এবিষয়ে প্রচলিত ইংরেজি প্রবাদটির মানে করলে এরকম দাঁড়ায়: প্রথম চমক দেবার দ্বিতীয় সুযোগটি পাবেন না। ফার্স্ট ইম্প্রেশন কীভাবে ভালো করা যায় এবিষয়ে টিপস ও পরামর্শের অভাব নেই বাজারে। যে কেউ চাইলেই পাবেন আর উপদেশের সাগরে ভাসতে পারবেন; কূল খুঁজে পাবেন না। হঠাৎ একটি বিষয়ে নানামুখী নসিহত পেয়ে মানসিক চাপ বেড়ে যায়। শেষে নিজের যতটুকু ছিলো তা-ও হারাতে হয়। টিপস গ্রহণ করার ব্যাপারে প্রথম টিপস হলো: সবই গলাধকরণ না করা। সবকিছু সবার জন্য সবসময় প্রযোজ্য হয় না। তবে পড়ার জন্য পড়া যায় - রিডিং ফর প্লেজার! কোন ডেডলাইন সামনে নিয়ে পরামর্শ নেওয়া আর পরীক্ষার পূর্বে ভোর রাত পর্যন্ত পড়া একই কথা।
কর্মজীবনের শুরুর দিনগুলো ভালোভাবে অতিক্রম করতে পারলে, এবং প্রথম চাকরিতে সুনাম অর্জন করতে পারলে - তা পরবর্তিতে মজবুত ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। অনেকে ইনটার্ন বা শিক্ষানবীশ বা স্বেচ্ছাসেবকের কাজকে অবহেলায় শেষ করেন। সেটিও প্রথম চাকরি হিসেবে ধরলে, তা থেকে পরে অনেক সুফল পাওয়া যায়। বলছি শুরুর দিনগুলোর কথা:
• ভালো দিয়েই হোক শুরু:
অলৌকিক বা অস্বাভাবিক কিছু না ঘটলে, শুরুর দিনেই কোন প্রতিষ্ঠানে সুপারম্যান হিসেবে আবির্ভূত হওয়া কঠিন। নিজের মতো থাকাটাই বেশি দরকার! তবে কিছু বিষয়ে বিশেষ ফোকাস দিলে, অপেক্ষাকৃত অল্প সময়ে প্রারম্ভিক অস্বস্তিগুলো কাটিয়ে ওঠা যায়। প্রথম দিনের স্কুলের মতো প্রথম দিনের উত্তেজনা সবকিছুতেই থাকে – কর্মস্থলে একটু বেশি থাকে। তাই দেহ মন এবং আপনার আউটলুককে ভালো মতো প্রস্তুত করে নিন। রাতের বিশ্রাম, সকালের নাস্তা, পরিপাটি পোশাক – এসব হলো অতি ব্যক্তিগত প্রস্তুতি যা স্বাভাবিকভাবেই সকলে করে। পোশাকের ক্ষেত্রে শালীনতার পাশাপাশি আপনার আরাম ও স্বস্তির বিষয়টিকে উপেক্ষা করবেন না। পরিচয়ের সময়ে স্বাভাবিক থাকুন এবং পরিবেশ অনুকূল হলে নিজেই উদ্যোগী হয়ে ডেস্ক-টু-ডেস্ক গিয়ে করমর্দন করুন দৃঢ়তার সাথে। কণ্ঠে বিনয় থাকুক, তবে আত্মবিশ্বাসকে যেন হারিয়ে না ফেলেন।
• নোট নিন:
হয়তো শুধু রাশেদ নামেই অন্তত ৩জনের সাথে পরিচয় হবে। কেউবা হবেন আপনার ক্লাসমেটের বন্ধুর বড়ভাই বা বড় বোন। কেউ হতে পারেন আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় ভাই। প্রথম দিনের মিটিংয়ে চোখ ছাড়াবড়া হতে পারে। হাতে পাবেন একগাদা নিয়মাবলী আর পলিসিপত্র। একদিনের তুলনায় অনেক তথ্য আপনার ওপর ওইদিন ঝাঁপিয়ে পড়লেও সকল তথ্যেরই ভবিষ্যত মূল্য আছে। তাই নোট রাখুন, দেখবেন পরে নিজেকে এজন্য বাহ-বাহ দেবেন। এ অভ্যাসটি পরেও ধরে রাখতে পারেন।
• নম্র ভদ্র পরিপাটি ও সময়নিষ্ঠ:
নম্রতা-ভদ্রতা-নিয়মনিষ্ঠতাই কর্মজীবনের চাবিকাঠি নয়, তবু এসব যাদের থাকে, তারা একটু একস্ট্রা লিভারেজ পেয়ে থাকেন। অফিসে সময়মতো আসাকে অভ্যাসে পরিণত করুন কর্মজীবনের শুরুতেই। সম্ভব হলে পনের-বিশ মিনিট হাতে রাখুন, কিন্তু দেরিতে আসাকে শুরু থেকেই এড়িয়ে চলুন, তাতে সকালের অস্বস্তি থেকে অন্তত আপনি রক্ষা পাবেন। কাজে ভুল হলে বা দেরি হলে, এবং তাতে আপনার সিনিয়র বিরক্ত হলে, শুরুতেই কারণ দাখিল করবেন না। আগে তাকে বলতে দিন। কাজে ও আচরণে নিজেকে পছন্দনীয় করে তুলুন সিনিয়র-জুনিয়র-পিয়ার সকলের কাছে।
