতা, সর্বোপরী আদর্শ যোদ্ধা হয়েও তিনি পাঠকের অনুকম্পা পেয়েছেন কেবল একিলিসের হাতে নিহত হবার পর।
দুই) পাঠকের হৃদয়কে জয় করার উদ্দেশ্যে গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটল সাহিত্যের আবেদনকে তিনটি ভাগে ভাগ করেছিলেন: ১. নীতি বা বিশ্বাসযোগ্যতা (Ethos), ২. আবেগ বা বিষাদ (Pathos) আর ৩. যুক্তি বা গ্রহণযোগ্যতা (Logos)। তার মতে লেখায় থাকতে হবে নৈতিক আবেদন, অনুভবের আবেদন এবং যুক্তির আবেদন। গল্প কবিতা অথবা উপন্যাস, যা-ই হোক, এ তিনটি বিষয় আনুপাতিকভাবে থাকা চাই। এতিনটি মৌলিক বিষয়কে ‘ভাব প্রকাশের’ প্রধান কৌশল হিসেবে দেখা হয়: বলা হয় রেটরিকেল ট্রায়াঙ্গেল Rhetorical Triangle।
‘যুক্তি, সত্যতা আর অনুভবের’ অনুপস্থিতি ভালোমতো টের পাওয়া যায়, বর্তমান সময়ের ‘কিছু’ বাংলা সিনেমার দিকে তাকালে। যুক্তি আছে তো সত্যতা নেই, সত্যতা আছে তো সেখানে অনুভবের নেই কোন খাবার। কাহিনীগুলোর এতো পুনরাবৃত্তি হয়েছে যে, যে কোন অংশ দেখলে এর পূর্বের বা পরের ঘটনা বলে দেওয়া যায়। না আছে আবেগ, না আছে সংগতি, না আছে বাস্তবতা। হাতেগুণা কয়েকটি দৃষ্টান্ত ছাড়া, বাংলা ভাষার পুরাতন ছবিগুলোই যেন আমাদেরকে সিনেমাশিল্পটিকে ধরে রেখেছে এখনও।
অন্যদিকে আজকালের বিজ্ঞাপনগুলোর দিকে তাকালে উপরোক্ত উপাদানগুলোর সংমিশ্রণ পাওয়া যায়। বাংলাদেশের তাঁতশিল্পকে তুলে ধরে একটি মোবাইল ফোন কোম্পানির বিজ্ঞাপনটি এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। বেশকিছু বিজ্ঞাপন দর্শকের অনুভবকে জাগিয়ে তোলে। তবে অধিকাংশ বিজ্ঞাপনেই আবেগ আছে, যুক্তিও আছে, কিন্তু সত্যতা প্রায়ই খুঁজে পাওয়া না। ফলে শ্রোতা-দর্শক তাতে আকৃষ্ট হয় না।
আবেগের কাছে যুক্তি অচল। আমার তাই মাঝেমাঝে মনে হয়, আবেগ বা Pathosই বেশি আকর্ষণ করে পাঠক বা শ্রোতার মনকে। অবশ্য কোনটির গুরুত্বই ছোট করা যায় না, তবু মনে হয়, অনুভবে সাড়া জাগাতে না পারলে একটি লেখা পুরোপুরি আকর্ষণহীন হয়ে পড়ে। সিলভেস্টার স্ট্যালনের অসম্ভব ক্ষমতাকেও মেনে নিতে আপত্তি নেই, যদি সেটা দর্শকের অনুভবকে জাগিয়ে দিতে পারে।
