একটি শিশু জিজ্ঞেস করলো, “ঘাস কী?”
একমুঠো ঘাস তার হাতে।
কী উত্তর দেবো আমি শিশুটিকে?
ঘাস যে কী, আমি তো তার চেয়ে বেশি জানি না।
আমার ধারণা এটি আমার মনোভাবের প্রতিবিম্ব,
আমার আশাবাদি চেতনার সবুজ বুনন।
অথবা, হতে পারে ঈশ্বরের হাতের রুমাল,
একটি সুগন্ধী উপহার এবং স্মৃতিজাগানিয়া
যা পরিকল্পিভাবে দেওয়া,
যার কোন এক কোণায় হয়তো লেখা আছে মালিকের নাম,
যা দেখে আমরা মন্তব্য করতে পারি,
আর জিজ্ঞেস করতে পারি, “এটি কার?”
অথবা, হতে পারে ঘাসটি নিজেও একটি শিশু,
উদ্ভিদজগৎ থেকে জন্মলাভ করা এক নাবালক।
অথবা, হতে পারে এটি একটি অভিন্ন চিত্রলিপি,
যার অর্থ হলো: প্রশস্থ এবং সংকীর্ণ জায়গায় একইভাবে গজিয়ে ওঠা,
বেড়ে ওঠা কৃষ্ণাঙ্গ আর শ্বেতাঙ্গদের প্রাঙ্গণে সমভাবে,
কানুক, টুকাহি, কংগ্রেসম্যান বা কাফ*;
সবাইকে আমি এক রকম দেই,
সবার থেকে আমি একই রকম করি গ্রহণ।
এবং এখন আমার মনে হয় এটি হচ্ছে
কবরে গজিয়ে ওঠা একগুচ্ছ অখণ্ড চুল।
কোমলভাবে তোমায় স্পর্শ করবো হে কোঁকড়ানো ঘাস,
হয়তো তুমি যুবকদের বুক থেকে ওঠেছো গজিয়ে,
হয়তো আমি জানলে বুঝতাম যে তাদেরকে আমি ভালোবেসেছিলাম,
হয়তো বৃদ্ধদের থেকে এসেছো, অথবা এমন সন্তানদের থেকে
যাদেরকে আগেই কেড়ে নেয়া হয়েছিলো মা’য়ের কোল থেকে,
আর এখন আছো তোমরা মায়ের কোলে,
এই ঘাস এত গাঢ় যে তা বৃদ্ধ মা’দের
ধূসর (চুলের) মাথা থেকে আসতে পারে না,
বৃদ্ধ পুরুষদের বিবর্ণ দাড়ি থেকেও তা গাঢ়,
এমন গাঢ় বর্ণ যা মুখের ভেতরের ধূসর লাল তালু থেকে আসে।
হ্যাঁ উললব্ধি করেছি আমি, এতগুলো সরব জিহ্বার মধ্যেও,
এখন উপলব্ধি করেছি (গাঢ় বর্ণটুকু)
মুখভ্যন্তরের ধূসর লাল তালু থেকে এমনিতেই আসে নি।
পারতাম যদি সেসব মৃত যুবক ও মৃত নারীদের
ইঙ্গিতটুকু ব্যাখ্যা করতে,
যদি পারতাম, ব্যাখ্যা করতে সেই বৃদ্ধ পুরুষ আর মা’দেরকে যাদের
সন্তানদেরকে কোল থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছিলো।
(ঘাসকে সুধাই) কী হয়েছিল সেই মৃত যুবক আর বৃদ্ধদের?
আর, কী হয়েছিল সেই নারী আর তাদের সন্তানদের?
তারা জীবিতই এবং ভালোই আছে অন্য কোথাও,
ছোট্ট এ ঘাস দেখিয়ে দিলো মরণ বলতে আসলে কিছু নেই,
আর মরণ যদি থাকেই তা জীবনকে সামনের দিকে নিয়ে যায়,
এবং তা ধরা পড়ার অপেক্ষায় থাকে না,
এবং জীবন ফিরে আসার জন্য মুহূর্তও থেমে থাকে না।
(ঘাসের মতো) সব জীবনই ওপরে বাইরের দিকে বের হয়ে যায়,
কিছুই পড়ে যায় না,
আর মরণ সকলের ধারণা থেকে আলাদা, তা সৌভাগ্যেরই বিষয়।
--------------------------
টীকা: কানুক, টুকাহি ইত্যাদি হলো অধিকার-বঞ্চিত রেড ইনডিয়ান ও নিগ্রোদের বিভিন্ন গোত্রের নাম। কংগ্রেসম্যান বা কাফ দ্বারা অভিজাত শ্রেণী তথা শ্বেতাঙ্গদের বুঝানো হয়েছে।
কবিতা সম্পর্কে: কবিতাটি হুইটম্যানের ‘সং অভ্ মাইসেল্ফ’ এর ষষ্ঠ পদ থেকে অনূদিত, যাকে কবি শিরোনাম দিয়েছেন ‘গ্রাস/ঘাস’।
কবিতাটি হুইটম্যানের সাড়াজাগানো কাব্যগ্রন্থ ‘লিভ্স অভ্ গ্রাস’ থেকে নেয়া। সবুজ ঘাস একদিকে কবির আশাবাদী চেতনার প্রতীক, অন্যদিকে পায়ের তলার এ ঘাস সমাজের বঞ্চিত মানুষের প্রতিনিধি। কবি ছিলেন নিগৃহীত কৃষ্ণাঙ্গ আর ক্রীতদাস প্রথার বিপক্ষে এক প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। এই বারবার গজিয়ে ওঠা ঘাস হলো অমরত্ব আর পুনর্জনমের প্রতীক।
কবি সম্পর্কে: আমাদের সাম্যের কবি কাজী নজরুলকে বিভিন্ন জায়গায় ‘বাংলার হুইটম্যান’ বলে যে উল্লেখ করা হয়, তা যথার্থই। ওয়াল্ট হুইটম্যান (১৮১৯-১৮৯২) সাম্য, গণতন্ত্র আর অধিকারের গান গেয়েছেন তার সমস্ত কবিতায়। তার ‘সং অভ্ মাইসেল্ফ’ মলূত সং অভ্ হিউম্যানিটি, মানবতার গান। ওটি চিরকুমার হুইটম্যানের ব্যক্তিগত জীবনগাঁথা নয়। তিনি গেয়েছেন আদর্শবাদ আর সার্বজনীনতার গান। হুইটম্যান মানবতার কবি (Poet of Humanity), যেমন আমাদের নজরুল। ‘ঘাস’ হুইটম্যানের একটি প্রিয় রূপক। বস্তুত তার বিখ্যাত গ্রন্থের নাম ‘লিভস অভ্ গ্রাস’ (১৮৫৫)।
এ কাব্যগ্রন্থটি সম্পর্কে একটি মজার তথ্য আছে, হুইটম্যান দশবার সংশোধন করে গ্রন্থটি দশবারই প্রকাশ করেছেন। জীবনের দুর্দশার কারণেও হুইটম্যান আর নজরুল এক ঘরানার কবি। হুইটম্যান সম্পর্কে এতকিছু বলার আছে যা এখানে শেষ করা যায় না।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই আগস্ট, ২০১৩ বিকাল ৫:১১