• বুঝে নিন বাতাস কোন্ দিকে বয়:
কল্পিত পূর্বধারণা নিয়ে বর্তমান কর্মস্থলকে বিচার করা যায় না। প্রথম দিনেই সহকর্মীদের আড্ডায় হট্টহাসিতে মেতে ওঠবেন না, আরও দেখুন। প্রতিষ্ঠানের স্বভাব এবং পলিসি জানতে সময় লাগে। তেমনি সময় লাগে সহকর্মীকে সঠিকভাবে বুঝার জন্য। এজন্য পর্যাপ্ত ধারণা না নিয়ে কোন বৃহৎ বিষয়ে মতামত বা প্রতিক্রিয়া প্রকাশ না করা হবে উত্তম। জেনে নিন প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য ও কাজের ধারা এবং অফিসে কাদের প্রভাব বেশি। শুরুতে অনেকেই একটু স্মার্টনেস দেখানোর সুযোগ নেবে, কিন্তু নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। গসিপিং বা সমালোচনামূলক আড্ডায় কোন কনট্রিবিউশন না করাই হবে বিচক্ষণ পেশাদারের কাজ। কৌশলে এড়িয়ে চলুন – সম্ভব না হলে বিষয় পরিবর্তন করুন।
• নিজেকে মেলে ধরুন:
শিক্ষা জীবনের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি তো হয়ে গেলো, এবার সময় নিজেকে গড়ে তোলা। তাই শিক্ষা জীবনের উচ্ছ্বাস বা হতাশার বিষয়গুলো যেন আপনাকে আর পিছু না টানে। বেতন এবং পদবির ব্যাপারে যদি আর কিছুই করার না থাকে, তবে ওসব বিষয় যেন আপনার কর্মস্পৃহায় আর বাধা না সৃষ্টি করে। এবার সময় নিজেকে মেলে ধরার। কাজের মধ্য দিয়ে নিজেকে আবিষ্কার করতে চাইলে, কাজেই নিজেকে শতভাগ নিয়োজিত করুন। মিটিং বা প্রেজেন্টেশনে যথাযথ পূর্ব প্রস্তুতি নিন – স্টাডি করুন প্রতিষ্ঠানের সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে। হিনমন্যতাকে জয় করে নিজের মতামত বিনয়ের সাথে তুলে ধরুন, যখনই সুযোগ আসে। আপনি যে প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে ভাবছেন, তা কর্তৃপক্ষকে বুঝতে দিন। আপনাকে তুলে ধরার দায়িত্ব আর কেউ নেবে না – এই ‘গিয়ানের কথাটি’ মনে রাখুন।
• সম্পর্ক গড়ুন, শতভাগ না মিললেও:
ব্যক্তিগতভাবে কাওকে পছন্দ না হতেই পারে। কিন্তু এসবকে ভিত্তি করে তাদের সাথে ‘কাজের সম্পর্ক’ যেন বিনষ্ট না হয় খেয়াল রাখতে হবে। যদিও কর্মস্থলে খুব বেশি ঘনিষ্ট হওয়াকে অনেকেই সমর্থন করেন না, কিন্তু পৃথিবীর সব আরাধ্য বিষয় তাদের কাছেই চলে আসে, যারা সম্পর্ক গড়তে এবং ধরে রাখতে পারেন। চাটুকারিতা এবং নেকামি এড়িয়ে সততা এবং আস্থার সম্পর্ক গড়ে তুলুন – ঘনিষ্ট না হলেও সেটি কাজে আসবে।
• শ্রম দিন, চ্যালেন্জ নিন:
কর্মজীবির জন্য কাজই জীবন। কাজের সাথে গভীর সম্পর্ক গড়ে তুলুন। সবসময় প্রত্যাশার চেয়ে একটু বেশিকিছু করার প্রচেষ্টা আপনার কাজে উৎকর্ষতা এনে দেবে। অন্যকে সহযোগিতা দিতে পারা একটি মূল্যবান যোগ্যতা। যারা বেশি শ্রম দিতে জানে, তারা নিজের কাজ শেষে অন্যকে সাহায্য করারও সময় পায়। আপনি কাজ এবং চ্যালেন্জ নিতে পছন্দ করেন, এরকম ধারণা প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে, আপনার কর্মস্থল হবে হাওয়াও ওড়ে বেড়ানোর মতো সহজ।
• কতৃপক্ষকে স্বস্তিতে রাখুন:
পেশাদারিত্বের এযুগে বিষয়টিকে নেতিবাচকভাবে দেখার সুযোগ নেই। আপনার জৈষ্ঠ্য সহকর্মী অবশ্যই কিছু বিষয়ে আপনার চেয়ে বেশি জানেন। সবচেয়ে বড় কথা হলো, তিনি আপনার বিষয়ে প্রতিবেদন করেন এবং কর্তৃপক্ষ আপনার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষেত্রে তার কথায় প্রথমে গুরুত্ব দেবে। তাছাড়া, তার কাজকে সহজতর করার জন্যই আপনার পদটি সৃষ্ট হয়ে থাকতে পারে। তাই চেষ্টা করতে হবে, কীভাবে নিজের নিয়মিত কাজের পাশাপাশি সিনিয়র বসের কাজকে সহজতর এবং আরামপ্রদ করে দেওয়া যায়। তাতে আপনার সিনিয়র আপনার কাজের ধরণ সম্পর্কে অবগত থাকবেন। তাছাড়া, এর মধ্য দিয়ে আপনি হয়তো, তার কাজের পদ্ধতি এবং প্রকার জেনে নিয়ে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত হতে পারেন। তাই শুরুতেই এবিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দিলে নিঃসন্দেহে এতে উপকার আছে।
• দ্বিধা ছাড়ুন; নিজের উপলব্ধি প্রকাশ করুন, কিন্তু সমালোচনার দরজাও খুলে রাখুন:
কিছু না বুঝলে প্রশ্ন করতে দ্বিধা করবেন না। তাছাড়া, প্রথম দিনগুলোতে অনেক অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করার ‘লেজিটিমেট’ সুযোগ আপনার থাকবেই! উপযুক্ত চ্যানেলের মাধ্যমে নিজের উপলব্ধিকে সততা ও আত্মবিশ্বাসের সাথে প্রকাশ করুন। হয়তো সবসময় সঠিক হবে না, কিন্তু অন্তত নিজেকে যাচাইয়ের সুযোগ পাবেন। কাজ করলে ভুল হবে, তাতে সমালোচনাও হবে। সমালোচনাটি সঠিক বা প্রাসঙ্গিক না হলেও সেটি ইতিবাচক আচরণ দিয়ে গ্রহণ করুন। সময় এবং স্থানটি উপযুক্ত না হলে ডিফেন্স করার প্রয়োজন নেই – সময়ের অপেক্ষায় থাকুন।
কর্মক্ষেত্রে ভালো পারফরমেন্স করতে চায় না, এরকম মানুষ খুব কমই আছে। শুধু শুরুর দিনে নয়, ক্যারিয়ার ডিভেলপমেন্ট-এর জন্য সমস্ত কর্মজীবন জুড়েই একরকম প্রচেষ্টা থাকতে হয়। তবে শুরু ভালো হলে নিশ্চিতভাবেই পরবর্তী কর্মজীবনে এর প্রভাব গিয়ে পড়ে। (সমাপ্ত)
সূত্র: ১) ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, ২) ডেইলি স্টার সহ বিভিন্ন মাধ্যম।
[প্রাত্যাহিক জীবনের একটি বৃহৎ অংশ জুড়ে রয়েছে আমাদের অফিস লাইফ। তাই এ নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনার প্রয়োজন আছে। কর্মক্ষেত্রে অযোগ্যতা বা অনিয়মকে দুর্নীতির জননী বলা হয়। এর সাথে সফল শিক্ষাজীবনের সরাসরি কোন যোগসূত্র নেই: চরম মেধাবী শিক্ষার্থীটিও কর্মস্থলে গিয়ে ভিমরি খেতে পারে। কর্মজীবন বা কর্মস্থলের উন্নয়ন তথা পেশাদারিত্ব নিয়ে বাংলায় পর্যাপ্ত লেখালেখি হচ্ছে না। আমি অনুরোধ করবো কর্মজীবি সহব্লগারদেরকে, তাদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করার জন্য। সেটি মন্তব্য বা ‘আলাদা পোস্ট’ আকারেও আসতে পারে। তাতে নবাগত বা ভবিষ্যৎ পেশাদাররা উপকৃত হবেন আর উন্নত হবে আমাদের কর্মস্থল।]
============================================
**কর্মসংস্থান ও কর্মজীবন নিয়ে অন্যান্য পোস্টগুলো:
১)) বাজার বুঝে কর্মসংস্থান খোঁজা
২)) কর্মসংস্থানে আত্মশক্তির গুরুত্ব
৩)) কর্মজীবনে উন্নতির জন্য সোস্যাল নেকওয়ার্কিং
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই নভেম্বর, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:৫২