তিন) একটি কেইস স্টোরি তুলে ধরছি, আমার সঙ্গীটি সিনেমায় মারামারি কাটাকাটি একদম সহ্য করতে পারেন না। তাই মারামারির দৃশ্যগুলো আমার একারই সামাল দিতে হয়! বাস্তবত, আমি নিজেও ওসব পছন্দ করি না, কিন্তু হিরোকে ঘুষি দিয়ে রক্ত বের করে ফেলবে সেটা তো মেনে নিতে পারি না! অথবা ধরুন, হিরোইনের শ্লীলতাহানির চেষ্টা করা হলো, তখন ইচ্ছে হয় নিজেও গিয়ে একটি ঘুষি লাগিয়ে দিই। কিন্তু আমার স্ত্রী ঠিক প্রতিশোধ গ্রহণের সময়টিতে থাকেন অনুপস্থিত। বলুন, কেমন লাগে! তখনই তো উচিত দু’জন একসাথে থাকার।
কিন্তু একবার হলো কি, এক ধুরন্দর ভিলেনের পাল্লায় পড়লাম। সিনেমার নাম বা হিরোর নাম বিবেচনায় না এনে শুধু প্রাসঙ্গিক অংশটুকু বলছি। সাপ্তাহিক ছুটির পূর্বের রাত হওয়ার সুবাদে দু’জনই টিভি সেটের সামনে বসার সুযোগ পেলাম। একজন সৎ ও চৌকশ পুলিস অফিসার ইতিমধ্যেই তার সততা ও সাহস দিয়ে আমাদের মন কেড়ে নিয়েছেন। প্রথম দিকেই একজন প্রভাবশালী ক্রিমিনালকে প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি থানায় হাজির হয়ে মুচলেকা দিতে বাধ্য করেছেন। সে একজন চোরাকারবারী এবং সমাজের সকল অপরাধের পৃষ্ঠপোষক আর সকল চোর-ডাকাত-দুর্বৃ্ত্তের গুরু। যেমন খারাপ তেমনই ভয়ংকর, কিন্ত্র প্রকাশ্যে সমাজসেবক। অন্য কোন পুলিস হলে হয়তো, তাকে ডাকারই সাহস পেতো না। কিন্তু থানায় আসতে বাধ্য করায় সেই সমাজপতিরূপী সন্ত্রাস-নেতাটি দারুণ অপমানিত হয়। প্রতিশোধ পরায়ন হয়ে সে তার নেতা, অর্থাৎ দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে দিয়ে সেই পুলিস অফিসারকে স্থানান্তর করিয়ে নিজ এলাকায় নিয়ে আসে। শহরে নতুন কর্মস্থলে এসে অফিসারটি প্রমাদ গুণে। সন্ত্রাস-নেতাটি ইতিমধ্যেই একটি টেলিফোন কলে ‘ওয়েলকাম টু ….’ জানিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে, এবার যাবে কোথায়! বিভিন্ন উপায়ে তারে চেলারা তাকে উত্যুক্ত করতে থাকে এবং মানসিকভাবে চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। ফাইল ঘেটে জানতে পারেন যে, এই থানার পূর্বের অফিসারটি এলাকার প্রধান সন্ত্রাসীর নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে নিজেরই রিভলবারে আত্মহত্যা করে। বিষয়টি তাকে আতংকিত করে তোলে। সাথে দর্শক হিসেবে আমরা ভয় পেয়ে যাই এবং হিরোর প্রতি আমাদের সহানুভূতি আরও বেড়ে যায়। সিনেমার ভিলেনের প্রতি আমাদেরও ঘৃণা বাড়তে থাকে। এসবের মধ্যেও পূর্বের অফিসারের হত্যাকারীদেরকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোটাকে প্রধান কাজ মনে হলো তার। কিন্তু কাজটি যে কত কঠিন তা তার