দেশের বিভিন্ন স্থানে বোমা-গ্রেনেড হামলা ও সন্ত্রাসের প্রতিবাদে তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগ এক সমাবেশের আয়োজন করেছিল। কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে ট্রাকের ওপর স্থাপিত মঞ্চে দাঁড়িয়ে শেখ হাসিনা তার বক্তব্য শেখ করার পর পরই বিকেল ৫টা ২২ মিনিটে অতর্কিতে চারিদিক থেকে গ্রেনেড এসে পড়তে থাকে।
বিপরিত দিকের পনরো তালা বিল্ডিং ছাদের উপর থেকে বেশিরভাগ গ্রেনেড গুলো ছোড়া হয়। ২২ টি গ্রেনেডের ৫ টি টার্গেটের খুব কাছাকাছি পরেছিল, একটি ট্রাকের পিছের চাকায়, একটি ট্রাকে লাগানো সিড়ির কাছে, যেটাতে আইভি রহমান মারা যায়। ট্রাকের বনেটে পরে ছিটকে ফুটপাতের ড্রেনে যাওয়া আরেকটি বিস্ফোরিত হয়নি।
সবচেয়ে বিপদজনক বিস্ফোরন টি হয়েছিল হাসিনার খুব কাছে। যেটাতে হানিফ, মায়া, সুরঞ্জিত বাবু ও অনেকে আহত হয়।
ট্রাক থেকে সিড়ি দিয়ে নামানোর পর হাসিনা কে সবাই ঘিরে মানব বর্ম তৈরি করে নেতা কর্মিদের জটলাটি গাড়ীর দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। সাদা শার্ট পরিহিত একজনের কাঁধ-পিঠ রক্তাক্ত!
আসে পাসে পড়ে থাকা আহত-নিহত দেহ, রক্তের ধারা, বোমার টুকরা, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জুতা সেন্ডেল। হাসিনার দুই দেহরক্ষী জটলাটিকে আগলে রাখছিল, রাজ্জাক সুরঞ্জিতের পিঠ রক্তে ভিজে পাঞ্জাবী লাল হয়ে যাছে, হানিফের লম্বা ঘাড় বেয়ে রক্ত ঝরছে, জিপের কাছাকাছি আসতেই ..প্রচন্ড বিস্ফোরন টি হয়। দেহরক্ষির একজন ল্যান্স করপোরাল (অব.) মাহবুবুর রশীদের মাথা বিস্ফোরনে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। মুলত এই অকুতভয় দেহরক্ষির কারনেই নেতাকর্মি পরিবেষ্টিত শেখ হাসিনা বিষ্ফোরনের ধাক্কা থেকে বেঁচে যায়। উভয় দেহরক্ষি বুলেট প্রুফ জ্যকেট পরিহিত থাকলেও মাথায় হেল্মেট ছিল না। এ সময় কয়েক রাউন্ড গুলির শব্দ শোনা যায়। ঠেলে উঠিয়ে অপর দেহরক্ষী ড্রাইভারের অপেক্ষা না করে নিজেই নেত্রীকে নিয়ে তিব্র গতিতে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। ঘিরে জটলার প্রায় সবাই কমবেশি আহত হয়। সবচেয়ে বেশি মেয়র হানিফ, বাহাউদ্দিন নাসিম, মায়া, সুরঞ্জিত, রাজ্জাক
হানিফের মাথায় ১০ টি ছররা ঢুকে যায়। এগুলো আর বের করা সম্ভব হয় নি, মাথার ইনফেকশনে উনি একপর্যায়ে পাগল হয়ে যান। এক বছর ভুগে তারপর মৃত্যুবরন করেন।
জিল্লুর রহমান সবার শেষে নামছেন, মুহুর্মুহ বিষ্ফোরনের শব্দে কান চেপে রেখেছেন ..তিনি তখনো জানেন না সিড়ির নিচে তার স্ত্রী পরে আছে, পা, নিম্নাঙ্গ নেই, উড়ে গেছে, চোখ খোলা তখনো! রক্তের একটি ধারা ড্রেনের দিকে যাচ্ছে ..
