হরতাল আর অবরোধের দিনেও বিশাল লম্বা লাইন। এতো মানুষ ভারতে গিয়ে কী করবে? কেউ বলে ফরম নেওয়া শুরু করেছে, কেউ বলে, এখনও দেরি আছে। অথচ ঘড়িতে প্রায় দশটা! একজন মহিলা এসে দালালি করার সুযোগ চাচ্ছিলেন বার বার। “আসুন আমার সাথে, একদম প্রথমে জমা পড়বে আপনার আবেদন।” অন্যান্য কর্মসংস্থানের মতো দালালিতেও নারীদের অংশগ্রহণ দেখে উৎসাহিত হবো নাকি হতাশ হবো, ভাবছি। আমি প্রথমে না শুনার ভান করলাম। অফিস থেকে এসেছি – একটু তাড়া তো ছিলোই। তবু মনের সাথে যুদ্ধ করে অন্য সকল প্রার্থীদের মতো দাঁড়িয়ে থাকলাম লাইনে। খুব ‘সিরিয়াস প্রার্থী’ হলে হয়তো তাই করতাম। আধা ঘণ্টার পার না হতেই আমার পেছনে অনেক দীর্ঘ লাইনের সৃষ্টি হলো। হঠাৎ একজন হিন্দু বৃদ্ধ এসে আমার সামনে দাঁড়ালেন। “বাবা, আপনার সাথে আমাকে নিন। বুড়ো মানুষ বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারি না।” একবার পেছনে তাকিয়ে অন্যদের প্রতিক্রিয়া দেখে নিলাম। অতএব শান্ত হয়ে মেনে নিলাম প্রাচীনকে।
এশিয়ার অনেক দেশ ঘুরেছি অথচ কলকাতাকে দেখা হয় নি আজও। অবিভক্ত বাংলার প্রাচীন শহর কলকাতাকে দেখার সখ সেই ছোট কাল থেকে। ছেচল্লিশ, সাতচল্লিশ আর একাত্তরের বাংলাদেশের সাথে কত গভীরভাবে জড়িয়ে আছে স্মৃতির শহর কলকাতা! বিগত দশকগুলোতে সুনীল বাবুর ‘পূর্ব-পশ্চিম’, এম আর আখতার মুকুলের ‘আমি বিজয় দেখেছি’ এবং ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদের Era of Sheikh Mujibur Rahman পড়ার পর কলকাতাকে দেখার জন্য অস্থির হয়ে ছিলাম। একসময় চিটাগং যাবার মতোই কলকাতায় যেতো এদেশের মানুষ। চিকিৎসা, বিয়ের বাজার বা শিক্ষার জন্য দক্ষিণবঙ্গের মানুষগুলো তো ঢাকায় না এসে কলকাতায় যাওয়াকেই সহজ মনে করতো। ‘হাত মে বিড়ি মু মে পান- লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ করতে করতে আমরাই এক সময় পাকিস্তানকে নিয়ে আসি। বাঙালি মুসলমানের সমর্থন না থাকলে পাকিস্তান হতে পারতো না। সে পাকিস্তান খরগ হয়ে আমাদের ওপরে চড়ে বসলো। আবার সেই আমরাই ‘জয় বাংলা’ বলে স্বাধীন করলাম বাংলাকে – পেলাম একান্ত নিজের বাংলাদেশকে। এতো দীর্ঘ ইতিহাস দু’বাক্যে বলে শেষ করা যায় না।
নাহ্ ভেবেছিলাম লাইন শেষ হলেই বুঝি ‘তাদের’ দেখা পাবো। প্রবেশ মুখেই সিকিউরিটি ডোর: সেটি পার হবার পর দেওয়া হলো ৫৯৯ নম্বর সিরিয়াল নম্বর। ভেতরের কক্ষে আমার মতো সিরিয়াল নম্বর নিয়ে অনেককে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে দেখলাম। অনিশ্চয়তা কমলো না। সাড়ে ন’টায় যদি আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হলো, তবে এতো মানুষের ভীড় কেন? সকলেই কি সাড়ে ন’টার প্রার্থী? নাহ্, তা তো হবার কথা নয়। খুঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, যার এপয়েন্টমেন্ট বারোটায় তিনিও সকালেই এসে উপস্থিত। ফেলানী রোডের কতৃপক্ষ কাউকেই নাখোশ করছেন না। তবে বসিয়ে রেখেছেন অনিশ্চিত অপেক্ষায়।
প্রায় আধাঘণ্টা অপেক্ষার পর আমার নম্বর ডাকা হলো। ভেবেছিলাম, এবার বুঝি পাবো ‘তাহার’ দেখা; মানে, যারা আমার কাগজপত্র গ্রহণ করে ভিসা দেবার প্রতিশ্রুতি দেবেন। কিন্তু এবারও হবে না। যুক্ত হলো আরেকটি সিরিয়াল ১৪২ নম্বর। স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রে আদিষ্ট হয়ে তৃতীয় তলায় গিয়ে দেখি, এলাহী কাণ্ড। এতো মানুষ কখন এসেছে? আরেকটি আবদ্ধ কক্ষ। শীতের দিনের গরমে কারও অনুকম্পা পাওয়া যায় না। এসি তো বন্ধই, ফ্যানও বন্ধ! উঁচু সিলিং ও দরজায় ভিনদেশী কারুকার্য। মানুষগুলোর ভাষা ও বসনে ‘ভারত-ভারত’ ভাব! ভিসা-প্রার্থীদের প্রস্তুতি ও আবেদনপত্রের সাথে সংযুক্ত কাগজপত্রের বহর দেখে আমি ভড়কে গেলাম। কেউ কেউ বগলেও একটি ফাইল নিয়ে এসেছেন, যেন ভারত যাওয়াই জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য। অথচ আমি যে মাসখানেক আগে আবেদন করেছিলাম সেটিই প্রায় ভুলে গিয়েছিলাম! গরম আর অনিশ্চয়তায় সবকিছু ঝাপসা লাগছে।
আরও প্রায় এক ঘণ্টা বসে থাকার পর আমার ডাক আসলো। সব কাগজের মধ্যে বিদ্যুতের বিলই হলো তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণপত্র। ঠিকানা নিশ্চিত না হয়ে ভিসার আবেদন গ্রহণ করবে না। যা হোক, সব দাবি মেটানোর পর গৃহীত হলো আমার আবেদন ও পাসপোর্ট। খুব সম্ভব সামনের সপ্তাহের শুরুতেই পেয়ে যাবো কলকাতা যাবার ছাড়পত্র। ফেলানীসহ অগণিত সীমান্ত হত্যার দায়ে অভিযুক্ত ভারতকে হয়তো কখনও ক্ষমা করতে পারবো না। তবু ‘পরদেশে আত্মীয়ের’ মতো কলকাতাকে একবার দেখে আসতে চাই। চোখের দেখা! কলকাতায় ‘থাকা ও ভ্রমণ’ সম্পর্কে অভিজ্ঞ সহব্লগারদের পরামর্শ চাই।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে নভেম্বর, ২০১৩ বিকাল ৫:০৮