কী ভূমিকা দেবো বিদ্রোহী কবি নজরুলের? কী বৈশিষ্ট্য তাকে মানায়? নজরুলের পরিপূর্ণ ভূমিকা লেখার সাধ্য কার আছে, আমার জানা নেই। যদি বলি, বাংলা সাহিত্যে বিদেশি শব্দকে কোন্ লেখক ভৃত্যের মতো খাটিয়েছেন? যদি বলি, কোন্ কবির লেখা একাধারে ইসলাম এবং হিন্দু দু’টি ধর্মেই সমাদৃত? কোন্ কবি একাধারে সৈনিক, সুরকার, গীতিকার, কণ্ঠশিল্পী, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, নাট্যকার, অভিনেতা, প্লেব্যাক সিংগার এবং চলচ্চিত্রকার ছিলেন? ব্যক্তিগত সামাজিক এবং কর্মজীবনে বিচিত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী বাঙালি কবির নাম কী? মেহনতি আর বঞ্চিত মানুষের জন্য কবিতা লেখে বাঙালির হুইটম্যান হয়েছিলেন কোন্ কবি? এরকম অনেক প্রশ্নের উত্তরে একটিই আসে নাম, কাজী নজরুল ইসলাম। স্বভাবে তো তিনি বিদ্রোহী; ভাষার প্রয়োগেও নজরুল ছিলেন প্রথাবিরোধী, অনেকটা বিপ্লবী। নজরুল তার গান-কবিতা-গল্পে-প্রবন্ধে এমন সব শব্দরাজি ব্যবহার করেছেন, যা কেউ করেন নি আগে। বাংলা ভাষাকে বিদেশি শব্দ দিয়ে এতো সমৃদ্ধ কেউ করার সুযোগ পান নি, সাহসও পান নি।
নজরুলের জীবনী বা সাহিত্য জীবন নিয়ে অল্প কথায় বলে শেষ করা যাবে না। এ লেখাটি বস্তুত অসাম্প্রদায়িক নজরুলের চেতনাতে আলোকপাত করার জন্য।
জন্ম, ছেলেবেলা এবং লেখক নজরুল
ইংরেজি ১৮৯৯ সালের ২৪ মে এবং বাংলা ১৩০৬ সালের ১১ জ্যৈষ্ঠ তারিখে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোলের চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন নজরুল, যার ডাকনাম ছিলো দুখুমিয়া। পিতা কাজী ফরিদ আহমেদ ছিলেন মসজিদের ইমাম ও মাজারের খাদেম। ১৯০৮ সালের পিতার অকাল মৃত্যুর পর তাকেই পিতার ভূমিকায় গ্রহণ করে হতে হয় মাজারের খাদেম ও মসজিদের মোয়াজ্জিন। বয়স ১০ হতে না হতেই সংসারের দায়িত্ব নিতে হয় দুখুকে। কাজ করতে হয় রুটির দোকানে। গ্রামের মক্তবে শেষ হয় তার বাল্যশিক্ষা। ১৫ বছর বয়সে চাচার বাড়ি ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালে এসে স্কুলে ভর্তি হন। সেখানে লেখাপড়া ভালোমতো শেষ না হতেই ফিরে যান পশ্চিমবঙ্গে এবং বিভিন্ন বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েন।
প্রবেশিকা পরীক্ষার পূর্বেই নজরুল যোগ দেন সেনাবাহিনীতে। ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণ তূর্য’ – নজরুলের সাহিত্য সাধনা এবং বৈচিত্রময় কর্মজীবন সবসময়ই পাশাপাশি চলেছে। মূলত করাচি সেনানিবাসেই নজরুলের লেখক জীবনের সার্থক সূচনা ঘটে।