সিনিয়র কর্মকর্তা ডিএসপি সাহেব এবং মন্ত্রী মহোদয় বুঝিয়ে দিয়েছে। তারাও একই পালের গরু হওয়ায়, পুলিস অফিসারকে সাবধান করে দিয়েছে, এসব নাজাই কাজে সময় নষ্ট না করে তিনি যেন রুটিন কাজে মনোনিবেশ করেন। এতে আইন-শৃঙ্ক্ষলা নিয়ন্ত্রণে পুলিস বিভাগের ক্ষমতা যে কত সীমিত, সেটি করুণভাবে ফুটে ওঠে – এই সাথে ফুটে ওঠে সৎ ও সাহসী পুলিস অফিসারটির অসহায়ত্ব। দর্শকের মন করুণাবিষ্ট হয়।
এরই মধ্যে পুলিস বিভাগের আয়োজিত একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ‘পুলিসের অধিকার ও ক্ষমতা’ বিষয়ক জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়ে সেই পুলিস অফিসার সকলের দৃষ্টি করেন। তার প্রতিটি কথায় ছিলো যুক্তি, প্রমাণ এবং আবেগের প্রাবল্য। সেখানে পুলিসের সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাও উপস্থিত ছিলেন। একজন পুলিসের আত্মহত্যার বিষয়টি জেনে তিনিও আবেগাক্রান্ত হলেন। ওটি ছিলো মূলত একটি হত্যাকাণ্ড। ওই অনুষ্ঠানে সকলেই একমত হলেন যে, সকলে মিলে সহকর্মী হত্যাকারীর বিচার নিশ্চিত করবেন। বাকি ঘটনা সকলেই অনুমান করতে পারেন। মজার ব্যাপারটি হলো, এর পর যতগুলো মারামারির ঘটনা ঘটেছিলো, আমার সঙ্গীটি আমাকে ত্যাগ করেন নি, বরং আমার চেয়েও বেশি আগ্রহ ও সমর্থন নিয়ে ‘প্রতিশোধ গ্রহণের’ দৃশ্যগুলো দেখে যাচ্ছিলেন।
চার) কীভাবে পেইতোস/ আবেগের প্রয়োগ ঘটানো যায়, সেটি একটি গবেষণার বিষয়। এর কোন সুনির্দিষ্ট নীতিমালা আজও প্রতিষ্ঠিত হয় নি। আবেগের ব্যবহার অতিমাত্রায় করলে সেটি যেমন যৌক্তিকতাকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দেয়, কম করলেও আকর্ষণ হারায়। তাই লেখককে খেয়াল রাখতে হয়, আবেগ যেন লেখার প্রধান বিষয় না হয়। একে লেখার বাহন হিসেবে ব্যবহার করা যায় – গন্তব্য হিসেবে নয়। একটি ‘সত্যকে’ প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ‘আবেগকে’ ব্যবহার করা যায়। অথবা একটি ‘যুক্তিকে’ তুলে ধরার জন্য আবেগের আশ্রয় নেওয়া যায়।
*আবেগ তৈরি করতে হলে নিজের আবেগ এবং নিজের মূল্যবোধ দিয়ে সেটি আগে উপলব্ধি করতে হয়। একই সাথে পাঠকের অবস্থানটিকেও পরিমাপ করতে হয়।
“আজ দুঃখ-ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। … … আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়। কি অন্যায় করেছিলাম?...”
বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যের শুরু থেকেই বুঝা যায় তিনি কীভাবে বিষাদাক্রান্ত হয়েছেন। একই সাথে তিনি বুঝেছিলেন, তারা শ্রোতা কারা এবং তারা কী প্রত্যাশা নিয়ে সামনে বসে আছে। তার আবেগ তিনি অতি দ্রুতি সংক্রমিত করতে পেরেছিলেন লক্ষ দর্শকের মনে। বক্তৃতার প্রথম অংশটি আমার কাছে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় মনে হয়।
*একই শব্দ একই উচ্চারণ, শুধু আবেগের প্রকাশ থাকলে, কীভাবে সেটি কোটি মানুষকে প্রভাবিত করে, এর জ্বলন্ত উদাহরণ হলো মার্টিন লুথার কিং-এর ঐতিহাসিক ‘আমি স্বপ্ন দেখি’ ভাষণটি।
“আমি স্বপ্ন দেখি যে, আমার চারটি শিশু একদিন এমন জাতির মধ্যে বাস করবে, যেখানে গায়ের রঙ দিয়ে নয়, চারিত্রিক গুণাবলী দিয়েই তাদেরকে মূল্যায়ন করা হবে । আমি স্বপ্ন দেখি। … সেদিন বেশি দূরে নয়।” শত বছর পরে হলেও তার সে স্বপ্ন পূরণ হয়েছিলো। এর প্রধান কারণ, তিনি তার আবেগ-নির্ভর যুক্তি দিয়ে শ্বেত ও কৃষ্ণ সকলকেই প্রভাবিত করতে পেরেছিলেন।
*সুকান্তের ‘মহাকাব্য’ কবিতায় যে আবেগ মিশিয়েছেন, তার আবেশ যুগের পর যুগ ফুরিয়ে গেলেও শেষ হবে না। এখানে আছে আবেগ, যৌক্তিকতা এবং সত্যের এক অনুপম মিশ্রণ। কবিতার কথাগুলো আজ প্রবাদ হয়ে আছে:
“হে-মহাজীবন, আর এ কাব্য নয়
এবার কঠিন, কঠোর গদ্যে আনো,
পদ-লালিত্য-ঝঙ্কার মুছে যাক
গদ্যের কড়া হাতুড়িকে আজ হানো!
প্রয়োজন নেই, কবিতার স্নিগ্ধতা—
কবিতা তোমায় দিলাম আজকে ছুটি,
ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়:
পূর্ণিমা-চাঁদ যেন ঝল্সানো রুটি॥”
দুঃখবোধ, হতাশাবোধ, হারানোর বেদনা, রসবোধ, প্রাপ্তি, স্বদেশপ্রেম, ঘৃণাবোধ, শ্রদ্ধা বা অপমান, ইতিবাচক বা নেতিবাচক – প্রতিটি উপলব্ধই পাঠকের মনে ‘পেইতোস’ সৃষ্টি করতে পারে।
পাঁচ) সমালোচনা: “জল পড়ে পাতা নড়ে” অথবা “গাছে কাঠাঁল গোঁফে তেল” অথবা “রাতে মশা দিনে মাছি – এই নিয়ে কলকাতায় আছি” কথাগুলোতে উপরোক্ত তিনটি উপাদান ছাড়াও রয়েছে আরেকটি বিষয়। তা হলো, ভাষার ব্যবহার বা শব্দচয়নের মুন্সিয়ানা। বাংলা অথবা উপমহাদেশীয় সাহিত্যের অনুপম বৈশিষ্ট্যটি এখানেই নিহিত। বাংলা ভাষার গদ্য, কবিতা বা উপন্যাসে ‘ভাষা ও ভাবের ছন্দ’ সৃষ্টি করেছে একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য। তথ্য, সত্য, অনুভব এবং ভাষার সম্মিলনে যে বক্তব্য প্রকাশিত হয়, তা কবিতা হোক আর প্রবন্ধ হোক, সেটি উত্তম সাহিত্যে স্থান পেতে বাধ্য!