পত্রীকার রিপোর্ট আনুযায়ী হামলায় ব্যবহৃত আরজেস গ্রেনেডগুলো সামরিক অস্ত্রাগারের গ্রেনেডের মত ছিল। এই উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন গ্রেনেড যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কিভাবে সংগ্রহ করলো তা তদন্ত করা সম্ভব হয় নাই। আলামত পুন-বিষ্ফরন করে নষ্টকরে ফেলা হয়েছিল একটি আইনের অযুহাত দেখিয়ে। অবিষ্ফোরিত বোমা জনস্বার্থে বিষ্ফোরন ঘটিয়ে নিরাপদ করতে হবে।
পিন বিমুক্ত চার-পাঁচটি অবিষ্ফোরিত গ্রেনেড ঘটনাস্থলে, কেন্দ্রীয় কারাগারে যাওয়ার পথে, ফুটপাতের পাসে ড্রেনে, গনশৌচাগারে পাওয়া গিয়েছিল। যেহেতু পিন খোলা হয়নি, তাই নিরাপদ। মুল্যবান আলামত হিসাবে গ্রেনেডগুলো ডেটনেটর খুলে রেখে দেয়া যেত।
সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার একটি গ্রেনেড পাওয়া যায় কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরে, ময়লার ভেতর। তাহলে কি কারাগারের বন্দিদের একাজে ব্যাবহার করা হয়েছিল?
পরদিন অজ্ঞাতসংখক আসামী কোর্টথেকে জামিন পেয়ে যায়। দুজন কারারক্ষী ছুটি নিয়ে চলেযায়। এরা কখনো ফিরে আসেনি। একজন কারারক্ষী তার নিজগ্রামে ১৪ লক্ষ টাকা সহ গ্রেফতার হয়। তাকে গ্রেনেড হামলার আসামি করা হয়েছিল। অজ্ঞাত কারনে সেও জামিন পেয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। এসবেরও তদন্ত হয়নি।
পরবর্তিতে পুন-তদন্ত সুরু হলে অভিযুক্ত পলাতক জেল ওয়ার্ডেন দের ব্যক্তিগত সিভি, ছবি খুঁজে পাওয়া যায় নাই। গায়েব করে ফেলা হয়েছিল।
জামিন নিয়ে সেদিন বের হয়ে যাওয়া অজ্ঞাতসংখক আসামীকেও সনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। সকল আলামত অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবেই সরিয়ে ফেলা হয়েছিল।
তদন্তকারিরা নিরুপায় হয়ে আবার হয়তো কোন জজমিয়া নিয়ে আসবে। এদের পেছনে দৌড়ে কোন লাভ নেই, এরা টাকার বিনিময়ে কাজকরছে, জেলথেকে মুক্ত হইছে।
শক্ত তদন্ত করে মুল হোতাদের ধরতে হবে।
২১শে আগষ্ট গ্রেনেড হামলায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জরিত না হলেও দায়িত্ব এড়াতে পারে না। তার কতিপয় সদস্য জরিত থাকতেও পারে, যেহেতু আরজেস গ্রেনেডগুলো সামরিক অস্ত্রাগারের ছিল বলে প্রাথমিক ভাবে মনে হয়েছিল। কিন্তু তদন্ত হয় নি।
সম্ভবত হত্যায় নিযুক্ত হুজি সদস্যরা তাদের সমর্থক সেনা সদস্যদের সাহায্য নিয়েছিল
এসব সেনা সদস্য পরে ২০১০ এ তাপস হত্যাপ্রচেষ্টতেও জরিত ছিল।