অসাম্প্রদায়িক নজরুল
শান্তি, সাম্য, অধিকার, স্বাধিকার –নজরুলের কাব্যিক চেতনার একেকটি হীরকখণ্ড। সাম্প্রদায়িকতা, কুসংস্কার আর কুপমণ্ডুকতা ছিলো তার চেতনার প্রতিপক্ষ। তিনি ছিলেন চেতনার কবি। তিনি যেমন মেনে নেন নি নারীর প্রতি অবিচার আর বৈষম্য, তেমনি মেনে নেন নি দুর্বলের প্রতি সবলের আধিপত্য।
বিভিন্ন লেখায় তিনি হিন্দু-মুসলিম বিভেদের অবসান চেয়েছেন এবং দু’টি সম্প্রদায়ের মধ্যে সামঞ্জস্যকারী বিষয়গুলো তুলে ধরেছেন গান ও কবিতায়। তিনি মুসলিমদের জন্য যেমন অসংখ্য হামদ নাত ও গজল লিখেছেন, তেমনি লিখেছেন হিন্দুদের জন্য অনেক গান ও কীর্ত্তন। একে অন্যের সাথে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি গড়ে তোলার জন্য তিনি অসংখ্য গান ও কবিতা রচনা করেছেন এবং তাতে ইচ্ছাকৃতভাবে সাম্প্রদায়িক শব্দাবলীর প্রয়োগও করেছেন।
“আমি হিন্দু-মুসলমানের মিলনে পরিপূর্ণ বিশ্বাসী। তাই তাদের কুসংস্কারে আঘাত হানার জন্যই মুসলমানী শব্দ ব্যবহার করি, হিন্দু দেব-দেবীর নাম নিই। অবশ্য এরজন্য অনেক জায়গায় আমার সৌন্দর্যের হানি হয়েছে। তবু আমি জেনে শুনেই তা করেছি।” (শব্দ ধানুকী নজরুল ইসলাম, শাহাবুদ্দিন আহমদ)
নজরুলের ‘ধূমকেতু’ আজও আমাদের চেতনাকে নাড়া দেয়। ধূমকেতু বের হতো সপ্তাহে দু’বার। মূল উদ্দেশ্য, স্বাধিকার আন্দোলনে সসস্ত্র বিপ্লবকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। ধূমকেতু’র বিশেষ একটি সংখ্যার জন্যই নজরুল কুমিল্লায় আটক এবং রাজবন্দী হয়ে কলকাতায় প্রেরিত হন। ‘রাজবন্দীর জবানবন্দি’তে নজরুল বলেন-
“… আমি কবি। আমি অপ্রকাশ সত্যকে প্রকাশ করার জন্য, অমূর্ত সৃষ্টিকে মূর্তিদানের জন্য ভগবান কর্তৃক প্রেরিত। কবির কণ্ঠে ভগবান সাড়া দেন, আমার বাণী সত্যের প্রকাশিকা ভগবানের বাণী। সে বাণী রাজবিচারে রাজদ্রোহী হতে পারে, কিন্তু ন্যায়বিচারে সে বাণী ন্যায়দ্রোহী নয়, সত্যাদ্রোহী নয়।”
‘সাম্যবাদি’ কাব্যগ্রন্থে কবি যা লিখেছেন, আজকের সুশীল সমাজ তাতে আঁতকে ওঠবেন। ‘সাম্যবাদি’, ‘মানুষ’ এবং ‘নারী’ কবিতায় নজরুল ধর্মীয় উগ্রতার বিপক্ষে মানবতার বাণী তুলে ধরেছেন। কাব্যিক খ্যাতির জন্য নয়, মানবতার জন্য তিনি লিখে গেছেন আমৃত্যু।
“গাহি সাম্যের গান-
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান।
যেখানে মিশেছে হিন্দু-মুসলিম-বুদ্ধ-খ্রিশ্চান।”
গাহি সাম্যের গান!
কে তুমি?- পার্সী? জৈন? ইহুদী? সাঁওতাল, ভীল, গারো?