বিষাদের একটি খণ্ডিত প্রকাশ হলো ‘বিরহ’।
মীরা দেব বর্মন তার গানে লিখেছেন “বিচ্ছেদ হবে এত মধুর জানিতাম না আগেতে … বিরহ বড় ভাল লাগে।” এটি পরে শচীন দেব বর্মনের বিখ্যাত গানে রূপান্তরিত হয়। বাঙালি প্রেমের গল্পে তাই বিরহ থাকেই। বিরহ যেন প্রেমের ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ প্রাপ্তি। বিরহ ছাড়া প্রেমের সাহিত্য অপূর্ণ। লাইলি-মজনু, রোমিও-জুলিয়েট, ক্লিওপেটরা-এনতনি, শিরি-ফরহাদ, এসব প্রেমোপাখ্যান আমাদের কাছে আজও জীবন্ত হয়ে আছে শুধু ‘বিরহের’ কারণে। দেশ ভাষা এবং সময়কে অতিক্রম করে গল্পগুলো আজ কিংবদন্তী।
“আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, আবেগ আমাদের জীবনের প্রধান পরিচালক, উপলব্ধি না করেই আমরা আবেগের আনুগত্য করি।” বলেছেন ডাচ চিত্রশিল্পী ভিনসেন্ট ভেনগগ। আমরা কখন কীভাবে আবেগতাড়িত হই, তা জানি না। কিন্তু জানি কীভাবে আবেগতাড়িত করতে হয়। সেটি এক বিরাট প্রাপ্তি। শেইকসপিয়র অথবা নজরুলের মতো এই প্রাপ্তিকে সকলেই লেখায় বা কথামালায় প্রয়োগ করতে পারেন না। এটি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা দ্বারা আসে না। আসে নিবিড় পর্যবেক্ষণ এবং গভীর জীবন বোধ থেকে। তাই যারা পারেন, তারা হয় প্রাকৃতিকভাবেই পেয়েছেন, নয়তো জীবনকে অনেক গভীর থেকে দেখেছেন।
‘পেইতোস’ বিষয়টিতে কেবলই পাঠক হিসেবে ‘খণ্ডিত পর্যবেক্ষণ’ তুলে ধরার চেষ্টা করলাম। ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণে যতটুকু বুঝেছি বা পেয়েছি, ততটুকুই লিপিবদ্ধ করে রাখলাম। ‘বিষাদ’ নিয়ে আরও ‘তথ্য এবং দৃষ্টান্তের’ অনুসন্ধান করছি। লেখাটি যদি কারও সাহিত্যচেতনাকে একটু নাড়া দিতে পারে, তবে মন্তব্যের মাধ্যমে অংশ নেবার অনুরোধ জানাই। বলা বাহুল্য, এটি একটি অসম্পূর্ণ লেখা।
‘লেখালেখি’ নিয়ে অন্যান্য পোস্টগুলো:
১) ভালো লেখার ৩টি গোপন রহস্য
২) নোবেল বিজয়ী মো ইয়ানের লেখার স্টাইল
৩) কী লিখবো, কেন লিখবো
৪) হোমার যেভাবে হেলেনের ‘রূপ’ বর্ণনা করলেন...
৫) ব্লগ লেখার ভুলগুলো
৬) কবিতা তোমায় দিলাম পুরাই ছুটি
-----------------------------------------------------------------------
পরিশিষ্ট:
১) Ethos, Pathos এবং Logos সাহিত্য সৃষ্টি বা মৌলিক লেখার প্রধান স্তম্ভ। গল্প, কবিতা, উপন্যাস বা মহাকাব্য যা-ই হোক, তা পাঠকের নীতিবোধ, আবেগ এবং ভালো-মন্দ যাচাইয়ের ক্ষমতাকে আঘাত করতে হবে। ইতোস, পেইতোস, লউগোস।
২) Ethos/ নীতি: লেখায় প্রকাশিত নীতি, অর্থাৎ পাঠকের নীতিবোধকে আহত বা জাগ্রত করার উপাদান।
৩) Pathos/ বিষাদ: বিষাদ, দুঃখ, আবেগ, হর্ষ অর্থাৎ পাঠকের অনুভবকে স্পর্শ বা আহত করতে পারার উপাদান।
৪) Logos /যুক্তি: যৌক্তিকতা বা বিচারবুদ্ধির প্রয়োগ, অর্থাৎ পাঠকের যৌক্তিকতা-বোধকে আহত বা জাগ্রত করার উপাদান।
৫) বিভিন্ন মাধ্যম থেকে লেখকের ব্যক্তিগত অনুসন্ধান থেকে লেখাটি প্রস্তুত হয়েছে। এরিস্টটল’স রেটরিক এবং হোমারের দি ইলিয়াড পড়ার স্মৃতি থেকে হাতড়ে বের করেছি ‘বিষাদ’।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জানুয়ারি, ২০১৪ রাত ১০:৩৫