এখানেও বিষ্ফোরক অন্যত্র সংগ্রহ করা হলেও এর ডেটনেটর ও টাইমিং ডিভাইস ছিল সামরিক অস্ত্রাগারের। তাদের গ্রেফতার করে কোর্টমার্শালে ৫ বছর জেলদন্ড হয়েছিল। সামরিক আদালতে তারা অনুতপ্ত ছিলনা। বরং একটি উগ্র ধর্মিয় গোষ্ঠির অনুশারি বলে গর্বিত ছিল। কদিন আগে উদ্ঘাটিত মেজর জিয়া গংও এরুপ উগ্র ধর্মিয় গোষ্ঠির অনুশারি ছিল।
আমার নিজ ধারনা এসব হত্যাকান্ডের মুল হোতা ছিল তৎকালিন বিএনপি-জামাতের একটি উগ্র ডানপন্থি গ্রুপ, যারা দলের হাইকমান্ড ও চেয়ারপারসনকে অন্ধকারে রেখে একটি নৃশংশ হত্যা পরিকল্পনা সুরু করে, টার্গেট ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষকে মেধা শুন্য ও নেতৃত্যশুন্য করে ফেলা। হত্যায় নিযুক্ত করা হয় যেহাদি চেতনায় উজ্জিবিত হুজি সদস্যদের।
সিলেট দিয়ে শুরু হয় তদের অপারেশন, আর্জেস গ্রেনেড বিস্ফোরন টেষ্ট করা হয় জনবহুল সাহাজালাল মাজারে (সায়েদির মাজার বিরোধী ওয়াজে উজ্জিবিত হয়ে)।
তার পর প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী কিবরিয়া কে সরাসরি গ্রেনেড ছুড়ে হত্যা করা হয়। এর কিছু দিন পর সিলেট মেয়র কামরানের উপর হামলা হয়, তিনি অল্পের জন্য বিষ্ফোরোনের হাত থেকে বেঁচে যান, তাকে লক্ষ করে ছোঁড়া গ্রেনেডে তার পার্কিং স্পেসে ইব্রাহিম সহ কয়েকজন নিহত হয়।
এর কদিন পরেই সিলেট মহিলা আওয়ামিলিগ সভায় ছোড়া গ্রেনেডে কয়েক জন নিহত হয়। মৌলবাদ বিরোধী ব্রীটিষ হাইকমিশনার সিলেটে শাহাজালাল মাজার পরিদর্শনে গেলে মাজারের ভেতর গ্রেনেড ছোড়া হয়, বোমাটি সরাসরি তার পেটে লাগলেও সৌভাগ্যক্রমে তাৎক্ষনিক বিষ্ফোরিত হয়নি, দুঃসাহসি আনোয়ার চৌধুরী গ্রেনেডটি কুড়িয়ে নিয়ে দূরে ছুড়ে ফেলেন সেখানেই বিষ্ফোরন ঘটে। বেচে যান বাংলাদেশী বংশদ্ভব আনোয়ার চৌধুরী। ঢাকায় ও দেশের অন্যান্ন স্থানেও তাদের ভাড়াটে আততায়িরা হত্যাকান্ড চালাচ্ছিল। জনপ্রীয় নেতা আহাসানুল্লা মাস্টার ... কবি সামসুর রহমান, হুমায়ুন আজাদ। তবে হাসিনা হত্যাচেষ্টা মিশনে তাদের উচ্চ প্রস্তুতি নিতে দেখা যায়।
২০০৫ এর দিকে ব্রিটিশ-ইইউ এর প্রবল চাপে সুধু অনোয়ার চৌধুরী হত্যা প্রচেষ্টা মামলা তদন্ত সুরু হয়, এতে মুফতি হান্নানের নাম বেরিয়ে আসে, তবে পরে তদন্তে আরো কয়েকজনের নাম বেরিয়ে আসলে এর গতি ধীর হয়ে যায়।
পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসলে জ়োড়দার তদন্ত শুরু হয়, মন্ত্রী সহ কিছু মুল হোতাদের পাকড়াও করে ও জজ মিয়াকে মুক্তি দেয়।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে আগস্ট, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:৪২