কন্ফুসিয়াস্? চার্বআখ চেলা? ব’লে যাও, বলো আরো!” [সাম্যবাদি/ নজরুল]
নজরুলের সাম্যকে শুধুই সমাজতান্ত্রিকতা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। তিনি সামাজিক এবং সাম্প্রদায়িক সাম্যের জন্য লিখেছেন। শুধু মুসলিম বা শুধু হিন্দু নয়, সংস্কারাচ্ছন্ন সমাজকে জাগিয়ে তোলার জন্য তিনি সকলের কবি হয়ে ওঠেছিলেন। তিনি ছিলেন সত্যিকার অর্থে একজন রেনেসাঁ বা নবজাগরণের কবি।
চেতনায় নজরুল
“সবার হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ/ চেতনাতে নজরুল
যতোই আসুক বিঘ্ন বিপদ/ হাওয়া হোক প্রতিকূল।
এক হাতে বাজে অগ্নিবীণা/ কণ্ঠে গীতাঞ্জলী
হাজার সূর্য চোখের তারায়/ আমরা যে পথ চলি।”
(ভূপেন হাজারিকা কণ্ঠে আমার একটি প্রিয় গান)
পাকিস্তানি শাসনামলে নজরুল দু’টি কারণে গুটিয়ে ছিলেন বাংলাদেশে: প্রথমত তিনি বাকরুদ্ধ ছিলেন; দ্বিতীয়ত অসাম্প্রদায়িক লেখার কারণে শাসকগোষ্ঠীর অবমূল্যায়ন ও কাফের খেতাব। তবে স্বাধীন বাংলাদেশে পুরোদমে শুরু হয় নজরুল চর্চা। নজরুল সঙ্গীতে প্রশিক্ষণ, স্বরলিপি প্রকাশ এবং নজরুল সাহিত্যে গবেষণা পত্রিকা প্রকাশ পায়। তিনি হয়েছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সংগ্রামী চেতনার অন্যতম নেপথ্য শক্তি। নজরুলের গানগুলো চেতনা জাগিয়েছে মুক্তিসংগ্রামীদের। ‘কারার ঐ লৌহকপাট/ ভেঙ্গে ফেল কর রে লোপাট’ শুনলে বাঙালির গা শিউরে ওঠবে জন্ম জন্মান্তর। ‘চল চল চল’ আমাদের জাতীয় রণসংগীত। দেশের স্বাধীনতার নেপথ্য ধ্বনি, কাজী নজরুল আমাদের জাতীয় কবি, যিনি মূলত অবিভক্ত বাংলার সকলের কবি ছিলেন। বাংলাদেশ এবং ভারতের একাধিক রাস্তা ও এভিনিউ’র নামকরণ করা হয়েছে তার নামে। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নজরুল ইনিস্টিউট এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নজরুল বিষয়ে পড়ানো হচ্ছে। ময়মনসিংহের ত্রিশালে নজরুলের বিদ্যাপিঠ দড়িরামপুর হাইস্কুলের পার্শ্ববর্তী এলাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।
নজরুলের মৃত্যুতে বাংলাদেশ ও ভারত একসঙ্গে শোক প্রকাশ করে। মৃত্যুর পর বাংলাদেশে ছিলো দু’দিনের জাতীয় শোক দিবস আর ভারতের আইন সভার এক মিনিটের নিরবতা। সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে তার জানাজায় ১০ হাজারেরও বেশি লোক জমায়েত হয়।
নজরুলের মৃত্যু এবং রবীন্দ্রনাথ
রবীন্দ্রনাথের সাথে নজরুলের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ও তথ্য আছে যার সবই এখানে প্রাসঙ্গিক নয়। রবীন্দ্রনাথের জন্মের ৩৮ বছর পর পৃথিবীতে এসেছেন নজরুল (১৮৯৯-১৮৬১)।
