আমার এক মুক্তিযোদ্ধা চাচা কথায় কথায় তিনি বলতেন ‘জয় বাংলা’ - বিস্মিত হলে ‘জয় বাংলা’, হতাশ হলেও একই কথা! আর আনন্দ পেলে তো কোন কথাই নেই। ছোটকালে তিনি অনেক গল্প শুনিয়েছেন গেরিলা যুদ্ধের। কীভাবে তারা একটির পর একটি অপারেশন সফল করে পাকবাহিনীর ঘাঁটিগুলো গুঁড়িয়ে দিচ্ছিলেন। অনেক ব্যথা-বেদনার স্মৃতিও আছে। আছে স্বজন হারানোর বেদনা। কিন্তু সব বেদনাকে মুহূর্তে ভুলে যেতেন যখন একটি অপারেশন বা গেরিলা আক্রমণের পরিকল্পনা সামনে আসতো। সকল ব্যথাকে অট্টহাসিতে ওড়িয়ে দিতেন একটি অপারেশন সফল হলে।
“তোমাদের এতো ত্যাজ আসতো কোথা থেকে?” অবুঝ আমি দু’গালে হাত রেখে জিজ্ঞেস করতাম। জবাবে আমার চাচাটি অনেক কথাই বলতেন, যার সবকিছু আমি বুঝতাম না, শুধু একটি কথা ছাড়া। দু’চোখে রক্তরোষ নিয়ে তিনি সেদিন বলেছিলেন, “দূর বোকা, ওদের তো জয় বাংলার মতো একটি রক্ত-গরম-করা স্লোগানই নাই! ওরা কীভাবে আমাদেরকে পরাজিত করবে!” জয় বাংলা বললে নাকি রাতের ভুতও পালাতো, পাঞ্জাবি তো দূরের কথা!
সে জয়বাংলা দেশ স্বাধীন হবার পর হয়ে গেলো দলীয় স্লোগান। অসম যুদ্ধে জয় বাংলা ধ্বজাধারীদের আত্মার জোর দেখে প্রতিবেশী দেশসহ সারা পৃথিবী সাহস যোগালো, সহযোগিতা দিলো, গান গাইলো। মাত্র নয়মাসে অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষায় দেশ স্বাধীন হলো, কিন্তু জয়বাংলা হয়ে গেলো প্রায় নিষিদ্ধ। জয়বাংলা হয়ে গেলো হিন্দুদের স্লোগান!
জয় বাংলা নামক একটি স্লোগানে দেশের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা শক্তি যুগিয়েছিল। জয়বাংলা শুধুই একটি স্লোগান ছিল না, এটি ছিল যুদ্ধ-আক্রান্ত বাঙালির জাতীয় পরিচয়। “আপনি কি জয়বাংলার লোক?” এপ্রশ্নের উত্তর হ্যাঁ হলে শুরু হতো বাঙালির মধ্যে নতুন আত্মীয়তা, নতুন সম্পর্ক। মুক্তিযুদ্ধকালে জয়বাংলা বলে ভারতে বিনামূল্যে ট্রেনভ্রমণ করা যেতো। কিন্তু আজকাল জয়বাংলা বললে হয়তো আমাকে প্রথমেই একটি গোষ্ঠীভুক্ত করা হবে, অথচ ব্যক্তিগতভাবে বৃহৎ কোন দলের প্রতিই আমার আনুগত্য নেই বা ছিলো না। জয় বাংলাকে আমি বাঙালির স্বাধীনতা যুদ্ধের সেই রণধ্বণি বলেই জানি।
আজ তরুণ প্রজন্ম জেগেছে, তার ফিরিয়ে এনেছে মুক্তিযুদ্ধের সিকোয়েল - মুক্তিযুদ্ধ দুই! স্বদেশপ্রেমে রেনেসাঁ এনে তারা সমগ্র জাতিকে আজ একত্রিত করলো। কথা অনেক বলা হয়েছিলো, তাই তারা নির্দেশ দিলো “এবার নীরব হোন”।
দেশবাসীকে তিন মিনিট নীরব করিয়ে তারা প্রমাণ করলো যে, জয় বাংলা ফুরিয়ে যায় নি। পদ্মা মেঘনা যমুনা যে আপনার আমার ঠিকানা, একথাই ভুলতে বসেছিলাম। আজ তারা স্মরণ করিয়ে দিলো তাদের লক্ষকণ্ঠের বজ্রধ্বনি দিয়ে যে, এদেশ স্বাধীন হয়েছিলো রাজনৈতিক একতা দিয়ে ধর্মীয় চেতনা দিয়ে নয়। আজ লক্ষ লক্ষ তরুণ একত্রিত হয়ে জয় বাংলাকে ফিরিয়ে এনে যেন বাংলা মা’কে শাড়ি পড়ালো, জয় বাংলার শাড়ি! কী আশ্চর্য ‘জয় বাংলা’ বললে এখন আর কেউ আমুলিক বলে গালি দেয় না। জয় বাংলা!
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ রাত ৯:৫৮