দু’জনকে পরিপূর্ণ সমসাময়িকতায় যেমন আনা যায় না, তেমনি লেখক হিসেবে তাদের সামাজিক এবং দার্শনিক পটভূমিও এক করা যায় না। ফলে, নজরুল-রবীন্দ্রকে একই সারিতে দাঁড় করানোর চেষ্টা করাও অন্যায়।
সাহিত্য সমাজে উভয়েই উভয়ের প্রতি যথাযোগ্য শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। কারারুদ্ধ নজরুলকে উৎসর্গ করে রবীন্দ্রনাথ কবিতা লিখেছিলেন। ১৯৪১ সালে রবীন্দ্রনাথ মারা যাবার পর স্বপ্রণোদিত হয়ে নজরুল তার প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপন করেন ‘রবিহারা’ ও ‘অস্তরবি’ কবিতাদ্বয়ের মাধ্যমে। ‘ঘুমাতে দাও শ্রান্ত রবিরে’ শিরোনামে একটি শোকগাঁথাও তিনি রচনা করেন। ‘রবিহারা’ কবিতাটি নজরুল নিজেই আবৃত্তিও করেন। তার ঠিক এক বছর পর নজরুল বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন এবং দীর্ঘ ৩৪ বছরের নিরবতার জীবন শেষে প্রেম ও মানবতার কবি নজরুল ১৯৭৬ সালের ২৯ অগাস্টে ঢাকায় মৃত্যু বরণ করেন।
বস্তুত রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পরের বছরেই নজরুলের কবি জীবনের মৃত্যু হয়। মাত্র ২৮ থেকে ৩০ বছর পর্যন্ত লিখেই দুখুমিয়া নজরুলকে দুরারোগ্য ব্যাধিতে পড়তে হয়েছিলো। রবির আকাশে অন্য কোন তারাকে স্বাভাবিকভাবেই খুব স্পষ্ট দেখা যায় না। কেউ কারও দ্বারা প্রভাবিত হবার প্রমাণও কারও লেখায় নেই। প্রত্যেকেই স্বকীয় এবং ভিন্ন ভিন্ন সত্ত্বায় প্রতিষ্ঠিত। তবে রবীন্দ্রনাথের ৬৭ বছরের সাহিত্যজীবনের মতো শারিরীক এবং মানসিকভাবে সুস্থ থাকলে, আমরা হয়তো অন্য উচ্চতায় নজরুলকে আজ দেখতে পেতাম।
মৃত্যু বার্ষিকীতে বাঙালির জাতীয় কবির স্মৃতিতে গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপন করছি।
___________________________________________________
কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রধান গ্রন্থসমূহ:
১) কাব্যগ্রন্থ: অগ্নিবীনা (১৯২২), সঞ্চিতা (১৯২৫), ফণিমনসা (১৯২৭), চক্রবাক (১৯২৯)
২) কবিতা ও গান: দোলনচাপা (১৯২৩), বিষেরবাঁশি (১৯২৪), ভাঙ্গার গান (১৯২৪), ছায়ানট (১৯২৫), জিঞ্জির (১৯২৮), প্রলয়শিখা (১৯৩০)
৪) ছোট গল্প: রিক্তের বেদন (১৯২৫), শিউলী মালা (১৯৩১), ব্যথার দান (১৯৯২)
৫) উপন্যাস: বাঁধনহারা (১৯২৭), মৃত্যুসুধা (১৯৩০), কুহেলিকা (১৯৩১)
৬) নাটক: ঝিলিমিলি (১৯৩০), আলেয়া (১৯৩১), পুতুলের বিয়ে (১৯৩৩)
৭) প্রবন্ধ: যুগবাণী (১৯২৬), ঝিঙে ফুল (১৯২৬), দুর্দিনের যাত্রী (১৯২৬)
গ্রন্থপঞ্জি/তথ্যসূত্র:
>বাংলাপিডিয়া, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম, ২০০৩।
>দৈনিক সমকাল, ২২ জুন ২০১১।
>ডেইলি নিউ এইজ, আতাউর রহমান, ২৫ মে ২০১২।
>বিভিন্ন সময়ে লেখকের ব্যক্তিগত অধ্যয়ন।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে আগস্ট, ২০১৩ সকাল ৮:২৭